জ্ঞান ভ্রম দূর করে। যেমন দড়িকে একবার স্পষ্টভাবে চিনে নিলে সব ভ্রম দূর হয়ে যায়, আর মনে দৃঢ় হয়—“এটি দড়ি ছাড়া আর কিছু নয়”—তেমনি একবার আত্মার সত্য স্বরূপ উপলব্ধি করা হলে সব ভ্রান্ত ধারণা (আমি দেহ, আমি সুখী-দুঃখী, আমি সীমাবদ্ধ) ভেঙে যায়। তখন আত্মা ধরা দেয় তার অদ্বিতীয়, অখণ্ড স্বরূপে।
জগৎও ভ্রমের মতো। স্বপ্নের মতোই এই জগৎ দেখা যায়। স্বপ্ন যতক্ষণ চলে, ততক্ষণ বাস্তব মনে হয়; কিন্তু জেগে উঠলে বোঝা যায়—অবাস্তব। এ হচ্ছে মরুভূমির মরীচিকার মতো—দেখা যায়, তৃষ্ণার্ত ছুটে যায়, কিন্তু আসলে কিছু নেই। আকাশকুসুম (আকাশে ফুল ফোটা বা দুর্গ থাকা)—এটাও একেবারেই কল্পনা, বাস্তবে হয় না। বেদান্তজ্ঞরা বলেন—এই বিশ্বজগৎও তেমনি, আসলে অদ্বৈত আত্মা ছাড়া অন্য কিছু নেই।
পরম সত্য এই—বাস্তবে না কোনো সৃষ্টি আছে, না কোনো লয় আছে। নেই কেউ “বন্ধনে”, নেই কেউ “মুক্তি চাইছে”, নেই কেউ “সাধনা করছে”, এমনকি নেই কেউ “মুক্তি পেয়েছে”—এই সবই কেবল ভ্রম, মায়া। চূড়ান্ত সত্য (Absolute Truth) এটা—কেবল অদ্বৈত ব্রহ্মই আছে, বাকিটা সব মায়ার খেলা। যেমন দড়ি সর্বদা দড়িই, তেমনি আত্মা সর্বদা ব্রহ্মই; ভিন্ন ভিন্ন রূপ কেবল মায়ার কল্পনা।
এক গ্রামে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তার চোখে পড়ল—একটা লম্বা বস্তু পড়ে আছে। সে আঁতকে উঠল, ভাবল—“সাপ!” অন্য কেউ বলল—“না, এটা হয়তো জলের রেখা।” কিন্তু ভোরে যখন আলো হলো, তখন দেখা গেল—এটা আসলে সাপও নয়, জলের রেখাও নয়, এটা ছিল শুধু একটা সাধারণ দড়ি।
যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ ভেবে ভয় হয়, তেমনি আত্মাকে ভুল করে আমরা দেহ, মন, সুখী-দুঃখী জীব ইত্যাদি ভাবি। আলো (জ্ঞান) আসার পর যেমন সব ভ্রান্তি দূর হয়, তেমনি আত্মার সত্য স্বরূপ জানা গেলে সব ভ্রম মুছে যায়।
ধরুন, আপনি রাতে স্বপ্ন দেখলেন—আপনার বড়ো বাড়ি আছে, প্রচুর সম্পদ আছে, শত্রুরা আক্রমণ করছে। ঘুম ভাঙলেই সব উধাও। কোনো বাড়ি নেই, কোনো শত্রু নেই—সব ছিল কেবল মনের কল্পনা। এই জগৎও তেমনি—স্বপ্নের মতোই বাস্তব মনে হয়, কিন্তু আসলে কেবল আত্মাই সত্য।
