বাংলাদেশের একেকটা জায়গা একেক দিকে সেরা। প্রত্যেকটা জায়গারই নিজস্ব কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য আছে, যেগুলির জন্য ওটাকে অন্যরকম মনে হয়। এই যেমন, গোছানো শহর বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা বিবেচনায় রাজশাহীই সেরা। আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ভাবলে চট্টগ্রামের কথা সবার আগে মাথায় আসে। পাহাড় আছে, অরণ্য আছে; এমনকি সমুদ্রও! এই তিন নিয়েই তো এই ছোট্ট একটুকরো জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যায়! চট্টগ্রামের সুন্দরের কাছে এসে একেবারে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাহস করে ‘আমিও তো ওরকমই’ বলে ফেলতে পারে একমাত্র সিলেটই! বাংলাদেশে জন্মে সিলেট না দেখে মরে যাবার কোনো মানেই হয় না। আমরা যে কেউই যে-কোনো সময়ই ‘নেই’দের তালিকায় চলে যেতে পারি। আজকের ভূমিকম্পের কথাই ধরুন না! যদি আজই সেই ভোরে ঘুম ভেঙে দেখতাম, মরে পড়ে আছি, তবে কেমন হতো? হিসেব করে বেঁচে কী হয় আসলে? ঘোড়ার ডিম হয়। একগাদা আফসোসের হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাওয়ায় উড়ে উড়ে বেঁচে থাকে কিছু হিসেবি আহম্মক। এভাবে করে হিসেব করে বাঁচতে বাঁচতে একটা সময়ে বিশ্রী রকমের বেহিসেবি এক মৃত্যুর দেখা মেলে। এই তো! মরে যাবার আগে যদি মনে হয়, ‘ধুশশ্ শালা! সব শেষ? বাঁচলামই তো না!’ তখন?
Braveheart মুভির একটা ডায়লগ এই মুহূর্তে মাথায় আসছে: Every man dies, not every man really lives. খুব হিসেব করে বাঁচে যারা, তাদের জন্য আমার এসব কথা নয়। হইচই-করা ক্যারিয়ারিস্টদের দেখলে ওদের জন্যে আমার চুপিচুপি করুণা হয়। ওরা ১০ বছরের প্ল্যান সাজিয়ে বসে থাকে, অথচ সামনের ১০টা মিনিট কীভাবে কাটাবে, সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটা কথা আমার খুব খুব প্রিয়: Tomorrow or the next life—which comes first, we never know. আমি ঠিক করেছি, ওরকম ইঁদুর-দৌড়ে আমি যাবই না। আমি চাই না, আমি কারও প্রতিদ্বন্দ্বী হই। বাবাকে দেখে শিখেছি, যে কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, তাকে হারানো পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ। আমি হেরে হেরেই জিততে থাকব যতদিন বাঁচি!
আরেকটা কথা। সিলেট ডায়েরির লেখাগুলি লিখেছি আমার নকিয়া সি২ হ্যান্ডসেট দিয়ে। ভ্রমণের সময়ে কিংবা কোনো অফিসে বসে ফেইসবুক পোস্টগুলি দিয়েছি, সাথে ল্যাপটপ থাকলে।
April 14
ঘুম ভাঙল ফোনে; মায়ের।
আরও কিছু 'শুভ নববর্ষ' শুনলাম, বললাম, পেলাম, দিলাম।
রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজ'য়ের আমন্ত্রণে পান্তাইলিশ খেলাম, সাথে আলুভর্তা, বেগুনভর্তা, শুঁটকিভর্তা। খাবার ভালো তো জগত্ ভালো!
এরপর গেলাম স্কলার্সহোম স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বাচ্চারা এত সুন্দর পারফর্ম করে! গুলুগুলু বাবুগুলা অ্যাত্তোগুলা কিউট! ওইগুলার গাল টাইন্যা টাইন্যা লুজ কইরা দিতে মঞ্চায়!
এখন আছি এমসি কলেজের ক্যাম্পাসে। চারদিকে শুধু উত্সব, আনন্দ আর ভালোবাসা। সব মানুষই রঙিন!
