(অনেক আগের লেখা এটি।)
এক ছোট্ট শহরের এক বড় ডাক্তারের কাছে এক অসুস্থ লোক এসেছেন মনের অসুখ সারাতে। মনের অসুখের চাইতে বড় অসুখ আর নেই। সে লোকের বিত্ত আছে, যশ আছে, সুন্দর একটা পরিবারও আছে। ঈশ্বর তাকে কোনওকিছুই দিতে কার্পণ্য করেননি। তাকে সবাই দেখে আর ভাবে, “আহা! অমন জীবনও হয়!” বাইরে থেকে তো আর মনের খবর জানা যায় না, তাই সবাই ভাবত, সে বড় সুখী মানুষ। যে যত বেশি দুঃখ লুকিয়ে রাখতে পারে, তাকে দেখলে তত বেশি সুখী মনে হয়। সেও ছিল ওরকম। বড় সুখীসুখী দেখতে বড় বেশি অসুখী একজন মানুষ। কেউ ভাবে না, তারও একটা মন আছে, সে বেয়াড়া মনটাও কখনও-কখনও খারাপ হয়ে থাকে। মন খারাপ হয়ে থাকাটা যে কী ভীষণ খারাপ রকমের একটা ব্যাপার, সে কথা বাইরের ওরা জানবে কী করে? সবাই যে চায়, ও সবার মন ভালো করে দিক। ও যেন জন্মেছেই সবার মনকে সারাতে। ওর নিজের কোনও মনটন থাকতে নেই। সবসময়ই হাসিমুখে সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার জন্যই সে বেঁচে আছে। এটাকেই জীবনের নিয়ম হিসেবে সবাই ধরে নিয়েছে।
সে লোক ডাক্তারকে বলছে, ও ডাক্তার সাহেব, আমার যে কিছুই ভালো লাগে না। আমার মনটাকে একটু সারিয়ে দিন না! আমি আমার মনটাকে একটুখানি ভালো রাখার বদলে পুরো দুনিয়াটা দিয়ে দিতে রাজি! আমাকে একটু বাঁচান না! আমারও যে খুব হেসেখেলে বাঁচতে ইচ্ছে করে। অন্যদের মতো করে আমিও চাই, শুধু আমার হৃদয়ের হাসিটাই ঠোঁটে থাক। আমিও হাসতে চাই প্রাণখুলে, শুধুই ঠোঁটখুলে নয়। আমি হাসি তো আমার চোখ হাসে না, আমার চোখ হাসে তো আমি হাসি না—এমন হাসি থেকে মুক্তি চাই। ডাক্তার সাহেব, দিন না আমাকে একটু ভালো করে!
ডাক্তার শুনলেন সবকিছু। হেসে বললেন, এ আর এমন কী ভাই? লোকের তো মন খারাপ হয়ই, না? আপনার ভাগ্যটা ভালো, পুরো দেশের লোককে হাসিয়ে আজকে সন্ধ্যায় আমাদেরকে হাসাতে আমাদের শহরে এসেছেন বিখ্যাত বিদূষক নীল। চেনেন তো ওকে? দেশসুদ্ধ মানুষের মন ভালো করে দেয় এই ভালোমানুষটি। আমি আজকে সন্ধ্যায় চেম্বার বন্ধ রাখবো ওর জন্যই। অমন অদ্ভুত মন সারাবার যাদুকর! কাছ থেকে একটিবার নীলকে দেখতে চাই। তো ভাই, সন্ধ্যায় ফ্রি আছেন তো? মন ভালো করতে বরং আজকে সন্ধ্যা ৭টায় টাউনহলেই চলে আসুন না! কতকত লোক আসবে একটু প্রাণখুলে হাসতে! আপনিও আসুন! দেখবেন, একদম ভালো হয়ে যাবেন।
লোকটি খুব কষ্টেও ঠোঁটের কোণায় হাসিটা ধরে রেখে খুব নিচু অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন, আমাকে যে আসতেই হবে, আমিই নীল।
এটাও একটা জীবন! এই জীবনে অনেকেই বাঁচে, যাদের নিজেদের জীবনটা অন্যদের ভালো রাখতেই কাটে। কেউ কোনওদিনই রাখবে না ওদের মনের খবর। ওরা বেঁচে আছে, এটাই ঢের। যেদিন হঠাৎই ‘নেই’ হয়ে যাবে, সেদিন ওদেরকে আমরা খুঁজবো। কেন খুঁজবো? মন ভালো করে দেয়ার মানুষটি যে ও, তাই; মানে, নিজেদের জন্যই।
কিছু আত্মকথন হোক এবার। এই কয়েকমাস ধরে বেশ কিছু ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে, যেগুলিতে মন ভালো করে থাকা যায় না। বাবা স্ট্রোক করলেন। শান্ত মানুষটি আরও শান্ত হয়ে গেলেন। মেনে নেয়া যায়? ডাক্তার জানালেন, মায়ের স্পাইন্যাল কর্ডের ২টি হাড় সরে গেছে, সেগুলি স্নায়ুর স্বাভাবিক কাজগুলিকে করতে দিচ্ছে না। এতে মায়ের যে কষ্টটা হচ্ছিল, সেটা চোখে দেখে সহ্য করাটাও সহজ নয়। স্পন্ডিলাইটিসের সমস্যাও যে কতটা প্রকট হয়ে যেতে পারে, সেটা যার হয়নি, কিংবা যে চোখে দেখেনি, সে বুঝবে না। এর একমাত্র চিকিৎসা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্ক্রু বসিয়ে হাড়গুলিকে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসা। চেন্নাইয়ে অ্যাপোলো হসপিটালে গিয়ে জানা গেল, ২টি নয়, সরে গেছে ১১টি হাড়। অপারেশন হল, বাবার হেলথ চেকআপ করানো হল। বাবার হার্টে কিছু ব্লক ধরা পড়ল। