আমার কাছে এই জীবন মানে কী? এই প্রশ্নটা নিজেকে কখনওই করা হয়ে ওঠেনি! গোটা একটা সুন্দর দিন পার করে, রাতের নির্জনতায় কিছু আত্মতৃপ্তি, কিছু একান্ত সুখ, কিছুটা প্রকৃতিসঙ্গে নিজেকে একটুখানি জানার নামই একসময় জীবন ভাবতাম। রাতের অন্ধকারে জোনাকপোকার নিভু নিভু আলো দেখলে মনে হতো, আমাকে একপলক দেখার জন্যই বুঝি আলো জ্বেলেছে ওরা! চাঁদটা যখন ঘুমন্ত পাতাগুলির গা চুঁইয়ে জ্যোৎস্না ঢালত, তখন মনে হতো, আমি গায়ে আলো মাখব বলেই তার এত অকাতরে বিসর্জন! বাগানের সদ্যোজাত কলিগুলো যখন প্রথমযৌবনে পা রাখত, তখন ভাবতাম, আমায় সুরভিত করার জন্যই তাদের নতুন জন্ম হয়েছে বুঝি! ভোরের ধ্রুবতারাটা যখন চাঁদের পাশে নিঃসঙ্গ এক নভোচারী, তখন আমি ভাবতাম তার দিকে চেয়ে চেয়ে, সে বোধহয় আমার সঙ্গী না হতে পারায় বড্ড বিষণ্ণ! কোকিলের কণ্ঠে বেজে-ওঠা আগমনী গান বুঝি আমায় বসন্তের ঠিকানাটা দিয়ে যাবার জন্যই ধ্বনিত হয়েছে! এককথায় বলতে গেলে, আমি ছিলাম সত্যিকার অর্থেই ভীষণ স্বার্থপর, প্রকৃতিগত সব ঐশ্বর্য শুধুই আমার নিজের করে চাইতাম, সেখানে অন্য কারও কোনও অংশীদারিত্ব ছিল না; বলতে পারেন, হতে আমিই দিইনি! সব সময় মনে হতো এই যে, ক্লাসে ফার্স্টগার্ল-হওয়া, একজন বাধ্য মেয়ে হয়ে-ওঠা; কিংবা দায়িত্ববান বোন, অনুগত ছাত্রী, স্বার্থহীন বন্ধু সবই তো হলাম সবার জন্য, নিজের জন্য এটুকু চাওয়া একান্তই নিজের মতো করে আমি চাইতেই পারি, তাই সেখানে অন্য কারও অংশীদারিত্ব কোনও কালেই আমি মেনে নিতে পারতাম না। আমার জীবনে খুব বেশি মানুষের উপস্থিতি ছিল না, কোনও মোটিভেশনেরও ছিল না কোনও প্রয়োজন, হয়তো আপনাদের মনে হতে পারে, আমার এই কুড়ি বছরের ছোট্ট জীবনে কতটুকুই-বা এই রহস্যময় পৃথিবীকে জানা হলো! এর উত্তরে একটা কথা বলি, আমার এই কুড়ি বছরের জীবনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, জীবনকে যেভাবে কাছ থেকে দেখেছি, আর যা-যা পেয়েছি, তা হয়তো অনেকের চল্লিশের ঘরে পা রেখেও হয়নি! আমার এই স্বল্পর্দৈঘ্যের জীবনে এমন কিছু মুহূর্তের, এমন কিছু ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছি, তা হয়তো কারও সারাজীবনেও পাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। এক্ষেত্রে আমার কুড়ি বছরের জীবন ঈর্ষণীয় সৌভাগ্যের অধিকারীই বটে! তবে কী জানেন, এত অমূল্য, এত দুর্লভ কিছু যে পাব, তা আমি কখনওই ভাবিনি, আমার জীবনে চাওয়ার থেকে পাওয়ার পাল্লাটা তাই বরাবরই ভারী। যা-ই পেয়েছি, তার সিংহভাগই ঐশ্বরিকভাবে পেয়েছি, তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ সবকিছুর জন্য। একটা প্রশ্ন খুব নাড়া দিচ্ছে, তাই না…এমন একটা কিছুও কি ছিল না, যেটা আমি মুখে না বললেও মনে মনে হলেও চেয়েছি? হা হা হা হা… সে প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ পরে আসছি... একটা মজার কথা বলি। আমার নিজের জীবন সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানতাম না, অতটা গহীনে হেঁটেই দেখিনি কখনও! কিন্তু একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি…বলতে পারেন, প্রমাণও পেয়েছি প্রতিবার, তা হলো, কিছু জিনিস ছিল, যা একবার পাবার পর এতটাই ভীত ছিলাম যে দ্বিতীয়বার যেন অমন আর না হয়, তার জন্য সব রকমের চেষ্টাই করেছিলাম! তবু তা যেন আমার জন্য অবধারিতই ছিল! হতেই হবে, আসতেই হবে, রীতিমতো এমন কিছু! সেখানে আমার ভয়, শঙ্কা, না পেতে চাওয়ার কোনও স্থানই নেই! এমনও হয়েছে…আমার চাওয়ার পূর্ণ একটা সকাল যেখানে হতো, একটা প্রাণোচ্ছল দুপুর যেখানে গড়াত, যে নির্জন রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, যেখানে আমার স্বার্থপরতার প্রখরতা সুস্পষ্ট, সেখান থেকেই কিনা সবকিছু ছেড়েছুড়ে অনেক দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম! ভেবেছিলাম, এই অসহ্য সুখ সইতে না পারার ভয় আর তাড়া করবে না! কত বড়ো বোকা আমি, তাই না! এতটা যুক্তিহীন চিন্তা কোনও বোকা ছাড়া আর কে-ইবা করতে পারে! বুঝতেই পারিনি তখন, এই ছোট্ট পৃথিবীটা গোল, সে ঘুরতে ঘুরতেই কোনও-না-কোনও সময় ঠিকই চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে, আমিও এর ঊর্ধ্বে নই! ভাবছেন হয়তো, কী এমন জিনিস, কী এমন সময়, যার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আমার