মানুষ দুইটা সময়ে সবচাইতে বেশি সম্মান পায়। এক। সে যেদিন বিয়ে করে। দুই। সে যেদিন মারা যায়।……….বিয়ে তো আমরা সবাইকেই করতে দেখি না। তবে মৃত্যুর পর মৃতদেহের প্রতি সম্মান সবাইকে পেতে দেখি। সব ধর্মেই মৃত ব্যক্তিকে সম্মান দেখাতে বলা হয়েছে। আমরা যখন বেঁচে আছি, তখন আমরা দেখতে পাই, কে আমাদের সম্মান করছে, কে করছে না। অনেকেই আমাদের সম্মান করে আমাদের দেখাতে কিংবা খুশি করতে। মৃত্যুর পর আন্তরিক সম্মান কয়জনই বা করে? কিংবা আদৌ করে কি কেউ? আমরা তো তখন দেখতে পাই না, বুঝতে পারি না কে সম্মান করছে, কে করছে না। পুরো পৃথিবী আমাদের অনুভূতি থেকে মুক্ত। বেঁচেথাকার সময় কত কায়দা করে রং মেখে নিজের নানান ইচ্ছেপূরণ করে বাঁচি। আর মৃত্যুর পর? কেউ আমাদের নাম ধরেও ডাকবে না। মৃতদের সবার নাম একটাই: লাশ কিংবা শব। তখন আমরা সাজলাম কি সাজলাম না, পরিচ্ছন্ন কি অপরিচ্ছন্ন, শেষযাত্রার জন্য প্রস্তুত কি অপ্রস্তুত, এইসব কিছুর তোয়াক্কা কে-ইবা করে? জাপানি মুভি ওকুরিবিটো (ইংরেজি তর্জমায় ডিপারচারস) মৃতদের তোয়াক্কা করতে শেখায়।
ডাইগো অর্কেস্ট্রাতে চেলো বাজায়। চাকরি চলে গেলে সে আরেকটা চাকরি নেয়। এনকফিনারের চাকরি—অন্যের মৃত্যুর উপর ভর করে টিকে থাকার চাকরি। মৃতদেহ পরিচ্ছন্ন করে যথাযোগ্য রীতিতে সাজিয়ে সম্মানের সাথে কফিনে রেখে দেয়ার কাজ। কাজটি খুব যত্নের সাথে করতে হয় ভালোবাসা ও মর্যাদা দিয়ে। সে সময় মৃত ব্যক্তির পরিবার ও পরিজন আশেপাশে থাকেন, তাঁরা বিভিন্ন আচার পালন করেন। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে জীবিতদেরই সময় দিতে দেয় না, সেখানে মৃতদের এতটা সময় দিয়ে মুছে, পরিচ্ছন্ন করে, নানা উপচার দিয়ে সাজিয়ে সৎকারের জন্য প্রস্তুত করার কথা কারো মাথায় আসার কথা নয়। এনকফিনাররা সেই কাজটাই করে। সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব পেশার মানুষেরই মৃত্যুর পর তাঁদের কাছের লোকজন এ সেবা পেতে পারেন। জীবিতদের সাথে জীবিতদের যে সম্পর্ক, জীবিতদের সাথে মৃতদের সম্পর্ক কিন্তু ভিন্ন রকমের। একজন মানুষ যেদিন মারা যান, সেদিন থেকে তাঁর সাথে আমাদের নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। নতুন সম্পর্কের শুরুটা করে দেয় এনকফিনাররা। তাদের হতে হয় নিখুঁত, পেশাদার। যে মৃতদেহটি সমাজসুদ্ধ লোকে অবজ্ঞার চোখে দেখে, সেটিকেই পরম যত্নে সৎকারের জন্য তৈরি করা—নিঃসন্দেহে খুবই সম্মানজনক কাজ।
প্রথম দিকে ডাইগো চাকরিটাকে সহজভাবে নেয়নি। একসময় সে কাজটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তার স্ত্রী যেদিন এ চাকরি সম্পর্কে জানতে পারে, সেদিনই ডাইগোকে বলে চাকরিটা ছেড়ে দিতে। ততদিনে মৃতদের প্রতি ডাইগোর এক ধরনের কমিটমেন্ট তৈরি হয়ে গেছে। কাজটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। সে তার স্ত্রীর কথা রাখতে পারে না। সময়ের সাথেসাথে স্ত্রীও ডাইগোর চাকরিটাকে মেনে নেয়। ডাইগোর বাবার মৃত্যুর পর ডাইগোর স্ত্রীই তাকে অনুরোধ করে যাতে সে বাবাকে শেষযাত্রার জন্য তৈরি করে দেয়। ডাইগো তার বাবাকে সহ্য করতে পারত না, কারণ বাবা তার ছোটবেলায় তার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই বাবার মৃতদেহটিকে কফিনে ওঠানোর আগে প্রস্তুত করার সময় ডাইগোর চোখ গড়িয়ে জল পড়ছিল। কাছের কাউকে স্পর্শ মানুষকে প্রবল মমত্ববোধে আক্রান্ত করে দিতে পারে। মৃত ব্যক্তির উপর কারো কোনো রাগ থাকে না। আর যদি ঘৃণিত মৃত ব্যক্তিটি হন বাবা, তবে ঘৃণার আগুন ভালোবাসার অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে।
এ মুভির একটা ডায়লগ মনে গেঁথে গেছে: তোমার জীবনের শেষ কেনাকাটাটি অন্যরা করে দেয়।………..কফিনকেনা নিয়ে এই কথাটি বলা হয়েছে। এ মুভি যতই সামনের দিকে এগোয়, ততই মনে হতে থাকে, মৃত্যুর আগেই যতটা বেঁচে নেয়া যায়, বেঁচে নাও! মৃত্যুর পর তোমার ছায়াটাও তো সাথে আর থাকবে না। বেঁচেথাকাই আনন্দ। মুভির গল্পটা মূলত মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের গল্প। এমন কোনো উপায়ে বাঁচাটা অপরিহার্য নয়, যেমন করে বাঁচলে মৃত্যুর সময় কারো অভিশাপ নিয়ে মরতে হয়। মুভির প্রোটাগনিস্ট ডাইগো খুব কাছ থেকে অনেক মানুষের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে। যতই মৃত্যুকে দেখে, ততই সে জীবনকে চিনতে পারে। যখন ডাইগোর চেলোতে অমর সুর বেজে ওঠে, তখন যে সে সুর জীবন ও মৃত্যুকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আমাদের মনে হাজারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। এ মুভির প্রসঙ্গ জীবন ও মৃত্যু। বারবার মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েও সিনেমাটি আমাদের এক ধরনের নিরুত্তাপ, নিরাবেগ, নাটকীয়তা বর্জিত পরিবেশেই রেখে দেয় শেষ পর্যন্ত।
মুভিতে বলে, অতীতে যখন বর্ণমালা আবিষ্কৃত হয়নি, তখন মানুষ পাথর-চিঠির মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করত। পাথরের ওজন এবং গঠনবিন্যাস পাথরদাতার মনের খোঁজ দিত। যেমন, মসৃণ গঠনের পাথর দাতার শান্তিপূর্ণ মনের খোঁজ দিত, আবার অমসৃণ গঠনের পাথর বলে দিত, কারো কথা ভেবে দাতার মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। ‘ডিপারচারস’ আমাদের হাতে কিছু পাথর-চিঠি ধরিয়ে দেয়। পাথরগুলির মধ্যে কিছু মসৃণ, কিছু অমসৃণ, আবার কিছু এমন, যা মসৃণও নয়, অমসৃণও নয়।