লিখিত পরীক্ষা দেয়াটা খুবই সহজ, লিখেটিখে দিয়ে আসলেই হয়; ফেল করা কঠিন বলে পাস করা আরও সহজ। শুধু পাস করার সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে ভাইভা পরীক্ষা দিতে পারবেন, আর কিছুই না। যদি ঠিকভাবে বুঝেশুনে পরিশ্রম করেন আর সেটাকে কাজে লাগাতে পারেন, তবে ভালভাবে পাস করার যথার্থ পুরস্কার হিসেবে চাকরিটা পাবেন। পরীক্ষার বাকি আর এক মাসও নেই। এ অল্প সময়ে কী করা যায়? কিছু বুদ্ধি দিই।
এক। এ সময়ে কোচিংয়ে দূরে থাক, নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়াও বাদ দিন। কোচিংয়ে বেশিরভাগ মেয়েরা যায় ঘরের কাজে ফাঁকি দেয়ার জন্য, আর ছেলেরা যায় মেয়েদের ফুচকা খাওয়ানোর জন্য। প্রিপারেশন প্রিপারেশন ভাব, প্রিপারেশনের অভাব। বাসায় বসে যত বেশি সম্ভব, পড়াশোনা করুন; দিনে কমপক্ষে ১৪-১৬ ঘণ্টা।
দুই। কোচিংয়ে মডেল টেস্ট না দিলেও ক্ষতি নেই। দিলেও, টেস্টের নম্বর দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি মূল্যায়ন করবেন না।
তিন। সম্ভব হলে, বাসার টুকিটাকি কাজের ভার এক মাসের জন্য অন্য কাউকে দিয়ে দিন।
চার। ফেসবুক থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন। ফেসবুকিংয়ের ফাঁকে পড়া নয়, পড়ার ফাঁকে একটুখানি ফেসবুকিং করুন।
পাঁচ। কে কতটুকু পড়ে ফেলেছে, সে খবর নেবেন না। আপনি যা যা এখনও পড়েননি, তা তা পড়ে নিন।
ছয়। যেসব প্রশ্ন বারবার পড়লেও মনে থাকে না, সেসব প্রশ্নকে গুডবাই বলে দিন।
সাত। যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা এ মাসের জন্য হয় চাকরি অথবা ঘুমটুম বাদ দিন।
আট। পড়তে বসার সময় মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপ হাতের কাছে রাখবেন না।
নয়। রাত ১১টার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ম্যাথস্, গ্রামার, অনুবাদ, মানসিক দক্ষতা প্র্যাকটিস করতে পারেন।
দশ। একটা বিষয় পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে জোর করে ঐ বিষয়টাই পড়তে থাকবেন না। বিশ্রামের টেকনিক হিসেবে, যে বিষয়টা ঐ মুহূর্তে পড়তে ভাল লাগে, সেটাই পড়বেন।
এগার। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী পড়বেন কম। বাকি ৪টা বেশি বেশি পড়ুন।
বার। যদি কোন বিষয়ের উপর প্রস্তুতি না নিয়ে এটা ধরে নেন যে, পরীক্ষার হলে ওটা এমনি এমনি পারবেন, তবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
তের। সব বিষয়ের সব টপিক অন্তত একবার হলেও পড়ে নিন। পড়তে না পারলে চোখ বুলিয়ে নিন।
চৌদ্দ। নিজের সাজেশনস্ রেডি করুন নিজে; সম্ভব হলে, একাধিক সেট। কারোর সাজেশনস্ অন্ধভাবে ফলো করবেন না।
পনের। প্রস্তুতি নেয়ার সময় এটা মাথায় রাখুন, আপনি প্রশ্ন কমন পাওয়ার জন্য নয়, বরং ধারণা থেকে লিখে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ষোল। কোন টপিক উত্তর করতে সর্বোচ্চ কত সময় নেয়া যাবে, সেটি প্রশ্নের গুরুত্ব ও নম্বরের ভিত্তিতে ঠিক করে লিখে রাখুন।
সতের। দাগিয়ে দাগিয়ে বারবার পড়ুন। পড়ার সময় বাড়তি তথ্য বইয়ে লিখে রাখুন।
আঠার। রেফারেন্স বই পড়ার সময় নেই। বাজারের কয়েকটা ডাইজেস্ট কিনে খুব দ্রুত পড়ে নিন।
উনিশ। আনকমন প্রশ্ন বলে কিছু নেই। কোন প্রশ্ন ছেড়ে আসা যাবে না; উত্তর জানা না থাকলেও ধারণা থেকে অন্তত কিছু না কিছু লিখে আসুন৷ ধারণা না থাকলে, কল্পনা থেকে লিখুন। কল্পনায় কিছু না এলে প্রয়োজনে জোর করে কল্পনা করুন! রিটেনে সবাই-ই বানিয়ে লিখে ক্যাডার হয়। নীল কালি ব্যবহার করে প্রতি পেইজে অবশ্যই অন্তত একটা প্রাসঙ্গিক চিহ্নিত চিত্র, ম্যাপ, উদ্ধৃতি, ডাটা, টেবিল, চার্ট কিংবা রেফারেন্স দিন।