এত চেষ্টা? হয়তো মনে হচ্ছে,…সত্যকেই-বা কেন ভয় পেয়েছিলাম? সত্য তো শুধু সত্যই হয়! যার মাঝে মুক্তি নিহিত, সেই সত্য থেকে পালিয়ে কেন বেড়াতে চেয়েছি? সত্যিই কি সব সত্যে মুক্তি আছে? তবু এই সত্যকে যে আমি বড্ড বেশিই ভালোবাসি, তাই না চাইতেও হারানোর ভয় যে নিয়ম মেনে আমাকে তাড়া করে ফেরে, এই সত্যে যে অসীম সুখের বাস, এত সুখ সইতেই যে পারব না আমি, এইসব ভয় নিয়ে না সত্যকে গ্রহণ করা যায়, আর না ত্যাগ করা যায়! দোটানায় জীবনযাপনমাত্রই খুবই দুর্বিষহ, অনেকটা মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের মতো! না গিলতে পারে, আর না উগরে দিতে পারে, জীবন এমনও তো হয়! কারও হাতে হাত রেখে একটু বিশ্বস্ততার সুরে কষ্টগুলো ভাগ করেও নিতে পারে না শত চাওয়া সত্ত্বেও,---আমার অবস্থাটা ছিল ঠিক এরকম। তখন মনে হয়েছিল, অসীম দূরত্বে চলে যাই, তাহলে হয়তো জীবনের একটা ধরনে বাঁচতে পারব! জীবনের মোটামুটি চারটা ধরন হয়। প্রথম ধরনে, জীবন সুখের সঙ্গী হয়, সেখানে সুখের পাল্লাটাই বেশি ভারী হয়। দ্বিতীয় ধরনে, জীবন দুঃখের সঙ্গী হয়, যেখানে কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের সতত বাস। তৃতীয় ধরনে, জীবন সুখ-দুঃখের সমন্বয়ে হয়, সেখানে কখনও সুখ, কখনও দুঃখ মিলেমিশে থাকে। চতুর্থ যে ধরনটা, সেখানে জীবন না পায় সুখ, না পায় দুঃখ, আর না থাকে সুখ-দুঃখের তেমন একটা সহাবস্থান! এই জীবনটাকে আপনারা দোটানার জীবন, শঙ্কাগ্রস্ত জীবন বা মধ্যবিত্তের জীবন যেভাবে ইচ্ছা সংজ্ঞায়িত করতে পারেন। তাই বলি কী, জীবনে হয় অনেক ধনী হবেন না হয় দরিদ্র, মধ্যবিত্ত আদলের হাতে জীবনটাকে সমর্পিত করবেন না, ওতে বাঁচতেই বড়ো কষ্ট! কখনও মুখে না বললেও মনে মনে হলেও যা চেয়েছি, তার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সত্যি বলতে, আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসার সাথে পরিচিত হবার আগ পর্যন্ত মনে মনেও কখনও কোনও চাওয়া ছিল না। হ্যাঁ, তবে পরীক্ষায় নাইনটি টু ক্রস করার বাসনা আমার জন্মগত চাওয়া ছিল! হা হা হা...নিতান্ত সাধারণের মাঝেই কেমন অদ্ভুত, তাই না! আসলে, কখনও কারও ভালোবাসা পাব, আমি কাউকে ভালোবাসব, কাউকে মনে করে আমার সকালটা শুরু হবে, কারও সাথে দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিতে আমার বিকেল গড়াবে, কারও চোখে স্বপ্ন হয়ে রাত্রি নামবে এমন ভাবনা, অনুভূতি, চাওয়া কোনও কালেই আমার ছিল না! সেটা কীরকম, বলি... আমার জন্য কেউ যত যা-ই করত না কেন, আমি সেটাকে সব সময়ই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতাম, কখনওই আমার প্রতি এটা কারও দুর্বলতা হিসেবে ভাবতাম না। ভালোবাসার প্রথম শর্তই হলো, অপর পাশের মানুষটার দৃষ্টিতে বা বিচারে নিজের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করা, অর্থাৎ সে আমার প্রতি দুর্বল, এমন একটা অনুভূতি তৈরি হওয়া! সেটাই আমি করতাম না কখনও! আমার হিসেবের ধরন বরাবরই সরল-সাদামাটা ছিল।…সে কেন এমনটা করল? কীসের জন্য? এত মেয়ে থাকতে এক আমার জন্যই কেন? এভাবেই-বা কেন বলল? ওরকম করেই-বা কেন তাকাল? ওই দৃষ্টিতে কেন এত সুধা মেশানো?---এসব প্রশ্নের কোনও জায়গাই ছিল না আমার ভাবনার জগতে। সত্যিই ছিল না! মনে হতো, হ্যাঁ, করতেই পারে, হতেই পারে, আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটতে পারে, হিসেব এত জটিল করার কিছু নেই।---আমার নীতিটা ছিল এইরকম। বিয়ে, স্বামী, সংসার, সন্তান এসব আমার ভাবনার মধ্যে কখনও আসেনি; সত্যি বলতে, মনে মনেও চাইনি। চাওয়ার মধ্যে পড়ালেখা আর প্রকৃতিই ছিল আমার একমাত্র বিষয়বস্তু। অনেক পড়ালেখা করব, অনেক উপরে নিজের একটা স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করব, পরিবারে সব অপূর্ণতায় পূর্ণতার প্রলেপটা প্রথম আমিই দেবো, এই তো! আমার আর-একটা ইচ্ছে ছিল---দুঃস্থ শিশু আর প্রবীণদেরকে নিয়ে কিছু করা, এই দুই শ্রেণির মানুষের জন্য অন্তর থেকে টান অনুভব করি। সব থেকে অসহায় হয় শিশুরা আর প্রবীণরা, মনে মনে খুব করে চাইতাম বড়ো হয়ে তাদের জন্য কিছু করতে। আর প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসতাম লেখালেখি করতে। নিজের অনুভূতিগুলো মুখে প্রকাশ করতে চাইতাম না, নিজের মতো করে প্রিয় ডায়েরির পাতায় সযত্নে লিখে রাখতাম। কবিতা, গদ্য, গল্প, নিজের কিছু ফিলোসফি, কিছু আবোল-তাবোল, পাগলামি সব...