এখন আমার একটাই কাজ করার বাকি: নাথিং। আমার কোনো জিনিসপত্র দরকার নেই, কোনো স্মৃতিই আমার লাগবে না। বন্ধু কি ভালোবাসা, কিছুই লাগবে না আমার। এগুলি সবই ফাঁদ।…….জীবনটাকে এভাবে দেখছে কেন জুলি? কী হয়েছিল তার?
“একটু কাশবে?”
…………এইটুকু বলেই বেচারা মারা গেলেন। তাঁর শেষকথা। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। গাড়িটা নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। হঠাৎ ঘন কুয়াশা! নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি গিয়ে পড়ল একটা গাছের উপর। প্রচণ্ড জোরে। একেবারে দুমড়েমুচড়ে গেল! স্ত্রী-ই কেবল বেঁচে রইলেন। গাড়ির পেছনের ডানের দরোজাটা খুলে শিশুটির খেলার বলটি মাটিতে এদিকওদিক গড়াচ্ছে। চারিদিকে নিস্তব্ধ কুয়াশা। স্ত্রীর খুব কাশির সমস্যা ছিল, সারাক্ষণই কাশতেন। এতটাই যে, কাশির শব্দ শোনাটা ভদ্রলোকের অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। শেষবারের মতো তিনি অভ্যাসযাপন করতে চাইলেন। এর নাম কী? ভালোবাসা? নাকি নিছকই অভ্যেস?
‘থ্রি কালারস: ব্লু (১৯৯৩)’ ফিল্মের স্ক্রিপ্টটা আমি লিখলে ‘একটু কাশবে?’-এর পেছনের গল্প উপরের মতো করে সাজাতাম। ক্রিস্তফ কিসলোভস্কির অতোটা অপরিপক্ব নন। দৃশ্যকে দিয়ে কথা বলানো, এ কাজে তাঁর নৈপুণ্য বিশ্ববন্দিত। এ মুভিতে তাঁর কারিশমার কিছু নমুনা দেখা যাক।
স্বামী প্যাট্রিসের মৃত্যুর পর জুলি জানতে পারল, একজন আইনজীবীর সাথে প্যাট্রিসের প্রণয়সম্পর্ক ছিল। মেয়েটিকে প্যাট্রিস ভালোবাসত, মেয়েটির গর্ভে প্যাট্রিসের সন্তান। ওরা কেউ সন্তান নিতে চায়নি, ভুলে হয়ে গেছে। প্যাট্রিসের মৃত্যুর পর মেয়েটি তা জানতে পারে, এখন সে ভ্রূণটিকে নষ্ট করতে চায় না। আরো জানল, স্ত্রীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্যাট্রিস সবসময়ই বলত, মানুষ হিসেবে জুলি অসাধারণ। প্যাট্রিস কি জুলিকে ভালোবাসত? নাকি কেবল সম্মানই করত? মেয়েটি জুলিকে যখন বলে, তুমি এখন থেকে ওকে আর আমাকে ঘৃণা করবে, জুলি উত্তরে বলে, জানি না। “তুমি জানতে চাও আমরা কোথায় শুতাম? মাসে কয়বার হত?” “না।” “তুমি জানতে চাও সে আমায় ভালোবাসত কি না?” “হ্যাঁ, আমি ওটাই জানতে চাই।” “হ্যাঁ, বাসত…….” এইটুকুর পর জুলি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, মেয়েটি আবারো জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখন থেকে আমায় ঘৃণা করবে, না?” উত্তরে জুলি কিছুই বলল না। বেরিয়ে গেল। এবং, সে, প্যাট্রিস ও তাদের সন্তান যে বাড়িতে থাকতো, সে বাড়িটি মেয়েটির নামে লিখে দিল। কেন? স্বামীকে ভালোবাসত বলে? নাকি স্বামীর অনাগত সন্তানের জন্য ভালোবাসা অনুভব করে?
