April 27
আজ সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা আর মোল্লাপুর ইউনিয়নের ৩-৪টি বাড়ি ঘুরে দেখলাম। দেখার মতো একেকটা বাড়ি! কী নেই বাড়িতে? সামনে লেক, তার উপরে ব্রিজ। বাড়ির ভেতরে হরিণের খাঁচা, বিশাল উঠোন, ফসলের খেত, ফলের বাগান, ফুলের বাগিচা, টিলার মধ্য দিয়ে দিয়ে বাড়িতে ওঠার রাজকীয় রাস্তা, সে রাস্তার কোথাও কোথাও সুকৌশলে তালা-দেওয়া ব্যারিকেড, যাতে করে যে-কোনো গাড়িই ঢুকে যেতে না পারে। রাজপ্রাসাদের আদলে গড়া ডলার-উপচানো সুরম্য বাড়িগুলো। খুব আধুনিক রুচিসম্মতভাবে গড়ে-ওঠা এসব বাড়িতে বাড়ির মালিক থাকেন খুব কম; ওঁরা দেশের বাইরেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। বছরে কালেভদ্রে এক বার দু-বার হয়তো আসেন। বাড়ি খালিই পড়ে থাকে, অবশ্য বাড়ি দেখাশোনা করার লোক আছে। সিলেটের লোকজন বেশিরভাগই লন্ডন, আমেরিকা আর ইয়োরোপে থাকে। অঢেল পয়সার মালিক একেক জন। দেশে ওদের একটা করে বাড়ি থাকেই, সাথে হোটেল ব্যাবসা। সিলেটের গ্রামগুলোর চেহারাই বদলে দিয়েছে ওরা। এই ট্রেন্ডটা আমার কাছে বেশ ভালো বলেই মনে হয়েছে।
এখানে বিশ্বনাথ উপজেলায় একবার জেদাজেদি করে এক কাপ চা বিক্রি হয়েছিল ১০ হাজার টাকায়। কে আগে চা নেবে, জেদাজেদিটা ছিল এ নিয়ে। ১ কিলোমিটার রাস্তা বানানোর সরকারি বরাদ্দ ১০ টাকা হলে, আরও ১০ টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়ে ওরা ২ কিলোমিটার রাস্তা বানিয়ে নেয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর সরকারি টাকা বিতরণের জন্য দরিদ্র লোক খুঁজে পায় না। এসব বানানো গল্প নয়, সত্যি।
আজ মাথিউরা আর মোল্লাপুর ইউনিয়নের বাড়িগুলো দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, এমনকী মুমতাজ মহল জীবিত থাকলেও শাহজাহান খুব সহজেই কমপক্ষে একটা তাজমহল বানাতে পারতেন, যদি তিনি একটি বারের জন্য হলেও লন্ডনে যেতেন। গোলাম মুরশিদের 'কালাপানির হাতছানি: বিলেতে বাঙালির ইতিহাস' পড়ে জেনেছি, কীভাবে জ্ঞানের অন্বেষণে যুগে যুগে বাঙালি বিলেতে গেছে। সিলেটে এসে বুঝলাম, বিলেতফেরত জ্ঞানী বাঙালি আর ধনী সিলেটির মধ্যে ফারাক কতটা স্পষ্টভাবে প্রকট। 'মালিকমহল' নামের বাড়িটা দেখে নিজেকে পুরোই পথের ফকির ফকির মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, সময় থাকতে থালা হাতে নেমে পড়ি! এখুনি সময়! এ দেশে লোকের অনেক টাকা হলে মন্দির-মসজিদ বানায়, লোকদেখানো অট্টালিকা বানায়; আর বিদেশে বানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পার্থক্যটা বুঝুন!
