সিলেট ডায়েরি (৭)



May 4
এক। বাসে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটে ফিরছি। এরপর বন্ধুর বাইকে বিয়ানীবাজার। আজকের বাসড্রাইভার গতিদানব টাইপের। পারলে বাসটাকে উড়িয়ে নেয়! ও কাউকেই ওর আগে যেতে দেবে না। একটু পর পরই বাসটা হরিণশাবকের মতো লাফিয়ে উঠছে। সামনের সিটে বেড়ালছানার মতো কিউট একটা মনুষ্যছানা মায়ের কোলে বসে বসে প্রভাতরাগের বিলম্বানুশীলনরত। বাসটি লাফালেই ও বিস্ময়ে থেমে যাচ্ছে। আবার প্রবলোত্‍সাহে সেইরকম চিল্লাচিল্লি! মহিলা বার বারই বলছেন, "ওই বান্দরের বাচ্চা! কানবি না। তুইল্যা আছাড় মারমু কইলাম।" মাঝে মাঝে বান্দর মহোদয়ের সাথে ফোনে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিত্‍কার করে করে কথা বলছেন। না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, কথা হচ্ছে ফোনে। ওঁর গলার স্বরের তীব্রতায় এটা মাথায়ই আসে না, উনি ফোন ব্যবহার করছেন। ভদ্রমহিলা আরেকটু কষ্ট করে গলার স্বর আরেকটু উঁচু করলে আর মোবাইল ফোনই লাগত না। কিছু পয়সাও সেইভ হত। বুদ্ধিটা দেবো নাকি? ক্যাটক্যাটে লাল লিপস্টিক-দেওয়া দুটো তরুণী কী নিয়ে যেন হা-হা-হি-হি করছে। এ বয়েসিরা কোনো কারণ ছাড়াই হা-হা-হি-হি করতে পারে। ওদের দেখাচ্ছে লাল-কালো পরীর মতন। বিআরটিসি'র এ বাসটি কুমিল্লায় যাবে। একটু পর সিলেটে নামব। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাত্‍ জেগে ওপরের কথাটা লিখতে ইচ্ছে করল। আরও অনেক মজার ব্যাপার শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। ওসব লিখলে একটা ছোটোখাটো বাসভ্রমণনামা হয়ে যাবে। থাক! নামতে হবে। হুমায়ূন রশীদ চত্বর।


দুই। : এই, তোমরা কোন গ্রুপ?: স্যার, আমরা জামাল গ্রুপ।


কলেজের মাঠে স্যার কিছু স্টুডেন্টকে ওরা সায়েন্স, হিউম্যানিটিস না কি কর্মাস গ্রুপের, এটা জিজ্ঞেস করায় ওই উত্তরটা এল। কলেজে ছাত্রলীগের ৩টা গ্রুপ আছে। ওদের মধ্যে প্রভাববিস্তার নিয়ে মারামারি লেগেই থাকে। "স্যার, প্রতিসপ্তাহে অন্তত ৩ বার আমাদের কলেজে যেতে হয়।"—ওসি সাহেবের কথা। কলেজের নাম বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ। ওদের কাজ দুটো। প্রেম করা আর গ্রুপিং করা।


বিয়ানীবাজারের পৌরসভা চেয়ারম্যান লুঙ্গি পরেই অফিস করেন। সব জায়গাতেই লুঙ্গিতে যাতায়ত করেন। অঢেল সম্পদের মালিক। একবার উনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। যথারীতি লুঙ্গি পরেই। এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর আগে ওঁকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে প্যান্ট পরতে রাজি করানো হলো। গাড়িতেই লুঙ্গি চেইঞ্জ করানো হলো। প্যান্ট-পরা অবস্থায় ওঁর অস্বস্তি ছিল দেখার মতো। প্লেনে ওঠা পর্যন্তই। উঠেই আবার লুঙ্গি-পরা জেন্টলম্যান হয়ে গেলেন। উনি ডিসি অফিস থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই ওই পোশাকে যান। ওসি সাহেব জানালেন, মানুষ হিসেবে উনি বেশ ভালো। এলাকার জন্য কাজ-টাজ করেন। গত ১৪ বছর ধরে উনি চেয়ারম্যান। ওঁর একটা বিখ্যাত ডায়লগ হলো: ও আচ্ছা, (অমুক সাহেব) টাকা খান না? বুঝলাম। তো, কত টাকা খান না?


