প্রেমে পড়েযাওয়াটা আসলে কী? এটা হল একধরনের পোকা যেটা কারও মাথায় একবার ঢুকে গেলে ওর আরও পোকাবন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে মাথায় নিয়ে আসে। অনেকগুলি পোকা মিলে মাথার ভেতরে সারাদিন পিকনিক করতে থাকে। সেই পিকনিকে অনেক হৈচৈ হয়। পোকাদের মধ্যে কেউ-কেউ একটু নেতাগোছের। ওরা নানান বক্তব্য দিতেই থাকে, দিতেই থাকে। কীরকম? ধরা যাক, একটা পোকা বেশ ফুড়ুৎফারুৎ করে ওড়ে। ও বলবে, আমার হেলেদুলে ওড়াপোকা পছন্দ। আরেকটা ওড়ে না, শুধুই ঝিমায়। ওর আবার পছন্দ ওর মতই ঝিমানোপোকা। এরপর সবাইই যার-যার পছন্দমত পোকাদের ডেকে নিয়ে আসে সেই একই মাথার ভেতর। এর মানে কী দাঁড়াল? আগে যদি ১০টা পোকা থাকে, তবে এখন আছে ১০ জোড়া। ব্যাপারটা ভাবতে খুব মজার না? হ্যাঁ, মজারই! আর যার মাথায় পোকাগুলি মহানন্দে দিনের পর দিন হানিমুন করছে, ওর মাথায়ঢোকা পোকাগুলির সাথে সাথে ওর ভাবনাগুলিও বদলায়। কীরকম? এই যেমন, একটা পোকার সাথে আরেকটা পোকার কনভারসেশন শোনা যাক। “ফ্রাইড রাইস?” “না, সাদা ভাত।” “আচ্ছা, ঠিক আছে। ওটাই বেটার।” কিংবা, “লাল?” “না, নীলই তো ভাল!” “কী যে বল না তুমি! নীল? তাও আবার রাতে?” “ঠিক আছে, তবে তা-ই হোক।” কিংবা, “শোনো, ওড়ো না।” “তবে?” “লাফিয়ো।” “কেন?” “লাফালেই তোমাকে ভাল লাগে।” “আচ্ছা।” যার মাথায় পোকা ঢুকেছে, তার সব মতামতই ভাল লাগে। সে একবার এদিকে বদলায়, আরেকবার ওদিকে। সেই বদলানোগুলি কতটা ঠিক, কতটা ভুল, সেটা কোনও ব্যাপার না। পোকার চলার পথের সাথে ওর ভাবনার পথচলা। তাই প্রেমেপড়াটা আসলে পোকায়কাটা মাথার অনুভূতি।
আবার ছেলেদের প্রেমে পড়েযাওয়া আর মেয়েদের প্রেমে পড়েযাওয়ার ব্যাপার কিন্তু এক নয়। একটা ছেলে প্রেমে পড়লে ও নিজেই বলে, আর একটা মেয়ে প্রেমে পড়লে অন্যরা বলে। আবার কিছু-কিছু প্রেম এমনও হয়, ভেতরে-ভেতরে হৃদয়টা প্রেমের তীব্র আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায়, অথচ চোখেমুখে নির্লিপ্ত বরফশীতল আভাস।
ভাল?
চলে যাচ্ছে। কে আপনি?
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।
সে তো অনেক আছে! পরিচয় দিন।
পরিচয় দেবো বলে নক করিনি।
তাহলে?
গান শোনাবো।
Not interested.
তাই নাকি? But I know, you are. আপনার কিউরিসিটি বেশি।
কী বলতে চান?
বলেইছি তো, গান শোনাবো। এই নিন শুনুন। ভাল লাগলে জানালে খুশি হবো।
গানটা আগে কখনও শুনেছে বলে প্রসূনের মনে পড়ল না। না-শোনা গান প্রথম শোনায় সাধারণত মনে ধরে না, কিন্তু ওই গানটা ধরল। সেই আইডি’টিকে একটা ন্যূনতম ধন্যবাদ দেয়া দরকার। ৩বার “থ্যাংকস” লিখেও পাঠাল না প্রসূন। জীবনটাই ব্যাকস্পেসের!
জানতাম, ফিডব্যাক আসবে না।
মানে? কীভাবে জানতেন?
আপনাকে চিনি তো! আপনার রক্তের প্রবাহের ধরনটাও মুখস্থ বলে দিতে পারি।
আপনি কে, বলুন তো?
না-ই বা জানলেন! গানটা আপনার ভাল লেগেছে, আমি ওতেই খুশি। নিন, আরেকটা.......আচ্ছা, দুটো দিচ্ছি। শুনে দেখুন, ভাল লাগবে।
লাগবে, কীভাবে জানলেন?
জানিই, এটা বলব না, এটা আমার অনুমান বলতে পারেন, আর কিছুটা আপনাকে বুঝতে পারার আত্মবিশ্বাস। অতটুকুই! শুনুন। আমি আসি।
যাবেন না, দাঁড়ান! আপনি কে, বলুন না!
দেখছেন না, ‘প্রসূনের জন্য’? ওটাই আমি! আর কিছু নয়।
এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি।
জানি। বাড়লামই বা একটু! কারও কোনও ক্ষতি তো করছি না!