আবারও বলছি। আসলে কোনো সৃষ্টি নেই, কোনো লয় নেই। নেই কেউ সত্যিকারের বন্ধনে, নেই কেউ সত্যিকারের মুক্ত। “আমি সাধক, আমি মুক্তি পাব”—এগুলোও কেবল মায়ার খেলা। শুধু ব্রহ্মই আছে—অদ্বৈত, অবিনশ্বর, চিরন্তন। তাই বেদান্ত বলে—“আত্মা সর্বদা মুক্ত। ভ্রান্তিই তাকে বন্ধনে আবদ্ধ মনে করায়।”
“মাটি-ধাতু-স্ফুলিঙ্গ” ইত্যাদি দিয়ে সৃষ্টির বর্ণনা—এসব শুধুই শেখানোর কায়দা। শাস্ত্র কখনো বলে—ঘট-পাতিল সবই মাটির রূপ; গয়নাগাটি সবই সোনার রূপ; অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ প্রকৃতপক্ষে আগুনই। এসব উদাহরণ সত্যকে ধরতে সাহায্য করার জন্য বলা হয়, যেন আমরা বুঝি: বহু রূপের ভেতরে একটিই দ্রব্য/সার। কেন এখানে “বাস্তব ভেদ” নেই বলা হচ্ছে? ঘট-কলস-থালা দেখতে আলাদা, দ্রব্যে (মাটি) অভিন্ন। আংটি-চেইন-বালা দেখতে আলাদা, সোনায় অভিন্ন। এই রূপকের সাহায্যে বলা হচ্ছে: নামে-রূপে যত পার্থক্যই থাক, সারতত্ত্বে সব এক। তাই শাস্ত্রীয় “সৃষ্টি-কথা”গুলো উপায়, চূড়ান্ত বক্তব্য নয়। একই বিদ্যুৎ ফ্রিজ, পাখা, বাল্ব—ভিন্ন ভিন্ন রূপে কাজ করায়; যন্ত্র আলাদা, কারেন্ট কিন্তু এক।
“জন্মহীন সত্তা” শুধু মায়ায় ভিন্ন বলে মনে হয়। চিরন্তন–অপরিবর্তনীয় সত্তা (আত্মা/ব্রহ্ম) নিজে জন্মহীন। তবু তাকে “অনেক” বলে মনে হয়—এটা মায়ার ফল (উপাধি/অধ্যাস), বাস্তব ভেদ নয়। যদি ভেদ বাস্তব হতো, তবে অমর সত্তাকেই মর্ত্য/পরিবর্তনশীল ধরতে হতো—এটা অসংগত। রঙিন কাঁচে সূর্যালোক ঢুকলে আলো লাল/নীল দেখায়, যদিও সূর্য এখানে রং বদলায়নি। স্বচ্ছ স্ফটিকের পাশে লাল ফুল রাখলে স্ফটিক লাল দেখায়; এখানে স্ফটিকের গুণ বদলায় না। এভাবেই আত্মা অভিন্ন হলেও, উপাধি-মায়ায় ভিন্নরূপ প্রতীয়মান।
“অবাস্তব বস্তু”-র জন্ম হয় না—বন্ধ্যা নারীর পুত্র হয় কি? ‘তুচ্ছ’ আর ‘মিথ্যা’, এই দুই স্তরের পার্থক্য করা যাক। তুচ্ছ (একেবারে অবাস্তব): যেমন “বন্ধ্যা নারীর পুত্র”, “বর্গাকার বৃত্ত”—এগুলো কখনও জন্মায়ই না, হয়ই না—না ভ্রমে, না বাস্তবে। মিথ্যা/মায়া-জাত: যা দেখায় আছে, কিন্তু স্বতন্ত্র/পরম সত্য নয়—যেমন স্বপ্নশহর, মরীচিকা। “বন্ধ্যা নারীর পুত্র” উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে: যা একেবারেই অবাস্তব, তার ‘উৎপত্তি’ বলাই অর্থহীন। আর “জগৎ” প্রসঙ্গে বেদান্ত বলে—এটি পরমার্থে ‘না-সত্য’ (মিথ্যা/মায়া), এটি কেবলই ব্যবহার-স্তরে রয়েছে। ভিডিয়ো-গেইমে কোনো এক “চরিত্র জন্ম নিল”—এটাকে গেইমের ভেতর সত্যি লাগে; অথচ খেলোয়াড়ের স্তরে কিছুই জন্মায়নি।