April 28
এক। দার্শনিক জি সি দেবের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, একটা পিচ্চি হিসু করছে। এর কোনো দার্শনিক ব্যাখ্যা নেই। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হলো, হিসু এলে হিসু করতে হয়, প্রকাশ্যে কিংবা লুকিয়ে। কথা সেটা নয়। কথা হলো, বিশ্ববরেণ্য এ দার্শনিকের বাড়ি এমন অবহেলায় পড়ে থাকাটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। সে বাড়ি এখন আর নেই, সেখানে এখন অন্য লোকের বাড়ি, দখল-করা। ওখানে এমন কিছুই নেই, যেটা দেখলে বোঝা যাবে, এখানে এই মহাত্মা জন্মেছেন।
পাশেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে স্কুলের বাচ্চাদের সাথে মন-ভালো-করে-দেওয়া কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি। ওদের স্কুলড্রেস সবুজ রঙের। ওদের দেখে বললাম, যাদের স্কুলড্রেস নেই, তারা বাদে বাকিরা আমাদের সাথে ছবি তুলতে আসো। শিশুরা ছবি তুলতে বড়ো ভালোবাসে। যাদের স্কুল ড্রেস নেই, ওরা নানান অজুহাত দেখাতে শুরু করল। কারও ড্রেস ধুয়ে দিয়েছে, কারও ড্রেস ছিঁড়ে গেছে। এরকম আরও অনেক কিছু। পরে সবাইকেই নিয়ে ছবি তুললাম। সবাই সে কী খুশি। আমাদেরকে ঘিরে দৌড়োচ্ছে, ইচ্ছেমতো লাফাচ্ছে। শিশুদের এ হাসিখুশি মুখ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। আমি নিজের অজান্তেই খুব জোরে শব্দ করে হাসছিলাম। প্রধান শিক্ষক মহোদয়ও ছিলেন সাথে। স্যার বড়ো অমায়িক ভালোমানুষ।
কালাচাঁদ মন্দির গিয়ে এটা বোঝা শক্ত যে, বিয়ানীবাজারের সংস্কৃতি চর্চা শুরু হয়েছিল এ মন্দিরকে ঘিরেই। এ মিলনমন্দিরেই একটা সময়ে নাটক হত, পালাগান হত। এখন আর তেমন কিছুই নেই। আছে মন্দিরটি আর কিছু সহজসরল মানুষ, যাঁরা মন্দিরটি দেখাশোনা করেন। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তখন এক অতিরূপসী মেয়ে মন্দিরের বাইরের ভাঙাচোরা কাঠ-বাঁশের গেটটি খুলে দিল। ভেতরে একটা পুরোনো পাকুড়গাছ আছে। একপাশে পড়ে-থাকা রথটায় বসে ছবি তোলা যায়। আমরা ভেতরে ঘোরাঘুরি শেষে ফেরার সময় মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিতেই ও কী যে মিষ্টি করে হাসল! এমন মিষ্টি হাসি দেখতেও এই ছোট্ট একটি জীবন ধন্যবাদ দিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায়।
বাসুদেব মন্দিরটি ১৫-শো বছরের পুরোনো। কষ্টিপাথরে তৈরি বাসুদেব বিগ্রহটি এখনও আছে। মন্দিরের গায়ে প্রাচীনত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। দেয়ালগুলো অজন্তা-ইলোরার ফ্রেসকোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এ শান্তসমাহিত পরিবেশে একটা ভোরবেলা কিংবা পড়ন্ত বিকেল কাটানো হতে পারে এক অপার্থিব আনন্দময় অভিজ্ঞতা। সামনের টাকুর দিঘির পাড়ে বসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল কয়েক শতাব্দী আগের সেই সময়ে, যখন পাঠক সম্প্রদায়ের পণ্ডিতেরা এখানে জ্ঞানচর্চা করতেন। মন্দিরের সেবাইতের স্ত্রী আমাদের কলা খাইয়ে আপ্যায়ন করলেন। ওঁর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। ভদ্রমহিলার সারল্য মুগ্ধ হবার মতো।
