অন্তরমহলের রসায়ন

একটা শিশু। জন্মের পর তাকে কোনোকিছু শেখানো হোক না হোক, সে নিজে-নিজেই কিছু জিনিস শিখে ফেলে। প্রকৃতি তাকে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে দেয়। একই অভিজ্ঞতা একাধিকবার হলে, সে ধরেই নেয়, সেটাই সত্য। ওই ব্যাপারটা এভাবেই ঘটে, এবং সামনের দিনগুলিতেও এভাবেই ঘটবে। বড় হতে-হতে সে একটাসময়ে ওই ঘটনার কোনো না কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলে। সে ব্যাখ্যাটাই হল তার অর্জিত জ্ঞান। তাকে বাড়তি কোনো পুঁথিগত শিক্ষা দেয়া না হলেও, সে কোনো স্কুল-কলেজে না গেলেও, এরকম বিভিন্ন জ্ঞান দিয়ে সে তার জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে তার একমাত্র শিক্ষক হল প্রকৃতি। আমরা সাধারণত আমাদের ধারণা বা অভিজ্ঞতার বাইরে ভাবতে, কাজ করতে পারি না, বা চাই না। যদি একই স্মৃতি বারবার মোটামুটি একইভাবে ফিরে আসে, তবে ধরে নিই, সেটাই সত্য, সেটাকে মেনে নিয়ে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা যায়। এই যেমন, পাখি ডাকে, এটা মেনে নিতে বাড়তি কোনো জ্ঞানের দরকার নেই। পাখি আগেও ডাকতো, এখনও ডাকে—এই অভিজ্ঞতাটি আমাদের মাথায় গেঁথে আছে। অতএব, ভবিষ্যতেও পাখি ডাকবে, এটা বিশ্বাস করে নিতে আমাদের কোনো অস্বস্তি হয় না, যদিও সামনে কী হবে, তা আমরা কেউই জানি না। এমনও তো হতে পারে, আজকের পর পাখি আর কখনোই ডাকবে না! কিন্তু আমরা সেটা মাথায় আনতে পারি না। আমরা যে মুহূর্তটিতে বেঁচে আছি, মানে, ঠিক যে মুহূর্তে আমাদের মাথায় নানান ভাবনা খেলছে, সে মুহূর্তের বিভিন্ন কাজ বা সিদ্ধান্ত আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা বা ধারণা থেকেই করে থাকি, বা নিয়ে থাকি। এখন প্রশ্ন হল, আমরা কি তাহলে কখনোই আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কাজ করবো না? অভিজ্ঞতায় যা জমা আছে, তা-ই শুধু ঠিক? এমনকি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি অভিনব কিছু পাই, যেটা আগে কখনোই ছিল না, সেটাকেও মেনে নেবো না? গবেষণা করে দেখলাম, অমুক কাজটা এভাবে করে করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাও, সেটাকে নেবো না? ধরে নিচ্ছি, মেনে নেবো না। কারণ, আমরা তো আর জানি না, সেটা মেনে নিলে কী হবে। আমরা ঠিক করলাম, আমরা যেমন আছি, তেমনই থেকে যাবো। হ্যাঁ, ওটাও একধরণের বেঁচেথাকা। তবে, ওরকম করলে আমরা সবসময়ই এমন একটা পৃথিবীতে থেকে যাবো, যে পৃথিবী সন্দেহ আর অবিশ্বাসে ভরা, যে পৃথিবী শুধুই পুরনোর প্রতি বিশ্বস্ত আর মোহগ্রস্ত। যেসব অভিজ্ঞতা বারবার হয়, সেসব নিয়েই কি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যায়? আমরা নতুন কোনোকিছুকেই গ্রহণ করার কথা ভাববো না, এইতো বেশ আছি! তবে হ্যাঁ, যদি সে নতুন কিছু আমাদের জীবনে ভবিষ্যতে কখনো ঘটে, তখন দেখা যাবে কী করা যায়! এই নিরাপদ নিশ্চিন্ত বিশ্বস্ত ভাবনাখোলকের ভেতরেই থেকে যাবো জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত! এক কথায়, আমরা এ পর্যন্ত যা করেছি, যেভাবে করেছি, যা শিখেছি, তার বাইরে যাওয়া যাবে না। কিছুতেই না! ব্যস্‌!……..এটাই কি বেঁচে থাকার নিয়ম?