আপনার লিস্টে আর কেউ নেই?
খুঁজেই দেখুন না!
কিছুই দেখা যায় না, আপনাকে অ্যাড করার অপশন নেই, কোনও ইনফোই তো নেই!
এর মানে, আমি এইটুকুই! আপনার ইনবক্সে আসব, গান দেবো, চলে যাব। এইতো! ও আচ্ছা, আরেকটা বাদ গেল, আপনাকে পড়ি, পড়ব।
আমার লেখা?
ও তো সবাইই পড়ে। আপনাকে ক’জন পড়ে? আমি পড়ি।
আপনার কথাগুলি বড্ডো গোলমেলে! আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
আপনাকে কি সবকিছুই বুঝতে হবে?
মানে? কী বলতে চাচ্ছেন? সরাসরি বলুন!
সরাসরি কিছু বলতে তো আমি আসিনি, আমি এসেছি শুধুই শোনাতে। আজ আর জ্বালাব না। আরও ৩টা লিংক দিলাম, শুনুন। হ্যাপি লিসেনিং!
আইডি’টা আর খুঁজে পাওয়া গেল না। ডিঅ্যাক্টিভেটেড। এরকমই হতো। গান দিয়েই হাওয়া হয়ে যেত ‘প্রসূনের জন্য’। কে এই অপরিচিতা? নাকি, অপরিচিত? প্রসূন হাজার ভেবেও কিছুই মাথায় আনতে পারে না।
হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন কেন মশাই মেয়েদের উপর?
ক্ষেপলাম কই?
অমন করে লিখলেন যে?
ওদের অমন করেই বলা উচিত!
একটা মেয়ে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে, এর মানে নিশ্চয়ই এ নয় যে আপনি পৃথিবীর সব মেয়েকেই কষ্ট দিয়ে কথা বলার অধিকার পেয়ে গেছেন! ভুল কিছু বললাম?
বেশি কথা কম বললে ভাল হয়! আপনি আমার লেখা বোঝেনইনি!
I humbly disagree, Sir! আমি বুঝতে পারি না, জগতে এমন অনেক কিছুই আছে, মানছি, কিন্তু আপনার লেখা সে দীর্ঘ লিস্টে নেই! বরং একটা লেখা লেখার অনেকদিন পর যদি আপনি কখনও সে লেখার অর্থ বের করতে না পারেন, সময়ের প্রবাহে ভুলে যান, তবে দয়া করে আমাকে একটিবার নক করবেন। আমি বলে দেবো, কী লিখেছেন, কেন লিখেছেন, কীভাবে লিখেছেন।
বাব্বাহ! এতটা কনফিডেন্ট?
আমাকে কনফিডেন্ট বলে লজ্জায় ফেলে দেবেন না, প্লিজ! ওই ছোট্ট একটা কথায় আমার অপরিচয়টাও হারিয়ে যাবে! বরং আপনি আমাকে আপনার মনের একটা বিশাল অংশ বলতে পারেন। আপনার ভাবনাগুলির মধ্যে যেগুলি অবচেতন, সেগুলির খোঁজ আপনি কোনওদিনই জানতে পারবেন না, কিন্তু আমি জানি। এখানেই আপনাকে হারিয়ে দিয়ে আমার জিত। এতেই আমি খুশি!
আশ্চর্য মানুষ আপনি!
মানুষ নই, মানুষী! হাহাহাহা.........
যদি না মানি?
মানবেন, কারণ মনে-মনে আপনি ওটাই মানতে চান!
সাংঘাতিক মানুষী! ভাল কথা, আপনার গানের পছন্দ ভাল।
জানি। যে আপনাকে পছন্দ করেছে, তার পছন্দের তারিফ না করে পালাবেন কই?
কিন্তু যে ক’টা গান দিলেন, এর একটাও আগে কোনওদিনই শুনিনি। এটা ভেবে সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। আমার ধারণা ছিল, আমি সব ভাল গানই শুনেছি!
কী যে বলেন না মশাই! সব ভাল গান শোনা হয়ে যায় নাকি? মানুষ অত বাঁচে? এও সম্ভব? আর আমি তো বুঝিই আপনি কোন-কোন গান শোনেননি, কিন্তু শুনলে আপনার ভাল লাগবে।
কীভাবে?
ওই যে বললাম, আপনাকে পড়ে।
আপনি আমার সব লেখাই পড়েছেন?
কেন? মুখস্থ ধরবেন নাকি? আপত্তি নেই। তবে, আপনারই তো মনে থাকার কথা নয় সবকিছু।
মনে রাখার জন্য তো লিখি না, ফেসবুকে রাখার জন্য লিখি।
জানতাম, এরকম কিছু একটাই রিপ্লাই আসবে। আপনি বড় জ্বালান, জানেন? আপনার লেখা কতবার করে যে পড়ি, আপনার কথা কতবার করে যে মাথায় আনি! এর অর্ধেক ডাকলেও অনেক আগেই ভগবানের সাথে দিব্যি দেখা হয়ে যেত!
আপনার অন্য কাজ নেই? আপনি কে, বলে ফেলুন না প্লিজ! বিরক্ত লাগছে!
