হৃদয়ের কথা

কখনো কখনো নিজের হৃদয়ের কথা শুনতে হয়। যখন কোনোভাবেই একটা সমস্যার কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না, যখন সমাধানের সব পথই বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়, তখন নীরবে নিভৃতে চুপচাপ নিজের মন কী বলে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হয়। সেসময় কিছু-না-বলাটাই সবচাইতে সুন্দর কথাটির চাইতেও ভালো কিছু দিতে পারে। যখন হৃদয় একেবারে ভেঙেচুরে যায়, যখন সব আলো একে একে নিভে যায়, যখন মনের সাথে যুদ্ধ করে শরীরও আর পেরে ওঠে না, তখন হৃদয়কে তার নিজের পথেই চলতে দিতে হয়। আমাদের ইগো, আমাদের অহমিকা, আমাদের অর্জন, আমাদের প্রজ্ঞার অভিমান, আমাদের অবস্থান—এই সব কিছুকে দূরে সরিয়ে রেখে শূন্য মনে রিক্ত হাতে স্রষ্টাকে খুঁজতে হয়। যাত্রা শুরু করতে হয় শূন্য থেকে।

ভারাক্রান্ত হৃদয় আলোর বোঝাটাও সহ্য করতে পারে না। নিজের ভেতর থেকে নিজেকে সরিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্বের অনুভূতি দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হয়। হৃদয়ের চাইতে বড়ো উপাসনালয় আর নেই। স্রষ্টার অনুগ্রহের সন্ধানে এক হৃদয় সঁপে দিলে লক্ষ হৃদয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। সুন্দরের খোঁজে যে সারাপৃথিবী ঘুরে মরল, অথচ একমুহূর্তের জন্যও নিজের হৃদয়ের দিকে তাকানোর সময় পেল না, সে বড় দুর্ভাগা। জীবনের সবচাইতে গুরুত্ববহ প্রশ্নগুলির উত্তর একমাত্র নিজের হৃদয়ের কাছেই পাওয়া যায়। এই হৃদয়মন্দিরই সত্য ও ধ্রুব, এখানেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। সব হৃদয়ে স্রষ্টা আসন পাতেন না, যে-হৃদয় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করতে জানে, স্রষ্টার প্রিয় স্থান সেটিই। স্রষ্টা বাস করেন মানুষের চেতনা, সুবুদ্ধি, বিবেকের মধ্যে।

আমাদের সকল কাজ ও ভাবনার আগে বা পরে, আমাদের চারপাশে, আমাদের ঘুম কিংবা জাগরণে, আমাদের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীদের হৃদয়ে, আমাদের চোখে কিংবা আমাদের বন্ধুদের দয়ার্দ্র চোখে, আমাদের সকল ভালো উদ্দেশ্য ও ভালো কাজে স্রষ্টার আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের ছাপ সুস্পষ্ট। যখন আমরা স্রষ্টার প্রশস্তি গাই, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের হৃদয় পরিশুদ্ধ করি, আমাদের চিন্তাভাবনা সুন্দর হয়, আমাদের মনে আনন্দ খেলা করে, নিজেদের এবং চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটা দারুণ অনুভূতি জন্মে, সুন্দর ভাবনা ও সুন্দর উদ্দেশ্য আমাদের কাজকে সুন্দর করে, আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেটা ভালো ও সুন্দর। যা-কিছু সুন্দর, তা শান্তি দেয়—এমন না-ও হতে পারে; তবে যা-কিছু শান্তি দেয়, তা নিশ্চয়ই সুন্দর।

