সিলেট ডায়েরি (৬)


May 2
এক। সুনামগঞ্জের চমত্‍কার সকাল। স্নিগ্ধ রাস্তা, এর আশপাশ। মেঘে-ঢাকা গাছ, মানুষ, পাখি। বৃষ্টি নামবেই নামবে! টাঙ্গুয়ার হাওড় দেখতে যাচ্ছি। সাহিত্যে পারসোনিফিকেশন বলে একটা ব্যাপার আছে। টাঙ্গুয়ার হাওড় নিয়ে যা জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, টাঙ্গুয়ার হাওড়কে পারসোনিফাই করে অনেক কিছু লিখে ফেলা যায়।


গতকাল হাসন রাজার বাড়ি থেকে গিয়েছিলাম নারায়ণতলায়। গুগলে সার্চ করলে আপনি নারায়ণতলার খোঁজ পাবেন না। এ পর্যন্ত সিলেটে যত জায়গা ঘুরে দেখেছি, এর কোনোটাই এর ধারেকাছেও সুন্দর নয়। ছবি দেবো, কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি, ছবি দেখে ওই সৌন্দর্যের টেন পার্সেন্টও বুঝবেন না কিংবা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। আমি ওটা নিয়ে লিখবই, তবে আমার অল্পজ্ঞানে ওই অপার্থিব সুন্দরের কিছুই লিখতে পারব না। খুব বেশি সুন্দরকে বর্ণনা করা যায় না। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর শব্দগুলোও সুন্দরের প্রতি সুবিচার করতে অক্ষম। নারায়ণতলা নিয়ে সিকিভাগও লিখতে গেলে ওখানে দু-দিন থাকতে হবে। ‘অ্যা মাদার ইন ম্যানভিল’ পড়েছেন তো? রলিংস যদি ওই পাহাড়ের ওপরের কটেজে না থাকতেন ওই সময়ে, তবে এতটা চিত্রময় বর্ণনা আমরা পেতাম কি? ‘পোস্টমাস্টার’-এও ওই গল্পের ছায়া দেখতে পাই। রবি ঠাকুর পদ্মার বোটে বসে যা যা লিখেছেন, সেখানেও অনুষঙ্গের ভূমিকা স্পষ্ট। আমি যখন জার্নিতে থাকি, তখন চারপাশটা দেখি আর তা নিয়ে লিখি। আমার লেখা পড়ে পড়ে, আমি যেখানে থাকি, সেখানে আপনারাও বিনে পয়সায় ঘুরে আসেন না? পরে কখনো লিখতে গেলে সেই ভাবটা কিংবা আবেগ এর কোনোটাই ওরকম করে আসে না। তবুও লিখব, সময় করে। নারায়ণতলা নিয়ে না লিখলে রীতিমতো ক্রাইম হবে। প্রয়োজনে ওখানে তোলা ছবিগুলো দেখে দেখে মনে করে করে লিখব। এমন জায়গা নিয়ে অনলাইনে কিছুই থাকবে না, তা কী করে হয়? আমাদের দেশে এমন স্বপ্নের মতো সুন্দর জায়গা আছে, এটা সবাইকে জানানোটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ওটার পাশেই ৪৮ জন মহান শহিদের কবরস্থান আর স্মৃতিসৌধও আছে। নাম, ডলুয়া স্মৃতিসৌধ। প্যাকড শিডিউলে ঘুরতে এলে লেখালেখি দূরে থাক, ঠিকমতো ছবিও তো আপলোড করার সময় পাওয়া যায় না।


সুনামগঞ্জে উঠেছি রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের রেস্টহাউজে (ওরা বলে, ইনস্পেকশন বাংলো বা ইবি)। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এ বৃষ্টিতে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ঘুরতে যাওয়াটা একটু রিস্কি। পৃথিবীর অন্যান্য অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির মতোই এখানে যাবারও খুব সহজ রাস্তা নেই। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাংলোতে ফিরে এলাম। সকাল থেকে প্রাপ্তি এই বৃষ্টিভেজা শহরে হাঁটা আর রাস্তার পাশের আল-ছালা-দিয়া-ঢাকা টাইপের রেস্টুরেন্টের গরম গরম রুটি, ডাল, ডিমভাজি আর চা! অপূর্ব! একচিলতে রোদ্দুরের প্রতীক্ষায় বসে বসে এ স্ট্যাটাসটা লিখছি।