বাহাদুরপুর জমিদার বাড়ির ইতিহাসটা জানি না। তবে এর আশপাশটা দেখলে বোঝা যায়, এ এলাকার নব্য লন্ডনি জমিদারদের তুলনায় এ জমিদারের শানশওকত কোনো অংশেই কম ছিল না। লিচুবাগানের দৃশ্য মনে রাখার মতো। বাড়ির আবহে রাজকীয় ছাপ নেই অত, তবুও একটা রাগি বৈশাখী দুপুর ফলের বাগানের ছায়ায় বেশ আয়েশেই কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আরও লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু থামতে হচ্ছে। না, মোবাইলের চার্জ ফুরোয়নি। লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের অফিসের গাড়িটা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। এ হতচ্ছাড়া লেখাটি লিখতে গিয়ে আমার জন্য পাঠানো অফিসার ভদ্রলোকটিকে অতটা সময় দিতে পারিনি।
দুই। বিয়ানীবাজার থেকে সিলেটে যাচ্ছি লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের আমন্ত্রণে মোটিভেশনাল সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে কথা বলতে। সেমিনারটি শুরু হবে বিকেল ৫টায় প্রতিষ্ঠানটির সিলেট অফিসে। ব্র্যাক ব্যাংকের সেমিনারটি যে-সব কর্মকর্তা মিস করেছেন, তাঁরাও আজ থাকবেন। প্রফেশনলরাও জীবনের গল্প শুনতে এত ভালোবাসেন! ওঁরাও ওঁদের গল্প শোনান। অনেক কিছু শেখা যায়। শেয়ারিং ইজ ফান!!
April 29
এক। আকাশ ভাবছে, ও কাঁদবে কি কাঁদবে না। এমন অবস্থায় কারুরই মন ভালো থাকে না। আকাশেরও নেই। কেমন জানি কখনো কখনো কেঁদেও ফেলছে একটু একটু। ওই অশ্রুর স্নিগ্ধতা সকালটাকে অন্যরকম করে দিচ্ছে। আমি যেখানটায় থাকি, সে জায়গাটা একটা টিলার ওপরে। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের রেস্টহাউজের আশপাশটা সুন্দর। রুম থেকে বেরিয়েই ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই বাগানবিলাস। রবি ঠাকুর বড়ো ভালো-লাগা একটা নাম দিয়েছেন। পাশেই হাসনাহেনা। ও সন্ধ্যারাণী, ওর রাজত্ব শুরু হয় সন্ধ্যার পর পর। মেঘলা সকালে খেজুর গাছ এত সুন্দর দেখায়, আগে কখনও খেয়ালই করিনি। পায়ের নিচে নরোম নরোম দূর্বাঘাসে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো জলকণা জমে আছে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে, আবার করেও না। টিলার নিচে প্রকাণ্ড মাঠ। ওখানে কিছু স্কুলের ছেলে-মেয়ে খেলছে। টেনিস বল দিয়ে ক্যাচক্যাচ, বোমফাইট, ডাংগুলি আরও কী কী যেন। মাঠ আর টিলার মাঝখানে একটা রাস্তা চলে গেছে। বেগুনি রঙের ড্রেস পরে ক্যাটক্যাটে লাল লিপস্টিক দিয়ে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে টানতে টানতে মায়াবী চোখের একটা ছোট্ট খুকি হেঁটে যাচ্ছে। ওর চোখে ভয় আর বিস্ময় দুটোই।
যাচ্ছি বড়োলেখা। মাধবকুণ্ড ঝর্না দেখব। সাথে কী এক রাজবাড়ি, মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, মন্দির, খোয়াজা মসজিদ, মাথিউরা টিস্টেট এবং অবশ্যই হাকালুকি হাওড়। ছুঁয়ে দেখা যায়, এমন একটা স্নিগ্ধ সকালে দূরে প্রকৃতির কোলে ঘুরতে যাওয়াটা খুব আনন্দের। সিলেটের আবহাওয়া একটু অন্যরকমের। মেয়েদের মনের মতো, ক্ষণে ক্ষণেই বদলায়। এই ঝুম বৃষ্টি তো এই কাঠফাটা রোদ্দুর! কাঠফাটা রোদ্দুর—কেমন অক্সিমোরন হয়ে গেল না? হোক! রোদকে একটুখানি রোদ্দুর বানিয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হয়? হোক কাঠফাটা, তবুও! সিলেটের রোদও বড়ো মিষ্টি।