জানি, লাগছে না। এমনিই বলছেন! যাকগে! আজকে ৭টা লিংক দিচ্ছি। ৪টা ইন্সট্রুমেন্টাল, ৩টা গান। আজকেরগুলি অন্যদেশের। শুনবেন, কেমন? টা টা।
নিমিষেই ‘নেই’ হয়ে গেল। প্রসূন শুনতে লাগল। না! একটাও আগে শোনা হয়নি। ওগুলি শোনার সময় ইউটিউবের পাশের সাজেশন থেকে আরও কিছু ভাল মিউজিক শোনা হয়ে যায়। প্রসূনের কৌতূহলের পারদের উচ্চতা বাড়তে লাগল প্রতি মুহূর্তেই। কে এই মেয়ে? কে কে? এত চমৎকার করে কথা বলে, গান আর ইন্সট্রুমেন্টালের পছন্দ এত ভাল!
ফুলবাবু, আজকে আপনার জন্য গাইলাম। সাহস করে গাইতে হয়নি, কারণ গান শুনে খারাপ লাগলে তো আর গলা টিপে ধরতে আসতে পারবেন না! আপনি তো আমার ঠিকানাই জানেন না!
এখানে ফুলবাবুটা কে?
আচ্ছা, প্রসূনবাবু। এবার ঠিক আছে?
গানগুলি আপনার?
না, অন্যের, আমি জাস্ট গেয়েছি।
আমিও তো সেটাই বললাম।
আমি অন্যকিছু শুনিনি, শুধু বলেছি অন্যকিছু।
বড় কথা ঘোরান আপনি! আচ্ছা, আপনি মিউজিক নিয়ে পড়েন বুঝি?
কেন, মিউজিক নিয়ে না পড়লে কি গান গাওয়া বারণ?
সেটা নয়। আপনার গানের রুচি আর গলায় মনে হল।
ধন্য হলাম। কিন্তু ট্রিট দিতে পারব না, স্যার। সরি! দেখুন তো, এগুলি শোনা হয়েছে কিনা?
এই পুরনো গানগুলি কই পেলেন?
কেন? ইউটিউবে! লিংক কি অন্য কোথাওর গেছে?
সেটা নয়। কিন্তু এগুলির খোঁজও জানেন আপনি! একটাও মন্দ লাগছে না, সত্যি! প্রেমে পড়ে যাব তো!
গানের নিশ্চয়ই!
যদি বলি আপনার?
সেটা ইনফ্যাচুয়েশন! ভাববেন না, কেটে যাবে। যে প্রেমে ফেলে, সে প্রেমে পড়ে কম।
ফেলেছি? কাকে? আপনাকে? আহা আহা!
ওটা বললেই তো খুশি হন, তাই তো? তাহলে ধরে নিন, ওরকমই কিছু! আপনি খুশি হলেই আমি খুশি!
আমাকে খুশি করতে হবে কেন?
হবে। কারণ, আমি চাই, আমার ভাললাগা আপনার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। বিয়ের পর অন্নপূর্ণার সেতার শোনার ভাগ্য রবিশংকরজি ছাড়া আর কারওই হয়নি। আমি চাই, শুধুই আপনার জন্য গাইতে। আপনি খুশি না থাকলে এতসব কিছু হবে কীকরে?
সবই হবে। আমিও তো তা-ই চাইছি। আপনি সারাজীবনই আমার গানের সাথী হয়ে পাশে থেকে যাবেন। ভাবতেও তো দারুণ লাগছে! কিন্তু অমন করে লুকিয়ে থাকলে বুঝি কিছু হয়? একটু বেরিয়ে আসুন না! নিজেকে আর লুকিয়ে রাখবেন না প্লিজ!
শুনুন প্রসূনবাবু, সারাজীবন আসলে কতটুকু? অনেক বড়? অনেক ছোট? কে বলতে পারে? এই যে ঠিক এই মুহূর্তে আপনার সাথে আছি---হোক তা ভার্চুয়ালি, এটাও তো সারাজীবন হয়ে যেতে পারে। আজকে ঘুমালেই কি ঘুমভেঙে কালকের সূর্যটা দেখা যাবেই যাবে? কে খেয়েছে সে দেখানোর দিব্যি? তাহলে সারাজীবন বলবই বা কোনটাকে? আচ্ছা, আসি আজকে। মা ডাকছেন।
প্রসূনের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল কথাগুলি! এত সুন্দর করে বলতে পারে ওইটুকুন একটা মেয়ে! আচ্ছা, ও কতটুকুন, সেটাও তো প্রসূন জানে না। তাহলে ওকে ওইটুকুন ভাবতে ইচ্ছে হল কেন? ও যদি প্রসূনের বড় হয়? নাহ! ওরকম কীকরে হবে? মেয়েটির গাওয়া গানগুলি শুনল প্রসূন। মোট ৮টি গান। ৫টি বাংলা ক্লাসিক্যাল, ৩টি উর্দু গজল। সেইরাতে আর ঘুম হল না প্রসূনের। একেকটা গান অন্তত ৫বার করে শুনল। থ’ মেরে ছিল গানগুলি শুনে। বলে না দিলে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয় যে, কণ্ঠটি কৌশিকীর নয়। প্রসূন এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে গানগুলি সার্চ করে দেখল, কৌশিকীর কণ্ঠে গানগুলি আছে কিনা। যতবারই গানগুলি শুনল, ততবারই ওর মনে হচ্ছিল, ও যেন ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখছে প্রতিটি কথাকে, সুরকে। পুরোপুরি এলোমেলো একটা রাত কাটল প্রসূনের!