একটু পর যাব সংস্কৃত কলেজে। এরপর সাস্টে। সাথে সুপারবিন্দাস কিছু ছোটো ভাইবোন, ফ্রেন্ড, ফ্যান, ফলোয়ার।
কাহিনি হইলো অ্যাত্তো অ্যাত্তো পাবলিক আইসা জড়াইয়া ধরতাসে। আমারে অ্যাত্তো মানুষ চিনে!! ভালোবাসায় পাঞ্জাবির ভাঁজ নষ্ট হইয়া যাইতাসে। আহা! ভালোবাসা বড়ো ভালো জিনিস! প্রবলেম হইলো, সবাই-ই পাঞ্জাবির ভাঁজ নষ্ট করতাসে না। ভাঁজ যারা নষ্ট করলে ভালো লাগত, তাদের কোনো খবরই নাই! এত কষ্ট কইরা ইস্তিরি-করা পাঞ্জাবি পইরা কী লাভ হইল? আমি কি এ ভালোবাসা চেয়েছিলাম?
April 20
# হ্যাপিনেস ইজ . . . যে অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল স্যার প্রধান অতিথি, সে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হওয়া। ব্র্যাক ব্যাংকের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে স্যারের পাশে বসে আছি। আমাকেও নাকি কিছু বলতে দেবে। স্বপ্ন দেখছি না তো? এখানে এ অবস্থায় কিছু বলা আদৌ সম্ভব? সত্যিই সব কিছু অদ্ভুত লাগছে!
# আজ রাত ৮টা থেকে শুধু সিলেটের বন্ধুদের জন্য বাংলাদেশ বেতার, সিলেট কেন্দ্রের আমন্ত্রণে FM-105'য়ে কথা বলব। এটাকে মিনি ক্যারিয়ার আড্ডা বলতে ইচ্ছে করছে। নোবডি থেকে সামবডি হওয়ার গল্প শোনাব। সঞ্চালনায় থাকছে জান্নাত ও শুভ। আমার কাছে কারও কোন প্রশ্ন থাকলে পোস্ট করতে পারেন ফেইসবুকের 105 fm পেইজে, কিংবা মেসেজও পাঠাতে পারেন।
April 21
সবাই বসার জন্য মেঝেতে যে লম্বা চাদরটা বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেটা ঠিকঠাক করার কাজটা জাফর স্যার মাথা নিচু করে করতে লাগলেন। যে সোফাগুলোতে আমাদের বসতে দেয়া হয়েছিল, সেগুলো পেছনের দিকে সরানোর দরকার ছিল। সবাই ওয়েট করছিল দারোয়ান শ্রেণীর কেউ এসে ওগুলো সরিয়ে দেবে। জাফর স্যার নিজেই উঠে ওগুলো সরাতে লাগলেন। এরপর আর হাত গুটিয়ে রাখা যায় না। বড়ো মানুষেরা লজ্জা দেন না, অথচ ওঁদের মহত্ত্বে লজ্জিত হতেই হয়। অনুপদাকে বললাম, "দাদা, জাফর স্যারের পাশে আমি বড্ডো বেমানান। আমি সত্যিই কিছু বলতে পারব না। আমি বরং দর্শকসারিতে গিয়ে বসি।" আমি সে কী এক সংকোচে একেবারে ছোট্টো হয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর দাদা আমার সাথে জাফর স্যার, ইয়াসমীন ম্যাডাম, কামাল স্যার এবং সিলেটের আরও কিছু সুধীজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অনুষ্ঠানে স্যার প্রধান অতিথি আর আমরা বিশেষ অতিথি। বিশেষ অতিথিদের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ, বাকিদের বয়স আমার বয়সের প্রায় দ্বিগুণ।
জাফর স্যারের বিনয় মুগ্ধ করার মতো। মানুষকে প্রচণ্ড সম্মান দিয়ে কথা বলেন, ওঁর কাছ থেকে অতটুকু পাবার যোগ্যতা আমার ছিল না। ব্র্যাক ব্যাংকের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে একটা কেক কাটা হয়েছিল। শিশুরা কেক দেখলেই ভাবে, হ্যাপি বার্থডের কেক। কী দরকার এমন সুন্দর, নিষ্পাপ, হাসিখুশি একটা ভুল ভাঙানোর? স্যার ভাঙালেনও না। বাচ্চাদের সাথে নিয়ে 'হ্যাপি বার্থডে' বলে কেক কাটলেন, সবাইকে কেক খাইয়ে দিলেন, নিজেও খেলেন।