এই মন না লুপ্ত, না ছড়ানো—এই মন স্থির হলে তা “ব্রহ্ম হয়ে যায়”। এর মানে কী? মন লুপ্ত নয় = অচেতন/অচৈতন্যে ডুবে যাওয়া সত্তা নয় (মন মূর্ছা/ঘুম নয়)। মন ছড়িয়ে নয় = ইন্দ্রিয়-বিষয়ে টানাটানি, কল্পনা-ছবির ভিড় যেখানে নেই। স্থির ও প্রতিচ্ছবিহীন = প্রশান্ত, অদ্বৈত-জ্ঞানের একাগ্রতায় স্বচ্ছ।
মন “ব্রহ্ম হয়ে যায়” মানে কী? এটা রূপান্তর নয়—মন ব্রহ্মে “বদলে” যাচ্ছে, এমন নয়। এর অর্থ: মন স্বচ্ছ আয়না হলে ব্রহ্ম-স্বরূপ নির্বিঘ্নে প্রতিফলিত/উদ্ভাসিত হয়; আত্মা-জ্ঞান প্রকাশ পায়। উপমার সাহায্যে বোঝা যাক। শান্ত হ্রদে চাঁদ সুস্পষ্ট; আর ঢেউ থাকলে বিকৃত। সিনেমা-পর্দা পরিষ্কার হলে ছবিও হয় স্পষ্ট। ধ্যেয়: মনকে অচেতন নয়, অচঞ্চল করা জরুরি—যাতে স্বরূপ-জ্ঞান জেগে ওঠে।
“কোনো ব্যক্তির জন্ম নেই”—উচ্চতম সত্যে অজাতে এ কথাটা কড়া শোনালেও, সূক্ষ্ম ব্যবহার-স্তরে জন্ম-মৃত্যু-কারণ-কার্য আছে—এটাই সামাজিক/বৈজ্ঞানিক নিয়ম। পরমার্থে (অদ্বৈত-দৃষ্টিতে) আদি-অন্ত নেই—আত্মা এক, জন্মহীন; নাম-রূপের ওঠানামা উপাধি-স্তরে। তাই বলা হয়: “কেউ জন্মায় না”—অর্থাৎ স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে কোনো “ব্যক্তি” পরমার্থে উদ্ভূত হয় না।
স্বপ্নে হাজার মানুষ “জন্মায়”, “মরে”—জেগে ওঠার পর জাগ্রত আপনার দৃষ্টিতে কারওই আসলে জন্ম হয়নি। ‘জন্ম’ কথাটা বলার জন্য স্বতন্ত্র কারণ-কার্য-সত্তা দরকার; পরমার্থে যেহেতু একটিই চৈতন্য, সেখানকারে “কারণ-কার্য”র জায়গা নেই। এটি নাস্তিক্য/শূন্যবাদ নয়; স্তর-বিভাগ বোঝাচ্ছে: ব্যবহারে দায়িত্ব, করুণা, নীতি—সবই মান্য; স্বরূপে আপনি জন্ম-মৃত্যু-অতিক্রান্ত।
বহুতে এক: মাটি—ঘট, সোনা–গয়না। এদের রূপ ভিন্ন, সার এক। ভেদ মায়া-জাত: সূর্য বদলায় না, রঙিন কাঁচে আলো বদলায়। পরমার্থে অজাতে: জাগরণের দৃষ্টিতে, স্বপ্নে কেউ জন্মায় না—তেমনি আত্মা-দৃষ্টিতে “জন্ম” নেই।
সৃষ্টির রূপক শুধুই শিক্ষার মই, আদতে সত্য নয়। ভেদ হচ্ছে মায়ার আরোপ, আত্মা সবসময়ই অভিন্ন। তুচ্ছ বস্তুর জন্ম নেই (বন্ধ্যা-পুত্র), অন্যদিকে জগৎ…সে তো মায়ায় প্রতীয়মান। মন অচঞ্চল এবং সচেতন হলে মনে আত্মা-জ্ঞান প্রকাশ পায়। পরমার্থে অজাতে (‘অজাতে’ মানে জন্মহীন, যা কখনও উৎপন্ন হয়নি)—চূড়ান্ত সত্যে কোনো জন্ম নেই, কোনো সৃষ্টি নেই, কোনো ধ্বংসও নেই—যা আছে, সেটাই সর্বদা আছে—অদ্বিতীয় ব্রহ্ম; কেউ জন্মায় না, কিছুই জন্মায় না—এক ব্রহ্ম বাদে।
