April 10
এক। সাহিত্যিক দম্পতি বুদ্ধদেব-প্রতিভার বড়ো মেয়ে মীনাক্ষীকে সুনীল-শক্তি-সন্দীপন এঁরা সকলেই পছন্দ করতেন। ওঁকে নিয়ে ওঁদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। কেউ যেন ও-বাড়ি না যায়, সেজন্য এঁদেরই কে যেন রটিয়ে দিয়েছিল পশুপ্রেমিক প্রতিভা বসু একটা প্রকাণ্ড আকৃতির বিকটদর্শন কুকুর পোষেন, যেটি অতি ভয়ংকর এবং কোনো আগন্তুক গেলেই প্রচণ্ডভাবে কামড়ে দেয়। একদিন সুনীল কী যেন এক কাজে বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে যান। বাড়ির দরোজা খুলতেই সেই বিশালাকৃতির কুকুরটি বেরিয়ে আসে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন, কোথায় ভয়ংকর বিকটদর্শন? এ তো রীতিমতো লাজুক হাসির কবি কবি চেহারার বড়োসড়ো কুকুর!
হবিগঞ্জে এসে যখন পৌঁছলাম, রাত তখন সাড়ে বারোটা। এ শহরে রোটার্যাক্ট ক্লাবের উদ্যোগে আমার একটা ক্যারিয়ার আড্ডা হয়েছিল, যেটি ছিল হবিগঞ্জের ইতিহাসে দীর্ঘসময় ধরে সবচাইতে বড়ো স্টুডেন্ট সমাগম। এর কৃতিত্ব প্রায় পুরোটাই ক্লাবের। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, এরকম একটা প্রোগ্রাম সুন্দরভাবে করতে আয়োজকদের কতটা শ্রম দিতে হয়। সে সময় ক্লাবের সবার সাথে আমার একটা আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল, যে-সম্পর্কটা এখনও আছে। সেবার সবাই মিলে রেমা-কালেঙ্গা ফরেস্টে ঘুরেছিলাম, ছিলাম 'অবিবাহিত, তাই কষ্টে জীবিত' দিবাকরদা'র বাসায়। দাদা এখন 'বিবাহিত, তাই সুখে মৃত'। দাদার বাসার সবার আপ্যায়নের কথা মনে থাকবে। হবিগঞ্জের কথা মনে এলেই শহরটাকে কেমন জানি আপন আপন লাগে। মফস্বল গোছের শহরগুলোতে গেলে আমি মানুষের যে-আন্তরিকতা পাই, সেটি কিছুতেই ভোলার নয়। সেই ভালোবাসার টানেই তো ছুটে যাই।
রবিন সিংহ আগে থেকেই সার্কিট হাউসে রুম ঠিক করে রেখেছিলেন। উনি আমার ডিপার্টমেন্টেই চাকরি করেন, আমার পরের ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। কোনো এক অজানা কারণে উনি আমাকে খুবই পছন্দ করেন। আমার অফিসের গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সিলেট থেকে বাসে এসেছি। গিয়াস-সহ এখানে পৌঁছোনোর পর রিকশাওয়ালাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যেতে বললাম। (গিয়াস আমাদের ডিপার্টমেন্টে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন, পরবর্তীতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে জয়েন করেন। ভীষণ মেধাবী মানুষ গিয়াস সাস্টের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্সে ও মাস্টার্সে ২য় হয়ে পাশ করেছিলেন। বছরখানেক আগে কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।) গতবার যখন অল্পসময়ের জন্য এখানে এসেছিলাম, তখন শহরের ভেতরটায় অতটা ঘোরাঘুরি হয়নি। আজ রিকশায় চেপে আসার সময় ডিসির বাসভবনের পাশেই একটা রেসিডেনশিয়াল প্রিমিজেস দেখে ভাবছিলাম, "বাহ্! বেশ গোছানো তো! এখানে থাকতে পারলে মন্দ হতো না।" তখন পর্যন্ত জানতাম না, ডিসির বাসভবন, এসপির বাসভবন, সার্কিট হাউস—এসব পাশাপাশিই। আর যে-পাশটায় 'জেলা প্রশাসকের বাসভবন' কথাটি লেখা আছে, ওপাশ থেকে 'সার্কিট হাউস' লেখাটি দেখা যাচ্ছিল না। একটু পরেই আবিষ্কার করলাম, একটু আগেও যেখানে থাকব ভাবিনি, আমার থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানেই। জীবনটা এমনই। যা পাবেন না ভাবছেন, দেখবেন, সেটিই আপনাকে খুঁজে নিয়েছে।