স্যার বক্তব্য রাখার সময় বলছিলেন, "সেদিন পহেলা বৈশাখে আমার এক ছাত্র বলছিল, স্যার, এই যে সবাই এত 'শুভ নববর্ষ, শুভ নববর্ষ' করছে, ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আজ বাংলা কত সাল, অনেকেই বলতে পারবে না।" স্যার বললেন, "আমরা তো বাংলা তারিখ অতটা ব্যবহার করি না, তাই এটা না জানাটা তেমন দোষের কিছু নয়। এই যে ধরো, আগস্ট মাসে কেমন লাগে, এটা ভাবলেও মাথায় আসে না। অথচ ভাদ্র মাসের কথা মাথায় এলেই কেমন একটা ভ্যাপসা গরম অনুভব করি। এর মানে তো এ নয় যে, আগস্ট মাসটা আমি কখনও অনুভব করিনি।" শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! দিস ইজ দি অ্যাটিচিউড! বড়ো মানুষ ছোটোখাটো অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে মাইন্ড করেন না, ওঁদের সময়ই নেই অত। স্যার বললেন, "ইংরেজদের নববর্ষ আর আমাদের নববর্ষের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি দেখেছি, ওদেরটা আসে কীরকম একটা তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে, আর আমাদেরটা আসে কেমন একটা শান্তপবিত্র আবহের মধ্য দিয়ে। তবে, এবারই প্রথম এর ব্যত্যয় ঘটেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। আমাদের মেয়েদেরও আরও সচেতন হতে হবে। এমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এটা লুকিয়ে না রেখে এর প্রতিকার চাইতে হবে।"
জাফর স্যারের স্ত্রী ইয়াসমীন ম্যাডাম কথাপ্রসঙ্গে বললেন, "আপনারা আপনাদের ব্যাংকের অনুষ্ঠানে স্যারকে ডাকলেন, উনি তো ব্যাংকিংয়ের কিছুই বোঝেন না। আমাকেই ব্যাপারটা দেখতে হয়।" আহা! জেনে বড়ো ভালো লাগল। আমাকে পৃথিবীর সব কিছুই জানতেই হবে কেন? যা-কিছু ভালো লাগে না, কিংবা না জানলেও চালিয়ে নেওয়া যায়, সেসব কিছু জানব না, শুনব না। আমি অনেক কিছু বলব ভেবে-টেবে দাঁড়ানোর পর তেমন কিছুই বলতে পারিনি। বড়ো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে অত বলা যায় না বোধ হয়। কালকের প্রোগ্রামটা ছিল খুব গোছানো। ব্র্যাক ব্যাংকের সবাই মিলে খুব যত্ন করে সব কিছু করছিল। এসব দেখে আমার জাফর স্যারের 'শান্তা পরিবার'-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বক্তব্য দেবার সময় সেটি বললামও। কামাল স্যারও খুব চমৎকার কথা বলেন। শাওনদা অ্যাঙ্করিং করছিলেন। দাদা, আপনাকে বলছি: মানুষকে এতটা সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখলেন কীভাবে? দাদা, এই আর্ট শেখাটা বড়ো শক্ত! এরপর খাওয়া-দাওয়া হলো, জাফর স্যারের সাথে গল্প হলো। আমি একথা বলতে সাহসই করিনি যে, স্যার, আপনার সাথে একটা ছবি তুলব। জাফর স্যার আর ইয়াসমীন ম্যাডাম নিজেরাই বললেন, আসুন, আমরা একটা ছবি তুলি। এ বিনয়ে আরও একবার মুগ্ধ আর লজ্জিত হলাম।