উপজেলা পরিষদের সামনে গেলাম। ইউএনও স্যার আমাদের জন্য একটা হাইএস অ্যারেঞ্জ করেছেন। যাত্রা শুরু করার কথা বাংলাদেশি সময় ৭টায়—মানে ৮টায় শুরু করলাম। এতে অবশ্য কিছু লাভ হয়েছে। দেখলাম ২০-২৫টা বানর পরিষদের চত্বরে হেঁটে যাচ্ছে। ওরা একটা গাছে চড়ে ছাদে উঠে কোথায় যেন চলে গেল। বানররা কোথায় কোথায় যেন চলে যায়। একটা কিংবা দুইটা জয়েন্ট ফ্যামিলি। বানর-পরিবার আমাকে দেখে ভেংচি কাটল। আমিও কাটলাম। আহা, স্বজাত্যপ্রেম! ওই কিছু দূরে টিলায় কিছু শাদা ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। ওদের বাচ্চাগুলো এত কিউট দেখতে! দেখলেই কোলে নিয়ে সেলফি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করে দিতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর সব শিশুই দেখতে সুন্দর। সে মানুষেরই হোক কিংবা অন্য প্রাণীর। চায়ের পেয়ালায় ফুঁ দিয়ে দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়ায় ভেজা-ভেজা সকালটাকে উড়িয়ে দিয়ে কলিগদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুটো কুকুরের ঝগড়া দেখছিলাম। খুব সম্ভবত প্রণয়ঘটিত কলহ।
গাড়ি চলছে। সাথে এইটিজের হিন্দি গানও চলছে। শান্ত নদী, ফসলের সবুজ মাঠ, কচুরিপানার পুকুর, বন্ধুর মতো গাছগুলো, পরম মমতায় গাভীর ওলানে বাছুরের মুখ, খড়ের গাদা…পেরিয়ে গাড়ি ছুটছে। এসব দেখে এই জীবনটাতে থেকে যাবার সাধ আরও তীব্র হতে থাকে। ভাবছি, আর নিজের মনেই হাসছি। হঠাত্ ড্রাইভার গান থামিয়ে দিল। শবযাত্রা। এদিকে আমাদের জীবনে ফিরে যাবার আনন্দ, আর ওদিকে জীবন থেকে ফিরে যাবার বিষাদ। জীবনের পাশেই মৃত্যু। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। মনে করিয়ে দিল, শেষঠিকানা ওখানেই!
প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫০টা মেসেজ পাই। সবকটাই পড়ি, রিপ্লাই করা হয় না। সম্ভবও নয়। আজকের একটা শেয়ার করি। এক ছেলে লিখেছে: ভাইয়া, আমি এবং আমার গার্লফ্রেন্ড দু-জনই আপনার বিশাল ফ্যান। আগামীকাল ওর জন্মদিন। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম, ওর জন্মদিনে আমি ওকে আদর করে নতুন একটা নাম দেবো, যে-নামে ওকে শুধু আমিই ডাকব। কিন্তু আমি এখনও কোনো নাম ঠিক করতে পারিনি। আপনি কাইন্ডলি আমাকে একটা নাম ঠিক করে দেবেন? . . . এখনও রিপ্লাই দিইনি। ঠিক বুঝতে পারছি না, অন্যমানুষের প্রেমিকাকে 'আদর করে' নাম ঠিক করে দেওয়াটা ঠিক হবে কি না! আমার যে অন্যকারও প্রেয়সীকে (তারই অনুরোধে) আদর করতে ইচ্ছে করে না! ওই সহজসরল বোকা প্রেমিককে কী রিপ্লাই দেবো, ভাবছি।
উফফ্! মাধবকুণ্ড যাবার রাস্তাটা এত অপূর্ব কেন? দেখলেই খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করে!!