রেস্টহাউজের কেয়ারটেকার জিজ্ঞেস করলেন, "স্যার, আপনি এখানে কী কাজে এসেছেন?" আমি বললাম, "কোনো কাজে আসিনি, ঘুরতে এসেছি।" সে চোখ কপালে তুলে বলল, "স্যার, বলেন কী! এখানে তো পানি আর টিলা ছাড়া আর কিছুই নাই!" কেয়ারটেকার স্বল্পশিক্ষিত মানুষ। ওঁর কথা বাদ দিই। আমি অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এ ভাবনাটা দেখেছি। ধরুন, একটা ঝর্না। ও আচ্ছা, ঝর্না! মানে, উপর থেকে পানি পড়ে। এই তো? তো সেই পানি না দেখলেই-বা কী হবে? পানি পড়ছে, পড়ুক! পড়তে দাও। আবার ওরাই অভিযোগের সুরে বলবে, "জ্যাবনটা ত্যানাত্যানা হয়া গ্যালো! কুনু মজা নাই!" জীবনের সুখ আসলে কী? এর খোঁজে বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে আসতেই হবে? আমার প্রিয় কবি রিলকের ভাষায় আমার ভাবনাটা বলছি: তুমি যদি মনে করো, তোমার জীবনটা সুন্দরভাবে বর্ণনা করার মতো যথেষ্ট সুন্দর না, তবে আমি বলব, তোমার সুন্দর কল্পনাশক্তির অভাব আছে।


জীবনদুঃখী কিটসের কবিতাতে কত সুন্দরের খেলা দেখি। ‘লাস্ট ফর লাইফ’ পড়ে দেখুন। ভ্যান গঘের পোর্ট্রেট দেখে ওঁর লাইফ ট্র্যাজেডি নিয়ে কতটুকুই-বা ভাবতে পেরেছিলেন? আরও অসংখ্য মানুষের কথা বলা যায়। মোবাশ্বের আলীর ‘শিল্পীর ট্র্যাজেডি’ একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলুন। সত্যি বলছি, আপনার নিজের জীবনটার দিকে তাকিয়ে মনে হবে, এই বেশ ভালো আছি! শুকরিয়া!


বাইরে মেঘ নেই। সব মেঘই একসময় কেটে যায়। মেঘভাঙা রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। বের হয়ে পড়ব। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পথে . . . লেখালেখিকে আপাতত ছুটি!


দুই। সাহেববাড়ি ঘাট থেকে নৌকোয় টাঙ্গুয়ার হাওড়ের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। যেতে লাগবে ৫-৬ ঘণ্টা। নৌকোটি বিশাল, বজরা নৌকো। এতে কমপক্ষে ২০০ জন যাত্রী অনায়াসে নাচতে নাচতে যেতে পারে। আর আমরা হলাম সাকুল্যে ৪ জন। এক পরিচিত ভদ্রলোক আছেন, তাঁকে বললাম, "ভাই, বড়ো নৌকো ঠিক করেন, যাতে ডুবে না যায়।" উনি বড়ো-ই ঠিক করলেন। তাই বলে অ্যাত্তো বড়ো! সাধু সাধু!!


ডিয়ার ভাই-বইনেরা! যাঁহারা যাঁহারা আমাদের সহিত টাঙ্গুরের হাওড়ে যাইতে চান, তাঁহারা দলে দলে মিছিলে মিছিলে যোগদান করুন! কোটা খালি! কোটা খালি! কোটাধারীদের জন্য মাত্র ৫০ টাকা! ৫০ টাকা!! আগে আসিলে আগে পাইবেন! সাথে ডিএসএলআর থাকিলে উলটা ৫০ টাকা পাইবেন। আনলিমিটেড খাওয়াদাওয়া ফ্রি!