প্যাট্রিস ছিল নামকরা মিউজিক কম্পোজার। তার মৃত্যুর পর তার কম্পোজার বন্ধু অলিভার প্যাট্রিসের কিছু ব্যক্তিগত ছবি জুলিকে দিতে চায়। স্মৃতি রাখতে চায় না বলে জুলি সেগুলি নিতে চায়নি। পরে সেগুলি চলে যায় এক টিভি চ্যানেলের হাতে। ওরা এক টকশোতে সেগুলি প্রচার করে। সেখানে সেই মেয়ের সাথে প্যাট্রিসের কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি ছিল। পরে অলিভারকে জিজ্ঞেস করলে তার কাছ থেকে প্যাট্রিসের পরকীয়া সম্পর্কের কথা জুলি জানতে পারে। জুলির তখন মনে হয়, প্যাট্রিসের মৃত্যুর পর যখন ছবিগুলি অলিভার জুলিকে দিতে চেয়েছিল, তখন নিয়ে নিলেই ভাল হত। তাহলে রিপোর্টাররা সেগুলি আর পেত না, প্যাট্রিসের পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে টিভিতে দেখতেও হত না। স্বামীর যতো সৃষ্টি, অসমাপ্ত সৃষ্টি, সবকটাই সে নষ্ট করে ফেলেছিল স্মৃতি রেখে দিতে চায় না বলে। জীবন থেকে পুরনো স্মৃতিকে বিদায় করে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাই নিশ্চয়ই ছবিগুলির প্যাকেটটা নিয়েই সে পুড়িয়ে ফেলত, খুলেও দেখত না। আর খুলে না দেখলে প্যাট্রিসের পরকীয়া সম্পর্কেও জানতে পারত না। সেটাই সবচেয়ে ভাল হত। একজন মৃত মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে, পুরনো ভালোবাসা নষ্ট করে বাঁচা খুব কঠিন। ওতে কেবলই নিজেকে শাস্তি দেয়া হয়।
রেস্টুরেন্টের টেবিলে একটা খালি বোতল। বোতলের মুখ খোলা। সেখানে একটা চামচ ঢুকানো। ওটা নড়ছে, নিচের অংশটা বোতলের ভেতরে গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, শব্দ হচ্ছে, চামচের মুখের উল্টোপিঠে জুলির মুখটা দেখা যাচ্ছে। টেবিলে জুলি একা বসে আছে। নিঃসঙ্গতার অপূর্ব দৃশ্যায়ন! আরেকটা। স্বামীর মৃত্যুর পর জুলি তার ব্যাগে একটা ললিপপ খুঁজে পায়। ওটা প্যাট্রিসের দেয়া। সেটিকে তীব্র আবেগ আর নৈরাশ্যে চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্যটি মনে বাঁধাই করে রাখার মতো! আরেক দৃশ্যে, প্যাট্রিসের মৃত্যুর পর গৃহপরিচারিকা কাঁদতে থাকে, জুলি তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কাঁদছ কেন? উত্তর এল: তুমি কাঁদছ না, তাই। এ মুভির ডায়লগগুলি মনে বেশ জোরেই ধাক্কা দেয়!