ঘড়িতে তখন আটটা ছুঁই ছুঁই। গান শুরু হবে। আমরা নিচে নেমে এলাম। প্রথম গানটা শুনেই চলে আসতে হলো। বাংলাদেশ বেতার, সিলেট কেন্দ্রের আমন্ত্রণে একটা প্রোগ্রামে কথা বলবার কথা আটটায়। যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।
রেডিয়োতে গেলাম, লাইভ কথা বললাম। এফএম-১০৫'য়ের ফেইসবুক পেইজে আর যে মোবাইল নম্বরটা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে অসংখ্য পোস্ট, খুদেবার্তা আসছিল। জান্নাত আর শুভ সঞ্চালকের দায়িত্বে। ওরা বলছিল, গতকালকের পোস্ট আর মেসেজ অন্য যে-কোনো সময়ের চাইতে অনেক অনেক বেশি। সিলেটের বন্ধুদের আগ্রহ দেখে খুবই ভালো লাগল। সবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি, যতটুকু পেরেছি, বলার চেষ্টা করেছি। অসংখ্য শুভকামনা ছিল, ধন্যবাদবার্তা ছিল। আটটা বিশ থেকে নয়টা, পৌনে দশটা থেকে প্রায় পৌনে নয়টা, এ সময়টাতে কথা বলেছি। মিনি ক্যারিয়ার আড্ডা, জীবনের কিছু গল্প। এরই মাঝে চমৎকার কিছু গান; আমার পছন্দের, শ্রোতাদের পছন্দের; খুনসুটিও চলছিল, একটুখানি গাইলামও। বেতারের সহকারী পরিচালক প্রদীপদা শেষ অবধি ছিলেন। গিয়াস-সহ আরও অনেকেই এসেছিল দেখা করতে। ওরাও পুরো সময়টাতে বসে ছিল। শ্রোতাদের কাছ থেকে মন-ভালো-করে-দেওয়া কথাগুলো পাওয়া, বেতারের সবার আতিথেয়তা, আর বেঁচে থাকার জাদুময় গল্প শোনানো, এ সব কিছুর আবেশমায়ায় কালকের বেতার-মুহূর্তটি ছিল স্বপ্নের মতন। বেতারের গাড়ি রাতে বাসায় পৌঁছে দিল। অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করা হয়েছে। অডিও ক্লিপটা পেলে আপলোড করে দেবো।
গতকাল সিলেটে বাস থামল সকাল আটটায়। রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে অফিসে গেলাম। লাঞ্চশেষে দু-জন বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। আগে থেকে কোনো খবর না দিয়ে ওদের ব্যাংকে গিয়ে ওদেরকে চমকে দিলাম। দই-কফি-বিস্কুটে আড্ডা হলো। এরপর আরও দুই বন্ধুর সাথে দেখা হলো মধুবনে পোলার আইসক্রিমে। এরপর আবার অফিস। ৫টায় অনুপদা গাড়ি পাঠালেন। সাড়ে ৫টায় অফিস শেষ করে গাড়িতে উঠলাম, ৬টায় ব্র্যাক ব্যাংকের প্রোগ্রাম। গেলাম। যতটা সম্মান পেলাম, অতটার যোগ্য আমি কিছুতেই নই। রাতে বেতারের প্রোগ্রামশেষে রুমে ফিরলাম। অনেক কথা বলেছি, শুনেছি। প্রচুর ছবি তোলাতুলিও হয়েছে। প্রায় ছবিতেই আমাকে দেখাচ্ছে পুরাই ম্যাদামার্কা। কোনো কারণ ছাড়াই গতকাল মফিজমার্কা অ্যাপিয়ারেন্সে সকালে অফিসে গেছি। ফ্যান্টম কমিকসের একটা কথা মনে পড়ছে: আমাদের অতিসৌভাগ্যে ঈশ্বরও ঈর্ষান্বিত হন।
April 22
ভাইয়া, আপনি এত দাওয়াত খাচ্ছেন কেন? কম কম খাবেন, একটু শুকান। এত মোটা হলে দেখতে ব্যাটা ব্যাটা লাগে। খাওয়া বেশি কমানোর দরকার নেই। বেশি চিকন হলে ম্যানলি ভাবটা চলে যাবে।
আর, একটু কালো হবার ট্রাই করেন। এত ফর্সা ছেলে দেখতে মেয়ে মেয়ে লাগে। আরেকটা কাজ করতে পারেন। কালো হবার দরকার নাই, বরং হালকা দাড়ি রেখে দিতে পারেন, শেইভ করবেন না, ট্রিমিং করবেন, একটা কিলার কিলার ভাব চলে আসবে।
মেয়েরা আসলে কী চায়???