: আপনি কেমন আছেন?
: জি না স্যার, ভালো আছি।


বিয়ানীবাজারের লোকজন এই স্টাইলে কথা বলে। যে-প্রশ্নই করা হোক না কেন, উত্তর শুরুই হবে 'জি না স্যার' দিয়ে। ইউএনও স্যার বেশ মানিয়ে চলতে পারেন। খুব ফ্রেন্ডলি আর পিপল-ওরিয়েন্টেড। উনি এইচআরএম বেশ ভালো জানেন। কোন সেবাগ্রহণকারীকে কতটা সুন্দরভাবে ‘না’ বলতে হয়, সেটা স্যারের কাছ থেকে শেখার আছে। খুব দ্রুত লোকজনের সাইকোলজি ধরে ফেলতে পারেন। সবাইকে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলেন। সিলেটের লোকজনকে ডিল করতে এর চাইতে অব্যর্থ বুদ্ধি আর নেই। কারও উপর খুব রেগে গেলেও পরে ব্যাপারটাকে এমনভাবে হ্যান্ডেল করেন যে, ওঁর রাগ আর থাকবেই না। সত্যিই ওঁর পাবলিক ডিলিংস খেয়াল করার মতো। স্যারের সেন্স অব হিউমারও বেশ ভালো। যে-ব্যাপারটা আমাকে সবচাইতে মুগ্ধ করেছে, সেটা হলো, স্যার কখনোই আলগা ভাব-টাব ধরেন না। কোনো কারণ ছাড়া লোকজনকে আজাইরা পেইন দেন না। শুধু কাগজে-কলমে দরকার, এমন ব্যাপারগুলোকে কাগজে-কলমেই রাখেন। লোকদেখানো সিরিয়াসনেস ওঁর মধ্যে দেখিনি। উনি কী, সেটা নিয়ে ওঁকে সাতকাহন বলতে হয় না, কাজের মাধ্যমেই দেখান। যে-কাজ দু-ঘণ্টায় করা যায়, সে কাজ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার মানুষ উনি নন। সবার তো দু-ঘণ্টার কাজ করতে দু-ঘণ্টাই লাগে না। আধঘণ্টায় খুব ভালোভাবে কাজটা শেষ করে ফেলতে পারলে বাকি দেড় ঘণ্টা ঘুমোলে অসুবিধেটা কোথায়? উনি শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইউএনও'র পুরস্কার পেয়েছেন। স্যারকে দেখে বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ আর শেক্সপিয়ারের ‘মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং’ নাটকের কথা মনে পড়ে। আসলে বড়ো মানুষ বড়ো ভাব ধরে না, ফাউলরাই ধরে। ওদের ধরতে হয়। নাহলে থলের বেড়ালটা বেরিয়ে আসবে যে!


লোদী সাহেবের বাগান দেখলাম। ফলজ আর ভেষজ। গাছ আমার এমনিতেই পছন্দ। তার উপর এখানে বেশ কিছু দুর্লভ প্রজাতির গাছ দেখলাম। ভালো লাগল। ভদ্রলোকের রুচির প্রশংসা করতেই হয়। এখন ঐতিহাসিক নানকার কৃষক বিদ্রোহে সম্মুখ যুদ্ধে নিহত রজনী দাস, ব্রজনাথ দাস, প্রসন্ন কুমার দাস, পবিত্র কুমার দাস, অমূল্য কুমার দাস, কুটুমণি দাস—এই ৬ বীর শহিদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের সামনে আছি। অমূল্য কুমার দাসের ছোটোভাই অপূর্ব কুমার দাসের সাথে দেখা হয়ে গেল। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্টের দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় কৃষক অমূল্য কুমার দাস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দৌড়ে এখানে এলে পুলিশ অন্যান্যদের সাথে ওঁকেও গুলি করে মেরে ফেলে। বেরিয়ে যাবার সময় কোনো বাধাই ওঁকে আটকাতে পারেনি। ভাত খাওয়া শেষ না করেই উনি জোর করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেছিলেন, আমাদের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের ভাইদেরকে ওরা মারছে। আমি কীভাবে ঘরে বসে থাকি?


