হ্যাঁ, গায়ত্রীদিদিও ঠিক একই কাজটা করে যাচ্ছিলেন আমার সাথে। উনি আমাকে তখন ‘দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ ফেরারি’ বইটা পড়তে বলেছিলেন, রবিন শর্মার লেখা। এরপর ‘ইট, প্রে, লাভ’, এলিজাবেথ গিলবার্টের। এরকম আরও কিছু কিছু বই। বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্টালের লিংক দিয়ে শুনতে বলতেন। আমিও তাঁর সাথে জগতবরেণ্য কম্পোজারদের নানা মিউজিক শেয়ার করতাম। ওঁদের জীবন ও দর্শন নিয়ে গল্প হতো। আমি মোটিভেশনাল ও স্পিরিচুয়াল বই পড়তে শুরু করি মূলত ওঁর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। এরপর উনি আমাকে ইনবক্সে বিভিন্ন ফিলোসফারদের কোটেশন দিতেন। উনি নিজের ফিলোসফি আমার সাথে শেয়ার করতেন। আমি করতাম কী, সেটাকে নিয়ে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতাম এবং উপস্থাপন করার সময় আমি চেষ্টা করতাম নিজের ভেতরটাকে আরও ঝালিয়ে নেওয়ার। ওটার সম্পর্কে একটা মতামত তৈরি করার জন্য পড়াশোনা করতাম। এই কাজটা করতে গিয়ে অনেক ফিলোসফিকাল টেক্সট আমাকে পড়তে হয়েছে। আমরা এক-এক দিন এক-এক টপিক নিয়ে আলাপ করতাম। এই ধরুন, অস্তিত্ববাদ। এটা নিয়ে উনিও নানান মতামত দিতেন, আমিও দিতাম। আমাদের প্রিয় টপিক ছিল সাহিত্য, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা, মনস্তত্ত্ব। কখনও কখনও সুফিবাদ, রুমি - গালিব - তাবরিজির কবিতা। ওসব আলাপচারিতা যদি সংগ্রহে থাকত, তবে ওগুলি দিয়েই হয়তো বিশ-পঁচিশ খণ্ডের বই হয়ে যেত। আমাদের প্রচুর ডিবেটও হতো। হয়তো আমি কিংবা উনি কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে নিজেদের উসকে দিতাম। ব্যস্ হয়ে গেল! ওটা নিয়েই চলতে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেক্সটের আদানপ্রদান। দেখা যেত এক-এক রাত আমরা হয়তো টানা দশ-বারো ঘণ্টা চ্যাটিং করতাম, তা-ও যেন ফুরতো না। কোনও একটা বিষয় নিয়ে আলাপের মাঝখানে উঠে যেতে হবে বলে লাঞ্চ - ডিনার মিস করেছি বহুদিন; আমিও, দিদিও।
এরকম করতে করতে আমার ভেতরের চিন্তাজগত ক্রমেই শাণিত হয়ে উঠল এবং আমার মধ্যে প্রচুর কনফিডেন্স গ্রো করে। আমি অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতো ওঁর অপেক্ষায় থাকতাম যে কখন আমি দিদির সাথে কথা বলতে পারব। আমার পুরো পৃথিবীটাই হয়ে গিয়েছিলেন উনি। ওঁর সাথে কথা বলাটাই ছিল আমার পুরো পৃথিবী এবং ওঁর সাথে কথা বলার সময় আমি এতটাই শক্তি অনুভব করতাম যে ওই শক্তি নিয়ে আমার দিনগুলি খুব ভালো কাটত। মজার বিষয় হচ্ছে, উনি আমার সাথে কথা বলার সময় কখনওই বলতেন না, তুমি পড়াশোনা করো, তুমি এই করো, সেই করো…তেমন কিছুই বলতেন না। ওঁর কথাগুলি ছিল বেশিরভাগ ফিলোসফিক্যাল এবং ওঁর নিজস্ব কিছু সমস্যা আমার সাথে শেয়ার করতেন। সেগুলি ছিল আমার জন্য অভিনব এবং আমি তা দ্রুত সমাধান করার জন্য খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতাম। চেষ্টা করার সময় আমাকে সেগুলি নিয়ে ভাবতে হতো। ধর্ম নিয়ে, আত্মা নিয়ে, জীবন নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে নানান দর্শন ও তত্ত্ব। সাথে সে সম্পর্কিত ওঁর কিছু ভাবনা। আমাদের দুজনের ভাবনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। দিদি আমার চাইতে বয়সে বারো বছরের বড়ো ছিলেন, সেটা আমার মাথায়ই আসত না কখনও। তিনি ছিলেন আমার একটা নেশার নাম। তাঁর চাইতে পরম বন্ধু আমার একজনও ছিল না।
মজার বিষয় হচ্ছে, ওই সমস্যাগুলি উনি নিজেই সলভ করতে পারতেন কিংবা আমার থেকে বেটার অপশন ওঁর ছিল। দিদির সাথে তো অনেক বড়ো বড়ো মানুষের ওঠা-বসা ছিল। অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ডসহ বিশ্বের নামকরা অনেক ভার্সিটির শিক্ষকরা ছিলেন দিদির বন্ধু। এ ছাড়া অনেক লেখক, দার্শনিক, পণ্ডিত ব্যক্তির সাথে তাঁর জানাশোনা ছিল। সেখানে আমার সাথে ওসব নিয়ে আলাপ করার কোনও মানেই হয় না। তা-ও তিনি এটাই করতেন। আমার সাথে সারাদিনই গল্প করতেন। আমরা পরস্পরের হাঁড়ির খোঁজ জানতাম না, কার ঘরে কী হচ্ছে কী হচ্ছে না, তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ ছিল না। আমাদের কথোপকথন ছিল অনেক বিমূর্ত বিষয় নিয়ে। একবার হলো কী, উনি আমার সাথে পিকাসোর কিউবিজম নিয়ে গল্প শুরু করলেন। অথচ আমার সাথে ওঁর ওটা নিয়ে গল্প করার তো কথা না। ফলে আমি গল্প করতে গিয়ে ওটা নিয়ে যা যা জানার, জেনে ফেললাম। দিদি ছিলেন এমনই একজন মহান শিক্ষক। উনি আমার চাইতে হাজারো গুণ দামি দামি মানুষকে ফেলে আমার কাছেই ফিরে আসতেন। এর সম্ভাব্য দুটো কারণ হতে পারে। উনি চাইছিলেন আমার চিন্তাজগটাকে শাণিত করতে কিংবা আমার সাথেই এগুলি শেয়ার করতে ওঁর ভালো লাগত। এর যে-কোনওটি হতে পারে।
