ভালো আছ তো, প্রিয়? আমার যা-কিছু আছে, তার সবই একতুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে শুধু ভালোবাসাটা সুদে আসলে বুঝে নিয়ো।
ইচ্ছে করে, ঘামে-ভেজা তোমার পিঠটা শক্ত করে খামচে ধরি! তোমার ঠোঁটে আমার ঠোঁট হারালে আমি ভীষণ বিপদে পড়ি; কোন জোড়া তোমার, আর কোন জোড়া আমার, তা আলাদা করাই কঠিন করে দাও যে তুমি! তোমার ছোট্ট ছোট্ট চোখদুটোর কত ভাষা, কত কথা, কত অভিমান...! পাছে কিছু বুঝতে পারি, সেই ভয়ে তোমার চোখে চোখটাই রাখিনি আজ অবধি ভালো করে!
তোমায় মনে পড়ে যখন তুমি ভীষণ ক্লান্তিতে গল্পের বইটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ো, কিংবা তোমার স্বপ্নে আমার বাড়ির ভেতরটা তন্নতন্ন করে খুঁজে মরো! বলি, শুধু ঘরের ভেতরটাই খুঁজবে? ওদিকে মনটা যে এলোমেলো করে দিলে, তার বিচারটা কবে করবে, শুনি?
আমি বোঝার চেষ্টা করেছি, আমার খুব কাছাকাছি থেকেও তোমার অমন দূরে থাকা, দূরে দূরে থেকেও আমার হাতটা এক্কেবারে শক্ত করে ধরে রাখা, এসবের কোনওটিই আমার নজর এড়িয়ে যায়নি কখনও।
কোনও এক রংখেলার দিনে বসে বসে ভাবলাম, সবুজ আছে, বেগুনি আছে, রানি গোলাপি...এমনকি কলাপাতার নামেও রঙ আছে, অথচ তোমার নামে একটিও রং নেই! পরক্ষণেই আবার ভেবে দেখলাম, তোমার নামে রং থাকলে ওরা সবাই যার যার মতন করে তোমায় ছুঁয়ে দেবে, তোমায় হাতের মুঠোয় পুরে ফেলবে, যার যার মতন গায়ে মেখে ওরা তোমায় নিজের করে নেবে একমুহূর্তেই!
তোমার কথামতো আমি তোমাকে ঠিকই ভুলে যাব, প্রতিদিনই যাচ্ছি একটু একটু করে। শুধু, নাওয়া শেষে আমার চোখের ভেজা পাপড়ি থেকে যে জলটি গড়িয়ে পড়ে, সেই জলখানি, সকালের হালকা রোদটুক, আর রাতের শুভরাত্রিটাই তোমার কথা খুব মনে করিয়ে দেয়। এই তো, এটুকুই! এটুকু ঠিকই সামলে নিয়ে দিব্যি ভুলে যাব। হ্যাঁ, এটাই শপথ করেছিলাম তো, আরও বছর দুয়েক আগেই? এতদিনে তো তা পারারই কথা ছিল, তাই না!?
যা যা ভুল বোঝার, বুঝে নাও। পরের বেলাতে সে সুযোগ আর পাবেই না! তল্পিতল্পা গুছিয়েছি এবার নিজেই, দাও না বের করেই। এবার আর থেকে যাবার বায়না ধরব না তো!
তুমি হাসলে পেখমমেলা ময়ূরটাও রূপের অহংকার ভুলে নিজের কালো পায়ের দিকে ঠায় তাকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই হাসিতে আমিও দিশা হারাই, দৌড়ে গিয়ে এই ফাঁকিবাজ আমিটাও, পড়ার ভান করে বইয়ের পাতা ওলটাই।
তুমি আজকাল বেশ ঘনঘন জানতে চাও, আমি কেমন থাকি! খুব ভালোই আছি, যেরকমটা থাকার কথা ছিলো আরকি; শুধু ওই মাঝেমধ্যে একটু তোমার নাম করে পুতুলটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখি। সত্যি আমি ভালোই আছি!