সুন্দর আলোর নাচনে আঁধারের রাজ্য দূরে সরে যায়। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা নিজের ভেতরের সুন্দর মানুষটির জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি বিবেকের এমন উদ্‌বোধন দূরের পাহাড়ে, সাগরে, গুহায়, প্রার্থনাগৃহে কিংবা কোনো নির্জন নিভৃত স্থানে হয়, তবে আমরা সে স্থানকে 'পবিত্র' বলি। যেখানে গেলে হৃদয়ের সুপ্তাবস্থার অবসান হয়, সে স্থানকেই আমরা বলি তীর্থ। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা কিংবা অন্য যে-কোনো ধর্মালয় আমাদের ততক্ষণ পর্যন্ত স্রষ্টার সান্নিধ্য দিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের হৃদয়কে জাগাতে না পারছি। বিভিন্ন মায়া আর অজ্ঞতার কারণে আমরা বাহ্যিক পৃথিবীতে শান্তি, ভালোবাসা, সুখ আর স্বস্তি খুঁজে বেড়াই। এতে আমাদের মধ্যে হতাশা, বিষণ্ণতা, বৈষম্য, মিথ্যে আত্মপ্রসাদ আর বিমর্ষতার বীজ রোপিত হয়, কারণ আমরা আমাদের ভেতরের ভালোবাসা আর মঙ্গলবার্তার যে অফুরান স্রোতধারা, সে ধারার আবর্তে এক চিরআগন্তুক হয়েই জীবন কাটিয়ে দিই।

যত বেশি বাইরের পৃথিবীর ঐশ্বর্যে আমরা শান্তি খুঁজি, স্রষ্টার আর আমাদের মাঝখানের দেয়ালটা তত বেশি মজবুত হয়। হৃদয়ের চোখ যখন খুলে যায়, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি, যে অবারিত শান্তির মহাসমুদ্র আমাদের মধ্যে বয়ে চলেছে, হয়তো তার বিন্দুমাত্রের খোঁজে আমি এতদিন হাতড়ে মরছি। আমাদের হয়তো একটা ভালো বাড়ি নেই, একটা ভালো গাড়িতে আমারা কখনোই চড়তে পারব না, দামি খাবার খাওয়ার সামর্থ্য হয়তো আমাদের এ জন্মে আর হবেই না, পৃথিবীর দারুণ সব জায়গা আমরা ঘুরে দেখতে পারবো না, বহুমূল্য কাপড় বা অলংকার আমাদের শোভাবর্ধন করবে না কোনোদিনই; ধরেই নিচ্ছি, যা যা থেকে লোকে শান্তি খুঁজে বেড়ায়, তার কিছুই আমাদের নেই—তবে আমাদের মধ্যে হৃদয়ের আলো আছে, আমাদের ভাবনা আমাদের হয়েই চিরকাল থেকে যাবে, আমরা আমাদের স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে বাহ্যিক জাগতিক মোহের শেকল থেকে মুক্ত করতে পারি। প্রকৃতি আমাদের সুন্দর পাহাড় আর উপত্যকা উপহার দিয়েছে, রাতের আকাশে তারার আলো আমাদের মোহিত করে রাখে, সূর্য আর চাঁদের কিরণ আমাদের গা ধুইয়ে দেয়, নানান ঋতুতে দিনরাত্রির বৈচিত্র্য আমাদেরকে স্রষ্টার মাহাত্ম্য নিয়ে ভাবায়, আগ্নেয়গিরির উদ্গিরন কিংবা একপশলা বৃষ্টির পরের রংধনু, মেঘ আর হাওয়ার মিতালি, সুন্দর ফসলের মাঠ, কলকল ধারায় বয়ে-চলা নদী, আকাশে পাখির ওড়াওড়ি, সাগরের বুকে পালতোলা নৌকার ভেসে চলা, শিশুর আশ্চর্য জন্ম, এ সব কিছুই কোনো এক শক্তির প্রতি আমাদের অনুগত করে দেয়। আমরা সেই শক্তির আরাধনা করি, সেই শক্তির সান্নিধ্য পাবার চেষ্টায় নিজেকে নিবেদন করি।


যখন আমরা নিজেদের মধ্যে ঐশ্বর্যের যে অতল সাগর, সেখানে ডুব দিই, তখন আমাদের মধ্যে এই গাঢ় অনুভূতি আর প্রত্যয় জন্মে যে, আমরাই সে শক্তি, অপার্থিব আনন্দের স্রোত আমাদের বিনীত করে দেয়, নতমস্তকে জ্ঞানের পথে নীরবে চলতে শেখায়।