৩৬তম বিসিএস প্রিলি নিয়ে………

(লেখাটি ১০/০১/২০১৬ তারিখে ৩৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর লিখেছি।)

যারা ৩৬তম বিসিএস প্রিলি দিয়েছেন, শুধু তাদের জন্য—

৩১তম বিসিএস ভাইভার আগেই ৩০তম বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়ে যাওয়ায় আর ৩১তম বিসিএস ভাইভা পরীক্ষা দিতে যাইনি। সে হিসেবে আমাকে ২০১১ সালের মে মাসে ৩১তম বিসিএস প্রিলির পর বিসিএস প্রিলি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আর পড়াশোনা করতে হয়নি। (এবং আমি পড়িওনি। চাকরির পড়াশোনা ভালোবেসে করার মতো কোনো পড়াশোনা নয়। সবাই এটা করে স্রেফ মার্কস তুলে চাকরি পেতে। অবশ্য কিছু-কিছু লোক আছেন, যারা বড় বড় ভালোবেসে ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবির নাম কী?’ জাতীয় প্রশ্নও বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের ওয়ালে পোস্ট করে সবার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে করে ‘শিওর হয়ে নেন’ এবং পরবর্তীতে ছোট-ছোট মার্কস পেয়ে ফেল করেন।) বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাস এমনই এক চিড়িয়াটাইপের সিলেবাস যা অভ্যাস এবং অনভ্যাস দুটোতেই বিদ্যাহ্রাস পায়। আমার বিদ্যাহ্রাস পেয়েছে, এবং সে দোষ আমার একার নয়; সিস্টেমেরও!

এবারের ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নটি একেবারেই ট্র্যাডিশনাল ধাঁচের প্রশ্ন। বেসিক যেমনই হোক, যারা যত বেশি প্রশ্ন পড়ে গেছে, তাদের পক্ষে এ পরীক্ষায় ফেল করা তত বেশি কঠিন। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল আমার দৃষ্টিতে এযাবতকালের সবচাইতে কঠিন প্রিলি আর রিটেনের ‘প্রশ্নওয়ালা’ বিসিএস। আমি নিজে ওই বিসিএস দিলে কতটা কী করতে পারতাম, সে সম্পর্কে অনেকের মতো আমি নিজেও সন্দিহান।

একটা সিক্রেট বলে দিই। খুব সম্ভবত ৩০তম আর ৩১তম বিসিএস প্রিলির জন্য সবচাইতে বেশি সংখ্যক প্রশ্ন সলভ করেছে, পুরো বাংলাদেশে এরকম ক্যান্ডিডেটদের তালিকা করা হলে আমার নাম ১ম ৫ জনের মধ্যেই থাকার কথা। একথা কেন বললাম? একথার মানে হল, আমি মনে করি, বিসিএস প্রিলিতে পাস করার জন্য ১০টা রেফারেন্স বই পড়ার চাইতে ১ সেট গাইড/ ডাইজেস্ট/ প্রশ্নব্যাংক পড়া বুদ্ধিমানের কাজ। বিসিএস পরীক্ষা জ্ঞানী হওয়ার পরীক্ষা নয়, মার্কস পাওয়ার পরীক্ষা।

একটা কথা বলে নেয়া ভাল। আমি সাধারণ জ্ঞানে অতি দুর্বল ধরনের ক্যান্ডিডেট ছিলাম। আপনি ভাবতেও পারবেন না, অতটা দুর্বল ক্যান্ডিডেটও থাকে! কীভাবে সেটা কাজ চালানোর মতো করে আয়ত্তে এনেছি, সেকথা অন্য নোটে লিখেছি বলে এখানে আর লিখছি না। বাকি ৪টা বিষয় আমি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ভালভাবে পারতাম। আমি সবসময়ই বোঝার চেষ্টা করেছি, অন্যরা যেভাবে পড়ে, সেটাতে সমস্যাটা কোথায়। যে পথে গেলে পড়া কমে, সে পথে যাওয়ার সুবিধে হল এই, (যদি বেশি নাও করেন) আপনি অন্যদের সমান সময়ই পরিশ্রম করবেন, কিন্তু অন্যরা যে সময়ে একটা অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম প্রয়োজনীয় জিনিস পড়ে, সে সময়ে আপনি একটা প্রয়োজনীয় জিনিসকে দুইবার রিভিশন দিয়ে দিতে পারবেন কিংবা আগে পড়া একটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং পড়া হয়নি এরকম একটা প্রয়োজনীয় জিনিস পড়ে ফেলতে পারবেন। হিসেব করে দেখুন, অন্যদের তুলনায় আপনার কাজের/ প্রয়োজনীয় পড়া হচ্ছে অন্তত দ্বিগুণ!