কবিদের সাথে আমার একটা বিশাল মিল আছে, জানো? কবিরাও রাতে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারে না, আমিও পারি না।
আমার যৌবনভরা শরীর কিংবা অনন্তযৌবনা মন, দুটোই তোমার স্পর্শ পাবার ব্যাকুলতায় রোজ রোজ ছটফট করে।
আচ্ছা, তোমার প্রিয় মানুষটা কি জানে, তুমি যখন গান গাও, তোমার চোখ থেকে শত শত ফোঁটা যন্ত্রণা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাও তখন? জানে না। সে তো শুধু গানটাই শোনে। জানলে তোমাকে ফেলে রেখে যেতেই পারত না! কত কষ্ট পেয়ে পেয়ে আজকের এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ, সে কি জানে? অবশ্য, ওসব তো আমিও জানি না। ভাগ্যিস, জানি না! জানলে তো তোমায় আমি সেই কবেই বুকের ভেতরে লুকিয়ে ফেলতাম, আর একটুও কষ্ট পেতে দিতাম না!
আচ্ছা, তোমার প্রেমিকা সব জেনেও তোমায় কষ্ট দেয় কী করে গো? তুমি কি জানো, তুমি খারাপ থাকলে আমি ঠিক টের পাই? তোমার মন নরম থাকলে আমি খুব বুঝতে পারি? তুমিও যখন অভিমানে চুপসে যাও, আমি ঠিকই ধরতে পারি।
সেদিন তুমি যেই ঠোঙাওয়ালার কাছে আমাদের স্মৃতিগুলো কেজি দরে বিক্রি করে দিয়ে এলে, অমনিই আমি সেগুলো সাড়ে ন'গুণ বেশি দাম দিয়ে কিনে এনে আমার শোবার ঘরে সাজিয়েছি, নইলে ওই লোকটা আমাদের সব স্মৃতিকে ফেরি করে বেড়াত। ও কি আর জানে এসব স্মৃতির মানে! এতটা পারো কী করে, বলো তো?
শুনেছি, তোমার প্রেমিকা নাকি রোজই নতুন নতুন শব্দ বুনে তোমায় মাতাল করে রাখে? আমি তো ওসব পারি না, শুধু সাদামাটা কিছু লিখে চোখের পানিটা আড়াল করতে পারলেই আমার দিব্যি চলে যায়। বস্তুত, দিনশেষে, নিতান্ত সাদামাটা হয়ে পড়াটাই তো কাদামাটির তৈরি মানুষের একমাত্র প্রয়োজনীয় লক্ষ্য, তাই না?
শুক্র আর শনিবার মিলিয়ে বছরে ছিয়ানব্বই দিন ছুটি থাকে, অন্যান্য সব ছুটির দিনের হিসেব তো ছেড়েই দিলাম। তবুও তুমি একটা দিন আমার কাছে আসবার সুযোগ পাওনি। শোনো, তোমাকে দেখতে চাইব না আর। দেখে নিয়ো, তোমার সময়ের মতনই ঠিক দামি হয়ে উঠবে একদিন আমার সময়টাও।
তোমার প্রেমিকা তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে না; আচ্ছা, তুমি নিজেই ঠিক জানো তো তোমার মনের কথা? আমি কিছু কিছু জানি। কখনও তোমাকে জানিয়ে দিলে সেই মেয়েকেও তুমি জানিয়ে দিয়ো, কেমন?
তুমি যখন লেখাটি পড়বে, তখন তোমার গালে আমার আঙুলের স্পর্শ অনুভব করতে পারবে। শোনো, এখনও কি তোমার চোখে মনের কথা ঠিক ফুটে ওঠে? ওঠে যদি, তবে তা আর স্পর্শ করব না ভুলেও! যদি আবারও তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁধা পড়ে যাই, বাঁধন খুলে দেবার জন্য মানুষ আমি কোথায় পাবো?
তুমি আমার মনের কথা বুঝতে পারলে আমাকে কি আর কলম ধরতে হতো, বলো? কতটা কষ্ট পেলে মানুষ কলমের খোঁচায় বেদনা ঝরাতে চায় রক্তের স্রোতের মতন, সেটা তোমরা কলমের বিপরীতে বসে-থাকা মানুষজন কী করে বুঝবে? আমি মানুষটা তোমার মতন নই, পাড়ার নিমাই কাকার মেয়ে কিংবা আমার পেটের সব কথা জানা বান্ধবিটির মতনও নই। এই গতিহীন আমিটা হচ্ছি আমার খরস্রোতা কলমের কালির মতন। আচ্ছা, তোমাদের কাছে কলমের কালি কি শুধুই কালো বর্ণে ধরা দেয়? কিন্তু ওই এক কালো রঙ কী করে আমার সুখ, যন্ত্রণা, অপমান, অবহেলা, এমনকি মুচকি হাসিটারও সাবলীল ব্যাখ্যা দিয়ে দেয়, সেটা আমি নিজেও আজ অবধি বুঝে সারতে পারলাম না!