আপনার ১৮ নম্বর বুকশেলফের তৃতীয় তাকে রাখা কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী পড়া হয়েছিলো?
ওরে বাবা! এত নিখুঁতভাবে বললেন কীভাবে?
আমি তো বলেইছি, আপনার কোনওকিছুই আমার অজানা নয়! যা কিছু আপনার, তা কিছু আমার মাথায় আছে। একদম সবই! এখন বলুন, পড়েছিলেন কিনা?
বলছি। তার আগে বলুন, আছেন কেমন?
খারাপ থাকব কেন?
বাঃরে! আমি কি তা বলেছি নাকি। জিজ্ঞেস করাও যাবে না?
সেটা নয়। এই প্রথমবারের মত এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হল তো, তাই আরকি! বললেন না, পড়েছেন কিনা?
না, এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি।
পড়লে একটু জানাবেন আমাকে, কেমন? আচ্ছা, গান নিয়ে আপনার বই মোট ১৯৭টি। কয়টা পড়ার সময়সুযোগ হয়েছে?
হবে কয়েকটা। বেশি নয়। আপনি বইটই পড়েন দেখছি।
কিছু-কিছু, অত নয়। গরীব মানুষ, কিনতে আর পারি কই? আমি কিন্তু আমার কথাই বললাম, আপনার কথা কিছু মিন করিনি।
হাহাহাহা........ না, ভয় পাবেন না, আপনাকে ব্লক করব না। আপনাকে ব্লক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সে আপনার দয়া, স্যার! কিন্তু সম্ভব নয় কেন?
সেটা আপনি বুঝবেন না। আপনার ঠিকানাটি দিন, আমার পছন্দের কিছু বই পাঠাব, পড়ে ফেরত দিলেই হবে।
ট্রিক্সটা ভাল, কিন্তু পুরনো। আপনার কাছ থেকে নতুন কিছু আশা করেছিলাম। যাকগে! আজকে গান দিচ্ছি না। কিছু কম্পোজার আর আর্টিস্টের ইন্টারভিউ দিচ্ছি। শুনবেন, লেখালেখির কাজে লাগবে। কালকের গানগুলি কেমন লেগেছিল?
কেমন লাগা উচিত?
তা তো বলবো না। একটা অনুরোধ করি। আমায় ভালোবাসুন আর না-ই বাসুন, আমার ভালোবাসার নৈবেদ্য নিবেদন করার সুযোগটা কখনও কেড়ে নেবেন না, কেমন? কথা দিচ্ছি, আপনি ক্লান্ত হয়ে ওঠার আগেই অনেক অনেক দূরে সরে যাব। আজকে বেশি গাইতে পারিনি, ৬টা দিলাম। আসি। শুভরাত্রি।
ঘোরলাগা মুহূর্তের মধ্য দিয়ে প্রসূন যাচ্ছিল প্রতিদিনই। একটু পরপর ইনবক্সে খেয়াল করে দেখত, ও নক করেছে কিনা। ওর গান আর লিংকগুলির জন্য প্রতীক্ষা করতে-করতে ওর প্রতি অদ্ভুতরকমের একটা নেশা জেগে উঠেছিল। ওর অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব ছিল স্রেফ একটা ফেসবুক আইডি। ও কি আদৌ কেউ, নাকি কেউই না, ওকে কীভাবে পাবে, ওর নামটা অন্তত জানা যাবে কীভাবে, এসব ভাবতে-ভাবতে প্রসূন পাগলের মত মুহূর্তগুলি কাটাত।
শরীরের কী হাল করেছেন, খেয়াল করা হয়েছে কখনও?
ওঃ আপনি!
অন্যকাউকে এক্সপেক্ট করেছিলেন বুঝি?
আপনার তো জানার কথা!
জানি বলেই তো চলে যাচ্ছি না। আমি অবাঞ্ছিত হয়ে যাওয়ার অনেক আগেই পালিয়ে যাব। শুনুন বাবুসাহেব, খাওয়াদাওয়া একটু ঠিকমত করলে হয় না? রাতজেগে লিখছেন, ভাল কথা। কিন্তু তার জন্য শরীরটাও তো ফিট থাকা চাই। অনধিকার চর্চা ভাবছেন না, জানি, তাই ভয় ছাড়াই বলে ফেললাম এতকিছু। তা, ইদানিং কী পড়ছেন?
রবীন্দ্রনাথের জীবনী পড়ছি।
প্রশান্তকুমার পালেরটা?
না, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়েরটা।
আচ্ছা। আমি প্রশান্তবাবুরটা পড়েছি। অনেক পরিশ্রম করে লেখা। ভদ্রলোকের ধৈর্যকে স্যালুট!
বলেন কী! নয় খণ্ডই?
নাহলে পড়া হয় কীভাবে?
