এখন আর তেমন একটা মনে পড়ে না তোমাকে, প্রথম প্রথম খুব বেশিই অকারণে মনে পড়ে যেত, ভুলে-থাকার হরেক রকম বাহানা তৈরি করতাম নিজের ভেতর, কিন্তু কাজের সময় কিংবা কথার ফাঁকে ফাঁকে কোথা থেকে যেন তোমার অভ্যেসগুলো ঠিকই মনে পড়ে যেত। প্রথম প্রথম রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করতে গেলেই মনে পড়ে যেত, তুমি খিচুড়ি খুব ভালোবাসতে। অমনিই চোখে জল এসে যেত, সরে পড়তাম রান্নাঘর থেকে। তারপর অনেক দিন রান্না ঘরে আর ঢুকতামই না, ভাবতাম, স্মৃতি তো আর মুছে ফেলা যায় না, বরং কিছুটা ধুলো জমুক ওতে। এভাবেই বেশ ভুলে থাকতাম পালিয়ে থেকে থেকে। অনেক অনেক দিন যখন নদীর ধারে ঘুরতে গেছি, ওখানেও মনে হতো যেন তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে চোখে চোখে রাখছ, মনে পড়ে যেত, সন্ধ্যার পর তোমার হাত দুটো এই দু-হাতের ভেতর জড়িয়ে খালি পায়ে কত বার যে হেঁটেছি একসাথে, কখন যে সন্ধ্যে গড়িয়ে চাঁদটা মাথার উপরে এসে যেত, টেরই পেতাম না! তারপর থেকে ভাবলাম, নদীর ধারে গিয়ে তো আর লাভ নেই, তাই বন্ধ হলো ওটাও। এরপর হঠাৎ একদিন বান্ধবীর বিয়ে, ওরা খুব জোড়াজুড়ি করল শাড়ি পরতে। ভাবলাম, পরিই না, অনেক দিন তো পরা হয় না! যখনই শাড়ির ভাঁজ খুললাম, মনে পড়ে গেল, আমাকে শাড়ি পরে থাকতে দেখলে তুমি ভীষণ খুশি হতে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল, মনে হলো, শাড়ির প্রতিটি ভাঁজের সাথে সাথে তুমি মিশে আছ, গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম শাড়ি অমনি সাথে সাথেই! এখন শাড়ি-পরা বারণ আমার, নিজেই নিজেকে শাসিয়ে নিলাম তা বলে! আর কোনও স্মৃতি নয়, আর কোনও অভ্যেস নয়, আর কোনও অভ্যস্ততাও নয়। কিছু দিন বাদে বান্ধবীদের সাথে রেস্টুরেন্টে যাব, বান্ধবীর জন্মদিনের উৎসব, ভাবলাম, একটা দুল জড়াই কানে, এবার অনেক দিন পর খুললাম কসমেটিকসের ড্রয়ার, খুলেই দেখি, শতশত সাজগোজের জিনিস! সত্যিই এত্ত সাজতাম আমি কখনও! একটা দুল হাতে নিতেই মনে পড়ে গেল, তুমি খুব চাইতে, আমি যেন এত এত গহনা পরে তোমার সামনে বসে থাকি। আবারও চোখ ভরে জল এল, পরা হলো না আর। ছোটো থেকেই আইসক্রিম আর বার্গার ভীষণ পছন্দের ছিল আমার, তুমি কখনও বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেলে এই দুটো না খাইয়ে বাসায় আনতেই না, অনেক বছর বাদে সেদিন বার্গার খেতে ইচ্ছে হলো, অর্ডারও করলাম। কিন্তু কেন জানি খেতে পারলাম না, বিলটা দিয়েই চলে এলাম। এভাবেই স্মৃতি থেকে রোজই পালিয়ে ফিরেছি আমি। ভেবেছিলাম, পালিয়ে গেলেই বুঝি ভুলে যাওয়া যায়, ভেবেছিলাম, ভুলে তো যাবই যাব! সারাজীবন কে মনে রাখে এসব? এ কারণেই হয়তো কারণে অকারণে বারে বারেই স্মৃতির পাতা ঝাপসা হয়ে চোখ ভরিয়ে দিয়ে যায়, ভোলা আর হয় না! এখন তোমাকে আর মনে পড়ে না, শুধু কী যেন একটা কিছু পেছন থেকে গুনগুন করে কাঁদে, একটা সম্পর্কের মৃত্যু কাঁদে, একটা পুরনো বাঁধন কেঁদে ওঠে, ছেঁড়া যায় না তা কিছুতেই! ছিঁড়ে গেলেও ঝুলিয়ে রাখে কিছু অসম্পূর্ণ পৃষ্ঠা পূর্ণ হবার বাসনায়, আক্ষেপে, আকুতি জানায়, যেমন করেই হোক, তাকে যেন শেষ করি! কেন আধো লিখে ফেলে এলাম! শূন্য অংশটুকু কাঁদে আর কাঁদে রোজ রোজ, অসম্পূর্ণ সুর কেঁপে ওঠে ঠোঁটের কোণে, অভিমানে ওপাশ ফিরে যেন বলতে চায়, ‘আমাকে কেন অর্ধজনম দিলে? কেন আমি অসম্পূর্ণ রয়ে গেলাম? কোন পাপের দায়ে পূর্ণ হলাম না আমি?’ কেননা সবাই-ই তো পূর্ণতার স্বাদ পেতে চায়, কেউ আধো আলোয় আলোকিত হতে চায় না, কেউ আধো চাঁদ ভালো দেখে না... এখন মাঝে মাঝে ভুলে যাই, চেষ্টা করি না, তবুও ভুলে যাই। কেন ভুলে যাই, জানো? ভুলে যাই, কেননা ভুলে-থাকা অসম্ভব, যাকে ভুলে থাকা যায় না, তাকেই মাঝে মাঝে ভুলে যেতে দিতে হয়! স্মৃতিরা যখন উঁকি মারে, তখন পৃষ্ঠা উলটে দেখি, কতটা লেখা হলো, আর কত বাকি! যা-কিছু বাকি, পূর্ণ করে যাব, যেতে হবে। নিয়তির নিয়মে, অন্যেরা যেভাবে করে গেছে, আমাকেও সেই পথ ধরেই আমার সমাপ্তির আগে সকল লেখার দায় চুকিয়ে যেতে হবে, বেলাশেষের আগে সবাইকে যেমনটি করে জীবনের এই শূন্য পৃষ্ঠাগুলো পূর্ণ করেই যেতে হয়, আমিও তা-ই যাব। রাখব না কোনও দায়, যেতে যেতে আমার এই স্মৃতির কোনও এক কোনায় তুমিও পড়ে রবে, আমার সাঁঝের মায়া হয়ে।