আমার এখানে আসার খবর পেয়ে রোটার্যাক্ট ক্লাবের অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। মৌলভীবাজার আর শ্রীমঙ্গল থেকেও ফোন পেয়েছি। সুমি মৌলভীবাজার ভ্যাটের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার। উনি কাল-পরশু ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। অনেকেই বলেছেন, "দাদা, আপনি কখন আসছেন? আমরা আপনাকে দেখার অপেক্ষায় আছি।" এ অনেক বড়ো পাওয়া। কাল সবাই মিলে ঘুরতে যাব।
এই রাত ১টায়ও শাওনদা দেখা করতে সার্কিট হাউসে চলে এলেন। উনি ছিলেন ক্লাবের গতবারের প্রেসিডেন্ট। ওঁর দুইটি দিক নিয়ে না বললেই নয়। বেশ আন্তরিক আর কর্মঠ। ভালো কথা, উনি আর বউদি বেশ ভালো গান করেন। বউদির কণ্ঠ শুনলে নিতান্ত সংগীত-বেরসিকও ক্রাশ খাবে, একথা বাজি ধরে বলতে পারি। আমি, গিয়াস আর শাওনদা সার্কিট হাউসের দোতলায় আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছি, এমন সময় নিচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে একটা খুব বড়োসড়ো কুকুর উঠে এল। অতি জ্ঞানী আর গম্ভীর চেহারার কুকুরটাকে দেখে আমার সুনীলের বর্ণনায় বসু পরিবারের কবি-কবি চেহারার কুকুরটির কথা মনে পড়ে গেল। মনে হতে লাগল, একটু কাগজকলম পেলেই ও এখুনিই কবিতা লিখতে বসে যাবে! কুকুরটা দাঁড়ায় একেবারে গা ঘেঁষে। কী যেন শুঁকতে থাকে। তাকানোর ধরনটা হুবহু 'হাচি: অ্যা ডগস্ টেল' মুভির কুকুরটার মত। কান দুটো নিচের দিকে নামিয়ে যখন বসে থাকে, তখন ওটাকে দেখায় ছোটোবেলায় ‘রেডিয়েন্ট ওয়ে'-তে কোনো এক গল্পে পড়া একটা কুকুরের মতো, যে-কুকুরটা মালিকের মৃত্যুর পর তাঁর কবরের উপর গিয়ে সারারাত শুয়ে থাকত। কুকুরটা আমার পিছু ছাড়ছিলই না, পারলে আমার রুমে ঢুকে পড়ে আর কি! এই বিশালদেহী আদুরে কুকুরটা এখন আমার রুমের দরোজার ঠিক বাইরে নিচে বসে আছে। ওর জন্য একধরনের মায়া অনুভব করছি, যে-মায়া কাছে টানে অথচ কাছে আসতে দেয় না।
(দয়া করে কেউ কুকুরটার সাথে সেলফি তুলে পোস্টাইতে রিকোয়েস্ট করবেন না।)
দুই। রশিদপুরে হবিগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কটা এত সুন্দর কেন? দু-পাশে চাবাগান, রাবারবাগান। এর মাঝখানের রাস্তা দিয়ে লংড্রাইভে চলে যাচ্ছি। বেশিই ভালো লাগছে। এখন 'চায়ের দেশে স্বাগতম' লেখা ভাস্কর্যের নিচে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে ছবি তুলছি। মন-ভালো-করে-দেওয়া ঝকঝকে দিন। আজকের দিনটা একটু অন্য রকমের নাকি?
তিন। দু-ধারে গহিন অরণ্য। ঝিঁঝির ক্লান্তহীন ডাক, পাখির কিচিরমিচির। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। যাচ্ছি মাধবপুর লেকে।
ফিলিং টারজান টারজান . . . মিসিং জেন . . . হু ওয়ানা বি মাই জেন?
চার। আহা! বেঁচে থাকলে এরকম একটি মাধবপুর লেক দেখা যায়!
পাঁচ। লাউয়াছড়া ফরেস্টে . . . অজগর গলায় প্যাঁচাইয়া ব্যাঘ্ররে ওষ্ঠচুম্মা দিয়া সেলফি তুলতে মঞ্চায়! মাম্মুরা! তুমরা কই কই কই?!