May 3
এক। রক্তি নদী, জাদুকাটা নদী, বারিক্কার টিলা, তাহিরপুর, কিনশি নদী, বাউলাই নদী, আনসার ক্যাম্প, গোলাবাড়ি গ্রামের হিজলবন আর ওয়াচ-টাওয়ার দেখে এখন টাঙ্গুয়ার হাওড়ের অপূর্ব পরিবেশে টেকেরঘাট আর বড়োছড়ার পথে . . .


গতকাল থেকেই জলের সাথে আছি। গত দু-দিনে যা দেখলাম, তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এ জায়গাগুলো শুধুই অনুভবের। আগুন কেমন, এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি। এখানে সনি এক্সপেরিয়া জেডের ক্যামেরা চোখের কাছে নিতান্তই শিশুতোষ। অথই পানি বলতে আসলেই কী বোঝায়, এখানে এসে শিখলাম। অদ্ভুত অদ্ভুত সব গাছ, সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমি, মন-ভালো-করে-দেওয়া অসংখ্য পাখি, বিচিত্র ধরনের গ্রাম, মানুষের অদ্ভুত সব জীবনযাত্রা, নৌকোযাপন, নদীর জলের রং বদলানো, গরুর গাড়ি, খড়ের গাদা, ফসল-মাড়াই, মাছধরা, অসংখ্য গরুর চরে বেড়ানো, মায়াবী পাহাড়, রোদ্দুরে মেঘ, হরেকরকমের সবুজ, আরও কী কী দেখেছি মনেও পড়ে না। কিছু কিছু জায়গা নিউজিল্যান্ডকেও হার মানায়। ওয়ালপেপার কিংবা গুগলইমেজ ছাড়া এ দৃশ্য সামনাসামনি দেখব, এটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। একটা ডিএসএলআর আর বাইনোকুলারের অভাববোধ করেছি প্রতিমুহূর্তেই। এত সুন্দর সহ্য করা সত্যিই কঠিন! এসব কিছু নিয়ে লেখাটা রীতিমতো দুঃসাধ্য! তবুও সময় করে লিখব, লিখতেই হবে, যত কষ্টই হোক। মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখে দেখে লিখতে হবে। আমি এ দীর্ঘ নৌকোভ্রমণের সময় লেখার চেষ্টা করেছিলাম, পরে দেখলাম, এর সাতকাহন কিছুতেই খুব চটজলদি বলে ফেলা যাবে না। তা ছাড়া এ অবিশ্বাস্য সুন্দর দেখা বন্ধ করে লেখালেখি করার কোনো মানেই হয় না। সুনামগঞ্জ সত্যিই অনন্য! হে ঈশ্বর, পরের জন্মে আমাকে সুনামগঞ্জের কোনো মায়ের গর্ভে জন্ম দিয়ে পাঠিয়ো।


দুই। বুইট্টা!!


প্ল্যান ছিল, টাঙ্গুয়ার হাওড় থেকে নদীপথেই টেকেরঘাট আর বড়োছড়া যাব। যাচ্ছিলামও। কথায় কথায় সারেংকে জানালাম যে, আমি আজকের মধ্যেই ঘোরাঘুরি শেষে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট হয়ে বিয়ানীবাজারে ফিরব। উনি বুদ্ধি দিলেন, নৌকোয় তাহিরপুর নেমে বাইকে চেপে টেকেরঘাট ঘুরে আবার বাইকে সুনামগঞ্জ ফিরলে অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা সময় বাঁচবে। আরও একটু বেশি সময় নিয়ে টেকেরঘাটের ওদিকটায় ঘোরাঘুরি করতে পারব, এই ভেবে তাহিরপুরে নেমে পড়লাম। এতে সারেংয়ের লাভ হলো এই, পুরো পথের বেশিরভাগ অংশই না গিয়েও পুরো ভাড়াটা আর সাথে বকশিসও পেয়ে গেলেন।


খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাইক ঠিক করলাম। ‘গোরে গোরে মুখরে পে কালা কালা চশমা’ পরিহিত এক যুবককে (পরে জানলাম, যুবাদর্শন বয়োবৃদ্ধ বালক। মানবিকের এসএসসি পরীক্ষার্থী। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাইক চালিয়ে পড়ার খরচ জোগাড় করে।) ঠিক করলাম। এ এলাকায় লোকজন ভাড়াবাইকে চলাচল করে। রাস্তাঘাটের অবস্থা অতিবাজে, বাইকই ভরসা। তাহিরপুর থেকে টেকেরঘাট যাবার রাস্তা দুটো। এর মধ্যে একটিকে রাস্তা বলা যায় না। পুরোপুরি গ্রামের মধ্য দিয়ে কাদাপানি ভেঙে ভেঙে যেতে হয়। রাস্তা কম, পেট্রোল লাগে কম। এই অকালপক্ব বালক ওই রাস্তায় গেল। একটু পর পরই বাইক থেকে নেমে কাদার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়। মহাযন্ত্রণা! বেশ খানিকটা পথ গিয়ে একেবারে হাঁটুকাদা। বাইক থেকে নেমে ওই গ্রামের লোকজন কে কী করছে দেখতে লাগলাম। দুটো শিশুকে দেখলাম, একটা ফড়িঙের পাখা আটকে লাফাতে লাফাতে নিয়ে যাচ্ছে। ওদেরকে বললাম ওটাকে ছেড়ে দিতে। ছেড়ে দিল। বাইক-বালককে বললাম, "ভাই, তুমি এ রাস্তা দিয়ে চালাতে পারবে না। অন্য রাস্তায় চলো, প্রয়োজনে কিছু বাড়িয়ে নিয়ো।"


ওদিকে দেখি, সে একটা জলার মধ্য দিয়ে নেবার সময় একপাটি স্যান্ডেল হারিয়ে ফেলেছে। মাছধরার স্টাইলে সে স্যান্ডেল খুঁজছে। দেখলাম, সে আরেক জোড়া স্যান্ডেল পেয়ে গেল। বললাম, বাদ দাও। ওটা পরেই চলো। সে বলল, না, স্যার, এটা হারালে একজন মানুষ রাগ করবে। আপ্রাণ চেষ্টায় সে ওটা খুঁজে পেল। আহা! প্রেমের নাম বেদনা! প্রেম করবে আরামে, সে আবার হয় কীরামে? . . . না, কাব্য-ফাব্য বাদ। বুইট্টায় ফিরে আসি। ওই পিচ্চিগুলোর সাথে গল্প করতে শুরু করলাম। ওই বেচারা তখন কাদাজলাতে হন্যে হয়ে স্যান্ডেল খুঁজছে, আর আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ওই পিচ্চিগুলো কে কে কোন ক্লাসে পড়ে জানতে চাইলাম। ওদের জিজ্ঞেস করতে হয়, স্কুলে যাও? ওদের মধ্যে ছোটোখাটো একজন বলল, সেভেনে। ওর সাইজ দেখে বিশ্বাস হলো না। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ পিচ্চিগুলো সাধারণত মহাফাজিল হয়। প্রচুর মিথ্যে বলে আর লোকজনকে বোকা বানায়। নিশ্চিত গুল মারছে। বিশ্বাস করলাম না। বললাম, তুমি ওয়ানে কিংবা টু-তে। তখন একটা অতিফাজিল পিচ্চি, যে কিনা ফাইভে পড়ে, বলে উঠল, জি না স্যার, হে সেভেনতই পড়ে। হে আসলে বুইট্টা। বুঝলাম না। পিচ্চি বলে কী? দেখলাম ওই পিচ্চিটা ওর মুখ চেপে ধরে ওকে সরিয়ে নিচ্ছে। বাকিরা মুখ চেপে চেপে হাসাহাসি করছে। আমার কিউরিসিটি বেড়ে গেল। ওদেরকে বার বার জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, বুইট্টা মানে, বয়সের তুলনায় খাটো, অর্থাত্‍ 'বুড়া বাইট্টা'-র সংক্ষিপ্ত রূপ। আমি তো হো হো করে হাসতে হাসতে শেষ!


অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আর এই স্ট্যাটাস লিখছি। হায়! এটাও নাকি রাস্তা! তেলাপোকা তবে কেন পাখি নয়? সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে যাচ্ছি। খেতের আইলের মধ্য দিয়ে, হাওড়-বিল পেরিয়ে। প্রায়ই নেমে বালিজলে বাইক ঠেলতে হচ্ছে। এই পুলসেরাত পেরিয়ে সুন্দর দেখতে যাচ্ছি। তবে যাবার রাস্তাটার আশপাশের দৃশ্য অতিঅপার্থিব!