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়েছে, তাই ৬ মাসের ওষুধেই সেরে যাবে। ডাক্তার তা-ই বললেন। আমার ছোটভাই একাএকা সবকিছুই সামলাচ্ছে। ছোটকাকি আর কাকাতো ভাই গত ১ মাস ধরে নানানভাবে নিরন্তর সেবা দিয়ে যাচ্ছে বাবা-মা’কে। ওরা থাকাতেই কিছুটা রক্ষে। বিপদের দিনে মানুষ চেনা যায়। এই ১ মাসে আর তেমন কেউ তো আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা’টাও বানাতে হয় বাবাকে। এইতো সেদিনও চায়ের কেটলি হাত থেকে পড়ে গিয়ে বাবার পা পুড়ে গেল। এমন আরও ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আমার কান পর্যন্ত সেগুলি পৌঁছয় না। আমার কাছে সবাই কী কী যেন লুকায়। আমি অতো বুঝি না, তবুও কিছু-কিছু তো বুঝি। বাসায় কোনও কাজের লোক নেই। অনেক খুঁজেও কাউকে পাচ্ছি না। গত ৫-৬ দিন আগে মায়ের শরীরে অনেক জ্বর হল। ১০২-১০৩। আমি জানলাম। তবুও গেলাম না বাসায়। চলে গেলাম ঢাকায়, যশোরে; ক্যারিয়ার আড্ডায়, স্বপ্ন দেখাতে। হাজারহাজার মানুষকে সেই ২ মাস আগে থেকেই কথা দেয়া হয়ে গেছে–সুশান্ত আসবে। সবাইকে শোনাবে জীবনের গল্প। ওর কথা শুনলে সবাই বড় ভালো থাকবে। ………….. এ দায়িত্ব বড় দায়িত্ব। ইচ্ছে থাকুক, আর না-ই থাকুক, যেতে হয়। ঘরের ব্যথা বাইরে বলা যায় না। সে না বলতে পারার ব্যথা আরও বড় ব্যথা। কেউ কোনদিনও জানবে না, সুশান্ত কেমন আছে। ওরা শুধু এইটুকুই জানতে চায়, সুশান্ত ওদেরকে কতটা ভালো রাখছে, রাখবে।…………… মা এখন ভালো আছেন। জ্বর নেই, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাবা দিনদিন আরও শান্ত হয়ে যাচ্ছেন। আমার ছোটভাইয়ের আগের রাগ, অভিমান এখন আর নেই। পড়াশোনা সহ সবকিছু সামলাতে-সামলাতে ও এখন খুব চুপ হয়ে গেছে। থালাবাসন ধোওয়া থেকে শুরু করে এমন এমন কোনও কাজ নেই, যা ওকে করতে হয় না। ঘরের সবকিছুতেও ও, বাইরেও ও। হৈচৈ করে কম, ধুমধাম করে মুখের উপরেও আগের মতন অতো বলে না। আমাদের বাসাটা এখন একটি শান্ত বাসা। সেই শান্ত বাসাটিকে আমি দূর থেকে অনুভব করছি শুধু, কারওর জন্যই কিছু করতে পারছি না। এই চাকরি এখন আর আমার ভালো লাগে না। জীবিকার কাছে জীবনকে পরাজিত হতে দিতে দিতে এখন আমি ক্লান্ত। আমার সবচাইতে ভালোবাসার মানুষগুলির কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।
চাকরি নিয়ে কিছু বলি। আমি যে খুব ভালো আছি, শান্তিতে আছি, তা নয়। সব ঠিকঠাক করার চেষ্টা করি, তবুও কী যেন ভুল হয়ে যায়, কী যেন শুধুই ভুল হয়ে যায়! আমার কলিগদের মধ্যে আমাকে পছন্দ করেন, এমন মানুষ খুব বেশি নয়। তবে আমার পরম সৌভাগ্য, চাকরির সুবাদে সত্যিকারের অসাধারণ কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। কলিগরা নাকি ভালো বন্ধু হয় না। কিন্তু আমি অনেক ব্যাচমেট, সিনিয়র এবং জুনিয়র কলিগকে পেয়েছি, যাদেরকে পুরনো বন্ধু কিংবা বড় ভাইয়ের মতোই বিশ্বাস করা যায়। সিভিল সার্ভিসে অয়েলিং, লবিং, ব্যাকবাইটিং এসব কালচারে আমি এখনও পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। সাদাকে সাদাই বলি। আমি সত্যিই জানি না, কী করলে সবাই ভালো বলে। কিংবা, জানলেও ওরকম করতে পারি কম। সবাই ভাবে, একটু বেশিই ভালো আছি। তাই, কেউ আমাকে অতো ভালোবাসে না। যাকে দেখলে মনে হয়, ‘ভালো আছে’, তাকে কেউ মন থেকে ভালোবাসে না। আমি হাসলে সেটা মেকি, কাঁদলে