এতটা ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথকে?
উনাকে ভালো না বেসে পারা যায় আবার কীভাবে? বাঙালির সিক্সথ বেসিক নিডটাই তো রবীন্দ্রনাথ! জানেন, সিনেমাগুলিতে ইদানিং রবীন্দ্রনাথের গানগুলি নিয়ে যা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, দেখলে আমার না খুব রাগ হয়। কিছু-কিছু জিনিসকে বদলে দেয়া পাপ। রবীন্দ্রসংগীতও ওরকম।
আহহ্ ভালই তো! রবীন্দ্রসংগীতের ফিউশন হচ্ছে। হতে পারে না?
পারে, তবে সুরকে বিকৃত করে নয়। লিন্কিন পার্ককে আপনি ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’ গাইতে দেবেন কেন? ওদের নিভৃত বলে কিছু আছে নাকি? ওদের সবই তো প্রকাশ্যেই চলে। ওরা নিভৃতের কী মাথামুণ্ডু বুঝবে, আপনিই বলুন?
তাই বলে কি রবীন্দ্রনাথকে ঋষির আসনেই রেখে দিতে হবে চিরকালই? সুরটা নাহয় একটু সরেই গেল! উনাকে অসম্মান করে তো আর কেউ গাইছে না কিছু। নীরদ সি চৌধুরীর আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ পড়ে দেখবেন। আমরা রবীন্দ্রনাথকে ঋষি বানিয়ে রাখতে-রাখতে উনার লেখকসত্তাকে হারিয়ে যেতে দিচ্ছি।
নীরদ সি চৌধুরীর বাড়াবাড়িটা বরাবরই বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। আজকে আপনার সাথে কোনও ডিবেটে যাব না। কালকে ১০টায় একজাম, এখন বাজে ২টা, এখনও কিচ্ছু পড়িনি। আজকে আসি। আপনি তো গত তিনদিন ফেসবুকে আসেননি, তাই গান একটু বেশিই জমে গেছে। ২১টা দিলাম। অনেক কষ্ট করে রেকর্ড করেছি। না শুনে ল্যাপটপ থেকে ফেলে দেবেন না যেন আবার! শুভরাত্রি।
প্রসূন-‘অপরিচিতা’র অসংজ্ঞায়িত প্রেম এভাবেই চলছিল। জীবনে প্রথমবারের মত প্রসূন এমন একজন মানুষের সাথে প্রতিদিনই যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিল যাকে সে একেবারেই চেনে না, অথচ যে ওর সব কিছুই খুব ভাল করে জানে। ব্যাপারটা ওর সাথেই ঘটছে, এটা মাথায় এলেও প্রসূন বিশ্বাস করতে পারত না। কারও সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে প্রসূনের নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে। সে নিয়মগুলির সাথে সবচাইতে বেশি অমিলের মেয়েটিকে সে দীর্ঘ ১ বছর ৭ মাস ১৭ দিন সময় দিয়েছে। অথচ মেয়েটির সম্পর্কে সে কখনওই কিছু জানতে পারেনি। এটা তার সাথে খুব বেশিই বেমানান! প্রসূন তার ভালোবাসার মানুষটিকে ঠিক যেরকম করে কল্পনা করে এসেছে সবসময়ই, মেয়েটি তার চাইতেও বেশিকিছু! একটাসময়ে প্রসূন মেয়েটিকে ‘তুমি’ করে বলা শুরু করে। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও মেয়েটি রাজি হয়নি প্রসূনকে ‘তুমি’ বলতে। পরের দিককার কথোপকথনগুলি বেশ দীর্ঘ হতো।
একদিন।
প্রেমে পড়ে গেলে তোমরা মেয়েরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে বড্ডো ভালোবাস। প্রাণ যাবে, তবুও মুখ খুলবে না। ভাবখানা এমন, ভালোবাসি বললে যদি তাড়িয়ে দেয়! মনে-মনে ভালোবেসে কী লাভ, বলো? একে বল, ওকে বল, অথচ যাকে ভালোটা বাস, তাকেই বল না। তোমাদের মধ্যে কেউ-কেউ কাউকেই কিছু বলে না। দেখলে বোঝা যাবে, প্রেমে পড়েছে, জিজ্ঞেস করলে বলবে, "না না, আমার চেহারাটাই ইদানিং প্রেমে-পড়েছে টাইপ হয়ে যাচ্ছে। আমি কী করব?" ভালোবাসে নিজের মনেই, জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় ভেতরে-ভেতরে, তবুও একটিবারের জন্যও বলে না। আমি ভালোবাসলাম, অথচ যাকে ভালোবাসলাম, সে জানলই না, এমনকি আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে পর্যন্ত সে জানে না, সে ভালোবাসা কিছুতেই ভালোবাসা নয়, দুর্বিপাক মাত্র। কখনও-কখনও অমন ভালোবাসায় নিজেকেও ঠকানো হয়, যাকে ভালোবাসছি ওকেও ঠকানো হয়। আচ্ছা বল তো, তুমি ধরেই বা নিচ্ছ কেন, আমি ফিরিয়ে দেবোই দেবো? হয়তো আমি নিজেও তোমার মতন, বুক ভেঙে কান্না আসে, তবুও কিছুই বলতে পারি না। হতে পারে না?