২০১১ সালের মে মাসের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিসিএস প্রিলি নিয়ে আমাকে আর কিছু করতে হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রিলির পড়ার স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। গত শুক্রবার রুয়েটে ক্যারিয়ার আড্ডা ছিল। সারাদিন রুয়েটের অডিটোরিয়ামে কথা বলার পর সেদিন রাতের গাড়িতেই ঢাকায় আসি। গতকাল সারাদিন চাকরির কিছু কাজে দৌড়ের উপর ছিলাম। আবার সারারাত জার্নি করে সকালে সাতক্ষীরায় পৌঁছেই ৯টার মধ্যেই অফিসে ঢুকি। আজকে সন্ধ্যায় একটু ফ্রি হয়ে ৩৬তম প্রিলিতে ‘কাট মার্কস’ কত হতে পারে, এ সংক্রান্ত পোস্ট দেয়ার অনুরোধ/ আবদার রক্ষার্থে একটা প্রশ্ন ডাউনলোড করে পরীক্ষা দিতে বসে গেলাম। যেহেতু আমি বৃত্ত ভরাট করছি না, খাতায় অন্যান্য কিছুও পূরণ করতে হচ্ছে না, পরীক্ষার হলের ‘রহস্যময় টেনশন’টুকুও নিতে হচ্ছে না, সেহেতু ৫০ মিনিটের মধ্যেই পুরো প্রশ্ন সলভ করার নিয়তে হাতঘড়ি আর ক্যালকুলেটর ড্রয়ারে রেখে দেয়ালঘড়ি দেখে পরীক্ষা দিলাম। জেনে দাগালাম ১৫৪টি। এরপর ইন্টারনেট আর বিভিন্ন অনলাইন ফোরাম ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলি চেক করে দেখলাম, ৫টি ভুল হয়েছে। মানে, আমি পেলাম ১৪৬.৫। ধরে নিচ্ছি, সত্যি সত্যি পরীক্ষা দিলে কনফিউশন আছে, কিন্তু পরীক্ষার হলে শেষপর্যন্ত ছাড়তে ইচ্ছে করে না এরকম আরও ১০টি বেশি দাগিয়ে ফেলতাম। ওগুলির মধ্যে ভুল হতো ৭টি, মানে ১৬৪টি দাগিয়ে ভুল করতাম ১২টি, মার্কস পেতাম ১৪৬। আমি যদি মোট ২০০ নম্বরকে এভাবে করে ভাগ করি : বাংলা (৩৫) + ইংরেজি (৩৫) + গণিত ও মানসিক দক্ষতা (৩০) + সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (৩০) + সাধারণ জ্ঞান (৫৫) + অন্যান্য (১৫), তবে হয়তোবা আমার মার্কস আসত এরকম : বাংলা (২৮) + ইংরেজি (৩২) + গণিত ও মানসিক দক্ষতা (২৯) + সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (২৪) + সাধারণ জ্ঞান (২২) + অন্যান্য (১১)। এর পুরো কৃতিত্ব কিন্তু ৩৬তম বিসিএস প্রিলির সহজ প্রশ্নের। বিসিএসটা ৩৫তম হলে ব্যাপারটা অন্যরকমও হতে পারত।

প্রশ্ন নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ লিখছি :

এক। প্রশ্নটি অবশ্যই অতি গতানুগতিক। এ প্রশ্নে পাস করার জন্য মেধাবী হওয়ার কোনো দরকার নেই। গাইড বই/ জব সল্যুশন/ প্রশ্নব্যাংক/ ডাইজেস্ট/ মডেলটেস্ট গাইড ইত্যাদি ভালোভাবে পড়া থাকলেই যথেষ্ট।