তুমি বলো, আমি নাকি সারাটা রাত জেগে কেবলই কাগজ আর কালি খরচ করা ছাড়া আর কিচ্ছু করি না, এ সবই নাকি অকেজোদের কাজ! কিন্তু জানো, শব্দগুলো লিখে ফেলার আগ পর্যন্ত ওরা আমার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকে, রীতিমতো হেঁচকি উঠে যায় আমার! আহা, তোমার ওসব খোঁটাকে মাথা পেতে নিয়েও যদি আমার বুকের ভেতরে জমাটবাঁধা অক্ষরগুলোর গুটিকয়েক অন্তত ছুঁয়ে দেখতে পারতাম!
সবাই বলে, লেখা সুন্দর হলেই কেবল নাকি সেটা কবিতা হয়, আমি বলি, প্রেম নিয়ে মানুষ বোকা বোকা ছড়াও লিখে ফেলে, সেগুলোও কবিতার চেয়ে কোনও অংশেই কম নয়।
তুমি বলেছিলে, তোমার প্রেমিকা যা-ই লেখে, তা-ই নাকি কবিতা হয়ে যায়! অথচ দেখো, আমি কত কত রাতের ঘুমকে পাশ কাটিয়েও দুটো ভালো শব্দই ঠিক করে জোড়া লাগাতে পারি না! সে কি জানে, আমার এত সাধনার ফসলটি সে বিনা পরিশ্রমেই ঘরে তুলছে?
মানুষ নাকি তার সবচেয়ে দামি আসবাবপত্র লুকিয়ে রাখে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা জমিয়ে রাখে। ওসব লুকোনো জমানো শেখার আগে যদি মানুষ ভালোবাসাটা শিখে নিত! হায়, মানুষ নাকি ভালোবাসাটা অবধি লুকিয়ে রাখে ভালো সময়ের অপেক্ষায়! এ-ও সম্ভব? আমি পারব না। ভালোবাসারও কি আবার লগ্ন আছে নাকি?
শেষবেলায় একবার শুধু তোমার হাতটা ধরতে চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম তোমায় আর একটিবার ভালো করে দেখতে। আমি ভুলে যাই বারবারই, এসব তো আমি আর চাইতে পারি না, সবই ফুরিয়ে গেল, সময় তোমাকেই জিতিয়ে দিল। আমার এই তুমিটাই যখন সেধে সেধে অন্য কারুর হাতটা ধরতে চাইবে, তখন সে অবহেলা করলে তাকে বলে দিয়ো, এক পিপাসিনী এত দূর থেকে রোজ রোজই তৃষ্ণায় মরে যায়! সে মানুষটা যা অবহেলা করছে, সেটাই ছিল আমার পরম আরাধ্য!
দেখলে তো, কবিতাকে কেমন গদ্য বানিয়ে ফেললাম! গদ্যকে শায়েরি করে ফেললাম। কান্নাটাকে হাসির আড়ালে মুড়িয়ে ফেললাম। শুধু তোমাকে আমার করতে আর পারলাম না।
তোমার চলে যাওয়াতে বেশ ভালোই হয়েছে, আমি ভীষণ দুঃখ পেয়েছি। একমাত্র দুঃখই তো কবিতার সমার্থক।
আমি কখনওই কবি হতে চাই না, কবিরা সত্যিই কী উজবুক, নিজেরাই নিজেদের কষ্টের গলা চেপে ধরে, টিপে টিপে বুকের ভেতর থেকে বের করে আনে, আবার নিজেরাই ওসবে রং মাখিয়ে রূপরস দিয়ে দিয়ে রূপকথার মতন করে সাজিয়ে দেয়। কী অদ্ভুত! কী বোকামি!
আবারও চাইছি, ভালো থেকো, প্রিয়! আমার খারাপ স্বভাবগুলোকে পাশ কাটিয়ে, শেষ অবধি নাহয় আমার সাথেই থেকে যেয়ো।