কার কাছে আমি চাইতে যাব জল? আমি কাকে দেখাব এ মনের অতল? পেলে ব্যথা দেবেটা কে আদর? কে নেবে রোজ মন খারাপের খবর? ক্লান্ত হয়ে পাতব কোথায় মাথা? কার কাছে ফেলব বলে না-বলা সব কথা? ফুরোলে ঘর জায়গাটি কে দেবে? কোন সে ঘর, যা দিনের শেষে আমার ঘরটিই হবে? কোন আকাশে উড়ব আমি রোজ? কার সীমানায় করব তোমার খোঁজ? সব আঘাতের ঢালটি হবে কে? কে এসে রোজ মায়ায় জড়াবে? অভিযোগগুলো কোথায় দেবে হানা? ভিজতে রোদে করবেটা কে মানা? পড়লে ভেঙে কে তুলবে টেনে গিয়ে? হাতের সাথে হাত বাঁধবে কে হাতটি কাছে নিয়ে? পড়ানোর ছুতোয় করবেটা কে শাসন? ভুল পথে যেতে গেলেই কে করবে বারণ? ভালোবাসার মানুষটি হয় কেমন? ব্যথা যত, ধুয়ে লুকোবে বুকে, এমন? এমন একটি মানুষ কোথায় পাবো? সন্ধ্যে নামলে কোন ঘরটিতে যাব? যাও, ভালোবাসা চাইব না গো আর, অলীক স্বপ্নে মায়াশহরে জমাব না ভিড় আর বারে বার, আশাটুকু খুঁজব না কোনও দুরাশার আলোকে, পথের বাঁকেই ঝেড়ে ফেলে আসব সকল ছায়া, আমার পুরনো দালান, আমার সাধের ভিটে, আমার একটা ‘তুমি’, সব কিছু থেকে বিদেয় নিয়ে হব এই জন্মের মতো নিরুদ্দেশ! আমি জেনেছি, সূর্য তুমি, আমি জেনেছি, আমার একটি সকাল তুমি; এই জানার মাঝেও অজানা ছিল, মিথ্যে কিছু ভান ছিল, সূচের একটু ফণা ছিল, কিছু কালো গভীর গর্ত ছিল, ছিল সবই, শুধু ছিলে না তুমি! এ বিদেয় পানসে বড়ো, এ বিকেল বড্ড অচেনা, এ শহর যেন আমার শহরটাই নেই, যে শহরে তুমি থাকো, সে শহরে আমিই শুধু নেই, হায়, কোথাও যে নেই...একটুও নেই! বেলা শেষ হয়ে এল, এবারে যেতে হবে ঠিকই, অন্য তীরে লোকালয়টা গড়ে গেছে, অন্য তীরে মানুষ হয়েছে ফানুস কেবল, অন্য যে তীর, সেখানে রয়েছে তোমার অভাব, আমার স্বভাবে তোমার অভাব এবার আসুক, মিলাক হারাক দগ্ধ সকল ভালোবাসা প্রেম, বিস্মৃত হোক ভোরবেলার যত কিংশুক! মিথ্যে আমি ছিলামই তো, আমার যত গাঁথা মালা, ছিল মিথ্যে ওরাও, আমার আঁকা সন্ধ্যেগুলো অচেনা হয়ে ছিল চিরকাল তোমার কাছে, আমি বুঝিনি, ওসব কীসের খেয়াল, কখন পাখি ফেরে অন্য নীড়ে, পাখি কখন পুরনো ঘরটা ছাড়েই ছাড়ে! আমার জানার সীমানা ছিল কেবলই একটিই চাঁদ, একলা সে খুব; বুকের উপরে চাপা-পড়া নষ্ট কিছু কষ্টও ছিল, শুধু ছিলে না তুমি, শুধু আমিই একা হারিয়ে ছিলাম, শুধুই প্রলাপ বকেছিলাম…ভালোবাসি…ভালোবাসি! মিথ্যে ছিল সপ্তপদী ভালোবাসা সেই, মিথ্যে ছিল মেহেদিরাঙা উঠোন আমার, তুমি বলেছিলে, এ উঠোন কখনও জীর্ণ তুমি দেবে না হতে, তুমি বলেছিলে, বুকের মধ্যে ঘরের মানুষ, তুমি বলেছিলে, ঘরের মানুষ রাখবে ঘরেই! তুমি কি বলোনি এসব? কী ছিল সেই ঘরটা তবে? কে ছিল সেই ঘরে তবে? তোমার ঘরে হরেক রকম সন্ধ্যে নামে, তোমার আকাশে অনেক, হ্যাঁ গো, অনেক তারা! তোমার যারা হয়েছে তোমার, আমি ছাড়া সেসব বাতি জ্বেলেছে যে বা যারা, আমি ছাড়া যারা তোমার কাছের খুবই, কাছের তোমার এক ওরাই, জানি তো এখন…! ওরা কারা, জানো কি তুমি? আমি তো নই! তোমার ঘরে সন্ধ্যেপ্রদীপ তবে জ্বলে কার হাতে? কে এসে নেভায় রাতের শেষ বাতিটা? কে এসে বুকে টেনে নেয় তোমার নিঃশ্বাসের সুখ? কে করে অমন আপন আমার চেয়ে? কোন সে মাটির মায়াভরা মুখ? ঘরমুখো এই