(এই লেখাটি আমার এবং আমার বাবার ব্যক্তিগত স্মৃতি ও দর্শন সমৃদ্ধ। এ লেখায় প্রচুর আত্মস্তুতিও রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই, লেখাটি পড়ে অনেকেরই মনে বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে। আমি বিনীত ভাবে অনুরোধ করছি যাতে অনাগ্রহীরা এ বড় লেখাটি পুরোপুরি এড়িয়ে যান। ধন্যবাদ।)
আমরা, খুব সম্ভবত, আমাদের বাবাদের কখনওই ছাড়িয়ে যেতে পারব না।
আমার ছোট কাকু আর্মিতে চাকরি করতেন। একদিন কাকুর কিছু কলিগ খুঁজতে-খুঁজতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে আমাদের বাড়ির সামনের উঠোনে এক মাঝবয়সি লোককে দেখলেন। উনি ফুলের গাছ লাগানোর জন্য কাস্তে দিয়ে মাটি সরাচ্ছিলেন। সে সময় আমাদের বাড়িতে ১২ জন মালী, চাকরবাকর কাজ করত। ওরা ভেবেছিল, ওই লোকটি আমাদের বাড়ির ভৃত্যস্থানীয় কেউ। একটু তাচ্ছিল্য করেই উনাকে ওরা জিজ্ঞেস করলেন, “শচীন্দ্র মোহন পালের বাড়ি কোনটা?” লোকটি উত্তরে বললেন, “এটাই। আপনারা কাকে খুঁজছেন?” “আমরা উনার ছেলে স্বপনের বন্ধু। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।” আমাদের বৈঠকখানাটা ছিল মূল বাড়ির বাইরের দিকে। লোকটি খুব আন্তরিকভাবে ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে ওখানে বসালেন, একজনকে ডেকে হাতমুখ ধোয়ার জল আর জলখাবার দিতে বলে আবার নিজের কাজে চলে গেলেন। একটু পর আমার ছোট কাকু বৈঠকখানায় এসে ওদের সাথে গল্প করতে শুরু করলেন। এর ঘণ্টাখানেক পর বৈঠকখানার পাশ দিয়ে ওই লোকটি হেঁটে যাচ্ছিলেন। “আচ্ছা, এদিকে আস, তোমাদের আমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।” ওরা ঠাকুরদাকে দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়ে বললেন, “আঙ্কেল, সরি, আমরা আপনাকে তখন চিনতে পারিনি।” “না না, কী যে বলেন! আপনারা ব্যস্ত হবেন না, বিশ্রাম নিন। স্বপন, ওদের সব ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখা। জলখাবার দিয়ে গিয়েছিল তো? পুকুরে জাল দেওয়ালাম; ওদের জন্য রান্না হচ্ছে। তোরা স্নানটান করে নিস।” ঠাকুরদাকে দেখেছি, মৃত্যুর আগেও নিজের কাজগুলি নিজের হাতে করে গেছেন। মানুষকে খুব বেশি সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন আজীবন। অপরিচিত মানুষ বয়সে কিংবা মানে যতো ছোটোই হোক, সবসময়ই ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলতেন। বাবা আইনজীবী। ঠাকুরদা যখন আমাদের বাসায় ছিলেন, তখন আমি ছোটবেলায় দেখেছি, বাবার ক্লায়েন্ট এলে, যদি উনি দরোজা খুলে দিতেন, “আপনারা বসুন, আমি উকিলবাবুকে ডেকে দিচ্ছি। উনি একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন।” হাসিমুখে এই বলে ভেতরের রুমে চলে যেতেন। অপরিচিতা মহিলাদেরকে ‘মাতাজী’ বলে সম্বোধন করতেন, বিনীতভাবে নিচুস্বরে কথা বলতেন। ছোট-ছোট শিশুদেরকে অনেক আদর করতেন, কিছু না কিছু উপহার দিতেন।
