নিরালায় তর্জনী হেলিয়ে

এবং, আরও একবার আমি জেনেছি, আপনিও,
মূলত, একটি অস্থির ছায়া অনুসরণ করেই হাঁটেন।
ছোট্ট কাঠের ঘরটির হিমশীতল দরোজাটি খোলা দেখে মনে হলো,
ওটা খালি হবে এর মধ্যেই। আসুন, ঘরটা আমরা ভাড়া নিই।
এরপর থেকে আমি শংকিত হলেই কুঁচকে যেতাম। কুয়াশা যে ঝাঁকুনিটা দিত, সেটি
এবং গোধূলিহাওয়ার ঝকঝকে শব্দগুলি
আমার কানের কাছে নিয়ম করে চিৎকার করত।




আমি সেই ঘরে এক লোকের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম,
নিজেকে বোঝাতে যাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে মৃত্যু পর্যন্ত।
ছবির নিচে বাতি জ্বালিয়ে রাখতাম, যার শিখা
কখনওই নিভে যেত না কিংবা আমার পাপগুলিকে স্পর্শ করত না।
...সেই আলতোআঁচে দরোজার চৌকাঠে চুপচাপ বসে গুনতাম, আর কয়দিন বাকি!




চোখ মেলে দেখলাম, সবাই চলে গেছে,
আমি মেঝেতে একা পড়ে আছি। আমার শুধুই দেরি হয়ে যায়!
আমার একাকিত্ব সৈকত থেকে সমুদ্রের শেষ অবধি প্রসারিত।
জানালার ধারে বসে কিংবা দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্ত বের করে,
যেমন করেই কাঁদি না কেন, আমার কান্নার শব্দ কেউ কখনও শুনতে পায় না।




আমি ঠোঁটের নয়, বোধের কিছু পবিত্রতা
গভীরভাবে নিই। জোরে বর্ষা নামলে
রাস্তা যখন ডুবে যায়, তখনও, এমন-কী
রোদ্দুর এসে যখন শহরে আগুন ধরিয়ে দেয়, এমন সময়ও
ধর্মচর্চা আমি কোনও কিতাব পড়ে কিংবা 
ধর্মীয় মহাত্মার কাছ থেকে শিখিনি। মূলত, ধর্ম,
নিজের সাথে অনর্গল কথোপকথনের রাস্তায় না হেঁটে,
বাইরের কারুর কাছ থেকেই জানা যায় না।
যজ্ঞের অরণি না পুড়িয়ে হৃদয়কে পোড়াতে জানলেই বরং ঈশ্বরদর্শন সহজ হতো!




সামনের স্নিগ্ধ অরণ্যটির পেছনে আমি সম্ভবত একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর দেখতে পাচ্ছি,
যেখানে চাইলেই আমি সাদাকাঠের বেদী তৈরি করতে পারি। ঈশ্বর আমাকে ভালোবাসে বলেই 
আমার গালের দুইদিকে প্রতিদিনই আরও সৌন্দর্য ও দুঃখ জমা হতে থাকে,
এবং তীক্ষ্ণ সংগীতের সাহচর্যে ওরা প্রায়ই রংধনুতে পৌঁছয়।
দেখলাম, আলোর তির্যক ছায়াগুলি বরফের উপর আছড়ে পড়ছে।
বলতে ইচ্ছে করল, যার কপাল পুড়ে গেছে, তার ফেরার পথটিও ভেঙে দিয়ো না।




এখানে আমি কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটি অবিশ্বাস্য পদযাত্রায় অংশ নেবো।
ভয় পেয়ো না, আমি যদি আমার প্রিয় মানুষের কাছে থেকে 
মরুপ্রান্তরেও মরে যাই, তবু আমার কোনও আপত্তি থাকবে না।
আমি এতদূর এসেও অবাস্তবকেই তাড়া করে যাচ্ছি;
অতএব, শিসের আওয়াজ, ঘুরে-বেড়ানো শকুনের ডাক, বর্ষার ঝলকানি,
তারা সবাই আমাকে খুঁজে বের করে। ওদের সাথে রেখে 
বেদীর সামনে নতজানু হয়ে থাকাটা আমাকে ঠিক মানায় না।




কখনও কখনও একটি রহস্যময় হাত এসে
ক্যামেরার শেষ স্ন্যাপটি থেকে কুঁড়িগুলির ছন্দবদ্ধ গুচ্ছ
আর বিবেকের খুঁটিগুলির একটি বাতিল অকেজো বান্ডিল,
খননগহ্বরের মধ্যে বাতাস চলাচলের রাস্তায়, খুব সন্তর্পণে, 
স্তম্ভিত আত্মাসমূহের পরিশুদ্ধির আশায়, রেখে দেয়।
তখন পদ্মফুলের সাদা বিছানায় মৃত রাজকন্যা শুয়ে থাকে,
এবং বসন্তের বাতাসে তার চুলের ঢেউ খেলা করে।




হয়তো সত্যিই, দুঃখ রাজকন্যার একটি চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম---বুঝিইবা কবে?
রোদে যখন শিশির জ্বলে, তখন এর নাম হয় রংধনু---জ্বলেইবা কবে?




আমাদের বাড়ির সামনের পুরনো বাবলাগাছটি থেকে
মেরুর নক্ষত্র পর্যন্ত, সেখান থেকে চাঁদ পর্যন্ত, আমি
এই দীর্ঘশ্বাসের জাল বিস্তৃত হতে দেখেছি।
ভোরের রুপোলি শিশির উপেক্ষা করে 
সেই জালের মাঝপথে হেঁটে হেঁটে আমি মাকড়সার ধূসর উপহাস
প্রত্যক্ষ করেছি এবং বুঝেছি, বিপথগামী প্রাণীদের ভোজের জন্য আমি তৈরি।




আমার ঘরের দেয়ালে সূর্য জ্বলছে, 
মন বিশ্বস্ত নদীটির তীরে ছুটে চলছে,
আগামীকাল থেকে সুগন্ধিমাখা ক্যুরিয়ারগুলি আসবে,
ফলে, বসন্তের সুরগুলি এক এক করে ভেঙে যাবে,
মাতাল মৃত্যু এসে জোরে শিস দেবে,
ঢেউ অবিরাম দুলে দ্বিধায়িত দ্বীপের চারপাশে ঝাঁকুনি তৈরি করবে,
অদ্ভুতভাবে, বাতাসের আগুনে ধুলোর চাদর পুড়বে,
শাখাগুলিতে শটগানের গুলির মতো ক্ষিপ্র কুঁড়ির দল ফুটবে,
ছদ্মবেশী লোকেরা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে ছুটে আসবে...




ঠিক তখনি, কুয়াশার ঠোঁট চুষে অভিভূত হতে গিয়ে দেখতে পেলাম,
আমাকে অদৃশ্য রেখে, তিনি,
তাঁর প্রসারিত, অনমনীয় ডানবাহুর উপর শান্তভাবে বসে আছেন, এবং
নৈঃশব্দ্যে আর নিঃসঙ্গতায় নিবেদিত পাখির চিরন্তন নীড়ে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য প্রতীক্ষা করছেন।

Content Protection by DMCA.com