আমি তো এমন ভালোবাসাকে মেনে নিয়েছি। ভালোবাসলে কি ভালোবাসার মানুষটিকে পেতেই হবে? এই যে আমার ভালোবাসার নৈবেদ্য দিয়ে প্রতিদিনই আপনার হৃদয়কে ভরিয়ে তুলছি, এ বুঝি কিছুই নয়? প্রেমকে কেন সকাম হতেই হবে? নিষ্কাম প্রেমে পবিত্রতা অনেকবেশি থাকে। এই যে আপনি দিনের পর দিন আমার মতন একজন অচেনা মানুষের সাথে আছেন, এতটাই কাছাকাছি আছি আমরা, যে থাকাটাকে স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু স্পর্শ করার চাইতেইও তীব্রভাবে অনুভব করা যায়, আমার কাছে তো এটাই প্রেম, এটাই ভালোবাসা। ভালোবাসলে মুখে বলে দিতে হবেই কেন, “ভালোবাসি”? কেন নিজেকে অন্তরাল থেকে টেনেহিঁচড়ে সামনে এনে ফেলতে হবে?
শোনো, তোমার ওসব বড়-বড় কথা শুধু বইয়ের পাতাতেই মানায়। অমন ভালোবাসা কেবলই মনের অসুখ বাড়িয়ে দেয়। 'আমি কেন আগে বলব' ইগোতে কত ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দেখলাম! এক পক্ষের সুপ্ত ভালোবাসা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে সুন্দরী রমণীর দিকে তাকিয়ে ওকে ইমপ্রেস করতে অতি হৃদয়হরা নীরব স্নিগ্ধ হাসির মতই অর্থহীন। এমন ভালোবাসার দহন আর দায় কখনও-কখনও সারাজীবনও বয়ে বেড়াতে হয়। ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলাটাই ভাল। ওতে যদি ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন না হয় অন্য ভাবনাতে যাওয়া যাবে। ওরকম নিত্য যাওয়াযাওয়িতে একটা সময়ে ভালোবাসা খানিকটা হলেও ফিকে হয়ে ওঠে---গন্তব্যহীন ভালোবাসার মৃত্যু তো জীবন বাঁচায়---অতএব, শুভস্য শীঘ্রম! ভালোবাসায় একপক্ষের অভ্যস্ততা কতদিনই বা বেঁচে থাকে? মরে যায়। ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলায় সুখ হয়তো অতটা নেই, তবুও স্বস্তি তো আছে! সুখের চেয়ে নাকি শান্তি ভাল। আমি বলি, শান্তির চেয়ে স্বস্তি আরও ভাল। যে ভালোবাসার প্রশ্রয় জীবনের সকল রস একেবারে শুষে নেয়, সেই ভালোবাসাকে শুধুই মনের মধ্যে বাড়তে দিলে মনের ভীষণ অসুখ হয়। সে অসুখের ভুক্তভোগী শুধু একজনই। হয়তো আরেকজন এসবের কিছুই জানে না, এমনকি কখনও-কখনও, জানা দরকার, এটাই কখনও জানতে পারে না। One-sided love, one-sided disaster, one-sided agony, one-sided dream. Meaningless!! Absolutely meaningless!! তোমার জন্য আমি নিজেকে শেষ করে দেবো কেন? Who the Hell are you? তোমার ভালোবাসা অতিবাজে এক ধরনের অসুস্থ ভালোবাসা। এতে হয়তো তুমি নিজে অনেক ভাল আছ, কিন্তু আমাকে ভাল থাকতে দিচ্ছ না। তোমার নিজের ভাললাগার জিনিসগুলি আমার সাথে ভাগাভাগি করে খুব সুখে আছ। ভালোই যদি বাসতে, তবে তো কষ্টগুলিকেও শেয়ার করতে। কই, কখনওই তো তোমাকে দেখলাম না বলতে তোমার বেদনার কথাগুলি। অথচ আমি খুব ভালভাবেই বুঝি, তুমি ভাল নেই। তোমার অনেক রকমের অসুখ, সবকটাই মনের। তোমার অসুখের ভাইরাসে তুমি আমাকেও অসুস্থ করে দিচ্ছ প্রতিদিনই! This is not fair! You’re just pathetic! আমি আর এসব ঠিকানা-ছন্দহীন নিরুদ্দেশ সম্পর্কের মধ্যে থাকব না। আজকের পর থেকে তুমি তোমার মতন থাকবে, আমি আমার মতন। Enough is enough!