সেটা ন্যাকামি, চুপচাপ থাকলে সেটা ভাব। আমার সবকিছুতেই দোষ। এভাবে আর কত চলা যায়? ইদানিং নিজেকে শামুকের মতন গুটিয়ে রেখে বাঁচি। ডিপার্টমেন্ট থেকে কোন বিশেষ দিন উপলক্ষে ম্যাগাজিন বের করলে কোনও লেখা দিই না। “আমি তো ওরকম করে লিখতে পারি না, তুমি পারবে কেন?” “তুমি পারো, আমি পারি না; অতএব তুমি অপরাধী।” এইসব বোধ মানুষের চিরন্তন। আপনি শুধু চাকরিই করতে পারেন, এর বাইরে আর কিছুই পারেন না, এটা আপনার কলিগদের জন্য বিরাট সুখের খবর। ধরেবেঁধে নিয়ে না গেলে এখন আর উপস্থাপনাও করি না, নানান কিছু লিখে দিই না। সিভিল সার্ভিসে নিজেকে লুকিয়ে রেখে লো প্রোফাইল মেইনটেইন করে থাকতে জানাটাই আর্ট। প্রথম হওয়াটা বড় অন্যায়। আপনার কাছ থেকে সবার প্রত্যাশা থাকবে বেশি, অথচ এর বিনিময়ে আপনি বাড়তি কিছুই পাবেন না। বাড়তি পুরস্কারবিহীন বাড়তি দায়িত্বঅর্পণ তিরস্কারের সমান। আমি কখনওই ভালো কর্মকর্তা নই, তাই আমি ক্ষমা চাইছি।
ইনবক্সে প্রতিদিন শতশত মেসেজ আসে। ফলোয়ারদের মেসেজ জমে থাকে আদার্সে। সেগুলির শতকরা ৯৭ ভাগই আমার কাছ থেকে সাহায্য কিংবা পরামর্শ চাওয়ার মেসেজ। আমি সত্যিই খুশি হতাম যদি আমি আগের মতোই থাকতাম। অতো ফলোয়ার নেই, অতো মানুষের দাবি নেই, প্রত্যাশা নেই। আমি এমন একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই, যার স্বাক্ষর এখনও অটোগ্রাফ হয়নি। সত্যিই চাই! আমি কীভাবে যেন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি একটু-একটু করে প্রতিদিনই। আমি সবসময়ই এই স্বার্থপরতাকে ঘৃণা করে বাঁচতে চেয়েছিলাম। এখন তা আর পারছি না। একটাসময়ে ইনবক্সে যে যা কিছুই জানতে চাইত, খুব যত্ন করে সময় নিয়ে বলতাম। (সুখের কথা, ওদের অনেকেই অনেক ভালোভালো জায়গায় গেছেন, আমাকে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন তাদের কেউ-কেউ।) এখন সেটা আর পারি না। ইনবক্সে মেসেজগুলি পড়ি আর রিমুভ করে করি। মেসেজও যে সবগুলি পড়তে পারি, তাও নয়। একটু ভাবুনতো, আপনার ইনবক্সে কয়েক হাজার মেসেজ জমে থাকলে আপনি ব্যস্ততার মাঝে কীভাবে সেগুলির রিপ্লাই দিতেন? সত্যি বলছি, অন্য সব কাজ বাদ দিলেও সত্যিই সম্ভব নয়। আমার মোবাইল ফোনের ইনবক্স ফোল্ডারে পড়া হয়নি, এমন মেসেজ জমে গেছে ৭৮৪টি। প্রায়ই ভাবি, একটা-একটা করে মেসেজগুলি পড়তে শুরু করবো। হয়ে ওঠে না কিছুতেই। এসবকিছু যদি আমার দোষ হয়, আমি সে দোষের জন্য ক্ষমা চাইছি।
অনেকেই অনুরোধ করেন, “আমাকে আপনার বন্ধু বানান।” একটু ভাবুনতো, আমার বন্ধু হলে কী হবে? ইনবক্সে চ্যাটিং করবেন? আমার পোস্ট পড়বেন? আমার লেখা শেয়ার করবেন? আপনার কোনও পোস্টে আমাকে ট্যাগ করবেন? আমার পোস্টে কমেন্ট করবেন? সেসব তো এমনিতেই করা যায়। আমার সবকিছুই পাবলিক করে দেয়া। আমার ওয়ালে পোস্ট করা ছাড়া আর সবকিছুতেই আপনার পুরোপুরি অ্যাক্সেস আছে। আমার বন্ধুতালিকায় চার হাজার নয়শ’র মতো বন্ধু আছেন। আমার বড় দুর্ভাগ্য, মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার কারণে ওদের মধ্যে বড়োজোর শতকরা ৭ ভাগের কথা আমি মাথায় রাখতে পারি। বাকিদের পোস্টগুলি দেখার সময়টুকু পর্যন্ত পাই না। আপনার মতন, আমার জীবনেও কিছু-কিছু মানুষ কখনও-কখনও আসেন, যাদেরকে বন্ধুতালিকায় রাখতে না পারলে আমার নিজেরই খুব অস্বস্তি হয়। পাঁচ হাজারের বেশি বন্ধু রাখাও যায় না। আপনিই বলে দিন, আমি কী করবো? আমার জায়গায় আপনি থাকলে আপনি নিজে কী করতেন? আপনি যা খুব মন থেকে চাইছেন, সেটা আমি করতে পারছি না। আমার অক্ষমতাকে ক্ষমা করবেন। (এই অক্ষমতা কিন্তু ফেসবুকেরও!)