দুই। এই প্রশ্নে কনফিউজিং/ ভুল প্রশ্ন কম ছিল।

তিন। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী অংশটা একটু কঠিন ছিল মনে হয়।

চার। কিছু প্রশ্ন নিয়ে কথা বলি :

১. বর্তমানে NAM এর সদস্যসংখ্যা- এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

২. সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে- এই প্রশ্নটি কনফিউজিং।

৩. LinkedIn এর ক্ষেত্রে কোনটি সঠিক? এই প্রশ্নটির ৪টি অপশন খেয়াল করলে মনে হয়, PSC এই প্রশ্নটি দিয়েছে, যাতে সবাইই ওটিতে ১ নম্বর করে পেয়ে যায়!

৪. যদি (25)^(2x+3) = 5^(3x+6) হয়, তবে x= কত? এই অংকটির ৪টি অপশন থেকে x এর মান প্রদত্ত সমীকরণে বসিয়ে সলভ করলে গতানুগতিকের ৫ ভাগের ১ ভাগ সময় লাগার কথা। x^2+y^2 = 185, x-y = 3 এর একটি সমাধান হল- এই অংকটির বেলায়ও আগের কথাটি প্রযোজ্য। ২ এর কত শতাংশ ৮ হবে? ….. এটিও!

৫. ১৫.৬০২৫ এর বর্গমূল = ? এই প্রশ্নটি দেয়াই হয়েছে যাতে কেউ কেউ বোকার মতো এটি করার জন্য সময় নষ্ট করে। কী দরকার ভাই? ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার সবচাইতে সহজ প্রশ্ন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ সরকারের বড় অর্জন কোনটি? এটিতেও তো ১ নম্বরই ছিল! অথচ সহজ টেকনিক জানা না থাকলে ওই বর্গমূল নির্ণয় করে একই ১ নম্বর পেতে অন্তত ২০ গুণ বেশি সময় লাগবে! কঠিন প্রশ্নে নম্বর কিন্তু সেই ১-ই!

৬. দুটি সমান্তরাল রেখা ক’টি বিন্দুতে ছেদ করে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। সঠিক বানান কোনটি? এটিও একই!

৭. Credit Tk 5000 _ my account. এই প্রশ্নটি যারা মোবাইলে ব্যাংকের মেসেজগুলি চেক করেন, তাদের পারতে ১ সেকেন্ডও লাগার কথা না।

৮. Verb of ‘Number’ is- এই প্রশ্নের উত্তর ২টি; number ও enumerate দুটিই হয়। মানে, এই প্রশ্নটিও কনফিউজিং।

৯. ‘Gitanjali’ of Rabindranath Tagore was translated by- এই প্রশ্নেরও উত্তর নেই, তবে PSC এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে নেয় W.B. Yeats অপশনটিকে। আচ্ছা, নেবেই কে বলল? নাও তো নিতে পারে! ইয়েটস্ তো বাংলা জানতেনই না! তাহলে গীতাঞ্জলি অনুবাদ করলেনটা কীভাবে? ……… অতো কথায় কাজ নেই। সংক্ষেপে বললে, এটিও একটা কনফিউজিং প্রশ্ন।

ভাল বুদ্ধি হল এই, কনফিউজিং প্রশ্নের উত্তর করারই দরকার নেই! ভুল প্রশ্নের কথা বলছেন? আচ্ছা, ভুল প্রশ্নের উত্তর করলেও যা, না করলেও তা। ওগুলিতে সবাইকেই অ্যাভারেজ মার্কস দিয়ে দেয়।

পাঁচ। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার কঠিন প্রশ্ন দিয়ে PSC ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার ক্যান্ডিডেটদেরকে এই ইঙ্গিত দিয়েছিল, “বেসিক শক্ত করতে প্রচুর প্রচুর পড়াশোনা কর, নাহলে প্রিলিতে ফেল করবে! শুধু বাজারের বই পড়ে বেশি লাভ নেই।” ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার সহজ প্রশ্ন দিয়ে PSC ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষার ক্যান্ডিডেটদেরকে এই ইঙ্গিত দিয়েছে, “বেসিক শক্ত করতে প্রচুর প্রচুর পড়াশোনা কর, নাহলে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষা একটা ‘গ্যাপ’ দিয়ে ‘ফিরে এলে’ প্রিলিতে ফেল করবে! তবে বাজারের বই না পড়েও বেশি লাভ নেই।”