আমরা কীভাবে বাঁচবো, কী নিয়ে বাঁচবো, সেটা ঠিক করে দেয় মূলত কী কী? দুটো জিনিস নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। এক। বেঁচে থাকার মানসিক ক্ষমতা, যে ক্ষমতা অতীতের অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে বর্তমানকে টিকিয়ে রাখে। দুই। এমনকিছু অভিজ্ঞতা, যেগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, যে অভিজ্ঞতাগুলি একাধিকবার জীবনে হয়েছে এবং হয়েছে বলে আমরা যেগুলিকে খুব সহজেই চিনতে ও বুঝতে পারি। যারা মনে করেন, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাই সকল জ্ঞানের উৎস, তারা বলেন, মানুষ এ পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছে, তার সবকিছুকেই একেবারে অকাট্য যুক্তিতে ফেলা যায় না। মানুষ তার জীবনে সর্বোচ্চ যতটুকু অর্জন করতে পারে, ততটুকু অর্জন করতে যতটুকু ক্ষমতার দরকার, তা মানুষের মধ্যে স্রষ্টাই দিয়ে দেন। জীবনে সবাই সবকিছু পায় না, তাই সবাইকে সব ক্ষমতা দেয়াও হয় না। আমাদের যাকিছুই আছে, তাকিছুকেই সবচাইতে ভালভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনটা কাটানোই আর্ট। অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা হল এই, মানুষ এই ছোট্ট এক জীবনে সবকিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না। ফলে, আজকের দিনে যে ঘটনাটির অভিজ্ঞতা কোনো এক ব্যক্তির ঝুলিতে নেই, সেটা যে কখনোই তার জীবনে ঘটবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, কেননা, সে একই অভিজ্ঞতা হয়তো কারো না কারো ঝুলিতে ইতোমধ্যেই জমা হয়ে গেছে। তবু অনেকে বিশ্বাস করেন, বিগত দিনগুলিতে তাদের জীবনে যা ঘটে গেছে, সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি সামনের দিনগুলিতে খুব সাবধানে চলেন, তবে একটা ভদ্রোচিত জীবন কাটানো সম্ভব। প্রাচীনকালে মনে করা হতো, যে অভিজ্ঞতাটি জীবনে হয়ে গেছে, এর বাইরে আর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অবশ্য, সে সময়ে স্রেফ সেটুকু বিশ্বাসকে ধারণ করেই জীবন কাটানো যেত, কারণ তখন জীবনের বৈচিত্র্য কম ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে, আমরা মানি আর না মানি, সামাজিক জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক ভিন্নতার কারণে অভিজ্ঞতার প্রতীতি ভিন্ন হবেই—দেশভেদে, কালভেদে, পরিস্থিতিভেদে।

আচ্ছা, আমরা শিখি আসলে কীভাবে? পূর্বধারণা থেকে? নাকি, ভুল করতে করতে? আমাদের আচরণকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের কাণ্ডজ্ঞান। আবার এই কাণ্ডজ্ঞান বা বুদ্ধিসুদ্ধি নানান অবস্থায়, নানান সময়ে, নানান জায়গায় নানান রকমের হতে পারে। আপনি ইয়োরোপের রাস্তায় চলার সময় নিশ্চয়ই যেখানেসেখানে থুতু ফেলবেন না। লোকে খারাপ বলবে বলে নয়, ওই কাজটি করলে আপনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বিধায় আপনার কাণ্ডজ্ঞান আপনাকে সে কাজটি করতে বাধা দেবে। আবার সেই একই আপনি বাংলাদেশে খুব স্বস্তি নিয়েই যেখানেসেখানে থুতু ফেলেন। কারণ, আপনি জানেন, এমন কাজ এখানে সবাইই করে, এমন করাটা যে ঠিক নয়, এটা পর্যন্ত কারো মাথায় আসে না, এবং এর জন্য শাস্তি হওয়া দূরে থাকুক, কেউ কিছু মনেও করে না। একটা কাজ দীর্ঘদিন করার ফলে সে কাজে দক্ষতা ও অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে যায়। ভাল শিল্পী, মুচি, ছুতার, মিস্ত্রি, ডাক্তার, প্রকৌশলী হওয়ার জন্য যতটা না দরকার পুঁথিগত জ্ঞান, ততোধিক দরকার প্রায়োগিক জ্ঞান। এমন নৈপুণ্য ক্রমাগত চর্চা আর অভিজ্ঞতার ফলে হয়। কোনো কাজ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি এবং সেটি শুরু করার আর করে যাওয়ার ক্ষমতা অভিজ্ঞতা থেকেই আসে। শত শত বই পড়েও অনেকে ভাল লিখতে পারেন না, আবার অতোটা পড়ুয়া নন, অথচ বেশ ভাল লিখতে পারেন, এমন মানুষও আছেন। একটা কাজ সবচাইতে ভালোভাবে করতে পারেন তারাই, যারা কাজটাকে মগজ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। এসব জিনিস জোর করে হয় না, ভেতর থেকে আসতে হয়।