অনেকেই বলেন, আমি যেন একটা ফ্যান পেইজ খুলি। খুবই ভালো পরামর্শ। কিন্তু আমি জানি, আমি সেটা মেইনটেইন করার মতো সময়, শক্তি কিংবা উৎসাহ, এর কোনটাই আমি পাবো না। যারা ওটা করতে পারেন, তারা গ্রেট। সবাই তো আর সবকিছু পারে না—আমি এটা মেনে নিয়েছি। এই যেমন, আমি অনেককিছুর মতো ওটাও পারি না। ভালো বই না পড়া, ভালো সিনেমা না দেখা—এই দুইটি জিনিসকে একটাসময়ে আমার কাছে পাপ বলে মনে হতো। ইদানিং আমার কী জানি হয়েছে। আমি এখন বই না পড়েও, মুভি না দেখেও দিনের পর দিন দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি। এটা আমার সাথে কোনওভাবেই যায় না। আমার সময়গুলি প্রতি মুহূর্তেই চুরি হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন ফোন ধরতেও ভয় পাই। যদি ক্লান্তিতে দুর্ব্যবহার করে ফেলি, সে ভয়! সেদিন একজন ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, Pair of words শেখার জন্য কোন ইংরেজি গ্রামার বইটা কিনবেন। আমি ভাবলাম, এই কথাটাও আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে? আমার মোবাইল নাম্বার পেয়ে যাওয়া মানেই কি যেকোনও তুচ্ছ কাজেও আমাকে বিরক্ত করতে পারার অনুমতি পেয়ে যাওয়া? খুব রাগ হল উনার উপর। রাগ করে কী কী যেন বলেও ফেললাম। পরে সেটা ভেবে নিজেই অনেক কষ্ট পেয়েছি। কাউকে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারটিতে সহজ সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্য আমার কোনওকালেই ছিল না। ইদানিং সেটাতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। কাউকে কষ্ট দিতে সে কী যে ভীষণ কষ্ট লাগে! তবুও দিতে হয়, দিতে বাধ্য হই। একটু ভাবুনতো, আপনার কাজের ফাঁকে যদি প্রতিদিন ৩০-৪০ জন মানুষকে ফোনে ২-৩ মিনিট করে সময় দিতে হতো স্রেফ ওদের প্রয়োজনে, আপনি ধৈর্য কতটা ধরে রাখতে পারতেন? বেশ কয়েকদিন ধরেই আমি ভেতরে-ভেতরে কেমন জানি অসুস্থবোধ করছি। সেদিন দুইবার লো প্রেসারের কারণে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। প্রায়ই লিখতে বসলে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে থাকি। মাঝেমাঝে এতো দুর্বল লাগে, ফাইলে স্বাক্ষরটাও করতে ইচ্ছে করে না। বাসায় আমি একা থাকি। কাপড় ধোয়াসহ আরও কিছুকিছু বিরক্তিকর কাজ নিজেকে করতে হয়। বেশ কিছুদিন হল, অনেক ধরনের মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়েও যাচ্ছি। ইদানিং আমার এই ধারণাটা মাথায় চেপে বসেছে, আমি বোধ হয় আর বেশিদিন বাঁচব না। জানি, ওরকম কিছু হয়তো ঘটবে না। কিন্তু অদ্ভুত কিছু বিষণ্ণতা আমাকে পেয়ে বসেছে। দিনের একটা সময়ে বিষাদঘেরা হয়ে থাকি। আমি আশেপাশের পৃথিবীটাকেও পুরনো আমি’র মতো করে দেখতে ভুলে যাচ্ছি। এই একটু বৃষ্টি হলেও এমনভাবে বৃষ্টি দেখতে থাকি, যেন এই শেষবারের মতো বৃষ্টি-দেখা। কখনও-কখনও চাঁদটা আলো দিতে থাকলে এমনভাবে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন ওটা আমার জন্য এই শেষবারের মতো উঠল। আমার আশেপাশের কেউ এসবের কিছুই জানে না। আমি জানি, আমি ক্রমশ ভালো-নেই’দের দলে ঢুকে যাচ্ছি। আমার হেলথ চেকআপ করানো দরকার। সে সময়টাও বের করে নিতে পারছি না। আমি এমন কখনওই ছিলাম না। আমার আমি’কে দেয়ার মতো সময়টুকুও ইদানিং আর পাচ্ছি না। ভাবতেও খারাপ লাগে। যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তাদেরকে এবং তাদের বন্ধুদের অনেককেই বলছি, আমি আপনাদের অনেকের সাথেই ভালো ব্যবহার করতে পারিনি। আমি আমার সকল দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি।