সৌধটি সোনাই নদীর পাড়ে। কিছু পিচ্চি আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। ওদের কাছ থেকে কাঁচাআম নিয়ে খেলাম। স্থানীয় লোকজনের সাথে গল্প করছি। বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে গল্প। সময় থাকলে সেসব কথা লিখতাম। ঘুরতে ঘুরতে আর কতই-বা মোবাইলে টাইপ করা যায়! এখন সবাই মিলে সোনাই নদীতে পড়ন্ত বিকেলে নৌকোয় ঘুরে বেড়াব।

May 5
শেওলা-সূতারকান্দি সীমান্তে ইন্ডিয়ান কাস্টমস অফিসে ঘুরতে এলাম। এ অফিসে সবাই বাংলায় কথা বলে। অন্যদেশের মানুষ আমার ভাষায় কথা বলে, এ অনুভূতি বড়ো আনন্দের। এখানে দেখলাম, অফিসের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড সবই প্রাণ-আপের স্পন্সর করা। আমাদের কোম্পানী আরেক দেশে রাজত্ব করছে। আমাদের প্রোডাক্ট ওদের মার্কেট দখল করে নিয়েছে। এসব ভাবলেই মন ভালো হয়ে যায়।


এপারের সীমান্তে আমাদের কাস্টমসের অফিসে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে ওপারের সীমান্তে গেলাম। ইন্ডিয়ান কাস্টমস অফিসের ইনচার্জ সুপারিনডেন্টের আদিবাড়ি বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জে। এ কারণেই আমাদের প্রতি ওঁর আবেগটাও অনেক বেশি। নিজের দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা সহজাত। উনি বার বারই সবাইকে পরিচয় করে দিচ্ছিলেন, আমার দেশের মানুষ! আমার দেশের মানুষ!! হবিগঞ্জের স্মৃতির রোমন্থন করতে করতে আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলেন। চোখে জল এসে যাচ্ছিল। দৃশ্যটা দেখার মতো। সত্যিই খুব সুন্দর একটা অনুভূতি হলো। আমার মনে হচ্ছিল, এই একটা বর্ডার না থাকলে কী হত? লেননের ‘ইম্যাজিন’ গানটার কথা মনে পড়ছিল। উনি কথায় কথায় বললেন, My father was a student of Sylhet MC College. He got 97 in Sanskrit. I feel proud to say that it's still a record! গর্বে ওঁর চোখমুখ চকচক করছিল। দেখে খুব চমত্‍কার লাগছিল। পুরোনো সাফল্যের কথা বলতে ও শুনতে বড়ো আনন্দ হয়। আর সেটা যদি হয় সেরাদের সেরা, তাহলে তো কোনো কথাই নেই! বলার মতো কিছু থাকলে তো বলবেই! যার বলার মতো ইউনিক কিছু নেই তার কাজ—শোনা। আমার নিজের সাথেও কেমন জানি একটুখানি মিলে গেল।


মজার ব্যাপার হলো, আসামের করিমগঞ্জের ওই জায়গায় গ্রামীণফোন আর বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক আছে। ইন্ডিয়ান কাস্টমসের আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মতো। ওই ভদ্রলোক বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বললেন। কী যে ভালো লাগছিল! আমার মাকে নিয়ে কেউ ভালো কিছু বললে মনে হয়, এই মানুষটা এত ভালো! খুবই আপন আপন লাগে।


ফিলিং বাংলাদেশ বাংলাদেশ!!