দুই। বৃষ্টি! বৃষ্টি!! হাকালুকি হাওড়ের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটছে মাথিউরা চা-বাগানের দিকে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। পুরোটা সবুজ চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! গাড়িতে বাজছে ইনস্ট্রুমেন্টাল! স্লো, আবার সুপারফাস্ট! উন্মাদের মতো নাচছি! লাইফ ইজ বিউটিফুল! পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে! উফফ্!!
April 30
এক। আজ সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জে যাচ্ছি। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে, সুনামগঞ্জ ঘুরে দেখব। বাংলা ফোক গানের তিন দিকপাল জন্মেছেন এখানে। হাসনরাজা, আবদুল করিম, রাধারমণ। বাংলা গানের শ্রেষ্ঠ কিছু সম্পদ আমরা এ তিন মহাত্মার কাছ থেকে পেয়েছি। সবাই-ই সুনামগঞ্জের। আমার জানার আগ্রহ, এর রহস্যটা কী! এ নিয়ে সময় করে কিছু লেখারও ইচ্ছে আছে।
কাল, পরশু আর পরদিন থাকব। আচ্ছা, সুনামগঞ্জে আর এর আশেপাশে দেখার মতো, ঘুরে বেড়ানোর মতো কোন কোন জায়গা আছে? আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, ফ্রেন্ড, ফলোয়ার আর ফ্যানদের মধ্যে যাঁরা ওদিকটায় আছেন, *********** নম্বরে আমার সাথে কথা বলতে পারেন। দেখা হবে, আড্ডা হবে, ঘোরাঘুরি হবে।
দুই। সাস্টের ‘স্পিকার্স ক্লাব’-এর প্রোগ্রামে আশ্চর্য সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটালাম। শুধু এ মুহূর্তের জন্যও বেঁচে থাকা যায়। মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার সবচাইতে আনন্দের ব্যাপার হলো, প্রত্যেকটা মানুষ ভালোবাসতে পারার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ভালোবাসাও মন খারাপ করে দেয়। আজ সবার কাছ থেকে যে অদ্ভুত রকমের ভালোবাসা আর আন্তরিকতা পেয়েছি, তার কণামাত্রের যোগ্যতাও আমার নেই। সবাই আমাকে এত ভালো ভাবে কেন? এতে শুধু যন্ত্রণাই বাড়ে। খারাপ হতে না পারার যন্ত্রণা বড়ো যন্ত্রণা। মানুষের প্রচণ্ড ভালোবাসা আমাকে অপরাধী করে দেয়। এ অপরাধবোধ অতটা ভালোবাসতে না পারার অপরাধবোধ। ভালোবাসার প্রতিদান দিতে না পারার কষ্ট আকাশের চাইতেও বিশাল। ঘৃণাও এতটা কষ্ট দিতে পারে না।
May 1
একটা মায়াবী নদী। সরু সরু নৌকা। একটুখানি বৃষ্টির আধটুখানি ফোঁটায় নদীর ভাষা কী যেন বোঝায়। নদীর পাড়ে সবুজ মাঠ। গোরুর পাল চরে বেড়াচ্ছে। একটা গোরু পরম মমতায় বাছুরকে স্তন্যপান করাচ্ছে। ঝিরঝিরি সবুজ বৃষ্টি! পাশের টিলায় শাদা শাদা ভালোমানুষ ভেড়ার দল সবুজের রসে জীবনের স্বাদ নেয়। কিছু মেষশাবক এদিক-ওদিক লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। নদীর ওপাশটায় ফসলের মাঠে