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নিলে একটা সমস্যা আছে। অসীম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা অসম্ভব, তাই সীমিত অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা ভুল হওয়ার আশংকা আছে। পূর্বের কোনো পরিস্থিতিতে ঘটা কোনোকিছু বর্তমান বা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সাথে পুরোপুরিই বেমানান হতে পারে। সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে প্রয়োগ করলে কাজটি ভুল হতে পারে, এমনকি বড় কোনো ক্ষতি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো স্থপতিকে বলা হল, অনেক উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর ৫০ তলা ভবন নির্মাণ করার নকশা তৈরি করে দিতে। যদি উনি ওরকম বাড়ির নকশা ইতোপূর্বে কখনোই না করে থাকেন, তবে তার পক্ষে স্রেফ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সে কাজটি করা সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? সে কাজটি কেউ না কেউ এর আগে করেছেন, এবং কাজটি কোন বুদ্ধিতে সফলভাবে করা যায়, সেই কৌশলটা কোথাও না কোথাও লেখা আছে। স্থপতি মহাশয়কে অবশ্যই নকশাটি করতে হবে বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে, উনার কাছে অভিনব, এমন কিছু পন্থা কাজে লাগিয়ে; উনার পূর্ব অভিজ্ঞতার মূল্য এখানে সামান্যই। ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। নতুন রোগের চিকিৎসা পুরনো অভিজ্ঞতা দিয়ে করা যায় না।

