যদি শেষপর্যন্ত কিছু চাইবার থাকে জীবন থেকে, তা হলো, বেঁচেথাকা। মানে, আরও কিছু দিন বেঁচেথাকা। ওই ‘আরও কিছু দিন’ ব্যাপারটা আসলে কত দিন, বা ঠিক কত দিন, তা বুঝতে বুঝতেই মৃত্যু এসে যাবে। আগেও এসেছে। যত বারই এ জীবনে ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে উঠেছি, তত বারই মনে হয়েছে, নিজেকে আমি আজও ভয় পাই। এই যে ভেতর থেকে একধরনের বাধ্যতা, যা আমায় বলে, বেঁচে থাকো, তোমায় আরও কিছু দিন বাঁচতে হবে, তা সত্যিই ভাবায়। আবারও, সেই আরও কিছু দিন! এই ট্র্যাপ থেকে বেরোতে আজও পারিনি। পারিনি বলেই জীবন সুন্দর। আপাতত এভাবেই ভাবছি। জীবন শেষ হতে চলল। মূলত এই অনুভূতিটাই মানুষকে বলে দেয়, এবার তা হলে বাঁচতে শুরু করা যাক। অনেক দিন হলো, নিঃশ্বাস নিচ্ছ। এবার একটু বাঁচো। …এইসব বলে। মানুষ এর পর বাঁচতে শুরু করে। তাই, জীবন ফুরিয়ে যাবার অনুভূতিটা আজও প্রাসঙ্গিক। আমাদের যা মনে পড়ে না, এবং আমরা যা মনে করতে চাই না, এই দুইয়ের মধ্যখানের যে বয়সটা, তার নামই হচ্ছে পরিপক্বতা। এর আগে ও পরে মানুষ একলা বাঁচে। কিছু মানুষের মদ্যপান ও প্রার্থনা একসাথেই চলতে থাকে। কিছু মানুষের মদ্যপান চলতে শুরু করলে প্রার্থনা থেমে যায়। কিছু মানুষের প্রার্থনা চলতে শুরু করল বলেই মদ্যপান শুরু হয়। বাকিদের কথা জানি না। ওদের সাথে আমার এখনও পরিচয় হয়নি। এদের ভিড়ে আমি কোথায় আছি, বা আদৌ আছি কি না, তা-ও জানি না। জানতে পারলে অন্তত বাকি জীবনটাতে সন্ত হয়ে বাঁচার একটা সুযোগ থাকত। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করলে দুটো হাত দেখি, আমার মায়ের। ক্লান্তিহীনতায় চোখ খুললে দুটো চোখ দেখি, আমার প্রেমিকার। দুটোই বিষণ্ণ করে দেয়, কেননা দুটোই ক্ষণস্থায়ী। দিন ফুরোলে নিজের চোখের সামনে কেবলই নিজের হাত থেকে যায়। আসলে, আমি একধরনের অসুখের মধ্যে বাস করছি। সে অসুখ সারানোর কোনও ওষুধ নেই, সে অসুখ কেবল বাড়ানোর ডাক্তার আছে। আমি অসুখটা বাড়াচ্ছি। ডাক্তারদের সাথে আমার বন্ধুত্ব বাড়ছে। এর বাইরে আর কোনও পথ আমি চিনি না। আজও বাঁচতে হচ্ছে। আমি ঘরে ফেরার পথে কিছু চোখ তাকিয়ে থাকে। ওদের চিনি। ওরা একসময় ঘরে ফিরতে চাইত। বড়ো হয়ে যাবার পর আর চায় না। আমিও বড়ো হচ্ছি। ভুলঘরে ফিরতে শিখছি ক্রমশই। এখন সব কিছু বিস্বাদ লাগে। ঘরে ফিরতেও। এর নামই বড়ো-হওয়া বোধ হয়। আমায় কেউ চেনে না। তাই জীবনও আমায় চিনতে পারছে না। আমায় সবাই চেনে। তাই জীবন আমায় আর চিনতে পারছে না। দুটোই সত্য। একটা সত্য ছোটোবেলার, আর একটা বড়োবেলার। ইদানীং বাঁচতে আর ভালো লাগে না, তবে বাঁচলে আজও ভালো লাগে। একই মানুষ, কখনও বড়ো, কখনও ছোটো। বয়স বুঝতে জন্মতারিখ খুঁজতে আর যেয়ো না। আমার সামনের বেড়ালটা চুক চুক করে দুধ খাচ্ছে, কিংবা আমি একটা টোস্টবিস্কিট ভিজিয়ে কড়া দুধ-চা খাচ্ছি, এই দুই নিয়ে আগে কখনও ভেবেছি বলে মনে পড়ছে না। এখন ভাবছি, আর মনে হচ্ছে, সুযোগ পেলে সব শালাই জিনিয়াস হতে পারত! আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাইনি। নিজের মতো করে বাঁচতে হয়, বাবা-কাকা’রা এটা কখনও শেখায়নি। যার করার কিছু নেই, সে-ই বাঁচে নিজের মতো করে। এটাই শিখেছি। এখন মনে হয়, এইসব ভাবনাই আমাদের সকল অসুস্থতার উৎস। একধরনের অসহ্য মৃত্যুবোধই আমাকে আজীবন জ্যান্ত করে রেখে ছেড়ে দিল। আজ বুঝতে পারি, কিছু ঘুম আমারও দরকার ছিল।