সব লিখে রাখতাম! কখনও কখনও একটা কবিতা লিখতে বসেছি তো চার লাইন লিখেছি কি লিখিনি, পরের দশ দিন আর এক লাইনও লিখিনি, আবার একদিনে গোটা চারেকও লিখে ফেলতাম,---যদিও জঘন্যই লিখতাম! কী আর করা যাবে, আমার ইচ্ছের জীবন, তার উপরে যে জোর চলে না! আমার মনটাকে আমি খুউব ভালোবাসি, সেখানে কোনও ধরাবাঁধা নিয়মের বেড়াজাল কক্ষনো রাখিনি, পাগলামিতে ভরা ছিল আমার এক-একটা প্রহর। এমন কোনও পাগলামি নেই, এমন কোনও দুষ্টুমি নেই, যা আমি করতাম না। মজার ব্যাপার হলো, আমার দুষ্টুমির সব থেকে বড়ো শিকার হতো আমার কলেজের স্যাররা! যেখানে আমি অন্যদের বেলায় দেখতাম, তারা স্যারদের সাথে কথা বলতেই ভয় পেত! সেখানে উলটো আমিই বরং স্যারদের উপর নানান ধরনের অত্যাচার করতাম। দু-একটা বলি। ক্লাসে যখন পড়াতে আসতেন, তখন ওঁরা যদি পাঁচটা লাইন পড়াতেন, আমি সেখানে পনেরোটা প্রশ্ন করতাম। যতক্ষণ না আমি সন্তোষজনক উত্তর পেতাম, আমার মাথায় না ঢুকত, ততক্ষণ পযর্ন্ত প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করেই যেতাম, আর স্যারদের রীতিমতো নাজেহাল করে ছাড়তাম! তবে আমি কখনও যুক্তিহীন প্রশ্ন করতাম না বা বুঝেও প্রশ্ন করতাম না। পরীক্ষার সময় আমি বলে দিতে পারতাম আমি কোন বিষয়ে কত নম্বর পাব---এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম আমি, খুব একটা গরমিল হতো না! শুধু আমার খাতাটায় স্যাররা কম করে হলেও ছয়-সাত বার চেক করে তারপর নম্বর দিতেন, কারণ ওঁরা ভালো করেই জানতেন, এক-একটা নম্বরের জন্য আমি রীতিমতো যুদ্ধ বাধিয়ে দেবো! এক নম্বর কেন কম পেলাম, কড়ায় গন্ডায় আমাকে বুঝিয়ে দিতে হতো। এতটাই বেয়াড়া ছিলাম আমি! স্যারদের মধ্যে একজন ভীষণ কিপটে ছিলেন, ওঁর অনেক ধরনের ফলের বাগান ছিল, কিন্তু উনি একটা পেয়ারাকে ছয় ভাগ করে আমাদের ছয়জনকে দিতেন! পেয়ারার টুকরো দেখলে নিজেদেরই কান্না পেত! ভাবতে পারেন, কেমন হাড়কিপটের যথার্থ উত্তরপুরুষ ছিলেন তিনি! এদিকে আমিও কম যাই না! একবার ওঁর গাছের আমড়া পেড়ে ওঁর অজান্তেই ওঁকে খাইয়েছি! হি হি হি…স্যার তো মহাখুশি যে ওঁকে আমি আমড়া খাইয়েছি! স্যার পরের দিনই টের পেয়েছিলেন, আগের দিন কোন অমৃত উনি আস্বাদন করেছেন! প্রায় ত্রিশটার মতো আমড়া সাবাড় করে দিয়েছিলাম আমরা! কী পরিমাণে যে জ্বালাতন করতাম স্যারদের! অথচ অবাক-করা বিষয় এই যে, আমার এই জিনিসগুলোই স্যারদের ভালোলাগার বিষয় ছিল! ওঁরা প্রায়ই বলতেন, আমার পাগলামিগুলোই এমন ছিল যে, কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারতেনই না! আমার জীবনের সোনালি সময়গুলোর সবটাই জুড়ে ছিল আমার কলেজ, যা আজ থেকে চার বছর আগে ছিল আমার ভালোবাসার একমাত্র স্থান! আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার ছোঁয়া, প্রথম অনুভূতি, ভালোবাসার সাথে আমার প্রথম পরিচয় সবকিছুর সূত্রপাত ঘটে আমার কলেজেই। আমি এমন কাউকেই ভালোবেসেছিলাম, যার সাথে সম্পর্কটা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার! তবে সব থেকে বড়ো অসম্ভব ছিল যেটা, সেটাও সম্ভব হয়ে গেল তখন, যখন ওই মানুষটাও আমাকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছিলেন! সময়টা ছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। তারিখটা আমার ঠিক মনে পড়ছে না, আসলে আমি বার তারিখ, দিন ক্ষণ খুব একটা মনে রাখতে পারি না। যা-ই হোক, ২০১৭ সালে মূলত আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়, এর আগে শুধু দুজন দুজনের প্রতি অসীম দুর্বলতা লুকানোর ব্যর্থপ্রয়াসই চালিয়ে যেতাম। সেবার আগস্ট মাসের শেষের দিকে আমাদের কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে যাবার পরিকল্পনা হচ্ছিল, আমি তখন সবেমাত্র একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তো শিক্ষাসফরে যাবার জন্য আমাদের খুব তোড়জোড় করে পরিকল্পনা চলছিল। কোথায় যাব, কী কী করব, এইসব ভাবনায় সবাই ডুবে আছি। অনেক চিন্তাভাবনার পর শৈলশহর নামে খ্যাত সিমলাই ঠিক করলাম স্পট হিসেবে। যতদূর দৃষ্টি যায়, সাদা পেঁজাতুলোর তুষারাবৃত শৃঙ্গ, দেবদারু গাছের সারি, পাইন ও রডোডেনড্রন গাছের রাজ্য সিমলা ছিল আমার ভীষণ পছন্দের জায়গা! যদিও বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীর ওতে অমত ছিল, কিন্তু আমার যে এক সিমলাই যাবার ছিল! তাই উনি ফাইনাল ডিসিশন দিলেন, সিমলাই সিলেকটেড! আমি কিন্তু ওঁকে বলিওনি এই কথা, অথচ উনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। কীভাবে, তা আজও জানি না! যাবার দিন-তারিখ, গাড়িসহ যাবতীয় সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিকঠাক চলছিল। এদিকে আমি তখন দিদিমার বাড়ি থাকি, মা-বাবা আর ছোটো বোন তখন দার্জিলিং থাকত, আমি অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি দিদিমার কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছি। আসলে আমার দিদিমার বাড়িই ছিল আমার সবকিছু---আমার ভালোবাসায় মোড়ানো পরিবার! ঠাকুরদাবাড়ির সাথে তেমন কোনও সম্পর্ক আমার ছিল না। যা-ই হোক, সেদিকে বেশি না যাই। আমি আমার নয়জন মাসতুত-মামাত ভাইদের মধ্যে তখন একমাত্র বোন ছিলাম, তাই সবারই প্রাণ ছিলাম আমি। ছোটোবেলা থেকেই এতটা ভালোবাসা আর আদর-যত্নে ওরা আমাকে বড়ো করেছে যে চোখ-রাঙানো কাকে বলে, আমি সেটাই জানতাম না! মা-বাবা যখন বাংলাদেশে শিফট করেছিল, তখন দাদু-মাসিমণিরা সবাই কেঁদে অস্থির, ওরা কোনওভাবেই আমাকে ঢাকায় আসতে দেয়নি, সেই থেকেই পরবর্তী পাঁচটি বছর আমি দাদুবাড়ি কাটিয়েছি। ওরা আমাকে সব সময় চোখে হারাত, কিছুক্ষণ না দেখলেই সবাই অস্থির হয়ে পড়ত। আর আমিও ছিলাম ভীষণ বাধ্য মেয়ে, যদিও আমার জন্য বাধ্যতার সুতো কেউ কোনও দিনই বাঁধেনি! দশমিনিটের পথও আমি একা একা পেরোতে চাইতাম না, আমি তাদের ছায়ায় প্রশান্তি আর স্বস্তি খুঁজে পেতাম। সুতরাং আমাকে একা একা এত দূরে গোটা একটা দিন আর অর্ধ-রাত্রির জন্য ছাড়তে কেউই রাজি ছিল না। আমি ঠিকমতো খাব কি না, কীভাবে থাকব, আমার খেয়াল রাখবে কে, সবাই এসব চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে, তখন উনিই ছিলেন একমাত্র ভরসার মানুষ, যাকে শুধু আমার পরিবার নয়, আমাদের পুরো গ্রামটাই ভরসা করত চোখ বন্ধ করে! এমন একজন মানুষ তিনি ছিলেন, যার বিকল্প সত্যিই হয় না! যা-ই হোক, ওঁর ভরসায় সবাই নিশ্চিন্তে আমায় যেতে দিল। আমি কেন জানি না বলেছিলাম যাবার আগের দিন ওঁকে যে আমি গাড়িতে ওঁর পাশেই বসব, আমি ভাবিনি, উনি এককথায়ই সানন্দে রাজি হয়ে যাবেন। প্রতীক্ষিত দিনটি এসে গেল, আমরা যথারীতি রওনা দিলাম। আমাদের বিশাল মাঠে গাড়ি দাঁড় করানো ছিল, ভোর ছয়টায় গাড়ি ছাড়ল, আমার পাশের সিটটা ওঁর জন্যই খালি ছিল। কিছুদূর যাবার পর, বাকি কয়েকজন স্যারের সাথে উনি গাড়িতে উঠে আমার পাশে এসে বসলেন। তখন আমার কেমন লাগছিল, আমার কলম এতটা পরিপক্ব এখনও হয়নি যে সেই মুহূর্তের অনুভূতি লিখে প্রকাশ করতে পারব! আমি সত্যিই জানি না, সেই স্বর্গীয় সুখটি কেমন ছিল! গাড়িতে আমরা ভীষণ মজা করেছি সবাই মিলে...আমরা প্রথমে ‘নিওগথিক’ স্থাপত্যশৈলীর নজির ‘ক্রাইস্ট চার্চ’-এ গিয়েছিলাম। পুরো চার্চটা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখেছি, আসার সময় মোমবাতি জ্বালিয়ে গড যিশুখ্রিষ্টের সামনে বসে প্রার্থনা করেছি। চার্চ থেকে বের হয়ে আমরা রিজের পাশে টুরিস্ট অফিসের সামনে দিয়ে সিমলা শহরের সর্বোচ্চ স্থান ‘জাখু হিলস’-এ গিয়েছি, যা রিজ থেকে খাড়াচড়াই পথে দুই কিলোমিটার! ওটা ঢালু পাহাড় ছিল, সেই পাহাড়ে কিছু দূর ওঠার পর আমি আর উঠতে পারছিলাম না, সবাই ভীষণ মজা তো ঠিকই করছিলাম, কিন্তু আমি একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন পেছন থেকে একটা হাত অতি সন্তপর্ণে আমার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে, অনেক কথার ফাঁকে ফাঁকে নীরব হাসির ফোয়ারা ছুড়ে ছুড়ে দিয়ে আমায় সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। আহা, আমার শত চাওয়ার সেই ভালোবাসার মানুষটি! সেদিনই আমাদের প্রথম স্পর্শ, একনির্ভরতায় হাত ধরে একসাথে পথচলা! যেন জীবনের এক ভিন্ন রূপরেখা টানলাম দুজন মিলে! পুরো স্পট আমরা এভাবে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। হ্যাঁ, এমনই এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাক্ষী হলাম দুজন! এদিকে বাকি স্যাররা, ছাত্রছাত্রীরা সবাই এক অপার বিস্ময়ের দৃষ্টি দিয়ে একটু পর পর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, আর প্রতিবারই