আমার অতি বাজে স্বভাবগুলির একটি হল, আমি ভালোরকমেরই শর্ট-টেম্পার্ড। যা বলার, একেবারে সরাসরি বলে ফেলি। আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করলে সেটাকে কিছুতেই ভালোভাবে নিতে পারি না। একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি দেখেছি, যারা আপনাকে বলেন, আপনি ছোট, তাদের মধ্যে দুই শ্রেণীর মানুষ আছেন। এক। কেউ-কেউ আপনার ভুল ধরিয়ে দেবেন এই জন্য যে, যাতে আপনি ভুলটা শুধরে নেন। দুই। কেউ-কেউ আপনার ভুলটা তুলে ধরবেন আপনাকে হেয় করার জন্য এবং উনি আপনার চাইতে বড়, এটা দেখানোর জন্য। দ্বিতীয় ধরনের মানুষকে আমি সহ্যই করতে পারি না। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, কেউকেউ আপনার পোস্টে কমেন্ট করেন স্রেফ ব্যক্তিগত আক্রমণ করার জন্য। কেউকেউ কমেন্ট করেন, আপনাকে ছোট করার ইচ্ছে নিয়েই। কেউকেউ আপনার ভাবনাকে খুব অশ্রদ্ধা করে উনার ভাবনাকে মহান বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একেবারে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউকেউ আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারলেই সে নিজে স্বস্তিতে থাকবে, এই বিশ্বাস নিয়ে কমেন্ট করে। কেউকেউ অপ্রাসঙ্গিক কমেন্ট করে অন্যদের বিব্রত করে। কেউকেউ বা, অন্যান্য যারা কমেন্ট করে, তাদেরকে নানানভাবে বিরক্ত করে। কেউকেউ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অশ্লীল বিষয় নিয়ে উস্কে দেয়ার জন্য কমেন্ট করে। কেউকেউ আছে, যারা আজেবাজে কমেন্ট করে না ঠিক, কিন্তু ওসব কমেন্টে লাইক দিয়ে নীরব সমর্থন জানায়। কেউকেউ সময় বের করে হলেও আপনাকে ছোট করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের ওয়ালে কিংবা অন্য কোথাও বিভিন্ন কথা পোস্ট করেন। আমার ওয়ালেও এইসব চলতে থাকে। এইসব কিছু দেখলে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারি না। হয়, ওদেরকে সমুচিত জবাবটা দিয়ে দিই, কিংবা ব্লক করে দিই। এর পেছনে আমার যুক্তি হল, আমি যেরকম করে ভাবি, সেরকম করে তো আর সবাই ভাববে না। আমার চিন্তাভাবনা অনেককেই বিরক্তিতে ফেলে দেয়। ওরা যখন আমার পোস্ট ওদের টাইমলাইনে দেখে, তখন খুব রাগ কিংবা অস্বস্তিবোধ করে। যেহেতু আমার প্রোফাইলটা পাবলিক প্রোফাইল বিধায় পোস্টগুলিও পাবলিক, সেহেতু খুবই উত্তম পন্থা হল, ওদেরকে এই ধরনের অহেতুক পোস্টের যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দিতে নিজেই কোনও ব্যবস্থা নেয়া। তাই আমি ওরকম কাউকে দেখলে মুহূর্তেই ব্লক করে দিই। ওরাও ভালো থাকুক, আমি এবং আমার লেখা যারা পছন্দ করে, তারাও ভালো থাকুক। আমি সত্যিই কাউকে বিরক্ত করতে চাই না। আমার নীতি, কাউকে নিয়ে ভালো কিছু বলার থাকলে বলবো, না থাকলে একদম চুপ করে থাকবো। আমাকে মাস্টারি করার জন্য এখানে দাওয়াত দেয়া হয়নি। কেউই কিছু কম বোঝে না। তবে সম্পর্কের মাত্রা বিচার করে কাউকে যেকোনও কিছু বলা যেতেই পারে। কারওর ব্যক্তিগত জীবনদর্শন নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই। আমি জীবন থাকতে কোনদিনও আপনার কোন ক্ষতি করবো না, এবং আমি চাই, আপনি আমার কোন ক্ষতি না করুন। আপনি আপনার নিয়মে বাঁচুন, আমি আমার নিয়মে। আপনার বাঁচার পথে পণ্ডিতি করার মতো সময়টুকুও তো আমার নেই। বাঁচুন এবং বাঁচতে দিন। এইতো! এর বাইরে বেঁচে থাকার জন্য আমার আর কোন দর্শন নেই। আর খুব ব্যস্ততার কারণে সবার সাথে লড়তে যাওয়ার মতো সময় আমি বের করতে পারি না, সে