ছয়। At Boddhovumi 71
. . . (এখানে আমাদের ভাইয়েরা ঘুমিয়ে আছে)
সাত। সারাদিন ননস্টপ ঘোরাঘুরিশেষে এখন রবীন্দ্রের বাসায় গতবারের মতো গানের আসরে আমরা ২০-২৫ জন। আমাদের সবাইকে পেয়ে রবীন্দ্র আর বউদি সে কী খুশি! হারমোনিয়াম-তবলার এই শতাব্দীপ্রাচীন ঘরোয়া আবেগ কখনও সেকেলে হবে না। গান চলছে একের পর এক, সাথে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া। তালি দিতে দিতে দু-হাত লাল লাল হয়ে গেছে, চিৎকার করে করে গলা মেলাতে গিয়ে গলা ভেঙে যাবার জোগাড়, ঘাড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মুণ্ডুটা এই খুলে গেল বলে! পুরোটা ঘর জুড়ে আন্তরিক একটা আবহ।
প্রিয় মান্না-লতা-কিশোর-সন্ধ্যা, তোমরা না থাকলে সন্ধ্যাটা এত মিষ্টি হত না। ফোকও চলছে। লালন, হাসন রাজা, রাধারমণ, শাহ্ আবদুল করিম। একটু পর শুরু হবে সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল। গতবারও হয়েছিল। এ গানের সাথে সবাই মিলে নাচতে সেইরকম মজা!
আমি একেকটা শহরে আসি, আর লোকে কী সুখেই-না এত পেইন নেয়! এই ভালোমানুষগুলো আছে বলেই জীবনটা এখনও সুন্দর মনে হয়। থাকার জন্য ছোটো শহরই ভালো। এখানকার মানুষগুলো খুব বেশিই আন্তরিক। ওরা এখনও জীবনের সব অর্থ জীবিকাতে খুঁজে বেড়ায় না। সহজ জীবনই তো জীবন! আহা, একটা সহজ জীবন কাটাতে পারতাম! বাবা পেরেছেন। শুধু এইজন্যই বাবাকে ঈর্ষা হয়।
April 11
এক। দু-পাশে সারি সারি গাছ নুয়ে নুয়ে অভিবাদন জানায়। গাছের ওপাশটায় বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, চোখ দিয়ে ছোঁয়া যায় যেন। ওই দূরে সাজানো কদলীবনের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ টিয়াদের ওড়াউড়ি। ওদের ওপরে রোদমাখা মেঘের ভেলা। শান্তস্নিগ্ধ আকাশ। আকাশের ওপারে মেঘে-ঢাকা টিলার পায়ের কাছটায় ধূসর গ্রাম। চারপাশে সবুজের হরেক রকমের সাজ; এখন পর্যন্ত গুনে দেখলাম, ৯ রকমের সবুজ। এরই মাঝে ভালোবেসে-ফেলা পিচ-ঢালা পথ।
সুশান্ত, এই পথঘাট, নদীপাহাড়, গাছপাখি, সাগর-আকাশ ভালোবেসে-টেসে থাক আপাতত। আল মাহমুদকে দ্যাখ। তুমি আরও পঞ্চাশ বছর এভাবে করে ভালোবেসে গেলে কিচ্ছুটি হবে না গো, বাছা! কেউ কেউ শুধু মুড়ি খেয়েই বেঁচে থাকে, তাই না?
হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটা একটু ঘুরে দেখলাম। এই বিশাল প্লান্টটি প্রাণ আরএফএল গ্রুপের। আমাদের গরিব মানুষগুলো এখানে কাজ করে। ওরাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। . . . এখন শাহ্জীবাজার ফ্রুটস্ ভ্যালির পথে . . . সাথে আছ রবীন্দ্রদা, সাইফুল ভাই, গিয়াস, শাওনদা, সুপ্রাজিত, কৃষ্ণ। প্রত্যেকেই বড়ো ভালোমানুষ, আন্তরিক। ভালোমানুষের সাথে ঘোরাঘুরির মজাই অন্য লেভেলের!