দুর্ঘটনার সময় একটু দূরে একটা ছেলে বসে ছিল। ওদের যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তখন ছেলেটি একটা নেকলেস খুঁজে পায়। পরবর্তীতে সে নেকলেসটা জুলিকে ফেরত দিতে আসে। দুর্ঘটনার ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ের সে-ই ছিল একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। জুলিকে সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কিছু জানতে চাও? “না।” বলে নেকলেসটা ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। জুলি অতীতের কোনো স্মৃতি কিংবা চিহ্ন রেখে বাঁচতে চায় না।
আরেকটা দৃশ্য। জুলি রেস্টুরেন্টে কফি আর আইসক্রিম অর্ডার করেছে। সে আইসক্রিমের চওড়া গ্লাসে গরম কফি ঢেলে দিল। আইসক্রিম গলছে। জুলি আইসক্রিমটা চামচে তুলে খাচ্ছে। জীবনের শীতলতায় কিছু উষ্ণতা মিশিয়ে নেয়ার ব্যর্থ, তবু আন্তরিক চেষ্টা। বাইরে এক লোক বাঁশি বাজাচ্ছে। অপূর্ব সে সুর। জুলি ওদিকে তাকাচ্ছে, বাঁশি শুনছে, লোকটাকে পড়ছে। টেবিলে কফির কাপের ছায়া, পিরিচে কয়েক ফোঁটা কফি লেগে আছে, চামচটা কাপের পাশে পড়ে আছে। কফিতে আইসক্রিম গলছে, সুরের মায়ায় শূন্যতা দূরে সরে যাচ্ছে একটুএকটু করে।
পুরুষের কাছে ভালোবাসাটা আসলে কী? শরীরের মোহ? অলিভার বলে, সে জুলিকে ভালোবাসে। জুলিকে সে পেতে চায়। পুরুষের কাছে, একটা মেয়েকে পাওয়ার অর্থ মেয়েটার মন নয়, শরীর পাওয়া। ওটা পাওয়ার জন্য যে আকুলতা, পুরুষরা তার নাম দিয়েছে ভালোবাসা। জুলি এমনই ভাবে। অলিভারের চাওয়া সে একদিন পূরণ করে। জুলি আর দশটা মেয়ের মতোই, আলাদা কিছু না। তার শরীরে ঘাম হয়, তার কাশি আছে। তার নগ্ন শরীরে অনেক দাগ আছে। তাকে এতটা মিস করার কিছুই নেই। শরীরের নেশা কেটে গেছে, এখন অলিভারের নিশ্চয়ই আর কোনো চাওয়া নেই। এটার জন্যই তো এতদিন সে বলে আসছে, সে জুলিকে ভালোবাসে। তুচ্ছ এ শরীরের বিনিময়ে জুলি এ মিথ্যে থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। এরপর? সে বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা অসমান এবড়োথেবড়ো দেয়ালের গায়ে নিজের হাতের মুষ্টি ও আঙুল ঘষেঘষে অনেক দূর নিয়ে যায়, রক্তাক্ত করে ফেলে। অনুশোচনাবোধের কী চমৎকার প্রকাশ!
একটা দৃশ্যে জুলি একটা ক্যাফেতে বসে আছে। তার হাতে একটা সুগারকিউব। সে কিউবটি কাপ থেকে ৫ সেকেন্ডে কফিটা শুষে নিল। দৃশ্যটি নিয়ে পরিচালক কী ভেবেছেন? তাঁর মুখেই শোনা যাক:
ব্যাপারটা সহজ। আমরা দেখাতে চেয়েছি, নায়িকা তার চারপাশের পৃথিবীটাকে কেমন করে নিজের মধ্যে ধারণ করছে।………সে এখন আর বাইরের জগতটা সম্পর্কে আগ্রহী নয়। অন্যরা কে কী করছে, তা সম্পর্কে, এমন-কী যে মানুষটা তাকে ভালোবাসে, তার সম্পর্কেও তার কোনো আগ্রহ নেই। অনেক খোঁজার পর আজ সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। কোনোকিছু নিয়েই তার কোনো মাথাব্যথা নেই। তার সব মনোযোগ ওই সুগারকিউবটার উপরেই।
থ্রি কালারস: ব্লু। এ ফিল্মট্রিলজির পরের দুইটি রং হোয়াইট এবং রেড। মুভির একটা শটে দেখা যায়, জুলির হাতে একটা বাক্স, সেখানে লেখা ‘ব্ল্যাংকো’, স্পেনীয় শব্দ, এর অর্থ ‘সাদা’। পরের শট। জুলিকে পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে সে একটু থামে, তার বামদিকে নীল পোশাকের এক লোক হেঁটে যায়, ডানদিকে লাল পোশাকের এক মহিলা হেঁটে যায়। আরেক দৃশ্যে দেখি, সুইমিং পুলে সাদা আর লাল স্নানের পোশাকে বাচ্চারা লাফিয়ে পড়ছে। ফ্রান্সের পতাকায় এই তিনটি রং আছে। নীল হচ্ছে স্বাধীনতার প্রতীক, সাদা সমতার এবং লাল বন্ধুত্বের প্রতীক। ট্রিলজির প্রথমটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়।