দেখুন, আমি জানি, ভালোবাসা এক ধরনের অভ্যস্ততা। সে অভ্যাস নিজেকে পুরোপুরি শেষ করে দেয়ার আগেই নিজেকে সরিয়ে নেয়া ভাল। ভালোবাসা ভাল জিনিস, তবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা আরও বেশি ভাল জিনিস। যে ভালোবাসা মৃত্যুর মতন, সে ভালোবাসা নিয়ে বাঁচা আর মরে-যাওয়া---একই ব্যাপার। একবার ভালোবেসে ফেললেই সারাজীবন ধরেই ভালোবাসতে হবে নাকি? যদি ভালোবাসা না পাই, তবুও? একতরফা ভালোবাসা অনুভূতিটনুভূতিকে একটাসময় পর ভোঁতা করে দেয় না? ভালোবাসা দাসত্ব নাকি? মরে যাব, তবু ভালোবাসার আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েই যাব পড়তেই থাকব। নিজেকে শেষ করে দিয়ে হলেও ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখব।----এসব হল পোকামাকড়ের ফিলসফি। মানুষ পোকামাকড়ের ফিলসফিতে কেন বাঁচবে? ঠিক, আপনার কথা ঠিক। সবই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমি আজ অসহায় হয়ে গেছি। আমি আপনার কাছ থেকে আশ্রয় চাই না, প্রসূনবাবু। শুধু আপনার ইনবক্সে একটু প্রশ্রয় চাই। আমাকে দয়া করে তাড়িয়ে দেবেন না। আমার মেসেজের রিপ্লাই দিতে হবে না, সিন করারও প্রয়োজন নেই। আমি শুধু এইটুকু অনুভূতি নিয়ে বাঁচতে চাই, আমি আমার সবচাইতে প্রিয় মানুষটির কাছাকাছি আছি, আর কিছু নয়। আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনও ঐশ্বর্য নেই। এইটুকু চলে গেলে আমি আর বাঁচব না।
আরও কিছু কথার পর কথা একেবারেই থেমে গেল।
সময় ফুরিয়ে যায়। মানুষ যখন সময়ের স্রোতে চলতে-চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন কখনও-কখনও পেছনে ফিরে তাকায়। পুরনো সুখের মুহূর্তগুলির রোমন্থন করে নিজেকে এক ধরনের ভাললাগায় ভরিয়ে তোলে। ৩ বছর পর এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় বাগানের শ্যাডোতে যখন কফির ধোঁয়ায় একেকটি ওরিয়েন্টাল ইন্সট্রুমেন্টাল মিশে-মিশে যাচ্ছিলো, তখন হঠাৎ প্রসূনের খুব ইচ্ছে করল, স্মৃতির বারান্দায় একবার হেঁটে আসতে। লেখার পর ছিন্নভিন্ন করে জলে ছুঁড়ে মারবে বলে ডায়রির এক পাতা ছিঁড়ে নিয়ে লিখতে শুরু করল।
ওর নামটা কখনওই জানা হয়নি। ঠিকানা রাখেনি, তা নয়, ও-ই দেয়নি। "আমি কে, জানাব না। কখনওই না।" জানায়ওনি। আমার কাছে ও ছিল স্রেফ একটি ফেসবুক আইডি। তবুও, ওর অনুভবটুকু কি কখনওই ধরা যেত না? ওর ভাললাগাটাকে নিজের মধ্যে রাখতাম। ও আমার লেখাগুলি পড়ত। প্রতিটি বর্ণ ধরে-ধরে কয়েকবার করে পড়ত। আমার প্রতিটি অক্ষরকে ও বড় ভালোবাসতো। অমন পাঠক আমি আর পাইনি। আমার লেখাগুলিকে আমি নিজেই কি কখনও অতটা ভালোবাসতে পেরেছি? সেইসময় অনেক লেখাই লিখেছি শুধুই ওর জন্য। ও জানত সব, আমার মনটাকে বুঝতে পারত। আমি বলার আগেই আমার মনের অনেক কথাই অবলীলায় বলে ফেলতে পারত। প্রথমপ্রথম আমি এর ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইতাম। কী এক ব্যাখ্যাহীন প্রচ্ছন্নতায় শরীরমন পুরোপুরিই আচ্ছন্ন হয়ে যেত তখন। পরেপরে ভয়ে আর সে চেষ্টা করিনি। প্রায়ই বলত, "আমি তো আপনাকে কিছুই দিতে পারব না, তাই আমার ভাললাগা সুর পাঠাই, আমার সবচাইতে প্রিয় আমার কণ্ঠটিই আপনার জন্য পাঠিয়ে দিই।" হ্যাঁ, ও আমাকে ওর ভাললাগা গান আর ইন্সট্রুমেন্টাল পাঠাতো। ওরকম অসম্ভব দারুণ রুচির মানুষ আমি এ জীবনে এখনও পাইনি। ওর পছন্দ করেদেয়া এমন একটা গানও ছিল না যেটা আমার ভাল লাগত না।
আমি সুরে ভাসতে ভালোবাসি। প্রতিদিনই ও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত নতুন-নতুন সুরে। বাংলা আর অন্যভাষার গান আর সুরে ওর যে অবাধ বিচরণ, সেখানে আমি কোনওদিনই বিন্দুমাত্রও রুচির ঘাটতি দেখিনি। ও বলত, "আপনি গান ভালোবাসেন বলে আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর কিছু হোক না হোক, আমি আপনার লেখা ভালোবাসি, অন্তত এজন্য হলেও তো আপনি আমাকে ভালোবাসতেই পারেন, নয় কি? আমাকে জানতেই হবে কেন আপনার, হুঁ?" আমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা একটা অদ্ভুত নামের আইডি থেকে ও আমার সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ রাখত। প্রতিদিন অন্তত ৫টা করে গান/ ইন্সট্রুমেন্টালের রিকমেন্ডেশন দিত, গান নিজে গেয়ে পাঠাত। আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম ওর সুরের জন্য। আমি কয়েকদিন কিছু না লিখলে ও বলত, "আপনি লিখবেন। প্রয়োজনে যাচ্ছেতাই লিখবেন। আমি আমার মতন করে গুছিয়ে পড়ে নেবো। আপনার লেখা পড়তে না পারলে আমি যে বাঁচার অক্সিজেনই পাই না।" আমি জানতাম, আমি যা লিখি, তা কিছুই হয় না। তবুও ওর মতন অমন একজন অপরিচিতা আমাকে ওইটুকু বলাও ছিল আমার জন্য অনেক কিছু! আমি ওর জন্যই লিখতাম কখনও-কখনও। ওর ভাবনার আভিজাত্য আর অতিপরিশীলিত রুচি আমাকে প্রচণ্ডভাবে স্পর্শ করতো! ওর মধ্যে মুজতবার শবনমকে দেখতে পেতাম, সুনীল-শঙ্খের মার্গারিটকে খুঁজে পেতাম, আর আমার শতাব্দীকে পুরোপুরিই খুঁজে পেতাম!