ওঁর কিছু ফ্রেন্ড ছিল, যেমন সারদা, শেখর, শর্মিলা, গিরীশ, রাজীব, পৃথ্বী, প্রীতি ইত্যাদি। এঁরাও খুব সফিসটিকেটেড মানুষ। ভীষণ শাণিত মানুষ। ভীষণ পরিচ্ছন্ন মানুষ। উন্নত চিন্তাভাবনার মেধাবী মানুষ। সমাজের অনেক উঁচু স্তরের মানুষ। তাঁদের সাথেও আমার কথা হতো। আস্তে আস্তে দেখা গেল কী, ওঁদের কাছে গায়ত্রীদিদি আমার অবস্থানটা এমনভাবে তৈরি করে দিলেন যে ওঁরাও আমাকে রেসপেক্ট করতে শুরু করলেন। ওঁদের সাথে আলাপচারিতার মধ্য দিয়েও অনেক কিছু শিখতে, জানতে ও বুঝতে পারলাম। আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমার একটা লেখা আছে---ব্রোকেন অ্যাপয়েন্টমেন্টস অব লাভ। এ লেখাটা কিন্তু কিছু মানুষের সাথে কথোপকথনের একটা সন্নিবেশ, আর কোনও কিছু না। সেখানে আমি যাঁদের সাথে গল্প করছিলাম, তাঁরা মেধায় মননে অনেক অনেক উপরের স্তরের মানুষ। অক্সফোর্ডের দর্শনের শিক্ষক থেকে শুরু করে অনেকেই ছিলেন সেই আলাপচারিতার কমেন্ট-থ্রেডে। এমন একটা কথোপকথনটা চালানোর মতো যে মানসিক শক্তি, যে আত্মবিশ্বাস লাগে, সেটা আমার কখনও ছিল না। এটা প্রথম উনিই আমাকে দেন। গায়ত্রী তালরেজা---আমার আপনজন, আমার শিক্ষক, আমার বন্ধু।
আমি যে আসলেই অনেক মানুষের থেকে আলাদা, আমার যে সকলকে সময় দেওয়ার দরকার নেই, সকলের সাথে মেশার দরকার নেই এবং সকলেই যে আমার টাইম ডিজার্ভ করে না, এইসব জিনিস ওঁর কাছ থেকেই প্রথম শিখি আমি। সবাইকে সময় দেয় তাঁরা, যাঁদের করার মতো কাজ অল্প, যাঁদের হাতে অফুরন্ত সময়। এই পৃথিবীতে কোনও সৃষ্টিশীল ও মেধাবী মানুষের কাছে এমন অফুরন্ত সময় থাকে না, থাকা সম্ভবও নয়। উনি আমাকে সবসময় উৎসাহ দিতেন এটা বলে যে, যারা তোমার মতো করে ভাবে, যারা তোমার থেকে ভালো করে ভাবে, যাদের মন ও মগজ তোমার চাইতে উন্নত, যাদের সাথে কথা বলতে গেলে তোমার মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করো, তাদের সাথে বেশি মেশো। ওরা তোমার সাথে মিশতে চাইবে না, তোমাকে সময় দিতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। তুমি এমন কিছু কারণ তৈরি করো, যাতে ওরা তোমাকে সময় দিতে উৎসাহ পায়। নিজেকে ওদের সমমনা ও সমপর্যায়ের করে গড়ে তুলো। বড়ো মানুষের সাথে না মিশলে বা ওদের খেয়াল করে না দেখলে জীবনে অনেক কিছুই শেখার বাকি থেকে যাবে। এর জন্য নিজেকে ক্রমেই আঘাত করো, দহন করো। প্রতিদিনই শিখো, সমৃদ্ধ হও। বিশ্রাম নাও, তবে থেমে যেয়ো না। তাহলে তুমি নিজেকে বদলাতে পারবে। মনে রেখো, যারা তোমার চাইতে যোগ্য, তারা তোমার চাইতে আন্তরিক, ধৈর্যশীল, পরিশ্রমী। তাদের ভাবনা তোমার ভাবনার চাইতে অনেক আলাদা।
আর-এর ধরনের লোকের সাথে মেশার সুযোগ মিস করবে না, তাদের সাথে---যারা একেবারেই সহজ। সহজ মানুষ হচ্ছে এই পৃথিবীর রত্ন। সহজ মানুষ খুঁজতে হয়, ওদের পাওয়া খুব কঠিন। যে লোকটা সত্যিকার অর্থেই সাধারণ, সত্যিকার অর্থেই সহজভাবে চিন্তা করে, এমন কাউকে পেলে তার কাছে যাও, গিয়ে চুপচাপ বসে থেকে জীবনকে চিনে আসো। জীবনের এমন কিছু দিক ওদের কাছে শিখতে পারবে, যা তুমি হাজারটা বই পড়েও শিখতে পারবে না। এই যে লেসনগুলি, তা সারাজীবনই তোমার কাজে লাগবে। এসব তিনি আমাকে বলতেন। দিদি বলতেন, একটা খাবার যখন আমরা খাই, তখন সে খাবারটা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হয়। অ্যাপ্রিশিয়েট না করলে সে খাবারটা দ্বিতীয়বার জীবনে আর আসে না। সে খাবারটা খাওয়ার সৌভাগ্য তোমার আর না-ও হতে পারে। একইভাবে, জীবনে যখন ভালো মানুষের দেখা পাবে, তখন তাঁর মূল্যায়ন করবে। যদি তা করতে না পারো, তবে এমন কারও সাথে তোমার আর কখনওই হয়তো দেখা হবে না। যারা ভালো মানুষের দাম দিতে জানে না, তারা ভালো মানুষের দেখা পায় না। কখনও কি খেয়াল করে দেখেছ, পশু-পাখিও মানুষ চেনে। ওরা সবার কাছে যায় না, যার কাছে যায়, তার কাছেই বারবার যায়। নিজেকে এমন করে গড়ে তুলো, যাতে তোমার কাছে…ভালো যা-কিছু, তা আসে। তুমি যদি পজিটিভ এনার্জি আকর্ষণ করার যোগ্য না হও, তবে তা তোমার কাছে কেন আসবে? খেয়াল করেছ, যে মিষ্টি খেতে ভালোবাসে না, গাড়িতে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানটা তার চোখে খুব একটা পড়ে না!