জুলি তার অতীত মুছে বাঁচতে চেয়েছে। চোখের জলে নয়, মনের সাহসে। স্বামী ও কন্যার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে, এমন যা কিছু, সেসব থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। বাড়িটা, সে বাড়ির ফার্নিচার, অন্যান্য জিনিসপত্র, এমন-কী কম্পোজার স্বামীর মিউজিক্যাল কম্পোজিশন সহ সবকিছু থেকে। সে নিজেও চলে গেছে অন্য ঘরে। সিনেমায় নীল রঙের ব্যবহার নান্দনিক। জুলির পোশাকের রং নীল, প্যাট্রিসের সাথে তার প্রেমিকার ছবিতেও নীল পোশাক। শুরুতে মেয়ের হাতের ললিপপ আর পরবর্তীতে ব্যাগে পাওয়া ললিপপ, দুটোই নীল। সবকিছু বেচে দিয়ে যা সে রেখে দেয়, সে ঝাড়বাতির রং নীল, সুইমিং পুলেও নীল আলো। সিনেমাজুড়ে ছিল নীল শেডের সযত্ন ব্যবহার। এককথায়, জুলির অস্তিত্বের রঙই নীল। সে নীলে বিষাদ আর মুক্তি মেশানো। স্বামী আর কন্যার মৃত্যুর পর সব দুঃখ আর স্মৃতি দূরে সরিয়ে জুলি বারবারই নিজেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছে। পারিবারিক বন্ধন মুক্ত হয়ে একা থেকেছে, জীবনের পথটা একাই হেঁটেছে। তবু কি একাকীত্বই জুলির মনস্তত্ত্বের শেষকথা? সিনেমা দেখে তা মনে হয়নি। পরিবার নেই, তবু সে মানুষের ছায়াতেই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। তার মা আর অলিভারের কাছে ছুটে গেছে নানান কাজের ছুতোয় কিংবা স্রেফ নিঃসঙ্গতা তাড়াতে। মুখে যতই বলা হোক, বন্ধুত্ব, চাকরিবাকরি, ভালোবাসা, পরিবার-সহ সকল বন্ধন থেকে নিজেকে স্বাধীন রাখবো, বাস্তবে তার কতটুকু করা সম্ভব? জুলিও কি তা করতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত?
এ সিনেমায় চারটি দৃশ্যে পর্দায় সব রং চলে যায়, কেবল কালোরঙ চলে আসে। কেন? সেসময় ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজতে থাকে, ওই সময়কার আবেগকে ফুটিয়ে তুলে। জুলি তার অতীত জীবনের সব রং বিলীন করে দেয় কালো রঙের মধ্য দিয়ে, বর্তমানতাকে নিয়েই বাঁচে। জুলি মৃত স্বামীর সব সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে, অথচ নিজের মধ্যেই প্যাট্রিসের কম্পোজিশন অনুভব করেছে বারবার। সুইমিং পুলের পানিতে নিজেকে অনেক সময় ধরে ডুবিয়ে রেখে প্রায় মেরেই ফেলছিল, তবু যখন সে ভেসে উঠল, তখনই তার মাথায় পুরনো সুরের অস্তিত্ব টের পেল, সে সুর তার মৃত স্বামীর সৃষ্টি। পিয়ানোর পাশে দাঁড়ালে কিংবা সুরের কথা অবচেতন মনে এলেও সে ঠিকই সুরের স্রোতে নিজেকে ভাসতে দেখে। স্মৃতি, কামনা, কাজ কিংবা কোনো প্রত্যাশা না রেখেই বাঁচার যে অবিরাম ইচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার কাছেই হার মেনে যায়। ‘থ্রি কালারস: ব্লু’ যদিও একটা ট্রিলজির অংশ, তবু অন্য দুইটির কাহিনির উপর এর কাহিনি নির্ভরশীল নয়। সিনেমাটি স্বামী ও একমাত্র সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুর পর একজন নারীর বেঁচেথাকার গল্প, দুঃখ গিলে মুক্তি খোঁজার গল্প। জীবন কারো জন্যই থেমে থাকে না, যতো চেষ্টাই করা হোক, জীবন কখনোই বাঁধা কোনো নিয়মে চলে না, জীবন জীবনের নিয়মেই চলতে থাকে।