দুই। শাহ্জীবাজার রাবারবাগান ঘুরে দেখলাম। খুবই সুন্দর একটা জায়গা, একেবারে ন্যাচারাল শ্যুটিং-স্পট। এখানে ছবি তুললে দারুণ আসে। আমি মুভি বানাতে জানলে এখানে একটা 'অরণ্যের দিনরাত্রি' বানানোর কথা ভাবতাম। একটা তথ্য দিই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিন্তু কবি হয়েই থাকার কথা ছিল, ঔপন্যাসিক হবার কথা ছিল না। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি'-কে সত্যজিৎ মুভি বানানোর পর সেটা খুব জনপ্রিয় হয়। পত্রিকা থেকে অনবরত অনুরোধ আসতে থাকে—উপন্যাস চাই, উপন্যাস! প্রয়োজনে ছোটো হোক, তবুও। . . . তাছাড়া কবিতার চাইতে উপন্যাসের বাণিজ্যিক মূল্যও বেশি। এভাবে করেই কবিতার সুনীল হয়ে উঠলেন উপন্যাসেরও সুনীল। সত্যজিৎকে ধন্যবাদ। এই রায় পরিবারটি বাঙালিকে অনেক দিয়েছে। সত্যজিতের সব লেখাই ভালো, সব মুভিই ভালো, সব আঁকাই ভালো। ভাবতে ভালো লাগে না ব্যাপারটা? সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার এই রমণীমোহন সুপুরুষকে ঈশ্বর সবকিছুই দিয়েছেন। অ্যা রেয়ার কম্বিনেশন অব ব্রেইন অ্যান্ড বিউটি!!! স্যালুট, বস!
এ বাগানে মোট দুই হাজার চল্লিশ একর এলাকা জুড়ে প্রায় দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার রাবারগাছ আছে। যে-দিকেই তাকাই, সেদিকেই সবুজ। ফোর হুইলারে চেপে গেলে বিশ কিলোমিটার রাস্তা যাওয়া যায়। এখানে রাবারকে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়। ল্যাটেক্সের কটু গন্ধ সহ্য করা কঠিন। একটা চুল্লিঘর আছে, যেখানে জমাটবাঁধা রাবার শুকোনো হয়। এর পাশেই নিচে ফার্নেস। একটু দূরে কিছু নিরীহ ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। ওদের দেখেই প্রথম যে-কথাটি আমার মাথায় এল, সেটি হলো, এদের মধ্য থেকে একটাকে ধরে বারবিকিউ করলে মন্দ হতো না! এই অরণ্যে নাইট বারবিকিউ পার্টি সত্যিই জমবে ভালো! (মানুষ আসলেই অতিবদ প্রজাতির প্রাণী। ক্যান যে মানুষ হইলাম! অঞ্জন দত্তের একটা ট্র্যাভেল-শো আছে, ‘চলো অঞ্জন’ নামে। (ইউটিউবে সব এপিসোড দেওয়া আছে, খুঁজে দেখে ফেলতে পারেন।) সেখানে তিনি বা কোনো এক অতিথি (কবীর সুমন বোধ হয়) বলছেন, বাঙালি জাতটার একটা সমস্যা আছে। সুন্দর কোনো প্রাণী বা পাখি দেখলেই প্রথমে তার মাথায় আসবে, এটা খাওয়া যায়? এমন চিরজন্মের খাই-খাই জাত পৃথিবীতে আর একটাও পাওয়া যাবে না।) একজন কর্মকর্তা আমাদেরকে সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখালেন, আপ্যায়নও করলেন। ভদ্রলোক বেশ আন্তরিক।
একটা স্বপ্নমাখা রাস্তা। একটা ফোর হুইলার। কিছু ভ্যাগাবন্ড সোলস। গন্তব্য দেউন্দি চাবাগান। রবীন্দ্রকে ধন্যবাদ। উনি না থাকলে এত প্রটোকল নিয়ে সহজভাবে ঘুরতে পারতাম না। শাওনদা না থাকলে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, এই আমিও এতটা সুন্দর, মানে উনি আমাদের আজকের ফটোগ্রাফার। ডিএসএলআর না থাকলে ঘোরাঘুরিটা এত মিষ্টি হতো না . . . সামনের সিএনজির পেছনে লেখা: জীবন কর্মময়, মরিলে বিশ্রাম হয়।
তিন। এ ক-দিনে আমার উপলব্ধি, সমরেশ-বুদ্ধদেব পড়ে চাবাগান বোঝা যায় খুব অল্পই। গল্প-সিনেমায় আপনি বড়োজোর চাবাগানে বুঁদ হয়ে থাকতে পারবেন, এর বেশি কিছু নয়। চাবাগান দেখতে হলে চাবাগান দেখতেই হবে, এ ছাড়া সম্ভব নয়। চাবাগানকে ভালো না বেসে থাকা কঠিন। যতই দেখি, ততই শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
দেউন্দি চাবাগানে এসে প্রথমেই এলাম ম্যানেজার সাহেবের বাংলোতে। বাজি ধরে বলতে পারি, এমন সুন্দর থাকবার জায়গা পেলে আপনি খুব করে চাইবেন, এ চাকরিটাই করতে। কী নেই চাবাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে? পৃথিবীর তাবত্ সুন্দর গাছ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। প্রকৃতির কাছাকাছি একটা সুন্দর বাড়িতে দেহ ও মনের জন্য প্রীতিকর যা যা থাকতে পারে বলে আপনার কল্পনায় আসতে পারে, তার সবই পাবেন এখানে। শুধুই মনে হতে থাকবে, জীবন এখানেই, জীবন এখানেই! আমার মুহূর্তেই মনে হলো, চাকরিটা ছেড়ে দিই, চাবাগানের ম্যানেজার হয়ে যাই। এ দেশ সব-পেয়েছির দেশ। সাথে একটা বিশাল রাজ্য তো আছেই! পাইকপেয়াদা সৈন্যসামন্তেরও কোনো অভাব নেই। হাত বাড়াতে হয় না, এর আগেই সব কিছু হাজির! সমস্যা একটাই: হাফপ্যান্ট পরে থাকতে হবে!