তো এ ব্যাপারগুলি উনি বলতেন। আর উনি একটা জিনিস আমাকে শেখাতেন, সেটা হলো, মনে রেখো, জীবনে অর্থ উপার্জনের চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা। তুমি যা অর্থ উপার্জন করবে, তার একটা বড়ো অংশ খরচ করবে সম্পর্ককে মজবুত করার কাজে। এক্ষেত্রে তুমি যা পাবে, তা তোমার ব্যয়িত অর্থের চাইতে অনেক দামি। গরিব লোকের বন্ধু বেশি হয় না। গরিব বলতে দুই অর্থে গরিব। যার টাকা নেই, যার মেধা নেই। এই দুইয়ের যে-কোনও একটা যার আছে, তার বন্ধুর অভাব হয় না। আমি তোমাকে বলি কী, সম্ভব হলে দুটোর দিকেই খেয়াল রেখো। তবে দেখবে, যাদের টাকার দরকার, তারাও তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবে, যাদের মেধার স্ফুরণ দরকার, তারাও তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। যার যা দরকার, তাকে তা দিয়ো। এটা মানুষ হিসেবে তোমার দায়িত্ব। দিলে কখনও কমে না, বাড়ে। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো, যাতে দেওয়ার মতো উদ্বৃত্ত তোমার সব সময়ই থাকে। দান করার মনমানসিকতা রেখো। সে-ই সবচাইতে দরিদ্র, যে দিতে জানে না। এমন দৈন্যদশা থেকে মনকে মুক্ত কোরো।
মানুষকে ভালোবাসতে জানা ও মানুষকে দাম দিয়ে চলতে জানা, এই দুইয়ের চাইতে বড়ো সম্পদ কমই আছে। একটা মানুষের সাথে তুমি যখন কথা বলবে, তখন তোমার নিজের ব্যাপারটা মাথায় রেখে কখনও কথা বলবে না। তোমার তার আত্মায়, তার অন্তরে বসে তার সাথে কথা বলতে হবে। তা না হলে তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না, সে কী চায়। এ ব্যাপারটা তোমার মধ্যে এক ধরনের শক্তি তৈরি করবে। আর নিজের মধ্যে কখনওই কোনও ইগো রেখো না। ইগো মানুষকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। এই পৃথিবীতে কেউ কারও উপর নির্ভরশীল নয়। বলতে পারো, তুমি তো অমুক অমুককে তাদের জীবনধারণে সাহায্য করছ। একটু ভেবে দেখো, সাহায্য যে করছ, সেটা না করলে তুমি নিজেও কি কিছু সুখ বা তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে না? এই সুখ বা তৃপ্তির তুলনায় তো তোমার সাহায্যের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। মানুষ বাঁচেই-বা কয়দিন, বলো? যতদিন বেঁচে আছ, আনন্দ নিয়ে বেঁচো। একা একা বাঁচার মধ্যে কোনও আনন্দ নেই। চেষ্টা করে দেখতে পারো দুইপথেই হেঁটে, নিজেই বুঝবে কোন রাস্তায় আনন্দ বেশি।
ধরো, তুমি যদি কাউকে দিয়ে কোনও কিছু করাতে চাও। তখন সে যেমন করে ভাবে, সে তোমার কাছ থেকে যা যা শুনতে চায়, তোমাকে তেমন করে ভাবতে হবে ও তা তা তাকে শোনাতে হবে। বেড়ালের কাছে গিয়ে বেড়ালের ডাক দিতে হয়, ওর মতো করেই আচরণ করতে হয়, তবেই বেড়াল তোমাকে কাছের কেউ ভাববে। তোমাকে নিজের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে তোমার সামনের মানুষটার মধ্যে ঢুকতে হবে, তার মনের মধ্যে বসে বসে কথা বলতে হবে। তোমার যে ভাবনা, তোমার যে ইগো, সে ইগোটাকে মাথায় রেখে তার সাথে কথা বলা যাবে না। তোমার ইগোর দাম কেবলই তোমার কাছে, এই পৃথিবী তোমার ইগোকে দুইপয়সারও পাত্তা দেয় না, যদি পাত্তা দেওয়াটা জরুরি বা অপরিহার্য কিছু না হয়। ব্যাপারটা বুঝছ? এটা উনি আমাকে বলতেন প্রায় সময়। আমি এটা করতাম। নিজের ইগোকে একেবারেই শূন্য করে ফেলার চেষ্টা করতাম। উনি বলতেন, যা করবে, মন দিয়ে করবে। ফাঁকি দিয়ো না। যখন ফাঁকিবাজি করছ, তখন ফাঁকিবাজিই করবে, একেবারে মন দিয়ে করবে। তুমি যা-ই করো না কেন, নিজের পুরোটা ঢেলে দিয়ে কোরো। যদি কোনও সুন্দরীর দিকে তাকাও, তবে এমনভাবে তাকাও, যেমন করে তার দিকে কেউ কখনও তাকাতে পারেনি। যে কাজই করবে, অন্যদের চেয়ে একটু হলেও ভিন্ন উপায়ে করবে, বেশি সময় ও শ্রম দিয়ে করবে, বেশি ভালোভাবে করবে। শুধুই বেতনের বা লাভের আশায় কাজ কোরো না কখনও। এটা যারা করে, তারা জীবনে কিছুই শিখতে পারে না।
