স্যার স্যার, ভালো পটল আছে! নেবেন? একদম ফ্রেশ! আলু, বেগুন, শিম…লাগবে, স্যার? কম দামে দেবো… ওর কথা শেষ হবার আগেই সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলাম, ওর বাঁ-গালে। লকডাউন চলছে, এখন ঘরে থাকতে হবে। এখানে কী? সে দাঁড়িয়ে গেল! ওকে বললাম, এক্ষুনি কানে ধর! ধর বলছি! আর একটিও বাক্যব্যয় না করে সে কানে ধরল। বলতে লাগলাম, বোস…ওঠ…বোস…ওঠ…বোস…ওঠ… আর বলতে হলো না, সে এখন নিয়ম মানছে। বাঙালি এভাবেই সোজা হয়! সে এখন বাধ্য নাগরিক। সুনাগরিক। একটা তালি হবে, তালি…! আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। সুনাগরিকের ছবি তুলে রাখা দরকার। আমার নিজের হাতেগড়া সুনাগরিক! এই ব্যাটা! হাতদুটো দুদিকে টান টান করে রাখ! ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক! সে হাসছে না, একটু হাসলে ছবি আরও ভালো আসত। উঠবস চলছে…আহা কী ভালো! আহা কী ভালো! চাচার শিক্ষা হয়ে গেছে। মিশন সাকসেসফুল! চাচা পসরা গুটাচ্ছে… সবাই দেখছে। সবাই সচেতন হচ্ছে। কেউ কেউ পালাচ্ছে…পালালে পালাক! সবাই ঘরে ফিরুক! ঘরে থাকুন! ঘরে থাকুন! হাত ধুতে থাকুন…ধুতে থাকুন! খবর্দার, কেউ বেরোবেন না! ওই তো ওইদিকে! শালা, লকডাউনের সময় রিকশা চালাও, ফাজলামো পেয়েছ, না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা! এই ধর ধর! পিঠের উপর কয়েক ঘা না পড়লে কেউ সোজা হয় না। ছুটে গেলাম! আমার হাতের লাঠিটা অবিচল মেজাজে তার দায়িত্বপালন করল! সবাইকেই সুনাগরিক হতে হবে। এখন ঘরের বাইরে আসা যাবে না। ঘরে থাকতে হবে, মরতে হলে ঘরে থেকেই মরতে হবে। বেচারা পড়ে গেল। দেখলাম। বড্ড মায়া হলো! আহা আহা! মায়া খুব খারাপ জিনিস, মায়া থাকলে পকেটে পয়সা থাকে না। ওইদিকের দোকানটা খোলা। একসের চাল কিনলাম। ওকে দিলাম। সে অনেক খুশি। তার শরীরে আর ব্যথা নেই। সে আমার জন্য দোয়া করছে। খুশি হয়ে ওর সাথে একটা সেলফি তুললাম। পুরো ব্যাপারটা সবজিওয়ালা দেখছিল। সে একছুটে আমার কাছে এল! স্যার, আমাকে কয়েক ঘা দেবেন? একসের চাল খুব দরকার। আমার নাতনিদুটো না খেয়ে আছে! আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি, আমি বুঝতে পারছি না, এখন কী বলতে হয়। আমি বিব্রত! ওকে এখান থেকে সরাতে হবে। অগত্যা, ওকেও চাল কিনে দিলাম। এরপর পড়ে গেলাম মহাবিপদে! আরও কয়েকজন মানুষ এসে জড়ো হলো। ওরা আমার দিকে তাকাচ্ছে। ওরা কেন এল? ওদের কী লাগবে? আমার কাছে কী? ওদের কথা শুনে যা বুঝলাম, ওরা সবাই কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি খেতে চাইছে। দেখলাম, কেউ কেউ কয়েক ঘা পাবার আশায় সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। ওদের চড় কিংবা ঘুসি হলেও চলবে, আমার যেমন খুশি! ওদের আজ কাজ নেই, হাতে পয়সা নেই, চালকেনার সামর্থ্য নেই। আমি হকচকিয়ে গেলাম! ওরা বলে কী! লকডাউনের সময় ওরা এখানে কী করছে? ভাইসব, আপনারা বাড়ি ফিরে যান! নিরাপদ আশ্রয়ে থাকুন। সময় এখন ভালো নয়। এই দুর্যোগ কেটে যাবে। তখন নাহয় রাস্তায় নামবেন। বেঁচে থাকলে কাজ অনেক করা যাবে! ঘরে যান, দরোজা বন্ধ করে হাত ধুতে থাকুন। আপাতত ঘুমান। ওরা আমার কথা শুনছে না। ওরা চেঁচাচ্ছে। ওদের চাল নেই, ওদের চাল লাগবে। ওরা অবাধ্য নাগরিক। ওরা ক্ষুধার্ত। ওরা সবই বোঝে, তবু কিছুই মানে না। ওদের কারও কারও ঘর নেই। কারও কারও ঘর আছে তো দরোজা নেই। ওদের দরোজা বন্ধ করার উপায় নেই। ওদের দরোজা খুলে বাঁচতে হয়! ওদের ঘরে শিশুরা কাঁদছে। ওরা মহামারি বোঝে না, ওরা কেবলই ক্ষুধা বোঝে। ওরা কেউ আমার কথা শুনছে না। হইচই ক্রমেই বাড়ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। আমাকে অন্য এলাকাতেও যেতে হবে। এখানে আর একমুহূর্তও নয়! এরা সুনাগরিক নয়, এরা কেবলই ক্ষুধার্ত! এরা কেবলই খাই খাই করে! এমন অবোধ অবাধ্যতা উপেক্ষা করে কিছু সুনাগরিক নিশ্চয়ই কোথাও-না-কোথাও নিজের ঘরে হাত ধুয়ে ঘুমাচ্ছেন। ঈশ্বর ওঁদের মঙ্গল করুন।