মানসিকতাও আমার নেই। তাই, আমি ব্লক করে দিই। একটা মজার ব্যাপার কখনও খেয়াল করে দেখেছেন? ফেসবুকও কিন্তু চায়, আপনি যেমন খুশি তেমন ব্লক করে ফেসবুকিং করুন। কীরকম? আচ্ছা, ভেঙেই বলি। আমি যখন প্রথম ফেসবুক ব্যবহার করা শুরু করি, তখন যাকেই পেতাম, তাকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতাম। বন্ধুদের ফ্রেন্ডলিস্টে ঢুকে কিংবা প্রোফাইল দেখে দেখে টানা রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকতাম। ফেসবুক এরকম একটানা রিকোয়েস্ট পাঠানোটা অ্যালাউ করে না। তাই, বেশ কয়েকজনকে রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর ফেসবুক আর রিকোয়েস্ট পাঠাতে দিত না। এর মানে হল, ফ্রেন্ড বানানো যাবে একটু হিসেব করে। অথচ আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আপনি ব্লক করার ক্ষেত্রে কখনওই এরকম কোনও বাধার শিকার হবেন না, সে আপনি যতজনকেই একটানা ব্লক করে দিন না কেন! এর মানেটাও সহজ: ব্লক করা যাবে বেহিসবি স্টাইলে। বাঁচতে হলে, বাঁচতে দিতে হলে, বাদ দিতে জানতে হবে। তবে, এখানে দুএকটি কথা আছে। অনেকসময়ই আমি ভুল বুঝে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীকেও ব্লক করে দিয়েছি। হয়তো উনি একটা ইতিবাচক ভাবনা থেকেই কিছু একটা বললেন কিংবা করলেন, যেটার প্রকাশভঙ্গীটা ছিল আমার বিবেচনায় একটু ভুল, আর আমি ভুল বুঝে দিলাম ব্লক করে। আমি তো আর জানি না, কার মনে কী আছে, কে কোন দিক দিয়ে কী ভাবছে। আবার এমনও হয়, হয়তো এমনিতেই কোনও একটা (আমার দৃষ্টিতে) আপত্তিকর পোস্ট কিংবা কমেন্ট কেউ লাইক দিয়ে ফেললেন। টাচস্ক্রিন মোবাইলে এই ব্যাপারটা ভুল করেও হতে পারে। আমার পক্ষে কারওর মনের খবর জানা সম্ভব নয়। আমি তাই অনেকসময়ই ভুল বুঝে অনেককেই ব্লক করে দিয়েছি। আমি আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি।
আমি মূলত অতি নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। একা থাকার চাইতে ভিড়ে একা থাকাটা বেশি কষ্টের। আমি সেই কষ্টলোকের দুঃখী বাসিন্দা। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ফেসবুকে যার যত ফ্রেন্ড, যার যত ফলোয়ার, যার যত পোস্ট, সে তত একা। আমার খুব বাজে দিকগুলির একটি হচ্ছে, আমি মানুষের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ রাখতে পারি না। আমি শুভাকাঙ্ক্ষী হারানোর অসীম প্রতিভাসম্পন্ন একজন মানুষ। ঠিক মানুষটিকে ভালোবাসতেও যে মানুষ ভুলে যায়, তার মতো দুঃখী আর কেউ হয় না। এমনকি কখনও-কখনও ভুল মানুষকেও ঠিক ভেবে বুকে টেনে নিই। আমি আমার চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে নিজের সাথে বাঁচি। আমার ভাবনাবলয় অতি স্বতন্ত্র হয়েই আবর্তিত হয়েছে বরাবরই। আমি ফেসবুকে কারওর লেখাও তেমন একটা পড়িটড়ি না। সে হিসেবে আমার অনেক ভাবনাই একক, তাই প্রমাদপ্রবণ ও স্বেচ্ছাচারী। আমার সাথে যারাই যোগাযোগ রাখেন, রেখে যাচ্ছেন, এই যোগাযোগ রাখার ব্যাপারটি সম্পূর্ণই তাদের নিজস্ব কৃতিত্ব এবং আমার সৌভাগ্য। আমার খুব মনে হয়, আমার মৃত্যুর সময় শেষ মুহূর্তে আমার পাশে কাউকেই পাবো না। বিশ্বের অনেক ব্যক্তি, যাদের নাম আমরা অনেকেই জানি, তাদের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। আমি যোগাযোগ করতে ভুলে যাই, কিংবা আলসেমি করে করি না। আমাকে যারা চেনে, তারা জানে, আমি এতোটাই অলস যে, কেউ আমাকে উপহার পাঠিয়েছে, সেটা আমাকে ক্যুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থেকে গিয়ে সংগ্রহ করতে