দিদির সাথে যোগাযোগের ওই সময়ে দেখা গেছে কী, কেউ আমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করল বা কোনও কিছু একটা ভুল করল, তখন আমি আবার তার কাছে ফিরে যেতাম। তাকে বলতাম, দেখো, তুমি আমার সাথে যা করলে, কেন করলে? ব্যাপারগুলি তুমি যেমন করে ভাবছ, তেমন নয়। আসো, আমরা এটা নিয়ে একটু আলাপ করি। কী করা যায়, দেখি। এরপর উনি যা বলতেন, তার প্রতিবাদ করতাম না। বলতাম, হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক। এর সাথে এই এই বিষয়গুলিও ভেবে দেখা যেতে পারে। এতে প্রায় সময়ই ওর রাগটা আর থাকত না এবং সে আমাকে জাজ করার পথ থেকে সরে যেত। এই বুদ্ধিটা দিদির কাছ থেকে শেখা। সব সময় যে এই বুদ্ধিতে কাজ হতো, তা নয়। দিদি বলতেন, তোমার সব চেষ্টা সত্ত্বেও, সে যেটা করছে, তোমার যদি সেটা পছন্দ না হয়, তুমি নিজেকে এমন একটা জায়গায় রাখবে যেন তার সঙ্গে তোমার আর মিশতে না হয়। কিংবা যদি মিশতেই হয়, তুমি তার কথাগুলিকে মন থেকে আর গ্রহণ করবে না। ওকে এটা বুঝতে দিয়ো না, শুধু তুমি নিজে সতর্ক থেকো যে ওর সব কথাই শুনবে কিন্তু কোনও কথাই তুমি তোমার মধ্যে ধারণ করবে না কিংবা কোনও কথাকেই এতটা কাছে আসতে দেবে না যা তোমাকে বিচলিত করে তুলতে পারে। নিজেকে ভালো রেখো। মৃত্যু যে-কোনও সময়ই চলে আসতে পারে। হয়তো বাঁচার জন্য সামনের মুহূর্তটাই শেষসুযোগ।
আমি বলতাম, এটা কি সম্ভব! কারও কাছে আছি, সামনাসামনি আছি, তার সাথে মিশছি, অথচ তার কথায় বা আচরণে প্রভাবিত হচ্ছি না, কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না! তখন উনি বলতেন, তুমি রেইনকোটের মতো হবে। রেইনকোট পরে তুমি যখন বের হও, তখন প্রচুর বৃষ্টি হলেও রেইনকোটে কিন্তু সেটা আটকায় না। কিন্তু প্রত্যেকটা বৃষ্টির ফোঁটা রেইনকোটে গিয়ে আঘাত করে ও করতেই থাকে। আঘাত ঠিক ততটাই বড়ো, যতটা আমরা গ্রহণ করি। রেইনকোটের যে বৈশিষ্ট্য, সে বৈশিষ্ট্য বৃষ্টির ফোঁটাকে ধারণ করতে দেয় না। রেইনকোট বৃষ্টিকে পড়তে বাধা দেয় না, কেননা বৃষ্টি তাকে স্পর্শ করার ক্ষমতাই রাখে না বলে বৃষ্টিকে পরোয়া করে না চললেও তার হয়। তো দিদি আমাকে বলতেন, তুমি নিজেকে রেইনকোট হিসেবে তৈরি করো। বৃষ্টি ভাববে, তোমাকে ভিজিয়ে দিল বোধহয়। ওকে সেভাবে করেই ভাবতে দাও, ও সেভাবে ভেবেই খুশি হয়ে যাক। তুমি তো নিজে জানো খুব ভালো করেই, তোমাকে ভেজানোর ক্ষমতা বৃষ্টির নেই। ওকে ওর মতো করে ভালো থাকতে দাও, তুমি নিজেকে এমনভাবে তৈরি করে নাও যাতে ওর ভালোথাকা তোমাকে খারাপ রাখতে না পারে। আমার খুব ভালো লেগেছিল এই কথাটা। উনি বলতেন, তোমার সামনের মানুষটা যেরকম করে বেঁচে আছে, তাকে সেরকম করেই বেঁচে থাকতে দাও। এটাই হচ্ছে ধর্ম।
দিদি কিন্তু খুব একটা রিলিজিয়াস মানুষ না, মানে ধর্মের আচার-প্রথা পালনের ব্যাপারে দিদির কোনও আগ্রহ ছিল না। দিদির কাছে ধর্মের মানেটাই ছিল ভিন্ন। ওঁর কাছ থেকে আমি ধর্মের অনেক কিছু শিখেছিলাম। সেগুলির কিছু কিছু আমার ‘অস্পষ্ট জার্নাল’ সিরিজের কিছু লেখায় আমি লিখেছি। উনি বলতেন, যে মানুষটা যেরকম করে বেঁচে আছে, যে মানুষটা যেরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছে, যে মানুষটা যেরকম করে বেড়ে উঠেছে---সমাজে, তার নিজের পরিবারে কিংবা দেশে, তাকে ঠিক সেরকম করেই বেঁচে থাকতে দাও। তার উপর তোমার বিশ্বাসকে চাপিয়ে দিয়ো না। তোমার কাছে হয়তো তোমার নিজের বিশ্বাসটাই শ্রেষ্ঠ, তবু মনে রেখো, তারও তো কিছু বলার থাকতে পারে! তাকে বলতে দাও। তুমি যদি তার কথা শুনতে রাজি না থাকো, তবে তোমার কথা তাকে শোনাতে যেয়ো না। ধর্ম মনের ব্যাপার, জবরদস্তির নয়। তুমি তার কাছ থেকে শিখবে, তার কাছ থেকে গ্রহণ করবে, খারাপটাকে বা তোমার জন্য অগ্রহণযোগ্যটাকে বর্জন করবে। তাকেও তোমার নিজের বিশ্বাসের ভালো ভালো দিকগুলির কথা বলো, তাই বলে তাকেও তোমার পথে চলতে জোর কোরো না, বিরক্ত কোরো না। এটা হাস্যকর। জানো তো, দোকানি কখন নিজের দোকানের জিনিসটা কেনার জন্য জোর করে? যখন সেটা পচতে আরম্ভ করে, সেটা দ্রুত বিক্রি করে ফেলাটা জরুরি হয়ে পড়ে।
