স্রষ্টার ধারণা

স্রষ্টার ধারণা আমাদের মধ্যে কখন এল? কীভাবে এল? কেন এল? স্রষ্টা কোথায় থাকেন? আমরা স্রষ্টাকে আমাদের প্রার্থনায় খুঁজি, প্রণতিতে কল্পনা করি। আমাদের ভালোবাসায় স্রষ্টা বাস করেন, আমাদের সকল সৎ কাজে স্রষ্টাকে স্মরণ করি, আনুগত্যের ভেতর দিয়ে যেন তাঁর কাছেই পৌঁছে যাই, স্রষ্টার খোঁজে স্বর্গে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে জীবন কাটাই। এরপর যখন আমাদের চারপাশের পৃথিবীর দিকে তাকাই, তখন দেখি সহিংসতা আর ঘৃণার রাজত্ব, কপটতা আর বিশ্বাসঘাতকতার ছড়াছড়ি। অবিচার আর নিষ্ঠুরতা আমাদের বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়, ধর্ম নিয়ে মানুষের বর্বরতা বিশ্বাসীদের প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়, বর্ণবাদ আর বৈষম্য প্রতারকদের ওপরে ওঠায়, মানুষ জীবিত অবস্থাতেই কবরে বাস করে আর সুখ খোঁজে, কাম আর কামনার আগুনে পুড়তে থাকে।

মিথ্যেবাদীদের পৃথিবী বুদ্ধিমান বলে ডাকে, নিষ্পাপদের বলে নির্বোধ।‌ যারা কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই, তাদেরকেই কিনা পৃথিবী ডাকে সুবিধাবাদী বলে! স্রষ্টা প্রার্থনাকক্ষে বাস করেন না, প্রার্থনাকারীদের হৃদয়ে বাস করেন। দূরের কোনো নির্জন পাহাড়ে, দ্বীপে, উপত্যকায় বা তীর্থক্ষেত্রে গেলে স্রষ্টার খোঁজ পাওয়া যাবে না, নিজ হৃদয়ের গোপন মণিকোঠায় স্রষ্টার অধিষ্ঠান। আমাদের পরম শান্তির খোঁজ আমাদের হৃদয়ের ভেতরেই, আমাদের ক্ষমতার পরিমাণ আমাদের সকল কল্পনার চাইতেও বেশি—আমরাই আলো, আমরাই আঁধার। যে-আঁধারের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করে চলেছি, সে আঁধার আমাদের হৃদয়ের ভেতরে; যে-আলোর খোঁজে আমরা জীবন কাটাই, সে আলোটাও হৃদয় হতে আসে। আমাদের মহত্তম সৃষ্টি কিংবা ভয়ঙ্করতম প্রলয় দুই-ই আসে আমাদের মধ্য থেকেই। স্রষ্টা আর আমরা—এর মাঝে আর কিছু না থাকুক।

কোনো ধর্মগুরু, কোনো ধর্মালয়, কোনো প্রার্থনাপুস্তক, কোনো ধর্মীয় সংস্কার—কিছুই আমাদের স্রষ্টার কাছে নিয়ে যেতে পারবে না, যদি আমরা আমাদের মনকে স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে না পারি। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের রীতি আমাদের জীবনদর্শনের সাথে মিল রেখে গড়ে ওঠে। কোনো ধর্মদর্শনই শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট নয়। অন্যের দর্শনকে আহত করে কিংবা ছোটো করে যত নিখুঁত প্রার্থনাই করি না কেন, স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব নয়।

আমাদের হৃদয় আমাদের প্রার্থনাঘর। সে ঘরে শান্ত সমাহিত হয়ে নিজেকে চারপাশের জগত ও অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের সামনে তুলে ধরতে হয়। এই হৃদয়ের শুদ্ধতাই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রকাশ করে। আমরা যখন বলি, আমরা স্রষ্টাকে ভালোবাসি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসাই প্রকাশ করি। আমরা যদি আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করি, তবে আমাদের কাজগুলি আমাদের প্রার্থনার মতো পবিত্র ও আন্তরিক হয়ে ওঠে, আমাদের ভাবনাগুলি আমাদের হৃদয়ের সবচাইতে মহৎ বৃত্তিগুলিকে তুলে ধরে। যে-উপায়ে আমাদের নিজেদের সবচাইতে সুন্দর রাখা যায়, সে উপায়টি অনুসরণ করতে যা যা করা প্রয়োজন, তার সব কিছুই আমরা করি। স্রষ্টার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাদের সুন্দর করে ভাবতে শেখায়; এতে আমাদের নিয়ত নিখাদ, নিষ্কলুষ ও দৃঢ় হয়, আমাদের শরীরে ও মনে এক আশ্চর্য শক্তি সঞ্চারিত হয়। তখন আমাদের যাপিত জীবনকে আমরা সুন্দর ও সত্য পথে পরিচালিত করি, যা আমাদের শান্তি দেয়, আমাদের মনে স্বস্তি বাড়ায়, আমাদের মানসিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের ও পৃথিবীর কল্যাণ করতে পারি।

ভালোথাকা ও ভালোরাখাই সবচাইতে উত্তম প্রার্থনা। তাই স্রষ্টাকে ভালোবাসা মানে নিজেকেই ভালোবাসা। এই ভালোবাসার মধ্য দিয়েই প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান মেলে। পৃথিবীর সব বইয়ের সবকটা অক্ষর মিলেও এর সিকিভাগ‌ও জ্ঞানের খোঁজ দিতে পারে না। আমরা যখন আমাদের অহং নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তখন আমরা নিজেদের সুন্দরতম সত্তার খোঁজ কিছুতেই পাই না। সেসময় অন্ধকারের পুরু পর্দা এসে আমাদের সামনের আলোর পথকে আড়াল করে রাখে। যখন সেই ঘন আঁধার সরে যায়, তখন আলোর ঝরনাধারা হৃদয়ের সবকটা দীপ একে একে জ্বালিয়ে দেয়। মন্দিরের সবকটা বাতি জ্বালিয়ে যেমনি করে পবিত্র মনে স্রষ্টাকে একাগ্রচিত্তে ডাকা যায়, তেমনি হৃদয়ের সবকটা প্রকোষ্ঠে আলো জ্বালিয়ে প্রাণের সাধনায় সিদ্ধিলাভের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। স্রষ্টা কোনো ধর্ম চেনেন না, কোনো প্রার্থনাগৃহের কাঠামোর নির্দিষ্টতা তাঁকে বাঁধতে পারে না। স্রষ্টা শুধু হৃদয়ের নৈবেদ্যে তুষ্ট হন। সে প্রসাদেই মানুষ পরম সুখের সন্ধান পায়।