হবে, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি দিনের পর দিন সেখানে যাইনি এবং উপহারটি পরবর্তীতে সেই প্রেরকের কাছে ফেরত গেছে। এমনও হয়েছে, আমারই কোনও একটা কাজ স্রেফ ভালোবাসা থেকে কেউ গুছিয়ে করে রেখে সেটা আমাকে বুঝিয়ে দেবে, এর জন্য আমি সময়টুকুও দিইনি। অনেক উপকারী বন্ধুর সাথে পরে আর যোগাযোগ রাখতে মনে নেই। অনেক হাই-প্রোফাইল লোকজন আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছেন স্রেফ আমাকে ভালোবেসে, অথচ আমিই দূরে সরে এসেছি। প্রায়ই পরিচিতজনদের ফোনটা ওই সময়ে রিসিভ করতে না পারলে পরবর্তীতে আর কলব্যাক করতে মনেই থাকে না। সঙ্গত কারণেই অনেকেই এই ঔদাসীন্যের জন্য আমার উপর মহাবিরক্ত। আমার খুব সৌভাগ্য, অনেক ভালোমানুষের ভালোবাসা আমার কপালে জুটেছে। একেবারেই নিঃস্বার্থভাবে পছন্দ করে এমন বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। যারা আমার নিঃস্পৃহতার জন্য আমার উপর বিরক্তি এবং অভিমান নিয়ে আছেন, আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।
৩টি ব্যাপার প্রায়ই লক্ষ্য করছি, সেগুলি নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, তাই বলছি:
এক। নিঃসঙ্গতার সুখ কিংবা অসুখ যা-ই থাকুক না কেন, সমাজের এবং পরিবারের নিয়ম হল, একটাসময়ে বিয়ে করতে হয়। যারা ৩০ পেরিয়েছে, কিন্তু এখনও বিয়ে করেনি, তাদের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি দুই রকমের। ৩০ পেরুনো অবিবাহিতদের আমাদের সমাজ সন্দেহের চোখে দেখে এবং ৩০ পেরুনো অবিবাহিতাদের আমাদের সমাজ সহানুভূতির চোখে দেখে। কিন্তু এটা খুব কম লোকই ভাবে, আমরা যারা এখনও বিয়ে করিনি কিংবা করতে পারিনি, তারাও পারিবারিক জীব। অন্যকিছু বাদ দিলেও, পরিবারের স্বার্থে হলেও আমরা চিরকাল বিয়ে না করে থাকতে পারবো না। আমার নিজের বয়স ৩১ পেরিয়েছে। অন্য সবার মতোই আমিও বিয়ে করে ফেলতে চাইছি অনেকদিন ধরেই, কিন্তু কেন জানি, ব্যাটেবলে মিলছে না। ইদানিং খেয়াল করছি, আমি যে ধরনেরই পোস্ট দিই না কেন, কিছুকিছু লোক সেটাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে বিয়েতে নিয়ে থামাচ্ছে। মাত্রাজ্ঞানহীন অনেকেই খুব বাজেভাবে মন্তব্যও করে ফেলছে। আমি এখনও বিয়ে করতে পারছি না বলে আপনাদের সেটা কোনওভাবেই সহ্য হচ্ছে না। আমি এখনও বিয়ে না করায় আপনাদের যে অসীম মনোদৈহিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।
দুই। আরেক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা আমাকে বিসিএস ক্যাডার/ সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া আর অন্যকিছু ভাবতেই পারেন না। আমি রাত ১০টায় রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছি, সেলফি তুলে আপলোড করছি, আর উনারা জিজ্ঞেস করছেন, “আপনি চাকরি করেন কখন?” উনি আমার চাকরিটা করলে রাত ১০টায়ও চাকরি করার জন্য জীবন দিয়ে দিতেন কি না, কিংবা দিলেও সে জীবন দেয়াটাতে কার কী এসে যেত, সেটা নিয়ে ভাবা যেতেই পারে। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলিতে আমি কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি, আর উনারা অমনিই জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আপনাকে সরকার বেতন দেয় কি ঘোরাঘুরি করার জন্য? চাকরি করে ঘোরেন কীভাবে?” বিনয়ের সাথে বলছি, আপনি সপ্তাহের ৫ দিন খাটুনি শেষে বাকি ২ দিন বিশ্রাম নেন নিজেকে মেরামত করতে আর আমার মেন্টাল আর ফিজিক্যাল স্ট্যামিনা আপনার চাইতে অনেক বেশি বলে আমাকে ছুটির ওই ২ দিন বাসায় বসে থাকতে হয় না। সিম্পল! কেউকেউ মহানন্দে বলে ফেলেন, “সারাদিন ফেসবুকে থাকেন, আপনি চাকরিতে ফাঁকি দেন, আপনি একজন ফাঁকিবাজ কর্মকর্তা।” আরে ভাই, আমার চাকরির ভয় আপনার চাইতে আমার বেশি। আমি জানি, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার বিষয়গুলি মাথায় না রাখলে আমাকে কী কী ঝামেলায় পড়তে হবে। এই চাকরি ছাড়া আমার কী-ই বা দাম! চাকরিটা না থাকলে আমার কোনও গ্রহণযোগ্যতা কিংবা স্বীকৃতিই থাকত না। আমি এসব বুঝি, বস! অন্য অনেকেরই যে কাজটি করতে ২ ঘণ্টা লাগে, সেই একই কাজটি আমি ৩০ মিনিটে করতে পারি। আমার বস জানেন, আমি কী। সরকার আপনার চাইতে কোনও অংশেই কম বোঝেন না। এসব নিয়ে গবেষণা করলে আপনি কী এমন অ্যাওয়ার্ড জিতে যাবেন, শুনি? আপনি বরং ‘নিজের বউকে চুমু খান’। (দয়া করে পড়ুন, ‘নিজের চরকায় তেল দিন’।) আমি কখনওই আমার চাকরি নিয়ে ফেসবুকে বাহাদুরি করেছি, কিংবা আমার চাকরি সংক্রান্ত পোস্ট দিয়ে গেছি, কিংবা ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছি, এমনকিছু তো মনে পড়ে না। আমি চাই, আপনি শুধু আমার চাকরির জন্যই আমার সাথে বন্ধুত্ব কিংবা শত্রুতা কোনওটাই না করুন। আমাকে আমার চাকরি দিয়ে বিচার করবেন না। সিভিল সার্ভিসের বিশালত্বের তুলনায় আমার অস্তিত্ব এতোটাই তুচ্ছ যে, তা নেই বললেই চলে। আমাকে ‘ক্যাডার সুশান্ত’ ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে না পারার আপনার যে অপারগতা, আমি সেটার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।
তিন। আমি সবসময়ই একটা নীতি মেনে এসেছি, মেনে যাচ্ছি, মেনে যাবো। সেটি হল, আমি জীবন থাকতে কখনওই কারওর কোনও ক্ষতি করবো না। একটা সময়ে ভাবতাম, আমি যদি কারওর কোনও ক্ষতি না করি, তাহলে কেন কেউ আমার ক্ষতি করবে? এখন বুঝি, কারওর মনে নিজের অবচেতনে অজ্ঞাতসারে ঈর্ষা জাগিয়ে দেয়াটাও বোধ হয় এক ধরনের ‘ক্ষতি করা’। সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত আমার চাইতে ভালো কাউকে দেখলে সবসময়ই এটা বোঝার চেষ্টা করেছি, “সে কেন আমার চাইতে ভালো? ওরকম ভালো কিছু করতে হলে আমাকে কী কী করতে হবে?” সেসব কাজ করার জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কখনওই বিন্দুমাত্রও কোন ধরনের ঈর্ষা অনুভব করিনি। যাদের ঈর্ষা বেশি, তারা আস্তে-আস্তে নিজেদের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। অন্যের সুখকে সহ্য করতে না শিখলে সুখী হওয়াটা সত্যিই কঠিন। আমি তো প্রায়ই ভাবি, আমি যেরকম আছি, আমি তো তার চাইতে অনেক অনেক বাজেভাবে থাকতে পারতাম। সেরকম অবস্থায় যে ঈশ্বর আমাকে রাখেননি, সেটা কোনওভাবেই আমার কৃতিত্ব নয়, সেটা উনার অসীম অনুগ্রহমাত্র। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। প্রায়ই খুব অসহায় হয়ে আমি দেখেছি, এ সমাজে কিছু-কিছু মানুষ আছেন, যারা বৃশ্চিকের মতন। একটা বৃশ্চিক একটিমাত্র কাজ পারে। সেটি হল, দংশন করা। এটা কিন্তু ওর দোষ না। ও যে আর অন্যকিছুই করতে পারে না। ওর ওটিই একমাত্র কাজ। ওর অন্যকিছুই করার কোনও ক্ষমতা নেই। এতে ওর কোনও দোষই দেখি না। একইভাবে ওরকম কিছু মানুষ আছেন, যারা অন্যের ক্ষতি করা ছাড়া আর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারেন না। ওদেরকে আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। হে বৃশ্চিক মানবগণ! আপনাদের সান্নিধ্য নেয়ার অক্ষমতার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা চাইছি! ক্ষমা চাইছি!! ক্ষমা চাইছি!!!