সবুজের মাঝে জীবনযাপন। চাবাগানে প্রকৃতির সবটুকু সবুজ নির্যাস একসাথেই পাওয়া যায়। টিলা, হ্রদ, পাহাড়ি পথ, মায়াবী গাছের সারি, নিজের একটা গাড়ি। একটা মিষ্টি রোদমাখা বিকেল কিংবা একটা বৃষ্টিস্নাত অলস দুপুর কাটানো, কিংবা চাঁদনি রাতে নরোম জ্যোৎস্নায় সমস্ত শরীরমন ধুয়ে নেওয়া। আপনার কল্পনায় রাজ্যের যত পাখি আসে, তার সবই ক্ষণে ক্ষণে ডেকে যায়। বউ-কথা-কও, ঘুঘু, কোকিল, দোয়েল, ময়না, শালিক, নওরং, ফিঙে, বুলবুলি! কোনটা নেই এখানে! পোকাদের একটানা ডাকের রেশে সারাদিন দিব্যি কেটে যাবে। রাতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎই সামনে এসে পড়ল একটা প্যাঁচা, খপ করে ধরে একটা পোকা খেয়ে নিল, কিংবা কয়েকটা শাদা খরগোশ ছুটে গেল গাড়ির সামনে দিয়েই! শেয়ালেরা দূর থেকেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে ভয় পাইয়ে দেয়। এসব দেখলে আর ভাবলে এসব নিয়েই বেঁচে থাকতে বড্ড ইচ্ছে হয়।
দেউন্দি চাবাগানের ম্যানেজার বড়ো ভালোমানুষ। আমাদের আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করলেন। সহকারী ম্যানেজার সাহেব পুরো বাগানটা ঘুরে দেখালেন। বেশ হাসিখুশি চমৎকার একজন ভদ্রলোক। চাবাগানগুলো কাস্টমসের স্টেকহোল্ডার। হয়তো সেজন্যই। তবুও এটাই সব কিছু নয়। ইম্প্রেসিভ ব্যবহার, ইম্প্রেসিভ আচরণ, এসবই সব! দেখছি আর ভাবছি, সত্যিই বেশ ভালো আছি। শুকরিয়া! চাকরিও এত কিছু দেয়! জীবিকার সাথে জীবনের বোঝাপড়া। শুধু এর বিদ্যেটা জানতে হয়, আর্টটা বুঝতে হয়। রবীন্দ্রকে ধন্যবাদ এত কিছুর আয়োজন করে দেবার জন্য। শাওনদা, আপনি কি জানেন, আপনি ক্যামেরা না ধরলে এই দুপুরটা কিছুতেই এতটা মিষ্টি রং ধরত না? সাইফুল ভাই, আপনার মাথায় এত আইডিয়া গিজগিজ করে কীভাবে?