আধুনিক মানুষ এক ধরনের দ্বৈতসত্তা নিয়ে চলে। সে মুখে এমনসব বিশ্বাস আর যুক্তির কথা বলে, যেগুলি সে নিজেই মেনে চলে না। স্বার্থ হাসিল করতে সে প্রায়ই মানবতার বড়-বড় বুলি আওড়ায়। কিছু প্রচলিত ধারণা বা যুক্তির উৎপত্তি খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বহুকাল আগে কোনো সুবিধাভোগী নির্দিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে কিংবা, পক্ষপাতদুষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভুলে খুব সহজেই এমনসব ধারণার জন্ম হয়েছে, এবং সেগুলিই চলে আসছে। কিছু-কিছু অন্ধ প্রথা, অর্থহীন কর্তৃত্ব, এবং আকস্মিকভাবে সৃষ্ট রীতিনীতি, যেগুলি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অগ্রহণীয়, সেগুলি আস্তে-আস্তে সমূলে উৎপাটন করতে পারলে সমাজ নানান দিক দিয়ে এগিয়ে যায়। যে সকল প্রতিষ্ঠান এবং ঐতিহ্য তাদের প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে, সেগুলিকে অনর্থক আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো মানেই হয় না। তবে হ্যাঁ, সেগুলির মধ্যে কিছু-কিছু বিভিন্ন বিবেচনায় আজকের দিনেও সমানভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতোটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে সেগুলিকে কোনোভাবেই আরোপিত মনে হয় না, দূরের কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না, এবং বর্তমান সময় ও পরিস্থিতির বিবেচনায়ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। যেসব সামাজিক কিংবা ধর্মীয় আচার-আচরণ থেকে বিশৃঙ্খল এবং বিচ্ছিন্ন নানান প্রথার উদ্ভব হয়, সেগুলিকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে না পারলে সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে নানান স্খলন ঘটে। তখন অভিজ্ঞতার লালনের চাইতে যুক্তির প্রাধান্য দেয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। সকল পুরনো অভিজ্ঞতা কিংবা ঐতিহ্যই সময়ের বিচারে প্রাসঙ্গিক বা বাঞ্ছিত নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথা, রীতি, নিয়মকানুনের নবজন্ম অত্যাবশ্যক। দুটো ব্যাপার অভিজ্ঞতার উপরে যুক্তির প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। এক। জীবনে চলার পথে আমরা যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করি, সেগুলি আমরা যেমন ভাবি পুরোপুরি তেমন নয়, বরং বিভিন্ন সীমাবদ্ধ আর পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তাভাবনার ফলে অনেকসময়ই আমরা অনেক সত্যকে নিজেদের মতো করে পরিবর্তিত আকারে গ্রহণ করি। অথচ যুক্তি দিয়ে সেসকল অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করলে অর্ধসত্য, আপাতসত্য আর মিথ্যাকে সরিয়ে প্রকৃত সত্যকে বের করে এনে গ্রহণ করা যায়। দুই। আমাদের মস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক গঠন সম্পর্কে সম্যকভাবে জেনেবুঝে সেখানে কোথায়, কোন অবস্থায়, কোন অভিজ্ঞতা কীভাবে, কতটা গৃহীত বা বর্জিত হয়, সেটাকে বিবেচনায় আনা যায়। এরপর অভিজ্ঞতা-ব্যবচ্ছেদকরণের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা ফর্মুলা বা ভিত্তিনিয়ম দাঁড় করালে পরবর্তীতে ভুল সিদ্ধান্তে আসার আশংকা অনেকটাই কমে আসে। সেই ফর্মুলাটাই পরবর্তীতে এ সম্পর্কিত নানান দিকনির্দেশনা দেয়।

আমাদের মনমানসিকতা তৈরি হয় বিভিন্ন সময়ে আমরা যে সকল পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা আর চেতনার মধ্যে দিয়ে যাই, সেগুলির উপর ভিত্তি করে। স্মৃতি এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নানান অনুষঙ্গ এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলিতে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিচ্ছবি, অনুভূতি আর ধারণা ক্রমসজ্জিত অবস্থায় থাকে। আমাদের আবেগ-অনুভূতিগুলি বিভিন্ন সময়ে আর পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে জ্ঞানের একেকটা প্রবেশপথ খুলে দেয়। আমাদের মন যে মুহূর্তে আমাদের ভেতরের খুব ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অসংখ্য চৈতন্যকে একসাথে জড়ো করে, সে মুহূর্তে মনের সক্রিয়তা সবচাইতে বেশি থাকে। সেসব মুহূর্ত বাদে অন্যান্য সময়ে আমাদের মন অনেকটা নিস্ক্রিয়ভাবেই বিবিধ বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে থাকে। একই সাথে মনের মধ্যে জমা হতে থাকে সাধ, কাজ, আবেগ, এবং কৌতূহলের নানান মাত্রিক রহস্যময় বিন্যাস। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমেই কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা জ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন উদ্দীপক। মনের ধরন, গঠন আর প্রতিবেদ পরিস্থিতিলব্ধ জ্ঞান আর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সময়ে-সময়ে বদলাতে পারে। আমাদের মানসিক জীবনযাপনের ধরনটা স্রেফ আনন্দ আর বেদনার অনুভূতির সাথে বিভিন্ন বাহ্যিক ধারণার একটা যোগসূত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।