April 23
At Dining Bus- Spice N Ice
এলাম, বসলাম।
ওয়েটার: স্যার, ম্যাডাম আসবেন?
আমি: সেটা তো জানি না, ভাই। কেন, ম্যাডাম ছাড়া খাওয়া যাবে না?
কবিগুরু বলেছেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা খাও রে! (কাউকে অবশ্য ডাকিওনি!)
এই রেস্টুরেন্টটা বাসের মতন, কিংবা বাস এই রেস্টুরেন্টটার মতন।
April 24
দু-পাশে সবুজ গালিচা। রাতের বৃষ্টির ছাপ চাবাগান থেকে সহজে মোছে না। সকালের ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। নীললোহিতকে মনে পড়ছে: আকাশ কখনও পুরোনো হয় না। . . . ‘সুদূর ঝর্নার জলে'-তে যুবক চেয়েছিল, এমন কেউ থাকুক, যাকে অন্তত একটা চিঠি লেখা যায়। আমারও ইচ্ছে করছে, একটা চিঠি লিখতে, মিষ্টি একটা চিঠি, ওতে আমার সমস্তটুকু জড়িয়ে থাকবে। নীল খামে পাঠিয়ে দেবো, না পৌঁছুক, তবুও . . . কিন্তু হায়! কাকে লিখব?! . . . ওপাশের অংশটা প্রান্তর, দেখলেই ওতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। শহরের এপাশটার ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। মেঘের ছায়া সরিয়ে সরিয়ে নরোম রোদ পোহায় একটু দূরের টিলাগুলো। ওখানটায় সবুজ জীবন থমকে আছে। ভোলাগঞ্জ-গোয়াইনঘাটের এ রাস্তায় চলতে চলতে একটু আগে ফেলে-আসা লাক্কাতুরা আর মালিনীছড়ার সুন্দর পিচঢালা রাস্তাটাকে বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে। এ অংশটা বেশিই এবড়োখেবড়ো। প্রকাণ্ড কোনো এক একচোখা দৈত্য খানিক আগেই এ পথ দিয়ে হেঁটে গেছে যেন। এ রাজ্য পাথরের রাজ্য, পাথরমহল। টুকরো টুকরো, স্তূপে স্তূপে পাথর চারিদিকে ছড়ানো। আশেপাশে গড়ে-ওঠা ব্যাবসাগুলো পাথর নিয়েই। পাথর ভাঙা, পাথর বদলে দেয়া, পাথর বেচা। পাথরের বিকিকিনি জমে উঠেছে, চারপাশে পাথুরে মানুষের আনাগোনা। ইটের ভাটায় ইট পুড়ছে, পুড়ছে মানুষের শ্রম। সারি নদীর পাশ দিয়ে নোয়াহ লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। স্পিকারে লাফাচ্ছে সানি লিওন, আতিফ, অরিজিত্, শ্রেয়া। ওরা বড়ো ভালো লাফায় গো! সান, ফক্সেস আর মাম—ক্ষুধা নয়, খাওয়ার ইচ্ছে নিবৃত্ত করছে।
দু-পাশে মাথা-নুয়ে-থাকা সাদাকালো পুরুষ্টু শরীরের শান্ত গাছের সারি। ওই দূরে তরুছায়া মসীমাখা ছোট্ট গ্রামখানি মেঘে-ঢাকা। গ্রামের পেছনটাতেই সবুজধূসর পাহাড়। ওখানেই মেঘের বাসা। একছুটে ওখানে যেতে বড়ো ইচ্ছে হয় আর যতই তাকাই, ইচ্ছে ততই বাড়তে থাকে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুঠো মুঠো রুপোলি সুখ। সবুজ মাঠজুড়ে লাল-শাদা-কালো গরুগুলো চরে বেড়াচ্ছে, ও যেন বাথান। ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ মুভির ওই দৃশ্যটার কথা মনে পড়ে যায়, যেটাতে মেয়েটি এমন একটা সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে গাইতে গাইতে নাচছিল আর বাঁশির সুরে সুরে হাওয়ায় দুলছিল। কিংবা ওয়ার্ডওয়ার্থের সেই সলিটারি রিপারের কথা। এপাশটার খালটায় দুই ভাই-বোন গামছায় ছোটোমাছ ছেঁকে তুলছে। শাদা শাদা হাঁসের ডানার ঝাপটায় জলের বিন্দু রৌদ্রের শরীরে মিলিয়ে যায়। কৃষকের বাড়ির উঠোনে চাতালে শুকোয় সোনাঝরা ধান। গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে ধার-করা রঙে-ঢঙে ক্লিক ক্লিক! বুড়ি দাদিমারা খেতের দিকে তাকিয়ে আছে দুষ্টু ন্যাংটো ছেলের দলের দিকে আর ফোকলা দাঁতে ফিক ফিক হাসছে। কী এক প্রচণ্ড খুশিতে ওরা নাচছে, কেউ কেউ ফুটবলটাতে ওর জন্মের দায় শোধ করছে তো করছেই। আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে…ওই নদী থেকে কলসি কাঁখে পল্লীবধূ ফিরে যাচ্ছে। এসব কিছু দেখছি আর ভাবছি, শুধু এমন একটা দিন দেখার জন্যও তো বেঁচে থাকা যায়!
বিছানাকান্দির পথে . . . পাথুরে নদীর টানে . . .
বন্ধুদের জন্য একটা ক্যুইজ: রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোটো নদী'-র ছোটো নদীটি আমাদেরই একটি নদী। বলুন তো কোন নদী?
April 26
এক। বিয়ানীবাজার? না কি বিরানীবাজার? গোলমেলে ঠেকে না? এ জায়গা আমাদের বড়ো আদরের দার্শনিক জি সি দেবের জন্মস্থান। ওঁকে ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে হত্যা করা হয়। বড্ড সহজসরল সাদামাটা মহত্ হৃদয়ের অধিকারী অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ ছিলেন তিনি। ওঁর কাজগুলোর সংকলন বাংলা একডেমি থেকে বেরিয়েছে। পড়ে দেখলে বোঝা যায়, এ মানুষটাকে পাকি বরাহশাবকের দল সেদিন মেরে না ফেললে উনি এ উপমহাদেশের দর্শনকে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন। ওঁর সৃষ্টি পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের সৃষ্টির সাথে সমমর্যাদায় তুলনীয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের অনেক স্বপ্ন খুন হয়ে গেছে। জি সি দেব যেখানে জন্মেছেন, সে জায়গাকে তো আর যেমন খুশি তেমন নামে ডাকা যায় না। একটা গল্প হয়ে যাক, কেমন?
সে অনেক দিন আগের কথা। সে সময় জমিদারি প্রথা চলছে পুরোমাত্রায়। সিলেট অঞ্চলের প্রথম রায়বাহাদুর হরেকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর ছেলে কৃষ্ণ কিশোর পাল চৌধুরী স্থানীয় লোকজনের সুবিধার্থে একটা বাজার স্থাপন করেন। সে বাজারে প্রায়ই হিংস্র জন্তুর আনাগোনা ছিল। তবে ভোরের দিকে বাজারটা একটু নিরাপদ ছিল। তাই লোকজন সকাল সকাল বাজার-টাজার সেরে ফেলত। এভাবে করে আস্তে বাজারটি হয়ে উঠল ভোরের বাজার। স্থানীয় ভাষায় খুব সকালের সময়টাকে বলা হয় 'বিহান'। বিহানে বাজার বসত, তাই বাজারের নাম হয়ে গেল বিহানীবাজার। লোকজনের মুখে মুখে 'বিহানী' বদলে গেল বিয়ানী'তে। এভাবেই আজকের বিয়ানীবাজার।
বিয়ানীবাজারে যাচ্ছি দু-সপ্তাহের জন্য, ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবেই। শুনেছি, সিলেটের সবচাইতে অভিজাত এলাকা এটি, সবচাইতে ধনী লোকজন এখানে থাকেন। বন্ধুরা! এখানে কারা আছেন? হাত তুলুন। দেখা হবে, আড্ডা হবে, ঘোরাঘুরি হবে, সেইরকম মাস্তি হবে!