এভাবেই চলছিল। কিন্তু ও নিজেকে কিছুতেই চেনাত না, নিজের সম্পর্কে আমাকে কোনওদিনই কিছুই বলেনি। নাম্বার চেয়েছি, দেয়নি। নামটাও বলেনি কোনওদিনও। কিন্তু গল্প করত, কলারাজ্যের গল্প। আর্ট ওরকম অতটা বোঝে, অমন কোনও মেয়ের সাথে আমার আজ পর্যন্ত কখনও দেখা কিংবা ‘অদেখা’ হয়নি। প্রচুর বই পড়ত ও। ভাল-ভাল মুভি দেখত। আর গানের কথা তো বলাই বাহুল্য! সুরের মধ্যে ওর মতন ডুবে থাকতে আমি এখনও পর্যন্ত কাউকেই দেখিনি। শুধু একটাই ব্যাপার আমার কাছে সহ্য হতো না---ওর নিজেকে লুকিয়ে রাখা। এরকম ক্ষেত্রে আমি কখনওই চ্যাটিং কন্টিনিউ করি না, কখনওই না। কিন্তু ওকে ছাড়তে পারতাম না। ও ছিল আমার কাছে একটা নেশার মতন। তাই ওকে রেখেছিলাম সে তালিকায়, যে তালিকায় নিয়মরক্ষার কোনওই দায় নেই। এবং ও ছিল সে তালিকার একমাত্র বাসিন্দা। এখনও সে তালিকায় কেউ আসেনি ও ছাড়া।
হঠাৎ একদিন কী হল! ওর এই আড়ালে থাকাটাকে আমি আর মেনে নিতে পারলাম না। ওকে অনেক-অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও বরাবরের মতই পরিচয় না দেয়ায় খুব খুব খুব বেশি দুর্ব্যবহার করে ফেললাম। মুখে যা-ই এল, তা-ই লিখে পাঠালাম। খুব আজেবাজে ব্যবহার করলাম ইনবক্সে। অতকিছুর পরও ওকে একটুও রাগতে দেখিনি! আমিই শর্টটেম্পারড হয়ে ওকে প্রচণ্ড আঘাত করে-করে কতকিছু যে লিখে পাঠালাম! সেসব কথা এখন ভাবলেও অনুতপ্ত হই। ও বারবারই বলছিল, যা-ই করি না কেন, যাতে ওকে ব্লক করে না দিই। আমার লেখা না পড়তে পারলে ও বাঁচবে না। ও যে গানটা ভালোবাসে, সেটা আমাকে শোনানোটা ওর অভ্যেস হয়ে গেছে; ওর নিজের গলায়, কিংবা অন্যের---এ অভ্যেসটাই প্রতিদিন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওকে যেন আমি বাঁচিয়ে রাখি অন্তত অনস্তিত্বে হলেও! আমি এসবের কিছুই শুনতে চাইলাম না। রাগে আর অভিমানে ব্লক করে দিলাম। এর অনেকদিন পর সেই আইডিটা খোঁজ করে দেখেছি। না, ওকে আর খুঁজে পেলাম না। আমার সুরের অভিমানী বন্ধুটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!
এখনও ওর প্রতি ভাললাগা সেইদিনের মতই আছে। ওরও আছে কি? না থাকাই তো উচিত!
বন্ধু, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো। আমি মাঝেমাঝেই তোমার কথা ভেবে অনুতপ্ত হই। শুধু ইগোর জন্য ক্ষমা চাইতে পারিনি কোনওদিনই! আজকে চেয়ে ফেললাম। যদি একটুখানিও ভালোবেসে থাক, তবে ক্ষমা কোরো।
.......লিখল, খুব যত্ন করে কাগজটি ভাঁজ করল, এরপর কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারল বৃষ্টিমাখা হাওয়ায়! স্পিকারে তখন প্রসূনের শতাব্দীর পছন্দের সপ্তম ইন্সট্রুমেন্টালটি বাজছে।