যদি কেউ খোলাখুলি স্বীকার করে—হৃদয়ের গভীর থেকে আসা সেই “জ্ঞানের ফিসফিস” শুনেছে, তবে সে বলতেই পারে, লিখতে পারে—কী কী কীভাবে বলে সেই অদৃশ্য বাণী।
কিন্তু সমস্যাটা হলো—এখানে শব্দ যথেষ্ট নয়। যা বলা যায়, তা কেবল ইঙ্গিত—সত্যিকার সুর তো শব্দের ঊর্ধ্বে।
নীরবতার গভীর থেকে যে-আহ্বান—“এসো, চূড়ান্ত বাস্তবতার সান্নিধ্যে এসো। নাম যা-ই দাও—ঈশ্বর, প্রভু, বিধান—শব্দ এখানে তুচ্ছ।”
এই উপস্থিতির মুখোমুখি হওয়া মানে—অকল্পনীয় এক শক্তির সম্মুখে দাঁড়ানো। ব্যক্তিসত্তার চেয়ে অসীম, মন যা কখনও ভাবেনি, কল্পনাও করেনি—ততটাই গভীর, ততটাই আলোড়নময়।
আলোর স্রোতে বিলীনতা—উজ্জ্বল সেই আলোয় প্রবেশ করতেই দেহের উপস্থিতি হারিয়ে যায়। তবু শোনা যায়—“তোমাকে ভালোবাসা হয়েছে, তোমাকে জানা হয়েছে, তোমাকে ঈশ্বরীয়ভাবে পরিচালিত করা হচ্ছে।”
এমন ভালোবাসার ঢেউ ভেসে আসে, যা প্রায় অসহনীয় মধুরতায় মন ভরিয়ে দেয়। সব অপরাধবোধ, সব অনুশোচনা, সব লজ্জা গলে যায়—অবশিষ্ট থাকে কেবল সেই বৃহৎ, আচ্ছন্ন-করা প্রেম।
এরপর ব্যক্তিসত্তার টুকরো টুকরো ছায়াও গলে যায় আলোয়। সময় অর্থহীন হয়ে পড়ে। শুধুই এক অনন্ত বর্তমান।
তবু আছে চেতনা—আর এখন মনে হয়, এই চেতনা সর্বব্যাপী। এ যেন গোটা মহাবিশ্বের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখা। জ্ঞান হঠাৎ প্রবাহিত হয়—সব কিছু জানা হয়ে যায়, সব কিছু কেমন করে কাজ করছে, তা বোঝা হয়ে যায়। মহাজগতের অদৃশ্য জাল কত নিখুঁতভাবে বোনা হয়েছে—তা একনিমিষে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ হলো পূর্ণতায় প্রবেশ, শান্তির অদম্য আসন।
যে এই ফিসফিস শুনেছিল, সে আর আগের মতো থাকে না। “আমি”—যেটিকে একসময় ব্যক্তিসত্তা ভেবে ধরা হয়েছিল—তা বোঝা যায়—আসলে দ্বিতীয় স্তরের বাস্তবতা। এখন জাগরণের পর জানা যায় প্রাথমিক বাস্তবতা—চেতনা।
ঋষিদের ভাষায়: রামন মহর্ষি একে বলেছিলেন “আমি-আমি”। বুদ্ধ বলেছিলেন “শূন্যতা, যা কিছুই নয়, তবু পূর্ণ”। যিশু বলেছিলেন, “অন্তরে স্বর্গরাজ্য”। এ যেন এক—“অন্য বাস্তবতা”।
যে-নামেই বলা হোক, এ অভিজ্ঞতায় সব শাস্ত্র, সব কবিতা জীবন্ত হয়ে ওঠে। সকল সত্য যেন নতুন অর্থে বাজে, ধর্মগ্রন্থগুলো দীপ্তিতে ভরে ওঠে।
ফিরে এসে দেখা যায়—পৃথিবী একইরকম, অথচ ভিন্ন। প্রত্যেক মানুষ দীপ্ত এক প্রেমের আলোয় ভেসে আছে। বোঝা যায়—এই জাগরণ সবার ভেতরেই আছে, মানবজাতির চূড়ান্ত নিয়তি হলো—সেই জাগরণে পৌঁছানো।
হৃদয়ের ফিসফিস যে একবার শোনে, তার কাছে জীবন হয় মায়ার খেলা, আর চেতনা হয় প্রেমের অসীম সাগর।