পরশু থেকে শুরু করে এই নোট লেখার সময় পর্যন্ত ‘৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার কাট মার্কস কত হতে পারে’ জাতীয় ইনবক্স মেসেজ আর ফোন পেয়েছি অন্তত ১৫০০+। যারা যোগাযোগ করেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ‘ভাল, মাঝারি, খারাপ’ ৩ ধরনেরই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে পাস-করা ক্যান্ডিডেট। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে সাইলেন্টলি এ সংক্রান্ত কিছু পড়াশোনা করে কিছু বিষয় আমার মাথায় এসেছে।

এক। সহজ প্রশ্ন, তাই এখানে ০.৫ নম্বরও অনেককিছু!

দুই। প্রশ্ন সহজ, অতএব ঝটপট সব দাগিয়ে ফেলি খুশিতে! — এই খুশির ঠ্যালায় আর স্নায়ুর চাপে অনেকেই অনেক প্রশ্নের উত্তর ভুল দাগিয়েছেন। (আমি পরীক্ষা দিলেও তা-ই করতাম।)

তিন। PSC যদি ১০ হাজার ক্যান্ডিডেটকে রিটেন দেয়ার সুযোগ দেয়, তবে কাট মার্কস হবে ১০৫-১০৯।

PSC যদি ১২-১৫ হাজার ক্যান্ডিডেটকে রিটেন দেয়ার সুযোগ দেয়, তবে কাট মার্কস হবে ৯৯-১০২।

PSC যদি ২০-২২ হাজার ক্যান্ডিডেটকে রিটেন দেয়ার সুযোগ দেয়, তবে কাট মার্কস হবে ৯১-৯৮।

এখন কিছু কথা বলে এই লেখাটি শেষ করছি।

এক। PSC এবার মোট কতজনকে রিটেন দেয়ার সুযোগ দেবে, সেটা তো আমরা কেউই জানি না। তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এবারের কাট মার্কস হবে ৯৩-১০০ এর মধ্যে।

দুই। জানা জিনিস ভুল শুধু আপনি একাই দাগাননি, যে ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হবে, সেও দাগিয়েছে। তাই এটা নিয়ে এত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।

তিন। বিশাল বিশাল মার্কস পাবে দাবিকরা বিশাল বিশাল পণ্ডিতদের বেশিরভাগই বিশাল বিশাল ফেল করে আমাদের সবাইকে বিশাল বিশাল বিনোদন দেবে। রেজাল্টটা বের হতে দিন আর দেখুন না কী হয়! Just wait & see!!

চার। প্রিলির রেজাল্ট বের হওয়ার পর রিটেনের প্রিপারেশন নেয়ার জন্য সময় বেশি পাবেন না। বিসিএস পরীক্ষা মূলত রিটেনে ভাল করার পরীক্ষা। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, কেউ যদি সঠিকভাবে রিটেনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে, তবে উনার মেধাতালিকায় ১ম ১০ জনের মধ্যে থাকার সম্ভাবনা ৯৫%। বাকি ৫% ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। ভাগ্যে বিশ্বাস করেন না? ঠিক আছে, আপনি অন্তত ১বার প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে দেখুন!

রিটেনের পড়াশোনা কীভাবে শুরু করা যায়, এ নিয়ে পরে লিখব। (আগ্রহীরা রিটেনের প্রস্তুতিকৌশল নিয়ে আমার ফেসবুক নোটগুলি দেখে নিতে পারেন। রিটেন নিয়ে আমার অন্তত ১৫+টি ফেসবুক নোট আছে।) আপাতত এইটুকুই! ঈশ্বর আপনাদের সবার মঙ্গল করুন।

শুভকামনায়

সুশান্ত পাল

আপনাদের একজন সিনিয়র সহকর্মী