এলাম। মাথানষ্ট দৃশ্য। চুনাপাথরের পাহাড়, অপূর্ব টিলা। আশেপাশের স্থাপনা একটু ভিন্ন ধাঁচের। গাছ, মাঠ, ঝোপ, ভেড়ার পালের চরে বেড়ানো। দারুণ! বুইট্টাকে মনে পড়ে . . .


তিন। পেছনে মেঘালয় পাহাড়। পাহাড়টি পাথরের। সেখানে এদিক-ওদিক ছড়ানো ঝোপ। একটু দূরেই পাহাড়ি ছড়া। পাহাড় বেয়ে কলকল শব্দে পানি নেমে আসছে। এর সামনে কয়েকটি টিলা। দেখলেই ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ঠিক যেন সবুজের চাদর। ওতে কিছু শাদা ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। টিলার নিচেই চারণভূমি। বাছুরেরা আনন্দে লাফাচ্ছে। পাশেই ট্রেনের পুরোনো ইঞ্জিন, কামান, ট্যাংক। খড়ের গাদায় শেষ বিকেলের নরোম আলো এসে কী আশ্চর্য এক সোনালি আভা ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরই মাঝে লেকটি। লেকের স্বচ্ছ জলের রং কোথাও নীল, কোথাওবা সবুজ। লেকের ধারে বসে শনের মতো শাদা চুলের দাদুরা ছিপ ফেলে বসে আছে। টিলায় রাখাল ছেলে বসে বাঁশিতে সুর তুলছে। লেকের পাড়ে ঝিরিঝিরি গড়নের পাতার নাম-না-জানা গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে এসব কিছু উপভোগের সময় শাদা রাজহাঁসের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে মনে হতেই পারে, বেঁচে থাকাটা এত আনন্দের! কী আশ্চর্য!


লেকটির নাম কুয়ারি। কুয়োর মতো গভীর বলে এমন নাম। দেখতে অপূর্ব সুন্দর! আমি এর সিকিভাগও বর্ণনা করতে পারব না। এরপর দেখলাম এক খাসিয়া রাজার বাড়ি। ওঁর কবরের গায়ে বাংলার স্বাধীনতার কথা লেখা আছে। ওই কথাগুলোই ছিল মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ কথা। ওঁর নাম U Wickliffe Syiem. পড়াশোনা করেছেন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। খাসিয়াদের ভালো লেগে গেল। ওরা খুব ভদ্র।


এর আগে ঘুরে দেখলাম লাকমাছড়া। পাহাড়ি ছড়া। স্ফটিকস্বচ্ছ জলের নিচে পাথর আর বালির খেলা। মেঘালয় পাহাড়। এ পাহাড়ের শরীরে পাথরের বেসাতি। বিশাল বিশাল পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে রংঢং করে ছবি তুললে অন্তত এক-শো লাইক তো পাওয়া যাবেই! ওদিকটায় আসাম। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো এমনিতেই খুব সুন্দর। মন আর চোখ দুটোই জুড়িয়ে যায়। সত্যিই দেখার মতো। কিছুদূর পর পরই নিউজিল্যান্ডের মতো চারণভূমি। বড়োছড়া এলাকাটা খুবই সুন্দর। একেবারে বিকেলের শেষ সোনালি নরোম আলোটার মতোই সুন্দর। ফণাতিথি নদী; নদীতীর একেবারে ছবির মতো কথা বলে যেন! এর পাশেই জয়নাল চেয়ারম্যানের শিমুলতুলা আর লেবুর বাগান। বিশাল এলাকাজুড়ে অদ্ভুত রকমের ভালো-লাগার শান্ত একটা বাগান। গাছগুলো বর্গাকারে খুব যত্ন করে সাজিয়ে লাগানো। শুধু কয়েকটা ছবি তোলার জন্যও এখানে কষ্ট করে আসা যায়। আমি বাজি ধরে বলছি, বাগানের যেদিকেই তাকাবেন, চোখ ফেরাতে বেশ কিছুটা সময় লাগবেই। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, আপনি বাগানের যেখানেই যে-প্রান্তেই দাঁড়ান না কেন, আপনার দু-দিকে দুই সারি শিমুলগাছের অপূর্ব সুন্দর সজ্জা ক্যামেরার লেন্সে ফ্রেমবদ্ধ করা যাবে। বাগানটি একটু উঁচুভূমিতে। এর নিচে একটু দূরে ফণাতিথি নদীর মায়াবী বালুতট। যেদিকেই চোখ যায়, ধূ-ধূ শাদা বালি—অনেকটা জাদুকাটা নদীর বালুতটের মতোই। চাঁদনি রাতে এখানে থাকলে চন্দ্রাহত হবেনই! এ শিমুলবাগানে আপনার জীবনের সেরা বিকেলগুলোর একটি কাটাতে আপনার প্রেয়সীকে লাগবে না। সত্যি বলছি!