বৃষ্টিভেজা রোদ্দুরে রবি ঠাকুরের ফটিকের দল ফুটবল খেলছে। যে ছোট্ট জলাটি নদীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেনি এখনও, সেখানটায় হাঁসের দল শাদা মেঘের ভেলার মতোই ভেসে বেড়াচ্ছে। ওই দূরে সরুমতন নাম-না-জানা নদীর শরীরের বাঁকে বাঁকে নারীর শরীরের চিরন্তন রহস্যের মাদকতা। ওর পাড়ে পাড়ে নরোম রোদ্দুরে-ভেজা কচি পাতার রং চোখে নেশা ধরিয়ে দেয়। রাখালছেলে নির্ভার সুরে খেতের আইলে বসে বসে বাঁশিতে রাখালিয়া সুর তোলে। সে সুর মেলায় পাশের মেঘে-ঢাকা গ্রামখানি ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে পেছনের পাহাড়ের নেশায়। কিষাণ-কন্যাদের রূপের ছটা আর হলদে কাটাশস্যের ঘ্রাণের মিলনে মেঘলা রোদে-ভেজা মাঠের কাব্য নতুন পঙ্ক্তিতে সাজছে। টিলার কোল ঘেঁষে বাঁশের মাচায় সত্তরের বলিষ্ঠ কৃষক ভেজা গামছায় ঘাম মোছেন, পাশেই আদরের নাতনি গুড়-মুড়ির পেঁটরা খোলে। আকাশজুড়ে সোনালি ডানা-ছড়ানো চিলের দল রোদের মায়ায় জীবনের গল্পে মাতে। গাছের গুঁড়ি কাঠ হবার অপেক্ষায় নদীতীরে রোদ পোহায়।
সময়ের ঘড়ি মাঠের কৃষকের মাথালের হিসেবে টিক টিক চলে। তিনকোনা জালে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে জলের সন্তানের খোঁজে ব্যস্ত। বাবাদের পাশে কৃষকপুত্ররা ঘুড়ি হাতে দৌড়োয় আর চ্যাঁচায়। ওদের আজ ছুটি। ইলেকট্রিকের খুঁটিতে বসা মিশমিশে ফিঙেরা কী এক জলদগম্ভীর দ্যোতনায় সাধকের ঢঙে রৌদ্রে স্নান করে। রাস্তার পাশেই শুকনো উঠোনের মতো মাঠে সোনাঝরা চাতালের সমান্তরালে জীবনের জয়গান। ছাতা-মাথায় কৃষি অফিসার কিছু কৃষককে জড়ো করে কী কী যেন বোঝাচ্ছেন। এদিক-ওদিক ছড়ানো গাদা গাদা খড়ের স্তূপ। এর আশেপাশে গরুর পাল চরে বেড়াচ্ছে। কিষাণ-কিষাণীরা ধান জড়ো করছে, মাড়াই করছে। পাশের মাঠখানি ধান পেকে হলদেটে সবুজ হয়ে আছে। অপূর্ব সুন্দর একটা দৃশ্য! একটা মেঠোপথ পাশাপাশি দুটো খালের জলের রং দু-রকমের করে দিয়ে সোজাসুজি চলে গেছে। ওই পথে লাঙলকাঁধে পেশীবহুল কিষাণযুবা শিস্ দিতে দিতে হেঁটে যায়। হলদেটে সবুজ হালকা গাছের ঝিরিঝিরি পাতাগুলো ঊর্বশীর এলোচুলের মতো দোলে। বিলের মাঝে মাঝে ধ্যানী সারস বেগুনি কলমিফুলের গোড়ায় গোড়ায় ছোটোমাছ খোঁজে।
এসবের ঠিক মধ্যিখান দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটছে সুনামগঞ্জের দিকে। আমার সাথে ভীষণভাবে ভালোবাসতে পারার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো কিছু ছোটোভাই। একটা হেডফোন, মাতাল হাওয়া, সারি সারি গাছের মাঝখানে রাস্তায় ছুটতে ছুটতে কান্ট্রি-সং আর ইনস্ট্রুমেন্টালে হারিয়ে যাওয়া, আর কিছু ভালোমানুষের ভালোবাসা। আহা! স্রেফ বেঁচে থাকলেও কত-কী যে পাওয়া হয়ে যায়!