যেখানে জীবন, সেখানেই কাজ। প্রাণীর কাজকর্মের ধরন প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। আশেপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারলে, জীবন টিকে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশই প্রাণীর আচরণকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি, প্রাণীও তার নিজস্ব প্রয়োজন মাফিক আশেপাশের পরিবেশকে কিছুটা নিজের মতো করে গড়ে নেয়। পরিবেশ এবং প্রাণীর মধ্যকার এই মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাণী বেড়ে ওঠে। ফলে, এক্ষেত্রে প্রাণীর আচরণ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি, প্রকৃতি থেকে যে অভিজ্ঞতাগুলি প্রাণী লাভ করে, পুরোপুরি সেগুলি দ্বারা প্রভাবিত। একটা কাজ নানানভাবে করা যায়। কে কীভাবে কাজটা করে, সেটা নির্ভর করে তার অভ্যাস, স্বাচ্ছন্দ্য বা অতীত অভিজ্ঞতার উপর। কেউ হাত ব্যবহার করে খাওয়াদাওয়া করে, কেউ বা ব্যবহার করে চামচ কিংবা কাঠি। প্রাণী তার নিজস্ব মনোদৈহিক গঠন আর প্রয়োজন অনুযায়ী তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে মিল রেখে বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে ক্রমে-ক্রমে অভ্যাসে পরিণত করে। এই অভ্যাসগুলিই পরবর্তীতে ভিন্ন-ভিন্ন পরিবেশে প্রাণীর আচরণ নির্ধারণ করে দেয়। কোনো একটা কাজ করা এবং সে কাজের ফলাফলের মধ্যকার সম্পর্কই মূলত অভিজ্ঞতা। বিচ্ছিন্ন দুএকটি ঘটনা বা কাজের আকস্মিক ফলাফলকে অভিজ্ঞতা বলে না। অভিজ্ঞতা ব্যাপারটা কোনো একটি কাজ একইভাবে একাধিকবার করার ফলে হয়। একটা কাজ করতে গিয়ে ভুল হতে পারে। সে কাজটিতে ততক্ষণ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা তৈরি হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে।

একটা কাজ বারবার করার সময় অভিজ্ঞতা তৈরি হতে থাকে। সে অভিজ্ঞতা কাজটির এবং কাজটির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা, পরিবেশ, অনুষঙ্গ আর ফলাফলের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়। সে সমন্বয় সাধনের সময়ই চেতনার একধরনের অন্তর্জগত সৃষ্টি হয়। এই চেতনা, আবেগের সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা যোগসূত্র স্থাপন করে। মানুষের জীবনে চেতনার প্রভাব জ্ঞানের চাইতে অনেকবেশি। এই চেতনার সাথে বুদ্ধি বা মেধার সম্পর্ক অতোটা নেই বললেই চলে। চেতনা হচ্ছে মানুষের আদিমতম শুদ্ধতম অনুভূতিজাত প্রবাহ। মূলত অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং ধারণা থেকেই চেতনার জন্ম। এই চেতনাই মানুষের আচরণকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। চেতনা ব্যাপারটা জ্ঞানের বৃহৎ বা ক্ষুদ্র পরিসরের বিভিন্ন অনুঘটকের কোনোটিতেই পড়ে না। ভাল বা মন্দ, যথার্থ বা অযথার্থ, এরকম কোনো ধারণাই চেতনাকে বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত করে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো ধরনের প্ররোচনা, প্রণোদন, সংপ্রশ্ন মানুষের চেতনাকে উদ্রিক্ত এবং উদীপ্ত করে, সেখানে প্রকৃত জ্ঞানের কোনো সংস্রব থাকুক আর নাই থাকুক। চেতনা হচ্ছে জ্ঞানের প্রাথমিক ধাপ। জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতকে নিজের মতো করে মানিয়ে নেয়ার যে প্রক্রিয়া, তার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে, কোনোকিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা বাড়ে। অভ্যাস, স্বভাব, চরিত্র, কাজ করার বা না করার প্রতি উৎসাহ, এসবকিছুই আমাদের চেতনার দ্বারা প্রভাবিত। জ্ঞান বা বুদ্ধিমত্তার উৎপত্তিও সেখান থেকেই। এই যেমন, মরু অঞ্চলের মানুষ আর মেরু অঞ্চলের মানুষের জ্ঞান বা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক বা পরিমাপক একই রকমের হবে না, এটাই স্বাভাবিক, কারণ ওই দুই অঞ্চলের মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ধরনের চেতনা ধারণ করে। ভৌগোলিক বিভাজন চেতনার বিভাজনে ভূমিকা রাখে।