ঠাকুরদার গুণগুলির অনেকটুকুই বাবা-কাকারা পেয়েছেন। বাবাকেও কখনওই অন্য কাউকে দিয়ে নিজের কাজ করাতে দেখিনি। এখন তো অসুস্থ হয়ে গেছেন, শরীরে আগের মতন পারেন না, তবুও নিজের কাজ নিজেই করেন, কোনও কিছু প্রয়োজন হলেও কাউকে তেমন ডাকেন না। আর অন্যকে সম্মান দেয়ার আর্টটা যদি বাবার কাছ থেকে কণামাত্রও শিখতে পারতাম, তাহলে তো আর কথাই ছিল না। আমি ভেবে দেখেছি, আমার মনের মধ্যে বেশ কিছু অহেতুক অহংকার খুব শক্তভাবে গেঁথে গেছে। যখন পিএইচডি করব, তখন বাবার চাইতে হয়তো অ্যাকাডেমিক শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যেতে পারব, কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে।
গতকালকের একটা ঘটনা শেয়ার করছি। স্বর্ণের চোরাচালান মামলায় বাদীপক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দিতে আমাকে কোর্টে যেতে হয়েছিল। চট্টগ্রামের জজ কোর্টের পাশেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আমার খুব কাছের ছোটভাই অভিজিত (ওকে আমি ‘তুই’ করে বলি এবং যেকোনও ব্যাপারে পরামর্শের জন্য কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ও আমাকে প্রায়ই ফোন করে।) ওখানেই কাজ করে। ও ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় ৫ম এবং বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ১ম হয়েছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, পড়াশোনা করেছে রুয়েটে। যা-ই হোক, ওর সাথে লাঞ্চব্রেকের সময় দেখা করলাম। ওর রুমে গল্পটল্প শেষে ও সহ বের হয়ে এলাম। আইনজীবী মিলনায়তন কক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাবার সাথে দেখা করতে ওখানে ঢুকলাম। “বাবা, ও অভিজিত, ম্যাজিস্ট্রেট; ডিসি অফিসেই কাজ করে। আমাদের বাসায় গিয়েছিল। তোমার মনে আছে?” বাবা ইদানীং খুব চট করে খেয়াল করতে পারেন না। আমি বলার পর ওর দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “কেমন আছেন আপনি? বসুন বসুন! এখানে বসুন! (অথচ ওখানে বসার মত কোন চেয়ার খালি ছিল না। বাবা যে চেয়ারটিতে বসেছিলেন, সেটাতেই অভিজিতকে বসতে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।)” “না না আঙ্কেল, আমি বসব না। আমি একটা কাজে এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। দাদার সাথে জাস্ট একটু ভেতরে এলাম।” “না না বাবা, সেটা কী করে হয়? আপনি একটু বসুন, আমি চা আনতে বলছি, বেশিক্ষণ লাগবে না। কিছু খেয়ে যান।” “আরেক দিন আসব আঙ্কেল, আজকে না। আজকে আসি।” বাবা আবারও ওর সাথে হ্যান্ডশেক করে ওকে এগিয়ে দিলেন। আমি কোনও কথা না বলে পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলাম, এমন বাবার সন্তান হওয়ায় গর্বে আর আনন্দে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ঈশ্বরকে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম এইজন্য যে, বাবা আমার চাইতে অনেক অনেক অনেক বড়। বাবার মতন সহজ হওয়া সত্যিই সহজ নয়।