May 6
এক। গতকাল অফিস আর সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হলো। বিয়ানীবাজারের এক ভদ্রলোক আবদুল আলীম লোদী। (উনি ইব্রাহীম লোদীর কেউ হন নাকি?) গাছ ভালোবেসে ভেষজ আর ফলজ উদ্ভিদের বাগান গড়ে তুলেছেন। ওঁর প্রচণ্ড ইচ্ছে, এ লোদী গার্ডেনের কথা দেশময় ছড়িয়ে যাক। সবাইকে খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাগান দেখান। কালকে সন্ধ্যায় অসম্ভব টায়ার্ড ছিলাম। শুধু কাউকেই 'না' বলতে পারি না বলে ওঁর অনুরোধ আর আগ্রহে রাত সাড়ে ৮টার দিকে লোদী গার্ডেনে গেলাম। দেশি-বিদেশি অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছে বাগান ভর্তি। উনি টর্চলাইট জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে গাছ চেনাচ্ছিলেন। গাছ আমি নিজেও ভালোবাসি, গাছের প্রতি একধরনের মমত্ব অনুভব করি। কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক অবসাদের কারণে অতিবিরক্ত লাগছিল। তবুও কষ্ট করে হাসিমুখে ওঁর কথা মন দিয়ে শোনার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। এমনই ঘর্মাক্ত হাসিমুখ, ওঁর অনুরোধে যে কয়েকটি ছবি তুলেছি, তার প্রত্যেকটাতে আমাকে দেখাচ্ছে পকেটমারের মতো, দেখলেই যে কারুরই ধরে গণধোলাই দিতে ইচ্ছে করবে। গাছ নিয়ে ওঁর প্রচণ্ড আবেগ আর ভালোবাসা সত্যিই দেখার মতো। এ পৃথিবীতে শুধু আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে মাস্টারপিস বানানো সম্ভব। সাথে প্রয়োজন অক্লান্ত পরিশ্রম করার মানসিকতা। এর সবই লোদী সাহেবের আছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। গতকাল এটা আরও একবার শিখলাম।


রেস্টহাউজে ফিরলাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে। শরীর যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। পরদিন, মানে আজ সকাল ৭টায় আবার ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে। এদিকে ‘প্রথম আলো'-তে শুক্রবারের চাকরি-বাকরি পাতায় বিসিএস লিখিত পরীক্ষার বাংলাদেশ বিষয়াবলীর প্রস্তুতিকৌশল নিয়ে লেখাটা রেডি করে বুধবার বিকেলের মধ্যেই পাঠাতে হবে। মানে, লেখাটা যে করেই হোক, রেডি করতে হবে আজ রাতের মধ্যেই। কিন্তু এ শরীর নিয়ে সেটি কিছুতেই সম্ভব নয়। স্নান-টান সেরে সাড়ে ১১টার দিকে ‘প্রথম আলো'-তে ফোন দিলাম। 'অনিবার্য কারণবশত আজকের লেখাটি ছাপানো সম্ভব হলো না। লেখাটি আগামী সংখ্যায় ছাপানো হবে।'—আমার পক্ষে এ ক্লান্ত শরীর নিয়ে লেখাটা খুব কঠিন হবে, তাই ওরকম কিছু একটা ছেপে দিতে বললাম। কিন্তু উনি জানালেন, এ মুহূর্তে এটা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সবাই লেখাটির জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। একটু কষ্ট হলেও যেন দয়া করে লিখে দিই। . . . সত্যিই অসহায় লাগছিল। যেমন-তেমন করে তো আর লেখাও যায় না, এত লোক পড়বে! তার উপর এ ধরনের লেখা লেখার সময় আমার ভেতরে একটা প্রচণ্ড দায়িত্ববোধ কাজ করে।