গভীর সংশয়ে ভোগে! ভাবে আবার ভাবতে পারেও না,---এমন অসম্ভব কিছু কি আদৌ সম্ভব হতে পারে? কেউ ভাবতে চাইলেও ভাবতে পারছে না, আবার ক্ষণিকের জন্য ভেবেও ফেলে,---তাহলে কী হতে পারে এটা? সব সময় একটা ঘোরের মধ্যে তাদের পুরো সফরটাই কেটেছে! হিলস স্পট থেকে বের আমরা মোমের মূর্তির জন্য খ্যাত জর্নিস ওয়্যাক্স মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে দেবদারু, পাইন, পপলারের গহীন বন, যার বুক চিরে বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী! উঁচু-নিচু, ঢালু পথ আর নির্জন বনের গভীরতা। তখন আমি ভয় পাব কী, আমার জায়গায় উনিই বেশি ভয় পেতেন! আমার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে রাখতেন! স্বভাবতই উনি একটু ভীতু প্রকৃতির ছিলেন, একটু বেশি নির্জন জায়গা হলেই ভয় পেতেন, আবার বাইকের স্পিড একদম লো করে দিয়ে চালাতেন, ওঁর হাইস্পিডে ভয় করত! হি হি হি...আমার খুব আদরের ভীতুর ডিম একটা! ওঁর মাঝে এরকম কিছু সারল্য, শিশুসুলভ আচরণ আমায় ভীষণ টানত! উনি কিন্তু আসতে চাননি এই গহীন বনে, শুধু আমি বলেছিলাম, এই সবুজের সমুদ্রে পাহাড়ি পথ ধরে আমি হাঁটতে চাই ওঁর সাথে, আমার ওই একবারই বলাতে, একটা কথা রাখতেই উনি নিজের সমস্ত ভয় দূরে সরিয়ে, নিজের নিয়মের বাইরে গিয়ে আসতে রাজি হয়ে গেলেন! আমার ছোট্ট জীবনে এর থেকে বেশি আর কী পাওয়ার থাকতে পারে! এরপর আমরা সবাই মিলে বোটরাইডিং-এ গেলাম। সেদিন রৌদ্রোজ্জ্বল, খুব মিষ্টি একটা দিন ছিল। সিমলার উপত্যকায় ছোটো ছোটো শান্ত জলধারায় আমাদের অবাধ বিচরণ, পাশাপাশি বসে যেন স্বর্গের দ্বারমুখী দুটি ময়ূর-ময়ূরীর প্রণয়লীলা! ভালোবাসা কাকে বলে, আমি সেদিন প্রতিটি শিরা-উপশিরায় অনুভব করেছি! দুপুরের শেষে আমরা সবাই একসাথে খেয়েছি। আমার এখনও মনে আছে, আমরা একটা কাঁচালঙ্কা দুজনে খেয়েছিলাম, যদিও আমার কাছেও একটা কাঁচালঙ্কা ছিল। আহা আহা, দুজনের ঠোঁট ছুঁয়ে-যাওয়া সেই একটি কাঁচালঙ্কা! কী স্বর্গ কী স্বর্গ! সেদিন বুঝেছিলাম, শিহরণ কী জিনিস, প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেছে অজানা আশ্চর্য এক সুখ! বিকেলটা যখন পড়ে এল, আমি ওঁর কাঁধে মাথা রেখেছিলাম, আমার অপর পাশের গালে উনি আলতো করে ডানহাতের উলটো পিঠটি বার বার ছোঁয়াচ্ছিলেন। তখন যে কী হচ্ছিল, আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি না! শুধু মনে হয়েছিল, আমার বুঝি আবার জন্ম হচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে! ভালোবাসার স্পর্শ মৃত শরীরেও ঠিকই প্রাণসঞ্চার করতে পারে, সেই ক্ষণে বুঝেছিলাম! বিকেলের শেষে আমরা স্টেশন সামার-হিল হয়ে দুই কিলোমিটার উত্তরে বিখ্যাত চাদউইক ফলস-এ গিয়েছিলাম। সবাই ড্রেস চেইঞ্জ করে সুন্দর করে সেজে বের হয়েছিলাম---ঝরনার জলে শুধু শরীর নয়, মনটাকেও স্নান করাতে! আমাকে উনি সেদিনই প্রথম বার ঝরনার ধারে গোধূলিক্ষণে সাজরত অবস্থায় দেখেছিলেন! সবার দৃষ্টি এড়িয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে চুপিচুপি বলেছিলেন, ‘তোমায় খুব মিষ্টি লাগছে, আমার দুষ্টু বুড়িটা!’ আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভীষণ আবেদনময়ী করে বলেছিলাম, ‘আপনি…আপনি...আপনি আমার বুইড়া একটা!’ বলে নেওয়া ভালো, আমাদের দুজনেরই আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশে। এরপর দুজনেই ফিক করে হেসে দিলাম, ঝরনার ধারে আমার সমস্ত মুহূর্ত উনি ক্যামেরার ফ্রেমে বেঁধেছিলেন, সেখানে জলে-ভেজানো বিস্তৃত সব বড়ো বড়ো প্রস্তরখণ্ডে উঠে উঠে আমরা সবাই ভীষণ লুটোপুটি করছিলাম! কিন্তু ওই যে ভীতুর ডিমটা, উনি…উনি তো জলের ধারেই নামতে চাইছিলেন না, সবাই অনেক করে ওঁকে অনুরোধ করছিল সবার সাথে ঝরনাস্নানের সাক্ষী হতে। সেই সময় আমি সবার সামনে মুখে কিছুই বলিনি, উনি শুধু একবার আমার চোখের দিকে চাইলেন! আমি জানি না আমি মনে মনে কী বলেছিলাম, আর উনি কী করে তা বুঝতেও পেরেছিলেন! আমি লজ্জায় দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেললাম! উনি জলে নামলেন, আর এদিকে তো আমি দুনিয়ার বাঁদরামি করেই যাচ্ছিলাম! উনি অনবরত দোয়া পড়ছিলেন যাতে পা পিছলে পাথরখণ্ডের ফাঁক দিয়ে পড়ে না যান! ওঁর ওই ভয়-পাওয়া রাঙা চেহারা দেখে আমি ফিক ফিক করে হেসে উঠলাম। উনি তখন ভয় পেলেও, দৃষ্টিতে ঠিকই আমার ওই হাসির পালটা প্রতিশোধ নেবার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন! হি হি হি...