কিছু-কিছু ব্যাপারে পরম্পরা কাজ করে। তাই বুঝি লোকে এখনও বিয়ের সময় বংশের খোঁজখবর নেয়। বাবার ঠাকুরদার নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র পাল। উনার পূর্বপুরুষরা বনেদি ব্যবসায়ী ছিলেন, কোলকাতায় থাকতেন। উনিই আমাদের গ্রামের বাড়ির গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাই আমাদের বাড়িটাকে সবাই চেনেন ‘পূর্ণচন্দ্র পালের বাড়ি’ নামে। উনি ছিলেন মূলত ভূস্বামী। ওইসময়ে উনার চাইতে বেশি জায়গাজমি আশেপাশের গ্রামে কারোরই ছিল না। পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, প্রচুর পড়াশোনা করতেন, দুহাতে দান করতেন, খুবই অভিজাত জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ, আর বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিলেন। সম্ভবত বাবার ঠাকুরমাও ছিলেন খুব সুন্দরী। কেন বলছি একথা? বাবার বিয়ের অনেক আগেই বাবার ঠাকুরদা মারা যান, আর ঠাকুরমা মারা যান বিয়ের ৫ মাস পরেই। মা, বাবার ঠাকুরমাকে দেখেছিলেন। আজকে খাওয়ার টেবিলে কথাপ্রসঙ্গে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মা, উনি দেখতে কেমন ছিলেন?” “অনেক সুন্দরী!” “তোমার চাইতেও সুন্দরী?” “আরে কী যে বলিস! আমি উনার ধারেকাছেও সুন্দর না।” কোনও মেয়ে যখন আন্তরিকভাবে নিজমুখে অন্যকোনও মেয়েকে ওর চাইতেও সুন্দরী বলে, তখন নিশ্চিতভাবেই বুঝতে হবে, ওই মেয়ে আসলেই ওর চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী। মেয়েরা আরেকটা মেয়েকে সুন্দরী বলার ক্ষেত্রে খুব একটা উদার হয় না; সে মা-ই হোক, আর খুকিই হোক। তাঁর ঠাকুরমার ইচ্ছেপূরণের জন্যই বাবা তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানি লিভার ব্রাদার্সের (বর্তমানে ইউনিলিভার) অনেক টাকা বেতনের চাকরি না করে আইনজীবী হয়েছিলেন। বাবা সে চাকরির পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। আমার ঠাকুরদার উচ্চতা ছিল ছ’ফুটের বেশি। শারীরিক গঠন যেকোনও হালের জিমম্যানের চাইতে বহুগুণে ভাল। প্রচুর খাওয়াদাওয়া আর পরিশ্রম করতেন। উনাকে ৮৫ বছর বয়সেও দেখেছি, মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটতে, ৫০ কেজি ওজনের চালের বস্তা অবলীলায় এক রুম থেকে অন্য রুমে নিয়ে রাখতে। উনি মারা যান ৯২ বছর বয়সে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অফিস করেছেন। উনি পেশায় ছিলেন আইনজীবী সহকারী, চট্টগ্রাম জজ কোর্টে কাজ করতেন। উনি উনার বাবার মতই উদার ছিলেন, দান করতেন, দুহাতে খরচ করতেন, আমাদের গ্রামের সবচাইতে সম্ভ্রান্ত ভূস্বামীদের অন্যতম ছিলেন। শিক্ষানুরাগী ছিলেন, পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন, নিজের সেজভাইকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন কলকাতার সবচাইতে নামকরা প্রেসিডেন্সি কলেজে। আমার ঠাকুরদা এবং উনার ভাইদের দেহসৌষ্ঠব আর অবয়ব দেখলে মনে হয়, আমরা খুব সম্ভবত আর্যবংশীয়। বাবা-কাকাদের বেলায়ও তা-ই, সবাই-ই ছ’ফুটের আশেপাশেই। (মামাদের কথা আজকে লিখছি না, মনে থাকলে আরেকদিন লিখব।)
আমি আর আমার ছোটভাই, অনেকটা বাবার মতই। তবে যতটা বাবার মত হতে পারিনি, সেটার ভাগই বেশি। ঈশ্বরের কাজগুলি বোঝার ক্ষমতা তো আর আমার নেই, তবে এইটুকু বলতে পারি, বাবারা আমাদের চাইতে অনেক অনেক বড় বলেই হয়তো বাবাদের সাথে নিয়ে বাবাদের সামনে মাথা নত করে বেঁচে থাকাটা এতটা আনন্দের। বাবাদের অবশ্যই বড় হতে হয়, এটাই বোধ হয় চিরন্তন নিয়ম।
বাবা, তোমায় ধন্যবাদ!