তোমার, কেবল একটা ঘরই ছিলাম আমি, অন্তত জেনেছি তো তা-ই! আমি বড্ড ভুল বুঝি, না? আমি যা-কিছু জানি, ভুলই জানি, সবটুকুই তো ভুলেই ভরা! এই জীবনের প্রতিটি পথই, আমি ভুল পথে হেঁটে চলে গেছি, জীবনের পথে যখন যার সাথে হেঁটেছি, হাত ধরেছি, ভুল মানুষের সাথেই হেঁটেছি প্রতিটি বারই, আমার সব কিছু ভুল হয়ে গেছে, আমার এই আমিটাই ভুলে ভরে গেছে, আপন বলে নিজেও নিজের রইল না সে আর, আপন নিজের বেশি কে কার আপন বাদে? ভুলই আমার আপন বড়ো, ভুলেই আমার আসল সুর ও স্বর! পেরেছিলে তুমি, একলা একলা রাতের তারা গুনে যেতে? পেরেছিলে বুঝি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে একলা একলাই মাতাল হতে? কোথাও কি ছিল না তোমার---আমার ছুতো? ছিলও যদি, আমি কি কেবলই ছুতোই ছিলাম তবে? আমি কি কেবলই নিতান্তই এক পথিক ছিলাম তবে? আমি কি কেবল ছিলাম শুধুই অদ্ভুতুড়েই? আমি কি ছিলাম আগন্তুকই কেবল? আমার আজ অনেক অনেক প্রশ্ন আছে, আমার প্রশ্নগুলো আমার দিকে বারে বারে চায়--- মিটিমিটি তারার মতো, গুটি গুটি আগুনেপোকার মতো, জোছনাভেজা চিক চিক জলের মতো, আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসে, আমাকে তুচ্ছু করে, আমাকে তাচ্ছিল্যের চোখে গভীর হয়ে দেখে, আমার দিকে করুণার দৃষ্টি ছুড়ে বাঁচে। চাইব না আর কখনও সে রাত, যে রাত শত সহস্র মুহূর্তের মাঝে ঢেকে মুছে গেছে, চাইব না আর সে মধু-সকাল, যে সকালটা ভাগ হয়ে গেছে অন্য কারও সাথে, চাইব না ক্ষণিকের সে আলোড়ন, চাইবো না ভুলেও স্বপ্নে-ভেজা সে মন। পরিচিত পাহাড় একলা আমারই থাকুক, অজ্ঞাতেরা অচেনা হয়ে ফুরাক, আমার স্বপ্নে স্বপ্নেরা হোক পরিব্রত, আমার খেয়া মায়ার অচিন তরী ভাসাক, বিচ্ছিন্ন হোক নিরবচ্ছিন্ন জলে, আঁধার ভাসুক আলোর টালমাটালে, আমার জমা নাহয় খরচাই কিছু হোক, আমার দুঃখ করুক দুঃখ ভোগ, তোমার আকাশে উড়ুক সরোজ পাখি, তোমার আকাশ সাজুক হাজার তারায়, তোমার সন্ধ্যে জ্বলুক হরেক আলোয়, তোমার ঘরে আসুক অবারিত অমোঘ শান্তি। আমার জ্যোতিষ তুমি, আমার একলা তীরের মাঝি, আমার একটি মাত্র নদী, আমার একটি খেলার সাথী, আমার সকল লাজুক চুরি, আমার অবাধ্য সব ইচ্ছে, কিংবা আমার ডাকা যত চিরসুখ, সে কেবলই তুমি, ফিরে যাচ্ছি সেসব কিছু দিয়ে, যা-কিছু ছিল আমার কিংবা আমাদের অধিকারে! আমার কি ছিল তবে? একটি বালিশ কি একটি কাঁথা? হারিয়ে গেছে সবই, দেবার নেই তো কিছুই, শূন্যহাতে ফিরছিই যখন, স্মৃতি থেকে যাক তবে কিছু, কিছু স্মৃতি পড়ে থাকুক আমাদের এ মাঝখানে, যে জায়গাটুকু ফাঁক রয়ে গেছে আলগোছেই প্রায়ই, মাঝে মাঝে, যে জায়গা বাঁচুক পুরনো ভালোবাসায়, সেইখানে কিছু মায়া থাকুকই নাহয় পড়ে, সেইখানে কিছু স্মৃতি বেঁচে থাক আর খেলা করুক রোজ রোজই, ---আমার হয়ে, তোমার হয়ে! এভাবেই বুঝি যুগে যুগে সব ভালোবাসাই পথে পড়ে রয়ে? এভাবেই বুঝি আলোগুলো যায় ঝরে পথের বাঁকেই? এভাবেই কি ঘরগুলো ভাঙে কিছু বুঝে ওঠার আগেই? এভাবেই কি কষ্টেরা জমে হাজারো ভালোবাসায়? ভালোবাসা! হায় রে ভালোবাসা! তুই কোথাও পেলি না ঠাঁই, ভালোবাসা তোর কোনও জায়গা হলো না একটুও আজো, অথচ যুগ যুগ ধরে কী এক দম্ভ নিয়েই বাঁচিস তুই ভালোবাসা!