এভাবে করেই বেঁচে থেকো তুমি। তাকে তুমি জাজ করতে যেয়ো না কখনও। কারণ, সে কীসের মধ্যে আছে, তুমি তা জানো না। সে যতটা কষ্ট পাচ্ছে, সে যতটা অসুবিধের মধ্যে আছে, কিংবা তুমি যেটাকে খারাপ কাজ বলছ, সে ওই খারাপ কাজটাই করে ভালো আছে, সেটা তুমি তো আর ভাবছ না। ধরো, তুমি ড্রিংক করো না, তাই বলে এই জগতের কেউ ড্রিংক করবে না, তা তো নয়। তুমি ধূমপান করো না বলে আর কেউ ধূমপান করবে না, তা তো নয়। তুমি কি জানো পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের মানুষ বেঁচে-থাকার প্রয়োজনেই ড্রিংক করে? ওটা না জেনেই লাফাচ্ছ কেন তবে? তবে হ্যাঁ, যদি সে এমন কিছু করে, যেটা অন্য কারও জন্য সমস্যা তৈরি করছে, অন্য কারও ক্ষতি করছে, তখন তুমি সেটার প্রতিবাদ করতে পারো। কিন্তু সে কারও কোনও ক্ষতি না করে যদি নিজের নিয়মে বেঁচে থাকে, সেই নিয়মকে বা পথকে কখনও জাজ করতে যেয়ো না। সব থেকে ভালো, কারও সঙ্গেই তর্কে না জড়িয়ে তাকে এড়িয়ে চলা। এটাই সবচাইতে ভালো। দিদি এটা বলতেন, যদিও এটা অবশ্য আমি এখনও শিখতে পারিনি।
দিদিকে দেখতাম, উনি কখনও কারও সঙ্গে তর্ক করতেন না। ওঁকে কখনও কারও সঙ্গে বিবাদ করতে দেখিনি। দিদির সে সময়টাই ছিল না। উনি যেটা করতেন, সেটা হচ্ছে, উনি এড়িয়ে চলতেন। একদমই এড়িয়ে চলতেন এবং উনি মানুষকে, সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা বলতে যা বুঝায়, সেটাই বাসতেন। ওঁর নীতি ছিল---হয় মানুষকে ভালোবেসো, নতুবা এড়িয়ে চলো। কাউকে ঘৃণা করার সময়টা বাঁচিয়ে দশজনকে ভালোবাসা যায় খুব সহজেই। এই পৃথিবীকে যদি শেষপর্যন্ত কিছু বাঁচিয়ে রাখে, তবে তা হবে ভালোবাসা, ঘৃণা নয়। তা ছাড়া কাউকে ঘৃণা করতে গিয়ে নিজের মনের শক্তি অপচয় হয়। কাউকে ঘৃণা করার সময়টা বাঁচিয়ে ওই সময়ে বরং একটা ভালো কবিতা পোড়ো। এটা তোমাকে সুন্দর করে ভাবতে ও সৃষ্টিশীল হতে সাহায্য করবে। মানবিক হও, মানুষের জন্য ভাবো। এই পৃথিবী বেঁচে আছে কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ ও মানবতার কর্মীর কাঁধে ভর করে, যারা শুয়ে বসে দিন কাটায়, ওদের কাঁধে ভর করে নয়।
ওঁর কিছু কিছু কাজ অসাধারণ প্রভাববিস্তারকারী। যেমন, উনি ক্যানসার-আক্রান্ত ছিলেন, ওঁর ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হয়েছিল। পরবর্তীতে উনি আর্টিফিশিয়াল ব্রেস্ট লাগান। এটা নিয়ে ওঁকে কখনও মন খারাপ করতে পর্যন্ত দেখিনি। ওঁর রসবোধ ছিল অতি প্রখর। এতটা মজা করতে জানতেন যে ভাবাই যায় না। নিজেকে নিয়েই মজা করতেন। ওঁর কথা শুনে ওঁর জন্য কষ্ট পাবো কী, হাসতে হাসতে প্রাণ বেরিয়ে যেত। এটাই বাঁচার নিয়ম বোধহয়---নিজে কষ্ট পেলেও অন্যকে ভালো রাখা, নিজের কষ্টকে কায়দা করে নিজের মধ্যেই রেখে দেওয়া। কষ্ট মার্কেটিং করার কোনও জিনিস নয়। যারা নিজের কষ্ট মার্কেটিং করে, তাদের কষ্টের দাম হয়ে যায় পণ্যের দামের সমান। যে দামে এক কেজি চাল কিনতে পাওয়া যায়, সে দামে যদি এক কেজি কষ্ট কিনে ফেলা যায়, তাহলে তো মহাবিপদ! তো দিদি খুবই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কথায় ও আচরণে নিজের অবস্থানটা দেখিয়ে দিতেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হবার পর থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত উনি একটা কাজ করে যাচ্ছেন, তা হলো, উনি ক্যানসার-আক্রান্ত রোগীদের বেঁচে-থাকার উৎসাহ দেন। উনি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে একটা স্কুল খুলেছেন ওদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগাতে।
উনি বলেন, বুঝলে সুশ, মানুষকে বেঁচে থাকতে দেখার চাইতে সুখ আর কোনও কিছুতেই নেই। আমার কাজে, আমার চেষ্টায় মানুষ ভালো আছে, হাসিখুশি আছে, এর চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? আমি তো বেঁচে আছি, ক্যানসার আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারেনি। মরেও তো যেতে পারতাম। বেঁচে যে আছি, তা-ই তো বোনাস! যদি মরে যেতাম, তবে কি এই সময়গুলি পেতাম, আমার ছেলেকে আরও কিছুদিন বেশি দেখতে পেতাম, তোমার প্রিয় জিজাজির (দুলাভাই) সাথে আরও কিছুদিন বেশি ঝগড়াঝাঁটি করতে পারতাম, বলো? জীবনের দায়টা তো শোধ করতে হয় কিছু না কিছু