………………………………………
আমি খুব সৌভাগ্যবান যে ছোটোবেলায় আমাদের বাসায় আইপিএস ছিল না। সন্ধ্যায় যখন কারেন্ট চলে যেত, তখন বাবা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসতেন। আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন কারেন্ট চলে যাবে। ছোট্টো আমি আর আমার ছোটো ভাই বাবার হাঁটুর ওপরে বসে-বসে বাবার মুখে শুনতাম, বিজলি বাতি চাঁদের আলোকে চুরি করে নিয়ে আমাদের ভুলিয়েভালিয়ে রেখেছে। বাবার কাছে তারা চিনতাম, চাঁদের আলো কীভাবে ছুঁয়ে দেখতে হয় শিখতাম, গাছের পাতায় চাঁদের আলো এসে পিছলেপিছলে গেলে সেটা কেমন লাগে, বাবা এইসব কথা বলতেন। কত ছড়া যে বাবা মুখে-মুখে কেটে দিতেন, সে সব ছড়া এখন আর মনেও পড়ে না। এমন একটাও ছুটির দিন ছিল না যেদিন বাবা মা’কে মাছ-তরকারি কুটা, ঘর ঝাড়মোছ করা, কাপড় ধোওয়া এইসব ঘরের কাজে হেল্প করতেন না। বাবা হয়তো সবচেয়ে দামি খাবারটা নিয়ে কোর্ট থেকে ঘরে ফিরতেন না, কিন্তু সবচেয়ে দামিভাবে আমরা খাবারটা খেয়েছি। বাবা বলতেন, তোর মা সারাদিন ঘর সামলে রাখে বলেই তো আমি বাইরে কাজ করতে পারি। বাবাকে কখনোই মা’র রান্নার সমালোচনা করতে দেখিনি। প্রকৃতপক্ষে, বাবা কখনওই কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন না। বাবার মধ্যে জাজমেন্টাল অ্যাটিটিউড নেই। আমরাও ছোটবেলা থেকে জাজ করা ব্যাপারটাকে ঘৃণা করতে শিখেছি। ভাল লাগলে গ্রহণ কর, ভাল না লাগলে এড়িয়ে চল। ব্যস্! অত ফালতু গবেষণা করছ কেন? তোমার কাজ নেই? এ বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা মতামত শেয়ার করছি। গতকাল (০৪-০৯-২০১৭) রাত সাড়ে ১০টায় এটিএন বাংলায় ড. মাহফুজুর রহমান, চেয়ারম্যান, এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ-এর একটি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। আমার আগেই মনে হয়েছিল, সে অনুষ্ঠানে এমন কিছু হবে না, যা দেখে আমার ভাল লাগবে। আমি অনুষ্ঠানটা দেখিনি আমার নিজের স্বার্থেই। যা আমার ভাল লাগবে না, তা আমি এড়িয়ে যাব। ভালটুকু গ্রহণ করব, খারাপটুকু বর্জন করব। সিম্পল! সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরপর সেটার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করার মতো সময় কিংবা রুচি, কোনওটাই আমার নেই। অনেককেই দেখেছি, ওই অনুষ্ঠান এবং গায়ককে নিয়ে খুবই আজেবাজে কথা লিখে নিজেকে হাল্কা করার লোভ সামলাতে পারেননি। সে দলে নির্বোধদের পাশাপাশি সুশীলসমাজের অনেক মেধাজীবী বাহকও রয়েছেন, যারা নিজেরা এতটা শ্রদ্ধেয় হওয়া সত্ত্বেও কোনও এক রহস্যময় অবচেতনার তাড়নে গায়ককে অশ্রদ্ধা করে, ব্যক্তিগত আক্রমণ করে শব্দবিষ্ঠা উৎপাদন করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে কিছু প্রশ্ন রাখছি—
এক। আপনাকে ওই সময়ে ওই অনুষ্ঠানটা দেখতে কেউ বাধ্য করেছিল কি? আইন জারি হয়েছিল ওই অনুষ্ঠান না দেখলে আপনার চাকরি চলে যাবে? ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে? পড়াশোনার ইতি টানতে হবে? আপনাকে ধরেবেঁধে জেলে পুরে দেয়া হবে? আপনার রুচিতে বাধল না এমন একটা ‘অতি জঘন্য সস্তা নিম্নমানের’ (আপনার বিবেচনায়) অনুষ্ঠানের পেছনে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে? নাকি আপনার অসুস্থ ঈর্ষাকাতর মন একজন ধনী সুপ্রতিষ্ঠিত আত্মপ্রত্যয়ী মানুষকে ছোট করার লোভ সামলাতে পারেনি, কারণ আপনার পক্ষে কখনওই উনার অবস্থানে যাওয়া সম্ভব নয়? উনি গেয়ে উনার শখ মিটিয়েছেন, আপনি শুনে আপনার শখ মিটিয়েছেন। ব্যস্, চুকে গেলো! এটা নিয়ে এত কথা উঠছে কেন? এ দুর্ভাগা দেশের ফেসবুকবাসী খুন-ধর্ষণ-লুটপাট সহ তামাম অন্যায়-অবিচার হাসিমুখে হজম করে ফেলতে পারে, আর অন্যকে হেয় করার লোভ হজম করতে পারে না। শালার ভণ্ড হুজুগে ফেসবুক-বাসিন্দাগণের সংবেদনশীলতার পরাকাষ্ঠা!