শিশুরা চুপচাপ সবকিছুই শুনে যায়, বোঝার চেষ্টা করে, এবং সাধারণত কোনটা গ্রহণ করা উচিত, কোনটা গ্রহণ করা উচিত নয়, সেটা না বুঝেই সবকিছুই গ্রহণ করে। প্রকৃতির কাছ থেকে এভাবে করে শিখতে শিখতে শিশু বড় হয়। সবকিছু গ্রহণ করলেও সবকিছুই ধরে রাখা যাবে না, তাই কোনটা কোনটা ধারণ করে শিশু বেড়ে উঠবে, সেটা ঠিক করাটা জরুরি। বাবা-মা, বড় ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সহ অন্যান্যরা ঠিক করে, কোন কোন জিনিস শিশু তার অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস আকারে ধারণ করবে। তারা সবসময়ই শিশুকে শেখাতে থাকেন, এটা কর, এটা বল, এটা খাও, এভাবে চল, ওটা করা যাবে না, ওটা ধরা যাবে না, ওটা বলা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। শিশু যে সমাজ ও পরিবারের সদস্য, সে সমাজ ও পরিবার শিশুকে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন নিয়ম, বিধি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদি পালন করতে শেখায়। এভাবে করে সে তার আচার-আচরণ, ব্যবহার, বিশ্বাস, অভ্যাস গঠন করে। রীতিনীতি, প্রথা, সামাজিকতা একেক দেশে, একেক সমাজে একেকরকমের। ছোটকাল থেকে বা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি মানুষকে নির্দিষ্ট ধাঁচে ভাবতে আর কাজ করতে শেখায়। একই কাজ একইভাবে অনেকবার করলে সেটা মানুষের মধ্যে অভিজ্ঞতা আকারে প্রোথিত হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় কোনো যুক্তি বা বুদ্ধিমত্তার বিন্দুমাত্রও ভূমিকা নেই। অভিজ্ঞতা এবং অভ্যাসের জন্ম অনেকটা কোনোকিছুকে অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমেই হয়। অভিজ্ঞতা হতে ভূয়োদর্শনের জন্ম। ভূয়োদর্শন হতে জ্ঞানের জন্ম। জ্ঞান হতে বিচক্ষণতার জন্ম। বিচক্ষণতা থেকে বাস্তব-সংগতিবোধের জন্ম। এই বোধ মানুষকে অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্তি দেয়। মানুষ তার নিজস্ব প্রজ্ঞা এবং বিচার-ক্ষমতা দিয়ে সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজনে অতীতের নানান অন্ধ বিশ্বাস, প্রথা, আচরণ থেকে আস্তে-আস্তে সরে আসে। প্রকৃত ঘটনা আর ধারণা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী নিজেকে বদলে বা খাপ খাইয়ে নিতে শেখে। অভ্যাস, বিশ্বাস আর চর্যা সময়ের সাথে মিলিয়ে নিয়ে বদলাতে না পারলে নিজের পরিবর্তন বা উন্নয়ন, এর কোনটাই সম্ভব নয়। অন্য অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যেতে চাইলে সবার আগে দরকার বর্তমানের জীবনযাপনটা বদলানো।

যেকোনো ধারণার জন্ম হয় প্রকৃতি থেকেই। জন্মের পর ধর্ম সেটিকে পরিশুদ্ধ করে, বিবিধ ললিতকলা সেটিকে নান্দনিকতা দেয়, শিক্ষা সেটিকে অন্তরে উপ্ত করে, এভাবে করে একসময় সেটি সর্বজন স্বীকৃত ও গৃহীত হয়ে যায়। তখন তা আর ধারণা থাকে না, প্রথা হয়ে যায়। কোনো বিষয় সম্পর্কে অতীতের অভিজ্ঞতা বা চর্চা প্রথার জন্ম দেয়। উন্নত এবং সময়োপযোগী কোনো নতুন প্রথাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতেও পুরনো বিধিপদ্ধতি, রীতিনীতি, নিয়মকানুন হতে ধারণা নিতে হয়। অতীতের মন্দকিছুই ভবিষ্যতের ভালকিছুর সূতিকাগার। এই সবকিছুই সৃষ্টি হয় প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতিকে অভিনব কোনো উপায়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কারণ যেসব উপায় অনুসরণ করে আমরা পরিবর্তনের কাজটি করি, সেগুলিও আসে প্রকৃতি থেকেই। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে কার্যকারণ আর বাস্তবতার নিরিখে নতুন ধারণা আর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে হালনাগাদ করতে হয়।