করে, তাই না? বেঁচেই আছি যেহেতু, আরও কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচি। আমি হাসতে শিখেছি, ওদেরও হাসতে শেখাই। আমি বাঁচতে শিখেছি, ওদেরও বাঁচতে শেখাই। মানুষ মরে অসুখে যতটা, তার চাইতে বেশি অসুখের কারণে মনে যে কষ্টটা আসে, সে কষ্টে। মানুষের মৃত্যুকে তো আর ঠেকিয়ে দিতে পারব না, তবে ওদের বাঁচার সময়টাকে একটু আনন্দময় ও দীর্ঘ তো করতেই পারি, তাই না? কাউকে কষ্টে থাকতে দেখলে আমার নিজেরই বাঁচতে অসুবিধে হয়। আমি নিজে বাঁচার স্বার্থেই অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। নিজে হাসার প্রয়োজনেই অন্যের চোখেমুখে হাসিটা এনে দিই।
এমন একজন মানুষকে সত্যিই কি ধর্ম পালন করতে হয়? যদি স্বর্গ-নরক বলে সত্যিই কিছু থাকে, যদি ঈশ্বর ন্যায়বিচারক হন, মৃত্যুর পর গায়ত্রীদিদি কোথায় যাবেন বলে আপনার মনে হয়? এই ফাঁকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। এই যে আমি ক্যারিয়ার আড্ডাগুলি করি, এটা আমি করি ওঁর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই। একেবারেই কোনও প্রাপ্তির আশা ছাড়া মানুষকে যখন আমরা কোনও কিছু দিই, সেখান থেকে যা পাওয়া যায়, তার মূল্য জাগতিক প্রাপ্তি দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। সেখান থেকে প্রাপ্তিটা হচ্ছে অসীম শান্তি, আনন্দ, ভালোলাগা, স্বস্তি, সুখ যা-কিছু আমাদের বেঁচেথাকার প্রেরণা যোগায়। এটা টাকাপয়সা দিয়ে পাওয়া যায় না, এটা কোনও দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। আপনার সমস্ত সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেও কোথাও পাবেন না আপনি এটা। মানুষের জন্য কাজের মধ্য দিয়েই তা পেতে হয়। মানুষকে ভালো রাখলে নিজেকে ভালোরাখা হয়।
এই যে আমরা বই পড়ি, কেন পড়ি? আমরা কেন গান শুনি? এগুলির তো কোনও অর্থমূল্য নেই। আর্থিকভাবে কোনও লাভ তো হয় না। সত্যিই হয় না? ভুল ভুল! মজার বিষয় হচ্ছে, এটার একটা মনিটারি ভ্যালু আছে। যে জিনিসটা আমাদের ভালো রাখে, সুস্থ রাখে, শান্তিতে রাখে, স্বস্তিতে রাখে, ওটা আমাদের কেনার সুযোগ থাকলে তো আমরা কিনে ফেলতাম, তাই না? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কিনে ফেলতাম। মানুষ টাকা দিয়ে সুখের অনুষঙ্গ কিনে নেয়। দাম বেশি হলেও কিনে ফেলে, প্রয়োজনে ধার করে হলেও কিনে। তো এই জিনিসটা যদি আমি কোনও কাজ করে পাই, তাহলে সেটা কিন্তু বেশ ভালো খবর। আমার ধারণা, যা-কিছু আমাদের ভালো রাখে, তা-কিছুর নিশ্চয়ই একটা আর্থিক মূল্য আছে। প্রায়ই দেখা যায়, আমাদের অনুমানের চাইতে অনেক অনেক বেশি তার মূল্য। কীরকম? নদীর পাড়ে কিছু সময় হাঁটলে বা বসলে যে সুখটা আসে মনের মধ্যে, তা কোনও বস্তুগত কিছু থেকে নিতে চাইলে অনেক অর্থ খরচ করতে হতো, এমনকি খরচ করলেও আদৌ কোনও কাজ হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তাই বলা চলে, ওই সাদামাটা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাওয়ার দাম অনেক অনেক বেশি।
আর-একটা কথা বলি, উনি একবার আমার জন্মদিনে উইশ করার জন্য আমাকে ফোন করেন, ওঁর সাথে পরিচয় হওয়ার পর প্রায় ৩ বছর পর। তো ফোন করার পর, উনি এতটা দ্রুত ইংরেজিতে কথা বলছিলেন যে, আমি রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আমি তো ইংরেজিতে অতটা ভালো কথা বলতে পারি না। আমি ওঁর সাথে কথায় কুলোতে পারতাম না। তখন আমি বললাম, ‘দিদি, আমি ইংরেজিতে ভালো কথা বলতে পারি না। তুমি আমাকে কী যে ভাবছ, আমি জানি না!’ তখন উনি আমাকে বললেন, ‘লিটল ব্রাদার! তুমি ইংরেজিতে যতটা ভালো লিখতে পারো, তুমি ইংরেজিতে যতোটা ভালো ভাবতে পারো, আমি যদি তার ১০%-ও পারতাম, তাহলে এই জীবনে আর কিছু চাইতাম না।’ তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার যে লিমিটেশনটা, এই লিমিটেশনের চাইতে অনেক বড়ো এমন একটা শক্তি আমার কাছে আছে, যেটা মনে আনলে লিমিটেশনটা আমি সহজেই ইগনোর করতে পারি। আহা, কী ম্যাজিক! নিজের দুর্বলতাকে শক্তি হিসেবে মেনে নেওয়ার ম্যাজিক!