দুই। গায়ক গান গেয়েছেন নিজে আনন্দ পেতে আর শ্রোতাদের আনন্দ দিতে। আপনি নিজে উনার শ্রোতা হয়ে উনার ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দিয়েছেন। আমি বলব, হি ইজ অ্যা ড্যাম সাকসেসফুল আর্টিস্ট! এত-এত উচ্চশিক্ষিত শ্রোতা-শ্রুত গানের এমন সফল শিল্পী আপনি এ দেশে কয়জন পাবেন? আমি উনার জন্য শুভকামনা করছি। উনি আরও গাইবেন, আমরা শুনব। আমরা বারবার বিনোদিত হব আর যিনি বিনোদন দিচ্ছেন তার সম্পর্কে বাজে কথা বলব। অবশ্য, কিছু মানুষ আছেন, যারা বাজে কথা ছাড়া বলার মতো অন্য কোনও কথা খুঁজেই পান না। উনারা বাজে হয়েই বাঁচেন, বাজে হয়েই মরেন। এটাই সত্যি। একজন রজনীকান্ত কিংবা অনন্ত জলিলের ফালতু সস্তা সমালোচক হওয়া সোজা, কিন্তু ওরকম হওয়াটা ভীষণ ভীষণ ভীষণ কঠিন। সাম্প্রতিক বন্যায় একজন অনন্ত জলিল যা কন্ট্রিবিউট করেছেন, তা একশো ভার্চুয়াল সংগঠনের দশ হাজার ফেসবুক মহাপুরুষ মিলেও করতে পেরেছেন কি? দুই টাকার ছাগল সবসময়ই স্বপ্ন দেখে লাখ টাকার বাগান খেয়ে সাবাড় করার! একটা গান আছে, সম্ভবত ২০০৮ সালের। ‘তুমি দিয়ো না গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া’। হিন্দি গানের সুর নকল করে তৈরি এ গানটা আমি আগে কখনোই শুনিনি। এইতো সেদিন হঠাৎ এক ফ্রেন্ডের টাইমলাইনে গানটা পেলাম। এমন আজব বস্তুও যে পৃথিবীতে আছে, সেটা হয়তো আমার মাথায়ই আসত না। মিউজিকের ব্যাপারে আমার টেস্ট এবং সেন্স, দুইই খুব শার্প। অথচ ইউটিউবে সে গানটি শোনার সময় ডানদিকের সং সাজেশন্স থেকে আরও কিছু গানও শুনে ফেললাম, যা আমার স্ব-আরওপিত স্ব-ঘোষিত ‘উন্নত রুচি’র কোনওভাবেই সাথে যায় না। ওই গানটা বের হয়েছে অনেক আগে। আমি কখনও শুনিনি। গানটার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি জানতাম না। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে সব কিছুর অস্তিত্ব নিয়ে জানলে চলে না। যারা গানটা বের করেছেন, তারা আমাকে জোর করে শোনাননি। কেউ আমাকে গানটা শুনতে বাধ্য করেননি। আমি ওই অখাদ্য এবং সাথে আরও কিছু ভ্রাতৃপ্রতিম অখাদ্য খেয়েছি সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে এবং অমন গানের শ্রোতাদের দলে নিজের জায়গা করে নিয়েছি। সে শ্রোতারা নিম্নরুচির হলে আমিও নিম্নরুচির। কখনও একান্তে গুনগুন করে ফেলি, ‘তুমি দিয়ো না গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া’ কিংবা ‘আমার দয়াল বাবা কলা খাবা, গাছ লাগাইয়া খাও’………… কেন করি, জানি না, সত্যিই জানি না। সবার অগোচরে কয়জন ভদ্রলোকই বা সত্যিকারের ভদ্রলোক? খোঁজ নিয়ে দেখুন, লাখে একজনও পাবেন কি না সন্দেহ! বেশিরভাগ ভদ্রলোক মাত্রই ভণ্ডলোক। আমি গানগুলি শুনেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এমন গানকে নিজের হৃদয়ে অমর করে রাখাটা ভাল রুচির পরিচায়ক নয়। তবে সে সব গানের আর্টিস্টদের নিয়ে ট্রল করা, গানের প্রোডাকশনের সাথে জড়িত লোকজনদের সমানে জাজ করতে থাকাটা নিঃসন্দেহে আরও বেশি বাজে ও সস্তা রুচির পরিচায়ক। ভাই, জীবনেও তো দুইলাইন ভাল জিনিস লিখতে পারেন না। কারও নাম উল্লেখ করে উনাকে নিয়ে বাজে কথা লেখার ব্যাপারে এত সিদ্ধহস্ত কেন? উনার সাথে বসে এক কাপ চা খাওয়ার যোগ্যতা আছে আপনার? উনার সামনে দাঁড়িয়ে জনস্বার্থে আপনার এই ফেসবুকীয় ছাগলানাচন পরিবেশন করুন তো দেখি আপনার বুকের পাটাটা কত উঁচু!