আজ সারাদিনের আবহাওয়াটা ছিল অতি চমত্‍কার। ঘুরে বেড়ানোর জন্য একেবারে আদর্শ। চরকির মতো শুধু ঘুরেছি আর ঘুরেছি। আর শ্রীকান্ত কানে গুনগুন সুরে গেয়েই গেছে, ভালো লাগছে, ভালো লাগছে; কেন তা বলতে পারি না . . . বাইকে চেপে টেকেরঘাট থেকে সুনামগঞ্জে ফিরছি। দু-পাশে ফসলের মাঠ। বাঁশবাগান আর বাদামবাগান। এ এলাকায় বেশ বাদাম হয়। রাস্তায় রাস্তায় বাদাম শুকোতে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে এত এত বাদাম ছড়ানো! এখানে বাদাম-খাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেম করেই কয়েকটা জীবন দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে। আহা! শুধু কারও হাত ধরে বসে বসে এ বাদাম খাওয়ার জন্য হলেও একটা প্রেম করা যায়!


আচ্ছা, বাদাম বাদ। এবার লেবু। সন্ধ্যার হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাইক ছুটছে। একটু পর পর লেবুর স্নিগ্ধ গন্ধ। যেন ঠান্ডা হাওয়ায় পুরোপুরি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কথা সেটা না। কথা হলো, লেবু নিয়ে কী বলা যায়? লেবু চিবিয়ে চিবিয়ে প্রেম করলে তো আর ভালো দেখায় না। আচ্ছা, বলেই ফেলি! এমন অপূর্ব ঘ্রাণের লেবুর রস আর কচকচে কাঁচামরিচ দিয়ে সদ্যফোটা ফুলের মতো গরম গরম ভাতের সাথে মেখে খাওয়ার জন্য কচি ধনেপাতা আর টম্যাটো দিয়ে মসুরির ডাল রান্না করে দিতে বলার জন্য হলেও একটা টুকটুকে বউ ঘরে আনা যায়!


সন্ধের নৈঃশব্দ্যকে হেডলাইটের তীব্র আলো আর হর্নের শব্দ প্রচণ্ডভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শালার রাজ্যের আনরোম্যান্টিক পোকার দল আমার চোখে-মুখে উড়ে উড়ে পড়ছে। হায়! অসূয়ান্ধ পতঙ্গকুল আমার ইশটিটাশ আর বাড়াতে দিল না। এমন মুনলিট নাইটে ব্যাটারা আমাকে সানগ্লাস পরিয়েই ছাড়বে দেখছি! দাঁড়া! তোদের মজা দেখাচ্ছি! সুস্বাদু পোকার স্যুপ রান্না করতে পারে, এমন মেয়ের সাথে প্রেম করে বিয়ে করব!


বাইক থামাতে বললাম। শনির হাওড়ের ধারে বসে চাঁদের আলো দেখব। কে যেন একটু দূরেই নাকিসুরে একটা অপরিচিত লোকাল ফোকগান গাইছে। খেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জ্যোত্‍স্নায় গা ধুয়ে নিচ্ছি আর গাইছি…চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে . . . বাইক স্টার্ট দিয়েছে। এখনই আবার রওয়ানা করতে হবে। নাহলে সিলেটে ফেরার গাড়ি মিস করে ফেলব।
Content Protection by DMCA.com