এখন আসল কথায় আসি। ওঁর জায়গায় অন্য কেউ হলে আমাকে অমন করে বলতেন কি আদৌ? অন্তত নিজের ইগোকে টিকিয়ে রাখতে হলেও তো কখনও এটা বলতেন না। অন্যকে এমন করে উঁচুতে রাখতে হলে নিজেকে আগে অনেক অনেক উঁচুতে উঠতে হয়। ওরকম একটা বড়ো মন লাগে। উনি যে কাজটা করেছেন, সে কাজটা করতে হলে আগে একজন গায়ত্রীদিদি হতে হয়। সবাই এতটা মহত্ত্ব ধারণ করতে পারে না, বহুআগেই উগরে দেয়। এ কথাটা ওঁর মুখ থেকে শোনার কারণেই কিন্তু আমার মানসিক শক্তিটা তৈরি হয়েছে মাথায়। উনি নিজেও তা জানতেন, এবং জানতেন বলেই আমাকে বড়ো করে দেখিয়েছেন, তা-ও আমার জন্মদিনে। এমন যথার্থ গুরু আর কে হতে পারতেন আমার জীবনে? এই চমৎকার পদ্ধতিটি জানা আছে কয়জন শিক্ষকের? উনি আমাকে না বললে হয়তো আমার নিজেরই সেরকম করে কিছুই মনে হতো না। আর মনে না হলে আমি নিজেকে সেরকম কোনও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটি হয়তো করতামই না। এই জন্যই এই মানুষটা আমার কাছে ঈশ্বরের মতো।
উনি আমাকে কখনওই লো ফিল করাননি। ভুলেও নয়, ভুলেও নয়! উলটো এমন হয়েছে বহুবার যে আমি ওঁকেই কখনও কখনও অতটা মূল্যায়ন করে কথা বলিনি। হ্যাঁ, সহজ করে বললে, ওঁকে অনেক সময়ই পাত্তা দিইনি, অবমূল্যায়ন করেছি। ওঁর অনেক টেক্সট না দেখেই রেখে দিতাম, ওঁর মেইলগুলি চেক না করেই ফেলে রাখতাম। উনি তা-ও দমে যেতেন না, আমাকে দূরে ঠেলে দিতেন না একমুহূর্তের জন্যও! আসলে বড়ো কাউকে একেবারে নিজের করে পেয়ে গেলে ছোটলোকদের যা হয় আরকি!---আমারও তা-ই হয়েছিল! মনে হয়েছিল, এই মানুষটা তো আমার জীবনে ফর-গ্রান্টেড হয়েই গেছেন, এতটা দাম কিংবা সময় আর দিতে হবে না। দিদি কি তা বুঝতে পারতেন না? ঠিকই পারতেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, উনি যে তা বুঝে ফেলতেন, এটাই আমাকে কখনও উনি বুঝতে দেননি। আসলে ওঁর দাম, ওঁর অবস্থান এতটাই উঁচুতে ছিল, যতটা উঁচুতে আমার ভাবনা পৌঁছাতে পর্যন্ত পারত না! কেউ যখন নিজের অবস্থান ও দাম সম্পর্কে ভালো করেই জানতে পারে, তখন কে তাকে দাম দিল কে দিল না, ওটা দিয়ে তার কিছুই এসে যায় না। স্বয়ং আইনস্টাইনকে যদি কোনও ছোটলোক একেবারেই বন্ধুর মতো কাছে পেয়ে যেত, তবে সে-ও একসময় আইনস্টাইনকে কখনও কখনও মূল্যায়ন করতে ভুলে যেত। ওতে একজন আইনস্টাইনের কী এসে যায়? তিনি তো জানেনই তিনি কী! তার উপর আমি তো ছিলাম দিদির ছোট ভাই। তাই আমার জন্য তার ক্ষমা ছিল অসীম! উনি আমাকে ভালোবাসতেন, তাই আমার ভুলগুলিকে দেখে হয়তো মনে মনে হেসে বলতেন, আমার আদরের বোকা ভাইটা!
দিদিকে দেখে শিখেছি, যে মানুষটা আপনাকে লো ফিল করাবেন, সে মানুষটা কিন্তু আপনার জন্য ভাইরাসের মতো, তাঁর কাছ থেকে যে-কোনও মূল্যে দূরে থাকতে হবে। আর যে মানুষটা আপনাকে লো ফিল করাবেন না, উলটো তাঁর সাথে থাকলে বা তাঁর সাথে মিশলে নিজের মনের শক্তি বৃদ্ধি পায়, তবে তিনি যদি অশিক্ষিত মূর্খও হন, তা-ও তাঁর সাথেই মিশুন। তাঁর সাথে মিশলে হবে কী, দিনের শেষে আপনি নিজে ভালো থাকবেন। দিনশেষে তো আসলে আপনার ভালোটা আপনাকেই থাকতে হবে। কেউ একজন অক্সফোর্ডের পণ্ডিত, হার্ভাডের পণ্ডিত, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, কিংবা আরও বড়ো কিছু, খুবই ভালো কথা…তাতে তো আপনার কিছুই এসে যায় না আসলে। তার সাথে মেশা বা না মেশায় আপনার কী হয়? কারও একশো কোটি টাকা থাকতে পারে, কিন্তু তার টাকা তো তার ঘরে, ওতে আপনার কী? যার সাথে থাকলে আপনি বিকশিত হতে পারেন না, সে যে-ই হোক না কেন, সে আপনার জন্য সঠিক মানুষটি নয়।
গায়ত্রীদিদির সাথে তো আমার কখনও দেখা হয়নি, দেখা হওয়ার সুযোগও তেমন একটা নেই। উনি আমেরিকায় থাকেন। আমার আমেরিকায় যাওয়া আদৌ হয় কি না, আমি জানি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও উনি আমাকে আমার ভেতরের মানুষটাকে চিনতে সাহায্য করেছেন দিনের পর দিন। আমার কাছ থেকে ওঁর পাওয়ার কিছুই নেই! কারও কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই জেনেও যে মানুষটা তার পাশে দাঁড়ান, তিনিই প্রকৃত মহৎ। যখন আমার পৃথিবীতে কথাবলার মতো কেউ ছিল না, তখনও উনি পাশে ছিলেন। এমনও সময় গেছে, উনি আমার সাথে কিছু একটা আলাপ করতে করতে সারারাত জেগে ছিলেন, পরের দিন উনি সকালে কোনও একটা জরুরি কাজে গিয়েছেন। কিন্তু রাত পুরোটাই জেগে ছিলেন আমার সাথে কথা বলার জন্য। যদি বলতাম, দিদি, ঘুমাতে যাচ্ছেন না কেন? কালকে তো আপনাকে সকালে বের হতে হবে। তখন উনি বলতেন, যে মুহূর্তে তোমার সাথে গল্প করছি, মানে এখন, এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই যে আমি সমৃদ্ধ হচ্ছি, হৃদয়ে আনন্দের চাষ করছি, এটি তো অমূল্য! সকালে বাঁচলে তখন দেখা যাবে, কী হয়! অবশ্য, তোমার ঘুম পেলে বা অন্য কাজ থাকলে তুমি গুডবাই বলতে পারো, কোনও ব্যাপার না!