শওকত ওসমানের ‘জননী’ পড়ছিলাম। ওটা আরও একটু পড়ে-টড়ে সাড়ে বারোটার দিকে লিখতে বসলাম। এ বসা প্রয়োজন থেকে নয়, আবেগ থেকে, ভালোবাসা থেকে, অসীম দায়িত্ববোধ থেকে। জানি, বেশিক্ষণ ঘুমুতে পারব না, কাল মোটামুটি ভোর থেকেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে হবে, তবুও। ল্যাপটপে স্লো ইনস্ট্রুমেন্টাল ছেড়ে লিখতে লাগলাম। ফেইসবুকিং করে-টরে লেখাটা শেষ করে যখন শুতে গেলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন আড়াইটা ছুঁইছুঁই। ঘুমুতে যাবার আগে মনে মনে শপথ করলাম, পরের জন্য আর না, এখন থেকে একটু নিজের জন্য বাঁচব। ‘দুচ্ছাই!’ বলে সব ছেড়েছুড়ে দেবো! কী হবে এসব করে? সবাই তো আর ভালোবাসে না, কেউ কেউ তো গালাগালিও দেয়। কী দরকার! যথেষ্ট হয়েছে! . . . নিজের উপর রাগটা একটা ভোর হওয়া পর্যন্তই! জানি, মানুষের অপরিসীম ভালোবাসায় এই ভূতের বেগার খাটা কখনোই বন্ধ করে দিতে পারব না। হয়তো থমকে যাবো কখনো কখনো, তবুও থামব না। সবচাইতে বেশি কষ্ট পাই, যখন দেখি, আমার কাজগুলো নিয়ে কেউ আজেবাজে মন্তব্য করছে। শারীরিক কষ্টও এতটা কষ্ট দেয় না। এসব লেখালেখি, ক্যারিয়ার আড্ডা, মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং থেকে এ পর্যন্ত একপয়সাও তো কোনোদিনই নিইনি!


তিন ঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছি। ৭টায় ঘুরতে বের হলাম। এখন আছি বিছানাকান্দি আর পাংথুমাইয়ের পথে। এরপর রাতারগুল, জৈয়িন্তাপুরের সাইট্রাসবাগান, রাজবাড়ি, লালাখাল। বিছানাকান্দি যাবার রাস্তার দু-পাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিল-হাওড়ের দূশ্যটা দেখার মতো। রাস্তার ধারে সারি সারি জেন্টলম্যান-দেখতে গাছগুলো, এরই মাঝ দিয়ে ছুটে চলা। বস্তুত জীবন তো ছুটে চলাই! হোক সুন্দরের মধ্য দিয়ে কিংবা অসুন্দরের মধ্য দিয়ে। জীবন শুধু সুন্দরই নয়, জীবন অসুন্দরও। আমার প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্টকে মনে পড়ছে: জীবন সম্পর্কে আমি যা শিখেছি, সেটিকে আমি তিনটি শব্দে বলে দিতে পারি—জীবন বয়ে চলে। ‘দ্য শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশন’-এর অ্যান্ডি ডুফ্রেইনের কথাটি মাথায় রেখেও জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়: Get busy living, or get busy dying.


দুই। এ নিয়ে ১২ বার। পিয়াইন নদীতে পানি এখন কম। নদীর তলদেশে বার বারই নৌকো আটকে যাচ্ছে। এভাবে নাকি অনেকসময়ই নৌকো উলটে-টুলটে যায়। এদিকে আমি সাঁতারও জানি না। মাঝিরা প্রায়ই নৌকো থেকে কোমরপানিতে নেমে নৌকো ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এগুচ্ছে, সাথে আমরাও। আমরা দশ জন কলিগ ব্যাপক মজায় আছি। হইহুল্লোড় চিত্‍কার চেঁচামেচি। নদীর দু-ধারে শাদা পাথরের স্তূপ। নদী থেকেই তোলা। বাকিগুলো সব হ্যাকনিড! কলার ভেলার সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁসের ভেসে চলা, সবুজের মেলা, জারুলের স্বর্গীয় ফুলের নিচে বিশ্রামমাচা, জেলেশিশু কিংবা শিশুজেলেদের মাছধরা, মায়ের আঁচল ধরে ধরে থপথপ করে শিশুর নাইতে আসা, ঝোপ কিংবা অরণ্যের দিনরাত্রিতে নদীর সন্তানদের বেঁচে থাকা, নদীর মানুষদের দেখে চিত্‍কার করে হাসিমুখে সর্বজনীন ভাষায় হাতনাড়ানো, দূরের ওই পাহাড়ের হাতছানি, ঝিরিঝিরি গাছের ছায়ায়-ঘেরা কুঁড়েঘরের হাতছানি, ঝকঝকে আকাশের রোদ্দুরের রোদ হয়ে ওঠা, রাজহাঁসের ডানার ঝাপটানিতে রুপোলি রৌদ্রের খেলা, ভেড়ার দলের শাদা পশমে সবুজের মরীচিকা, ঘাটেঘাটে ডিঙিনৌকোর ওঠানামা, এসব আর কি! এসব দেখেনি কে? হ্যাকনিডই তো, না? আমার অনেক লেখায় এসব কথা অসংখ্য বার বলেছি। নৌকোটা এদিক-ওদিক দুলছেই তো দুলছে। ভয় হয়ই! প্রথমদিকের ভয়টা এখন আর অত নেই। আমরা যতটা সহজ করে ফেলেছি, আসলে মরে যাওয়াটা অতটা সহজ নয়। বেঁচে আছি, তাই জীবনটা সুন্দর। ফেরার সময় এ নদীতে হেঁটে হেঁটে ফিরব। ওটা নিয়েও লিখব। কোনো প্রেমিকা নেই, এ লেখার জন্যই তো বেঁচে থাকা!