তিন। সারাজীবন চেষ্টা করেও কি আপনার সাধ্যে কুলাবে এমন একটা সলো প্রোগ্রাম করে এত শ্রোতাকে টিভির সামনে বসিয়ে রাখার? কুলাবে না। কারণ আপনার অত অর্থ কিংবা ক্ষমতা নেই, সারাজীবনেও হয়তো হবে না। আপনি ড. মাহফুজুর রহমানের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি ব্যাপক উন্নত রুচির, যা সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাচ্ছেন? আপনি উনার চাইতে যোগ্য? সবাই উনাকে ছোট করছে, ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছে, এ সুযোগে আপনিও একটু অমন না করলে নিজেকে ‘সুশীল’ প্রমাণ করবেন কীভাবে—এ দায় আপনার বিবেকের দাদে চুলকাচ্ছে? নাকি, আপনার ওই ছোটলোকিতেই আনন্দ? ডিয়ার হিপোক্রিট, সাহস থাকলে আপনার ভয়েসে একটা গান গেয়ে শেয়ার করুন তো দেখি! অবশ্য, শেয়ার করলেই বা কী? আপনি এমন কে যে আপনার গান শুনে একটাও ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাটা নাচবে? বলতে পারেন, আপনার ভয়েস ভাল না, তাই আপনি শেয়ার করবেন না, উনার মতো কাউকে বিরক্ত করবেন না। ভুল বললেন, বস্! উনি কাউকে বিরক্ত করেননি। বিরক্ত যদি হয়েই থাকেন, তবে আপনি নিজ দায়িত্বেই হয়েছেন। আপনি সে অনুষ্ঠান দেখার দাওয়াতপত্র পেয়েছিলেন নাকি? নাকি ওইসময়ে অন্য সবকয়টি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল? কালকে ওই সময়ে দেশের ‘দেশপ্রেমিক’ টিভি-দর্শক ভারতীয় কোনও চ্যানেল না দেখে দেশীয় একটা চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখেছেন। বিদেশি কোনও চ্যানেলের টিআরপি না বেড়ে আমাদের চ্যানেলের টিআরপি বেড়েছে। এ অর্জনের জন্য উনাকে আমরা কেউ থ্যাংকস দিয়েছি? আপনি করে দেখাতে পারবেন এমন কিছু? আপনার আমার মতো কয়েক ডজন পাবলিককে কিনে পকেটে রেখে ঘোরার ক্ষমতা উনার আছে। উনি অনেক লোকের কর্মসংস্থান করেছেন, সরকারকে অনেক টাকা ট্যাক্স দিচ্ছেন, বাংলাদেশের মিডিয়াতে অবদান রাখছেন। আপনি কী করতে পারছেন দেশের জন্য? ফেসবুক কী সহজেই জুতোর সোলকে মুকুটের চূড়ায় উঠিয়ে দেয়! বাস্তবজীবনে জুতোর সোল কিন্তু পায়ের তলায়ই থাকে।
দুর্বলরা অন্যের দুর্বলতা নিয়ে মেতে থাকে, সবলরা অন্যের সবলতা থেকে শিক্ষা নেয়।
বাবার কথায় ফিরে আসি। বাবা মা’কে বলতেন (এবং এখনো বলেন) হোম মিনিস্টার। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বাসায় শুধু ডাল-আলুভর্তা রান্না করলে যে খাবারের টেবিলে বসে মা’কে জিজ্ঞেস করতে হয়, আর কিছু নেই? এটা ছোটোবেলা থেকে কখনোই শিখিনি। বরং মা যে সারাদিন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এই অসুস্থ শরীরেও ব্যস্ত সময় কাটান, বাবা সেটা অ্যাকনলেজ করতেন বারবার। মায়ের সব কাজের প্রশংসা করতেন। মা ছোটো বাচ্চাদের মতো খুব খুশি হয়ে উঠতেন আর সমস্ত কষ্ট ভুলে বাবার কাছে গল্প করতে বসে যেতেন সারাদিনে কী কী হল। বাবা বলেন, মেয়েরা বড্ডো ছেলেমানুষ হয়। ওদের মনে কষ্ট