আর-একটা রহস্যময় ব্যাপার বলি। উনি কোনও না কোনওভাবে টের পেয়ে যেতেন, আমি কষ্টে আছি কিংবা আমার মন খারাপ, এবং উনি এটা সত্যি সত্যি অনুভব করতে পারতেন। কীভাবে এটা হতো, আমি জানি না, তবে উনি তা করতে পারতেন। আমরা অনেক সময় বলি, আমি তোমার কষ্টটা সত্যিই অনুভব করতে পারছি। এটা একটা মিথ্যে-দাবি। কেউ কারও কষ্ট সত্যিকার অর্থে অনুভব করতে পারে না, বড়োজোর বুঝতে পারে যে, অমুক লোকটি কষ্ট পাচ্ছে, সেটা ভেবে নিজেও একটু দুঃখ পেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা কারও জন্য যা অনুভব করতে পারি, তা হচ্ছে সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি। এটা সবাই পারে। কিন্তু যে কষ্টটা পাচ্ছে, সে আসলেই কেমন অনুভব করছে, তা তার জায়গায় থেকে অনুভব করা, এর নাম হচ্ছে এমপ্যাথি, যা অনুভব করতে সবাই পারে না। সিমপ্যাথি এবং এমপ্যাথি, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? এটা খুবই মজার একটা জিনিস। ধরা যাক, একটা কুকুরের পা ভেঙে গেছে। ও তিন পা দিয়ে হাঁটছে। আপনার সেই কুকুরের প্রতি একটা সহানুভূতি তৈরি হলো। অর্থাৎ, ও যে কষ্ট পাচ্ছে, এই ব্যাপারটি আপনার মনে একধরনের কষ্ট দিচ্ছে। আহা, বেচারার পা-টা ভেঙে গেল! এটা হচ্ছে সিমপ্যাথি। আর এমপ্যাথি হচ্ছে, ওর পা-টা ভাঙার কারণে যে কষ্টটা ওর হচ্ছে, আপনি যদি কল্পনা করেন, আপনার একটা পা নেই, সেই পা-টা ভেঙে গেছে, আপনি বাকি এক পা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, তখন আপনি ওর যে তীব্র যন্ত্রণা, তীব্র বেদনা, এটা আরও বেশি অনুভব করতে পারবেন। এটাকে বলা হয় এমপ্যাথি। এটা করতে সবাই পারে না। সুতীব্র সংবেদনশীল মনের অধিকারী হতে হয় এটা করতে গেলে।
তো গায়ত্রী তালরেজা, উনি আমার প্রতি সিমপ্যাথি অনুভব করতেন না, উনি সরাসরি এমপ্যাথিই অনুভব করতেন। আমি এটার প্রমাণ পেয়েছি অনেক অনেকবার। কীরকম? আমি ওঁকে নক করলাম, দুই-এক লাইন বলার পর উনি জিজ্ঞেস করছেন, মানে ইংরেজিতেই…উনি তো আর বাংলা জানতেন না,…‘তুমি কি ডাউন ফিল করছ কোনও কারণে?’ আমি বললাম, ‘না তো!’ তখন উনি বলতেন, ‘একদমই মিথ্যা বলবে না আমাকে! সত্যি করে বলো!’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দিদি।’ তখন উনি হুট করেই বলতেন, ‘মানুষের প্রত্যেকটা কথা ধরার কোনও দরকার আছে? ওদের প্রতিটি কথা ধরে মন খারাপ করে রাখার কী মানে?’ সত্যি বলছি, শুনে ভয়ে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত! উনি কীভাবে জানলেন যে, আমি কারও কথায় কষ্ট পেয়েছি! তখন আমাকে দুনিয়ার সবাই মিলে আমাকে নানান কথা শোনাত, কেননা আমাকে কথা শুনিয়ে যাওয়া ছিল খুব সোজা। প্রথমত, আমি কোনও প্রতিবাদ করতাম না। দ্বিতীয়ত, আমি এমন একটা অবস্থানে ছিলাম, যে অবস্থানের কাউকে কথা শুনিয়ে দেওয়াটাকেই সবাই তাদের অধিকার বানিয়ে ফেলেছিল। লোকে অন্যকে কথা শোনাতে স্বর্গসুখ পায়। সবই ঠিক আছে। কিন্তু উনি জানলেন কী করে? আমি বলতাম, ‘দিদি, তুমি কীভাবে জানো?’ উনি বলতেন, ‘আমি কীভাবে জানি, তা ঠিক বলতে পারব না। আমার জানায় ভুলও হতে পারে, তবে আমার মনে হলো যে তুমি কারও কোনও কথা মাথায় ও মনে পুষে রেখে খুব কষ্ট পাচ্ছ। ব্যাপারটা কি ঠিক?’ আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ, দিদি। আমি সত্যিই অনেক কষ্ট পাচ্ছি।’
(চলবে…)