বিয়ানীবাজারে যাবার রাস্তাটা অসাধারণ রকমের সুন্দর! দু-পাশে সবুজ, মাঝখানে ঝকঝকে রাস্তা। একটু পর পর দেখা মেলে বিস্তীর্ণ উঁচুনিচু অংশের, ও অংশের কিছু ফসলের খেত, কিছু জলা, কিছু বিরানভূমি। আচ্ছা, বর্ষায় ওগুলো কি হাওড় হয়ে যায়? গাড়িতে বাজছে ওরিয়েন্টাল ক্লাসিকস। সকালের রুপোলি রৌদ্রের ডানা আমার দু-চোখ আলতোভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে . . .
দুই। শেওলা-সুতারকান্দি সীমান্ত ঘুরলাম। চারপাশটা একটা বিকেল কাটানোর জন্য বেশ সুন্দর। মুজতবার চুঙিওয়ালাও আছেন; এদিক দিয়ে কয়লাই আসে বেশি। সারি সারি ট্রাক অপেক্ষা করে থাকে, ওদিকে যাবার কিংবা এদিকে আসার। ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া, শূন্য কিমি, এখানেই বাংলাদেশ সীমান্ত শেষ, থামুন, চেকপোস্ট . . . এসব দেখলেই দাঁড়িয়ে গিয়ে ক্লিক করতে ইচ্ছে করে। দু-পাশে প্রকৃতির অপার্থিব খেলা। কাঁটাতারের একলাইনে চলে-যাওয়া স্ট্রাকচার ফেলানির কথা মনে করিয়ে দেয়। ভাবতে ইচ্ছে করে, ইসস্! পুরো পৃথিবীটা যদি একটাই দেশ হতো! সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে গেলে প্রথমেই যে-ভাবনাটা মাথায় আসে, সেটি হলো, বর্ডারটা পার হয়ে গেলে কী হবে?—মানুষের এই প্রবৃত্তি চিরন্তন। আচ্ছা, নিয়ম ভাঙতে কেমন লাগে? একটুখানি ভেঙেই দেখি না! হবস্-থরো পড়ে জানতে পারি, হাজার বছরের পুরোনো মানুষের এই দিকটা এখনও বদলায়নি; বদলাবেও না কোনোদিন।
এখন এলাম বাসুদেব মন্দিরে। বেশ পুরোনো একটা মন্দির। প্রাচীনত্বের ছাপ সবখানে। পুরো আবহটা লিখতে গেলে সময় লাগবে। শুধু এটুকুই বলব, শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপনাগুলো একটা ভোর কিংবা একটা বিকেল কাটানোর জন্য সত্যিই দারুণ! চারপাশের এমন একটা আবহ হঠাত্ই জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, কথা বলার কেউ থাকুক আর নাই-বা থাকুক, কথা বলা যায়-ই!
তিন। বারোপালের দিঘির শানবাঁধানো ঘাটে বসে বসে একটা গোধূলিবেলা বেশ কাটিয়ে দেওয়া যায়! এ নরোম আলোটা এত মিষ্টি, এত মিষ্টি! আলোর খেলা কত কিছু মনে করিয়ে দেয়! ভুলিয়েও দেয় বুঝি? শেষ বিকেলের আলোয় গাছের পাতারা কেমন জানি কাছে টেনে নেয়! দিঘির ধারের গাছগুলোকে দেখলে মনে হতে থাকে, আমি ওদের চিনি, আমি ওদের চিনি! ওই দিঘির জলে কার ছায়া গো? সেই কবে হারিয়ে যাওয়া ওর নয় তো?