বুদ্ধিমত্তা জিনিসটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক। অতীতের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের চাহিদা অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কোনো নির্দিষ্ট কাজ নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকভাবে করতে পারার ক্ষমতাই হল বুদ্ধিমত্তা। যুক্তিশাসন ও বাস্তব-সংগতি অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তার রূপ বদলায়। এই বুদ্ধিমত্তা আমাদের অতীত প্রথা, অজ্ঞতা আর বিশ্বাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে। বুদ্ধিমত্তাকে সবসময়ই অভিজ্ঞতা আর পরিস্থিতি অনুযায়ী পরখ করে নিতে হয়। প্রতিনিয়ত চর্চা করে-করে কোনো প্রচলিত ধারণা বা প্রথাকে সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করার মাধ্যমে কোন অবস্থায় কোন কাজটি কোন পথ অনুসরণ করে করা উচিত, সেটা জানা যায়। এটা দরকার অনুযায়ী বদলেও নেয়া যায়। বুদ্ধিমত্তা একেবারে চিরস্থায়ী ধ্রুব কোনোকিছু নয়। এটির গঠন, পুনর্গঠন, বিভাজন চলতেই থাকে। স্থান ও কালের পরিবর্তনের সাথে-সাথে বুদ্ধিমত্তারও পরিবর্তন হয়। এর সাথে আমাদের আচরণগত নানান ধরনের পরিবর্তন আসে। এক এলাকার আচরণ আরেক এলাকার লোকজনের কাছে অদ্ভুত অযৌক্তিক মনে হতে পারে। কিন্তু সে আচরণের আদ্যন্ত ভালোভাবে জানলে হয়তো তা আর বেখাপ্পা বেমানান ঠেকবে না। আংশিক বা ভুল ব্যাখ্যা আমাদের প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। কোনো একটি ঘটনা কেন ঘটল? ওভাবেই বা কেন ঘটল? ওইসময়েই বা কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই মোটামুটিভাবে সর্বজনগৃহীত একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সবাই যা ভাবে, সবাই যা বিশ্বাস করে, সবাই যা মানে, তা সবসময় সত্য নাও হতে পারে। তাই, যুক্তির প্রতিষ্ঠা-প্রক্রিয়াতেও কখনো-কখনো গলদ থেকে যায়। এর চাইতে বরং অভিজ্ঞতা থেকে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, তা বারবার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ভিন্ন-ভিন্ন পরিবেশে যাচাইবাছাই করে গ্রহণ বা বর্জন করা শ্রেয়। পরীক্ষিত ও নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে গৃহীত সত্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত না নিলে ব্যর্থতা, দুঃখ, হতাশা, নৈরাশ্য, এমনকি জাতীয় জীবনে বিপর্যয় পর্যন্ত নেমে আসতে পারে।

বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি বা যুক্ত্যাভ্যাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্যক্তি কিছু-কিছু পূর্ব-নির্ধারিত নীতি, আইন, প্রথার প্রতি তার নিজের মানসিক দাসত্বকে মেনে নেয়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব গিয়ে পড়ে ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপনে, এমনকি অভ্যাস, আচার আর বিশ্বাসেও। সমাজে কিছু-কিছু ধারণা প্রচলিত, যেগুলি নিরীক্ষা বা অভিজ্ঞতার সাহায্যে যাচাই বা ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সেগুলিকে মেনে নিতে হয়। ওসব সংস্কার বা ধারণাকে বাদ দিয়েও চলা সম্ভব নয়, কারণ ওগুলিকে বাদ দিলে সমাজে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, অন্যায় বেড়ে যেতে পারে। বোধ আর চিন্তা, অভিজ্ঞতা আর যুক্তি, বিশ্বাস আর বাস্তবতা—এসব ধারণার মধ্যকার আপাত পরস্পরবিরোধী যে অনড় অবস্থান, সেটা আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে। যখন প্রচলিত নিয়মকানুন কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারে না, মানুষ তখন কাণ্ডজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে কাজটা করে। কাণ্ডজ্ঞান আসলে কী? ধরুন, আপনি কোনো একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এটা করবেন, নাকি ওটা করবেন, নাকি কিছুই করবেন না, এরকম নানান ভাবনা আপনাকে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে দিচ্ছে না। যখন আপনি এমন একটা দোলাচলে, তখন দেখবেন, আপনার মনের ভেতরে যে ‘আমি’টা বাস করে, সেই ‘আমি’ আপনাকে কিছু একটা বলছে যেন, একটা তীব্র সংকেত পাঠাচ্ছে এবং আপনারও সে সংকেতটি গ্রহণ করতে ইচ্ছে করছে। ওই অদৃশ্য সংকেতটি অনেক শক্তিশালী, ওটাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। ওটার পোশাকি নাম Intuition বা স্বজ্ঞা, ওটা সকল বিশ্বাস, সকল অভিজ্ঞতা, সকল যুক্তি, সকল জ্ঞানের চাইতে বড়। যুক্তি দিয়ে হয়তো পুরো পৃথিবীটাকেও মেপে ফেলা যায়, কিন্তু স্বজ্ঞা দিয়ে পুরো জীবনটাকে মোটামুটি অনায়াসেই চালিয়ে নেয়া যায়। জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় আসে, যখন পুরো পৃথিবীর সব যুক্তিতর্ককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের মনের কথাটাই শুনতে হয়। জীবনটা যখন ব্যাখ্যাতীত হয়ে পড়ে, তখন ব্যাখ্যাহীনতায় ভর করে বাঁচার নামই জীবন!

একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করছি।

১০০ জন লোকের সামনে একটা ক্রিকেট ব্যাট আর একটা টেনিস বল রাখা হল। দেখলে সহজেই বোঝা যায়, ব্যাটটা অত্যন্ত দামি আর বলটা একেবারেই সস্তা। সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হল: “এই যে ব্যাট আর বল দেখছেন, এ দুটোর দাম মোট ১২০৪ টাকা। বলটির দাম ব্যাটের দামের চাইতে ১২০০ টাকা বেশি। বলুনতো, ব্যাটের দাম কত? যারা সঠিক উত্তর দিতে পারবেন, পুরস্কার হিসেবে তারা সবাই মালদ্বীপ ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। সময় ৫ মিনিট। স্টার্ট!” উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। সে গুঞ্জন ১০০ জনকে ২ ভাগে ভাগ করে ফেলল।

এক দল নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ব্যাটা আমাদের বেকুব পেয়েছে! আমরা যেন কোনোদিন ব্যাট-বল চোখে দেখিনি! ব্যাটের দাম বলের দামের চাইতে কম হয় আবার কীকরে? আর তাছাড়া ব্যাটটা দেখলেই বোঝা যায়, বেশ দামি। আর বলটা? এ বল ফ্রিতে দিলেও কোনো নির্বোধও নেবে না। এই বলটা ব্যাটটার চাইতে দামি হয় কোন যুক্তিতে? নিশ্চয়ই গাঁজা খেয়ে এসেছে ব্যাটা! আমাদের বোকা বানানোর ধান্দা আরকি! আমরা উত্তরটা দিই আর অমনিই ব্যাটা আমাদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশা শুরু করবে। ওসব মালদ্বীপ ফালদ্বীপ ফালতু কথা!……..এই দলের মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা আর যুক্তির উপর ভর করে কোনো উত্তরই দিল না, চুপ করে রইলো।

আরেক দল মানুষ খুব সহজেই অংক কষে উত্তরটা দিয়ে দিল: ব্যাটের দাম ২ টাকা।………হ্যাঁ, স্রেফ বিশ্বাসের উপর ভর করে ওরা মালদ্বীপে ঘুরতে চলে গেল। জীবনে জিততে হলে কখনো কখনো নির্বোধ হতে হয়।

কখন, কীভাবে কোন রস ঠিক মুহূর্তটিতে আমাদের অন্তরমহলকে জাগিয়ে তোলে, সে রসায়ন জেনেবুঝে কাজে লাগিয়ে পথচলার নামই বাঁচা।

Content Protection by DMCA.com