এমন প্রতিশোধের শিকার হতে আমি যে হাজার জন্মেও হাজার বার রাজি! আমাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দেড়টা বেজে গিয়েছিল। আসার সময় গাড়িতে আমরা অনেক রকমের গেমস খেলেছিলাম, গানের কলি নিয়ে লড়াই করেছিলাম, সবাই অনেক বেশিই আনন্দ করেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্তি চেপে বসেছিল শরীরে, সবাই যে যার মতো সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ওঁর বাহু জড়িয়ে ধরে আমি আগের মতোই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই মুহূর্তে রাতের পুরো অন্ধকারটাই আমার কাছে আয়নার মতো ঠেকছিল! মনে হচ্ছিল, অন্ধকারের চোখে চোখ রেখে আমি নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আহা, কখনও কখনও অন্ধকারও যে এমন আয়না হয়ে ওঠে, সেই রাতের আগে তা কোনও দিন বুঝিইনি! আমার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ ছিল ওটা। আমি তো কখন ভাবিইনি, আমার ভালোবাসার শুরু এতটা রোমাঞ্চকর, এতটা অভিনব হবে, আর এতটাই রঙের বাহার থাকবে ওতে! আমি ভুল করে স্বপ্নেও ভাবিনি অত কিছু, না চেয়েও পাওয়ার অনেক ঊর্ধ্বে সেদিন আমি উঠে গিয়েছি! আমাকে চাইতে দিলে হয়তো আমি এর সামান্যতম কিছুও বিধাতার কাছে চাইতে পারতাম না! এর পরের কিছু দিন আমি যেমনি ঘোরের মধ্যে ছিলাম, তেমনি ছিলেন উনিও। বিশ্বাস তখনও হচ্ছিল না…কী ঘটতে কী ঘটে গেল? আদৌ ঘটেছে তো? কীভাবে সম্ভব হলো? এত অভিনব সূচনা কে ঘটাল? এসব প্রশ্নের উত্তর সত্যিই নেই আমার কাছে। এরপর থেকে আমাদের প্রতিটি দিন ছিল এক একটা পূর্ণ বসন্ত! উনি ছিলেন আমার চেয়ে আটাশ বছরের বড়ো। আমাদের ধর্মও ছিল ভিন্ন। তবে কী জানেন তো, ভালোবাসাটা ঠিক বয়সের সাথে বয়সের হয় না, মনের সাথে মনের হয়। দুটো মন যদি এক হয়ে যায়, তবে সেখানে বাকি পৃথিবীটাই তো গৌণ---বয়স, অবস্থান, ধর্ম কোনও কিছুই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে না কখনওই! কোনও কারণ ছাড়াই নিজে নিজে হেসে ওঠা, নিজের সাথে নিজেই একা একা কথা বলা, কাউকে ভেবে পুরো দেহ-মনে শিহরণ জাগা, প্রতিদিন ভোর হবার অপেক্ষায় থাকা, কখন সকালটা হবে আর আমি কলেজে যাব, বিস্তৃত মাঠের শেষ প্রান্ত থেকে তাঁর আগমন দুচোখ ভরে দেখব! আহা, তাঁর মতো করে অমন অপূর্ব ভঙ্গিতে হাঁটতে, হাত নাড়াতে, কথা বলতে, তাকাতে, হাসতে আর কাউকেই আজ পর্যন্ত দেখলাম না! অথচ এই আমিই কিনা একটা সময় রাত নামার অপেক্ষায় দিন পার করতাম! আর এখন আমি ভোর নামার অপেক্ষায় রাত পার করি! ভালোবাসা কী করে যেন আমার সমস্ত আমিত্বকে দখল করে নিল! কলেজে ঢুকেই প্রথমে আমার মুখটা দেখে লজ্জামিশ্রিত মিষ্টি হাসি দিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলতেন উনি! আমার অসম্ভব রকমের আদর জাগত তখন, ওঁর রাঙা মুখটায় টুক করে একটা চুমু এঁকে দিতে খুউব ইচ্ছে করত! আমার সব থেকে প্রিয় মনটাকে কারও কাছে রেখে আসবার অনুভূতি, ক্লাসের ফাঁকে কাউকে একটুখানি দেখবার জন্য ব্যাকুলতা, কারও গলার স্বরটা শুনবার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকা…সব…আমার সব অনুভূতি, সবকিছুর শুরু আর শেষ ওই মানুষটিকেই ঘিরে ছিল---এখনও আছে, আজীবনই থাকবে! আহা, সেই কলেজের ক্লাসরুমগুলো, বিশাল বড়ো মাঠটা, অফিসকক্ষ,---সেসবের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি কোনায় জড়িয়ে আছে আমাদের ভালোবাসাময় স্মৃতি, আমাদের গায়ের গন্ধ, এক-একটা জ্যান্ত অনুভূতির জন্ম! ওই মানুষটিই ছিল আমার দৃষ্টি, আমার স্পন্দন, আমার গুরু, আমার অভিভাবক, আমার অনুপ্রেরণা, আমার সাহস, আমার নেশা, আমার জীবনের টার্নিং-পয়েন্ট, আমার কল্পনার একমাত্র বিষয়, আমার পথনির্দেশক, আমার স্বপ্নস্রষ্টা, আমার হারানোর ভয়, আমার পরম পাওয়া, আমার একমাত্র সত্য, আমার সকল অভিমানের একমাত্র জায়গা, আমার গোটা একটা দিন, গোটা একটা রাত, আমার পূর্ণিমার সরু চাঁদটা, ভোরবেলার ধ্রুবতারাটাও, আমার ডায়েরির পাতাগুলো, আমার আকাশজুড়ে ডানা-মেলা প্রথম শালিক, আমার...আমার...