বিশ। সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, টীকা, শর্ট নোটস্, সারাংশ, সারমর্ম, ভাবসম্প্রসারণ, অনুবাদ, ব্যাকরণ ইত্যাদি ভালোভাবে পড়ুন৷ নোট করে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না৷
একুশ। লিখিত পরীক্ষার সবচাইতে দরকারি টপিক হল অনুবাদ। যতই কষ্ট হোক, অবশ্যই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়কে নিয়মিত অনুবাদ করুন।
বাইশ। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় বিভিন্ন লেখকের রচনা, পত্রিকার কলাম ও সম্পাদকীয়, ইন্টারনেট, বিভিন্ন সংস্থার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা, বিভিন্ন রেফারেন্স থেকে উদ্ধৃতি দিলে মার্কস বাড়বে৷
তেইশ। প্রশ্ন নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১০ মার্কসের একটা প্রশ্ন উত্তর করার চাইতে ৪+৩+৩=১০ মার্কসের ৩টা প্রশ্নের উত্তর করা ভাল।
চব্বিশ। লেখা সুন্দর হলে ভালো, না হলেও সমস্যা নেই৷ লিখিত পরীক্ষায় অনেক বেশি দ্রুত লিখতে হয়৷ তাই গড়ে প্রতি ৩-৫ মিনিটে ১ পৃষ্ঠা লেখার চেষ্টা করুন।
পঁচিশ। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে যাঁরা লেখেন, এরকম ২৫-৩০টি নাম ডায়রিতে লিখে রাখুন। পাশে ছোট করে লিখে ফেলুন কে কোন ধরনের বিষয় নিয়ে লেখেন। উদ্ধৃতি দেয়ার সময় কাজে লাগবে।
ছাব্বিশ। কোন কোন সেগমেন্টে ক্যান্ডিডেটরা সাধারণতঃ কম মার্কস্ পায় কিন্তু বেশি মার্কস্ তোলা সম্ভব, সেগুলো নির্ধারণ করুন এবং নিজেকে ওই সেগমেন্টগুলোতে ভালোভাবে প্রস্তুত করে কম্পিটিশনে আসার চেষ্টা করুন৷
সাতাশ। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর জন্য প্রতিদিন অনলাইনে ৪-৫টি পেপার পড়ার সময় খেয়াল করুন কোন কোন বিষয়সমূহ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন ম্যাপ, ডাটা, চার্ট, টেবিল, পর্যালোচনা, নিজস্ব বিশ্লেষণ, সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে সেটির প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদির সাহায্যে লিখলে আপনার খাতাটি আলাদা করে পরীক্ষকের চোখে পড়বে।
আটাশ। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় যত বেশি সম্ভব তত পয়েন্ট দিয়ে প্যারা করে করে লিখবেন। প্রশ্নের প্রথম আর শেষ প্যারাটি সবচাইতে আকর্ষণীয় হওয়া চাই। বিভিন্ন কলামিস্টের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন ইস্যুকে ব্যাখ্যা করে উত্তরের শেষের দিকে আপনার নিজের মত করে নিজের বিশ্লেষণ দিয়ে উপসংহার টানুন। কোন মন্তব্য কিংবা নিজস্ব মতামত থাকলে সেটিও লিখুন।
এখন বিষয়ভিত্তিক কিছু আলোচনা করছি।
বাংলা: ব্যাকরণ, ভাব-সম্প্রসারণ (খুব প্রাসঙ্গিক ২০টি বাক্যে), সারমর্ম (২-৩টি সহজ সুন্দর বিমূর্ত বাক্যে), অনুবাদ—এই টপিকগুলোতে বেশি জোর দিন। পত্র লেখার সময় নিয়মে ভুল করবেন না। কাল্পনিক সংলাপের জন্য বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে ধারণা বাড়ান। গ্রন্থ-সমালোচনার জন্য কমপক্ষে ৩০টি সুপরিচিত বাংলা বই সম্পর্কে জেনে নিন। রচনার লেখার সময় মাইন্ড-ম্যাপিং করে পয়েন্ট ঠিক করতে থাকুন, আর ঘণ্টা পড়ার আগ পর্যন্ত লিখতে থাকুন।
ইংরেজি: ইংরেজিতে ভাল করার মূলমন্ত্র ২টি : এক। বানান ভুল করা যাবে না। দুই। গ্রামাটিক্যাল ভুল করা যাবে না। এই ২টি ব্যাপার মাথায় রেখে একেবারে সহজ ভাষায় লিখে যান, মার্কস আসবেই। কম্প্রিহেনশনের জন্য আইএলটিএস রিডিং পার্টের টেকনিকগুলো অনুসরণ করুন। কিছু প্রামাণ্য বইয়ের সাহায্যে কয়েকটি ডাইজেস্ট থেকে গ্রামার এবং ইউসেজ প্রচুর প্র্যাকটিস করুন। সামারির জন্য পেপারের সম্পাদকীয় আর আর্টিকেলগুলোকে সামারাইজ করার চেষ্টা করুন। লেটারের জন্য পত্রিকার লেটার টু দি এডিটর অংশটি দেখুন। এসেই কমন পড়বে না, এটা মাথায় রেখে সাজেশনস রেডি করে প্রস্তুতি নিন।
সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আগের বছরের আর ডাইজেস্টের সাজেশনসের প্রশ্নগুলো প্রথমেই খুব ভালভাবে যথেষ্ট সময় নিয়ে কয়েকবার পড়ে ফেলুন। বিজ্ঞানের প্রস্তুতি নেয়ার সময় আপনি বিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা ছাত্র না, এটা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নেবেন না। এ অংশে প্রয়োজনীয় চিহ্নিত চিত্র, সংকেত, সমীকরণ দিতে পারলে আপনার খাতাটা অন্য দশজনের খাতার চাইতে আলাদা হবে।
গাণিতিক যুক্তি: প্রতিরাতে কিছু না কিছু ম্যাথস্ প্র্যাকটিস না করে ঘুমাবেন না। শর্টকাটে ম্যাথস্ করবেন না, প্রতিটি স্টেপ বিস্তারিতভাবে দেখাবেন। কোন সাইডনোট, প্রাসঙ্গিক তথ্য যেন কিছুতেই বাদ না যায়। একটু বুঝেশুনে পড়লে অংকে ফুলমার্কস পেতে সায়েন্সের স্টুডেন্ট হতে হয় না।
মানসিক দক্ষতা: এ অংশের প্রশ্নগুলো হবে সহজ, কিন্তু একটু ট্রিকি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ভালভাবে প্রশ্ন পড়ে, বুঝে, পূর্ণ মনোযোগের সাথে উত্তর করতে হবে। ডাইজেস্টের পাশাপাশি ৩-৪টা আইকিউ টেস্টের বই সলভ করুন; সম্ভব হলে ইন্টারনেটে একটু প্র্যাকটিস করতে পারেন। এ অংশে ফুল মার্কস পাবেন না, এটা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিন।
বাংলাদেশ বিষয়াবলী: কোন কোন ধরনের প্রশ্ন আসে, সেটি সম্পর্কে খুব ভালভাবে ধারণা নিন। বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যাখ্যা, বিভিন্ন সংস্থার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল, কিছু আন্তর্জাতিক পত্রিকা ইত্যাদি থেকে তথ্য-উপাত্ত দিন। পুরো সংবিধান মুখস্থ করার কোনও দরকারই নাই। যেসব ধারাগুলো থেকে বেশি প্রশ্ন আসে, সেগুলোর ব্যাখ্যা খুব ভালভাবে বুঝে বুঝে পড়ুন। সংবিধান থেকে ধারাগুলো হুবহু উদ্ধৃত করতে হয় না।
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী: টপিকগুলো গুগলে সার্চ করে করে পড়তে পারেন। ইন্টারনেটে মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তরই পাবেন। উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, বিভিন্ন সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য, সমালোচনা পড়ে নিন। এ অংশের নতুন টপিক প্রবলেম সলভিং কোয়েশ্চেনে ভাল করার জন্য যে ইস্যু কিংবা সমস্যার কথা দেয়া থাকবে, সেটিকে বিশ্লেষণ করে নানা দিক বিবেচনায় সেটার সমাধান কী হতে পারে, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং আপনার নিজের মতামত ইত্যাদি পয়েন্ট আকারে লিখুন। এটিতে ভাল করার জন্য নিয়মিত পেপার পড়ার কোন বিকল্প নেই।
লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় দুটো ব্যাপার মাথায় রাখুন : এক। কী কী পড়বেন, সেটা ঠিক করার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, কী কী পড়বেন না, সেটা ঠিক করা। দুই। মুখস্থ করার দরকার নেই; শতভাগ শিখেছি ভেবে তার ষাটভাগ ভুলে গিয়ে বাকী চল্লিশভাগকে ঠিকমতো কাজে লাগানোই আর্ট৷ এ কয়দিনকে খুব ভালভাবে কাজে লাগান। যে চাকরিটা অন্তত ৩০ বছর আরাম করে করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন, সেটার জন্য মাত্র ২১ দিন নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে পড়াশোনা করবেন না, এরকম বেকুব তো নিশ্চয়ই আপনি নন! গুড লাক!!
এ লেখাটি গত ৫ আগস্ট বুধবার কালের কণ্ঠের ‘চাকরি আছে’ পাতার প্রধান ফিচার হিসেবে ছাপা হয়েছিল। লেখাটির লিংক নিচে দিচ্ছি :