একজন মৃৎশিল্পী মাটির ঘর তৈরি করল—তার সাথে ঘট, কলস, থালা, খেলনা। সব দেখতে আলাদা, কাজও আলাদা। কিন্তু মূল উপাদান? সবই মাটি। একজন সোনার কারিগর আংটি বানাল, চেইন বানাল, বালা বানাল। সব আলাদা রূপে, কিন্তু সারটা একটাই—সোনা। এইভাবে শাস্ত্রও পৃথিবী-ধাতু-স্ফুলিঙ্গের উদাহরণ দেয়—বহু রূপ দেখে মানুষ যেন বুঝতে পারে: “রূপে ভেদ আছে, সারতত্ত্বে নেই।”
ভেদ কেন মায়া?—অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে মনে হলো। দড়ি বদলায়নি, কিন্তু ভুল ধারণায় সাপ প্রতীয়মান হলো। ঠিক তেমনি জন্মহীন আত্মা—মায়ার কারণে বহু-ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। যদি এই ভিন্নতা সত্যিই বাস্তব হতো, তাহলে অমর আত্মাকেই মর্ত্য ধরতে হতো—যা একেবারেই অযৌক্তিক।
বন্ধ্যা নারীর পুত্র: কোনোদিন জন্মায় না। চৌকো বৃত্ত: একেবারেই অকল্পনীয়। এরা যেমন বাস্তব নয়, ভ্রমেও জন্মায় না—তেমনি “অবাস্তব জগৎ” পরমার্থে নেই—স্বপ্ন বা মরীচিকার মতো শুধু দেখায় আছে।
যদি মন লুপ্ত হয়, তখন আসে অচেতন অবস্থা (অজ্ঞান)। যদি মন ছড়িয়ে পড়ে, তার মানে হয়—কামনা-কল্পনায় জড়িয়ে থাকা। কিন্তু—যখন মন না লুপ্ত, না ছড়ানো, বরং শান্ত, প্রতিচ্ছবিহীন, অচঞ্চল, তখন সেই মন আয়নার মতো ব্রহ্মকে প্রতিফলিত করে। তখনই আত্মস্বরূপ প্রকাশিত হয়।
অজাতে (জন্মহীন সত্য)—শাস্ত্রের উচ্চারণ: “কোনো ব্যক্তির জন্ম হয় না।” কারণ জন্ম মানে “কারণ-কার্য সম্পর্ক”—আর পরমার্থে কেবল একটাই চৈতন্য, তার কোনো দ্বিতীয় কারণ নেই। যেমন স্বপ্নে হাজার মানুষ জন্মায়-মরে, কিন্তু জেগে উঠলে বোঝা যায়—আসলে কেউ জন্মায়নি।
সৃষ্টিকথা হচ্ছে শিক্ষার মই, ভেদ হচ্ছে মায়ার আরোপ। অবাস্তব হচ্ছে, যা কখনও জন্মায় না (যেমন বন্ধ্যার গর্ভে সন্তান)। মন স্থির হলে আত্মা প্রতিভাত হয়। ‘পরমার্থে অজাতে’ মানে—কেউই জন্মায় না, কিছুই জন্মায় না—থাকে শুধুই অবিচল ব্রহ্ম। যেমন দড়ি সবসময় দড়িই থাকে, তেমনি আত্মাও সবসময় ব্রহ্ম—ভিন্ন রূপ-রং-কায়া কেবলই মায়ার খেলা।