আমার সব…মানে সবই! আমার শব্দ ফুরিয়ে যায় ওঁকে নিয়ে লিখতে গেলে, আমার কলম অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে, ডায়েরির পাতাগুলো বড্ড জিরজিরে হয়ে পড়ে, ওরা আর বইতে পারে না শব্দের ভার! জানালার গ্রিলের অপরাজিতাগুলো নুইয়ে পড়ে, নীল আভা ছড়াতে আর চায় না ওরা, গন্ধরাজগুলো সব গন্ধহীন হয়ে পড়ে, কেউ যেন এসে চুরি করে নিয়েছে ওদের সমস্ত সুধা! কলমটা আবারও স্থবির হয়ে পড়ে, কিন্তু অব্যক্ত কথাগুলো যেন বেড়েই চলে প্রতিনিয়ত! আমার কলম যে আজও অসহায় ওঁর ভালোবাসার কাছে, আমার জন্য ওঁর ভালোবাসা ছিল নিঃশর্ত, আপসহীন, তৃপ্তিময়, নিখাদ, সব নিয়মের সীমানা ছাড়িয়ে, সকল যুক্তির ঊর্ধ্বে, সব চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডি পেরিয়ে, সব স্বার্থের ইতি টেনে, সংর্কীণতার বহু দূরে, এক প্রশস্ত বুকের নিষ্পাপ ভালোবাসা…চিরদিনেরই জন্য! উনি আমাকে সব সময় বলতেন, ‘তুমিই প্রথম, তুমিই শেষ। যদি কখনও হারিয়েও যাও, মনে রেখো, কেউ একজন তার উঠোনে একলাই বসে থাকবে, তুমি আসবে, তাই।’ উনি আমাকে প্রায়ই গান গেয়ে শোনাতেন, আর বলতেন, ‘এগুলো শুধু গান নয়, এগুলো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার বার্তা।’ একটা গান ছিল, যে গানটা আমার সাথে ওঁর বন্ধনের সুতো! গানটার কথা না-ইবা বললাম, শুধু যে আমার জন্যই তোলা ছিল তা! আপনাদের সে ভাগ দিই কী করে, বলুন? একদিন আমিও ওঁকে একটা গান বার্তা হিসেবে দিয়েছিলাম, যদিও আমি গেয়ে শোনাইনি, লিখে পাঠিয়েছিলাম। সেদিনটা ছিল আমাদের এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষার ফলপ্রকাশের দিন। ভালোবাসায় যতই ডুবে থাকতাম না কেন, পড়াশোনায় সেটার এতটুকুও আঁচ উনি কখনও আসতে দেননি। আমাকে বলেছিলেন, টেস্ট পরীক্ষায়ও আমাকে প্রথম হতে হবে, না হলে উনি আমার সাথে দুইমিনিটের জন্য কথাবলা বন্ধ করে দেবেন! হি হি হি...তাঁর মনে কত্ত যে ভালোবাসায় মোড়ানো ছিলাম আমি, তা ভাবতেও অনেক সুখের শিহরণ জাগে! সেবারও বরাবরের মতো আমিই প্রথম হয়েছিলাম। আমাদের ফল প্রকাশের আগে গণিতের স্যার বলেছিলেন, এবার শিমু প্রথম হবে, আর আমি দ্বিতীয় হব। আমাকে নিয়ে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে হিংসে কাজ করত, যদিও মুখে প্রকাশ করত না কেউ, কিন্তু আমি যে চোখের ভাষা ভালোই পড়তে পারি! আসলে হিংসে এখানেই কাজ করত যে উনি আমার বড়ো শক্তি ছিলেন, দু-একজন স্যারও এটা সহ্য করতে পারতেন না, তাই একটা প্রতিযোগিতা চলতেই থাকত আমার সাথে। তখন উনি বলেছিলেন, আমাকে দ্বিতীয় সারিতে ফেলার মতো মুখ এই কলেজে তৈরি হয়নি এখনও! যা-ই হোক, ফলপ্রকাশের দিন আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। আগে কোনও দিনই রেজাল্ট নিয়ে ভয় তো দূরের কথা, দুশ্চিন্তাও হয়নি! কিন্তু ওঁর যে এত বিশ্বাস আর ভরসার দৃষ্টি আমি দেখেছি আমার জন্য, সেখানটাতেই আমার যত ভয় কাজ করছিল! যদি এলোমেলো কিছু হয়ে যায়! যথারীতি ফলপ্রকাশের শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত চলে এল। আমার সেই গণিতের শিক্ষককে উনি ফলপ্রকাশের দায়িত্ব দিলেন, তখন স্যার একটাই কথা বলেছিলেন, ‘আমি হেরে গেছি!’ ফল শোনার অপেক্ষায় আর কেউ রইল না, উনি বিজয়ীর হাসি দিয়ে রেজাল্ট-কার্ডটা হাতে নিয়ে এসে আমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলেন, আর আমাকে একটা কলম উপহার দিলেন। আমার মনে হলো, যেন পুরো পৃথিবীটাই আমি জয় করে ফেলেছি! একটা কথা বলাই হয়নি। উনি কিন্তু আমাকে প্রপোজ করেননি, আর আমিও করিনি! কোনও আয়োজন, পরিকল্পনা কিছুই ছিল না আমাদের মধ্যে। আমরা দুজন দুজনকে ইমপ্রেস করার চেষ্টাও কোনও দিন করিনি। আমরা এমন কিছুই করিনি, যার জন্য কেউ বিশেষভাবে আকৃষ্ট হতে পারে। এই অসম্ভব ভালোবাসা সম্ভব হয়ে যাবে, সেটাই আমাদের জানা ছিল না! কীভাবে যেন আমার ভালোবাসাটুকু উনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমার চোখে উনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন যে, সেখানে ওঁর জন্য অসীম ভালোবাসায় শানবাঁধানো দিঘির ঘাটে কেউ অপেক্ষা করে আছে! সত্যি বলতে, আমি এখনও অবাক হই, আমিই-বা কী করে ওঁর গোপন ভালোবাসার গহীন দুয়ারে কড়াটা সত্যিই নাড়লাম! এই প্রশ্নের উত্তরে উনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘ওই চোখকে বোঝার মতো দৃষ্টি এই চোখেই নিহিত! চোখের ভাষা যে বোঝে না, সে ভালোবাসতেই জানে না। নীরব চাহনি যে ছুঁতে পারে না, সে গহীনে প্রবেশের ক্ষমতাই রাখে না!’ আহা! ভালোবাসা কত বিচিত্র রঙের আঁধার! ভালোবাসা তো অনেক দেখেছি, একটা সময় পর ভালোবাসার একটা বিশেষ বাণী থাকে, আর সেটা হচ্ছে---ব্রেকআপ! আমাদের ভালোবাসায় ‘ব্রেকআপ’ নামের শব্দটার কোনও স্থান ছিল না কখনওই; যা ছিল, যা আছে, আর যা থাকবে তা হলো---অভিমান, ভালোবাসামিশ্রিত একধরনের অভিমান! তবে সত্যিটা বললে, আমিই করতাম ওঁর উপর অভিমান, উনি খুব কমই অভিমান করতেন আমার উপর। আমি রেগে গিয়ে পুরো ছয়-সাত ঘণ্টা কথা বলতাম না, কিন্তু উনি ছয়-সাত মিনিটও কথা না বলে থাকতে পারতেন না! আমরা আমাদের দুজনকে খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম, অনুভব করতে পারতাম প্রতিমুহূর্তেই! শত মাইল দূরে থেকেও ঠিক বলে দিতে পারতাম, এই মুহূর্তে উনি কী করছেন, কোথায় বসে আছেন, কী ভাবছেন, এর পরের কথাগুলো উনি কী বলবেন, সবই!...উনিও ঠিক একই জিনিসগুলো আমার ক্ষেত্রেও বলে দিতে পারতেন! কিন্তু আজ এই চার বছর পরে কেউ আর কিছুই বলে না তো! আমিও আর কাউকে অভিমান করে কিছুই বলি না! কেন বলি না? উনিই-বা কেন বলেন না? না উনি আমায় আঘাত করেছেন, আর না আমি ওঁকে! তাহলে কেন? আজ এই ক্ষণে আমি একা বসে বসে ডায়েরির পাতাগুলো জুড়ে শব্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছি! কিন্তু কেন? আজ কোথায় আমার সেই সুখের রাজ্য? কোথায় আমার সেই ‘উনি’, আর কোথায় ওঁর এই ‘আমি’?! অভিমানের পাল্লাটা এতটাই ভারী হয়ে গেল যে, তা প্রকাশের অবকাশটুকুও পেলাম না দুজনের কেউই! আমি অভিমান করে বসে আছি, উনি কেন বলছেন না! উনি অভিমান করে বসে আছেন, আমি কেন বলছি না! সত্যিই তো, কেন আমিই-বা বলছি না? কেন দৌড়ে গিয়ে ওঁকে জড়িয়ে ধরে বলছি না, ‘আমি আপনাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসি!’ কীসের এত বাধা?! কেউ আমাকে বলে দাও, এ কেমন অদৃশ্য দেয়াল, যেটা ডিঙোতে আমার এত বাধছে?! বলা হয়নি ওঁকে অনেক অনেক কথাই, আর শোনাও হয়নি ওঁর যত জমানো আবেগমথিত দিশেহারা পথচলার গল্প! আজ আমরা যোজন যোজন দূরত্বে বসে আছি, হয়তো এখন সীমানার শেষ প্রান্তের বিপরীত মোড়ে দাঁড়িয়ে দুজন! কিন্তু ভালোবাসাটা আজও একই সমান্তরাল পথের পথিক! যা ছিল, তা আছে, তা-ই থাকবে! সীমানার প্রান্তে থাকা দুজনের বিশ্বাস নামক সুতোটা যে প্রচণ্ড রকমের শক্তিশালী! আজ যেমনি আমি একাই লিখে যাচ্ছি ওঁকে নিয়ে অনবরত, ঠিক তেমনি উনিও একাই আমায় অনুভব করে যাচ্ছেন ওঁর একলা উঠোনে! হয়তো এর নামই নিয়তি! ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, অথচ বিপরীত মোড়ের দুটি মানুষকে আজও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে আলাদা ঘরে! আমি ভাবি আর শুধু ভাবতেই থাকি, কিন্তু দিনশেষে এর পরিণতি শুধু ভাবনাতেই আটকে থাকে... উনিই তো আমার সেই মানুষটি ছিলেন...যিনি কিনা আমি চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকার কারণে কথা না হওয়াতে অস্থির হয়ে টেক্সট করেছিলেন, ‘চার চারটি বছর হয়ে গেল কথা হয়নি, আমাকে কী করে ভুলে আছ তুমি?’ আর আজ এইক্ষণে দাঁড়িয়ে, উনিই তো সেই একই মানুষ, চার বছর কেটে গেল অবলীলায়, অথচ একবারও অভিমান করে আমায় বলেননি, ‘চার ঘণ্টা ধরে আমার সাথে কথা বলোনি কেন তুমি?’ জ্যোৎস্নাযাপনে আমি যখন একলা নিশাচর, তখন উনি ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘আমার দুর্ভাগ্য, আমি কারও নিশিজাগা তারা হতে পারিনি!’ হায়, এ কেমন অদৃষ্ট! আজ যখন কত শত জ্যোৎস্না আমার আকাশে অমাবস্যায় ঠায় ডুবে যায়, আমার এক-একটা নিশি একলা যাপনের সঙ্গী শুধু এক ডায়রি আর কলম ছাড়া আর কেউ নয়, তখন উনি নিশ্চুপ নির্বাক, যেন দৃষ্টিহারা এক দর্শকমাত্র! এ কেমনতর সৌভাগ্যের ঘুমন্তপুরের যাত্রী হলেন উনি! আর আমি? আমিই-বা কে? এমন তো ছিলাম না আমি! নিজেকে চিনতে আজ বড়ো কষ্ট হয় আমার! এই আমারই কিনা বসত ছিল তাঁর শয়নে স্বপনে জাগরণে, আর সেই আমিই কিনা আজ তাঁর ঘুম ভাঙাতে অক্ষম অথর্ব! আজ স্বপ্নদুয়ার কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন! শুধুই বৃষ্টির অপেক্ষায় দুজন দুদিকে বসে আছি! কে জানে এই বৃষ্টি হয়তো দুচোখ ছোঁয়ার আগেই অন্তরাত্মাই ছুঁয়ে দেবে! তবু, সবকিছুর পরও, ঊর্ধ্বগত প্রাণ সেই মহাক্ষণে দাঁড়িয়েও বলবে, ‘তুমি ছিলে, তুমি আছ, তুমিই থাকবে!’