দিলে সেটা বহুগুণে ফেরত আসে। আমার মা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। এটা করতেন স্রেফ শখে। আমাদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা, বাসার সব কাজ সামলে রাখা, সামাজিকতা ঠিক রাখা, এইসবও মা’কেই করতে হত। আমার মনে হয়, যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেন, তবে এর ফল আপনি না পেলেও আপনার ছেলেমেয়ে পাবে। আমি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। ফ্যামিলিতে যিনি পয়সা আয় করেন না, তিনিও কিন্তু আপনার মতোই টায়ার্ড ফিল করেন। পয়সা আয় করা বা না-করার সাথে ক্লান্তিবোধ করা না-করার কোনও সম্পর্ক নেই। আমি দেখেছি, বাসার সব কাজ করার জন্য বেতন দেয়া হলে আমার মায়ের বেতন আমার বেতনের অন্তত ডাবল হত। জীবনের ছোটো-ছোটো সুখগুলোকে যদি ভালোবাসা দিয়ে উপভোগ করা যায়, তবে জীবনের সব হিসেব তো মিলেই, সাথে বোনাসও মেলে। খাবার খেতে ভাল লাগে স্বাদে নয়, ভালোবাসায়। তাই বুঝি সবার মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সবচে’ সুস্বাদু রান্না। যারা অনেকদিনের জন্য ঘরের বাইরে আছেন, তারা তো জানেন মায়ের হাতের মসুরের ডাল আর বেগুন ভাজি খাওয়ার লোভে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্যকেও কতো সহজেই গুডবাই বলে দিতে ইচ্ছে হয়!
এইসব কিছু কেন মাথায় এল? প্রেসিডেন্ট আবদুল কালামের ছোটোবেলার একটা গল্প পড়লাম। আমার নিজের মতো করে সেটা লিখছি।
একদিন ডিনারে আবদুল কালামের মা তাঁর বাবার সামনে একটা পোড়া রুটি আর এক বাটি সবজি দিলেন। ছোট্টো কালাম অপেক্ষা করছিল, বাবা কিছু বলে কি না দেখার জন্য। যেন কিছুই হয়নি, বাবা এরকমভাবে তৃপ্তিভরে রুটিসবজি খেয়ে নিলেন আর ছোট্টো কালামকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তাদের স্কুলে কী কী হয়েছে, বন্ধুরা আর টিচাররা কে কী বলেছে। কালামের মা রুটিটা পুড়ে যাওয়াতে আফসোস করছিলেন আর দুঃখপ্রকাশ করছিলেন। তখন কালামের বাবা বললেন, আহ প্রিয়তমা! আমার পোড়া রুটি খেতে খুব মজা লাগে। আজকের রুটিটা চমৎকার হয়েছে! মা হাসিমুখে ঘুমাতে গেলেন। পরে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ছোট্টো কালাম বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তোমার পোড়া রুটি খেতে সত্যিই ভাল লাগে? বাবা বললেন, তোমার মা আজ সারাদিন কাজ করে খুব ক্লান্ত। রুটি যে সেঁকে দিয়েছে, এটা শরীরের জোরে নয় বাবা, ভালোবাসার জোরে। পোড়া রুটি কাউকে কষ্ট দেয় না, কিন্তু দুর্ব্যবহার দেয়। শোন ব্যাটা! এই জীবনে যাদের নিয়ে থাকবি, যা কিছু নিয়ে চলবি, এর কিছুই পারফেক্ট না। তবুও এসব নিয়েও খুব সুন্দরভাবে বাঁচা যায়। ব্যাটা! জীবনটা ছোটো তো! আমরা বাঁচবোই বা ক’দিন, বল তো? আফসোস নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কোথায়?
এই গল্পটা পড়ে আমি মনে-মনে আরও একবার বললাম, বাবা, তোমাকে ধন্যবাদ!