তিন। সিলেট বিভাগে আর কোথায় কোথায় ঘোরার বাকি, সেটাই তো বুঝতেসি না! এই শুক্র-শনিবার কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, বুদ্ধি দ্যান। সময় থাকলে আমার সঙ্গে চলেন! এই উইকএন্ডটাই সিলেটে আমার লাস্ট উইকএন্ড। এটাকেও কাজে লাগাতে চাই!


সত্যিই ব্যাপক ঘোরাঘুরি করা হয়েছে। আমার অনেক সিলেটি বন্ধু বলেছেন, ওঁরা নিজেও এতটা সিলেট ঘুরে দেখেননি। কেউ কেউ বলেছেন, সিলেটের রূপের প্রশংসা করে এত সুন্দরভাবে আমার আগে কেউ কখনও লেখেননি। মাধবপুর লেকের বর্ণনা পড়ে সাস্টের এক ছোটোবোন ফোন করে বলেছে, দাদা, আমার বাড়ি মাধবপুর লেকের পাশেই। অথচ আপনার লেখা পড়ে মাধবপুর লেকটাকে এখুনি ছুটে গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে!


অনেকেই সিলেটের অনেক স্বল্পপরিচিত স্পট নিয়ে আমার লেখা পড়ার পর আমার সাথে কথা বলে জেনে নিয়েছেন, ওটা দেখতে কেমন, কীভাবে যাওয়া যায়। যেমন, নারায়ণতলা। গুগলে সার্চ করলে এ জায়গা নিয়ে কিছুই আসে না। অথচ জায়গাটা স্বপ্নের মতো সুন্দর!


কালকে বিয়ানীবাজার থেকে সিলেটে ফিরব। আগামী সপ্তাহের শেষে আবার ২ মাসের জন্য ঢাকায় পিএটিসি’তে ফিরে যাব। সিলেটে আছি আর ১ সপ্তাহ। সত্যিই আমার জীবনের সেরা কিছু সময় এখানে কাটিয়ে যাচ্ছি। এই সিলেট ট্যুরের কথা সারাজীবন মনে থাকবে। Dear Sylhet, I will miss you forever! You’re the best girlfriend of my life!


May 13
বিদায় সিলেট !!!


২ মাস! অথচ মনে হচ্ছে কিংবা ভাবতে ভালো লাগছে, এই তো সেদিনই তো মাত্র এলাম! সময় কেটে যায়। আমার জীবনের সেরা কিছু মুহূর্ত এখানে কাটিয়ে গেলাম। সিলেট এবং সিলেটের চমত্‍কার মানুষগুলোকে সারাজীবন মনে থাকবে। সিলেট যতটা সুন্দর, সিলেটিরা আরও বেশি সুন্দর! এত আন্তরিক! এত সহজসরল! এত অতিথিপরায়ণ! আমি সত্যিই অভিভূত! চট্টগ্রাম যদি সৌন্দর্যের রানি হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সিলেট সে রানির আপন ছোটো বোন। অসম্ভব রকমের ভালোলাগা সাথে করে নিয়ে সিলেট ছেড়ে যাচ্ছি। ঠিক এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, কী যেন নেই! কী যেন নেই!! বুকের ভেতরে কেমন জানি এক ধরনের হাহাকার অনুভব করছি। চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবার সময়ও এরকম হয়! তবে কি . . . !!


প্রিয় সিলেট, অনেক বেশিই ভালো থেকো। আবার দেখা হবে . . .
Content Protection by DMCA.com