চাবাগান নিয়ে চমৎকার কিছু বাংলা মুভি আছে। ওগুলো দেখলে বর্ষাকালে ওখানে গিয়ে কয়েক দিন থেকে আসতে ইচ্ছে করে, কিংবা পড়ন্ত বিকেলে কারও হাত ধরে হাঁটতে। বন্ধুরা, দেখি এরকম কিছু মুভির নাম বলুন দেখি। শুরুটা আমিই করছি: উত্তমকুমারের ‘ধনরাজ তামাং’।
চার। দ্য প্যালেস রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা ঘুরে দেখছি। পুরাই মাথানষ্ট একখান জিনিস বানাইয়া রাখসে! শুধু এখানে হানিমুন করার জন্যও বিয়ে করা যায়! বেশি অসাম, বেশিই!!
April 12
আজ একটা এনজিও'র কাজকর্ম দেখলাম। সীমান্তিক। বিচিত্র ধরনের কাজ করে এরা। হেলথ, এডুকেশন, ম্যাটারনিটি-সহ আরও অনেক সেক্টর নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার ডোনেশনে এনজিও'টি চলে। এখানে যারা কাজ করে, কিংবা সেবাগ্রহণ করে, ওদের জীবনের অদ্ভুত সব গল্প আছে। ওরা বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিংও দিয়ে থাকে। ওদের নানাধরনের কাউন্সেলিং সেলও আছে।
একটা ট্রেনিংয়ের কথা বলি। মিডওয়াইফরি ট্রেনিং। যে-সব মেয়ে এ ট্রেনিং নিচ্ছে, ওরা এইচএসসি পাশ করে এসেছে। আমরা বিভিন্ন প্রশ্ন করে দেখেছি, ওরা ভালোই শিখছে। ওরা বেশ ভালো গায়ও। ওরা ছবি আঁকে, সেলাই জানে, আরও কত-কী! প্রশিক্ষণ ওদের আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা এখন বিশ্বাস করে, ওরা কিছু-একটা করতে পারবে। সিদ্ধান্ত নিতে শিখছে, নিজেকে সম্মান করতে শিখছে। নিজেকে সম্মান করতে জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আর্ট। এ আর্টটা ওরা রপ্ত করতে শিখছে। কথা বলে জানলাম, এ ব্যাচটা বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচ। ওরা ব্রাক ইউনিভার্সিটির অধীনে এ ট্রেনিংটা নিচ্ছে। ওদের বেশিরভাগই একেবারে প্রান্তিকশ্রেণীর ফ্যামিলি থেকে এসেছে। হয়তো এইচএসসির রেজাল্ট অতটা ভালো না, ভালো কোথাও ভর্তি হওয়াটাও কঠিন, তাই চাকরিও অনিশ্চিত। ওরা আত্মনির্ভরশীল হবার প্রত্যয়ে কোর্সটা করছে। কোর্সটা করলেই একটা চাকরি জুটবে। এতে বেকারত্ব কমবে, প্রসূতিমৃত্যুর হারও হ্রাস পাবে। ভালো তো! সবাই তো আর রকেট-ইঞ্জিনিয়ার হবে না রে ভাই! দরকারও নাই। Doing the best thing is not what matters, doing the best thing you can is the only thing that matters.
একেবারে গাধা টাইপের স্টুডেন্টাও কোনো-না-কোনো কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারে। সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সে কাজটিতে ওকে সেরা করে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েরা কিছু একটা করতে না পারলে কী করত? বাসা থেকে ধরে বিয়ে দিতে দিত নিশ্চয়ই। এখনও দেবে। তবে বিয়ের সময় ওদের সম্মানটা কিন্তু বেশিই থাকবে। এসব দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা চাকরিক্ষম হলে বিয়ের পরেও শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহের শিকার হয় কম, ওদের মতামতের একটা দাম থাকে। বিয়ের পর চাকরি করুক আর না-ই করুক, ওর শেখা বিদ্যেটা কিন্তু কখনো-না-কখনো কাজে লাগবেই। জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা . . . আজকাল মেয়েরা কেউই বসে থাকছে না, কিছু-না-কিছু করছে। দেখলেই খুব ভালো লাগে। আমরা চাই, আমাদের মেয়েরা মাথা উঁচু করে চলুক, ওদের কষ্টের খবরে পেপারগুলো ভরে না যাক।
জানি, ভিন্ন মতও আছে। এনজিওগুলো বিদেশি অর্থে ফুলেফেঁপে কলাগাছ হচ্ছে। হবেই! এটা ব্যাবসা তো, না? রুরাল ডেভেলপমেন্টও হচ্ছে এর সাথে সাথে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি এরা ঠিকভাবে কাজ করে গেলে দেশের অনেক আন্ডারডেভেলপড কিংবা লেস-এক্সপ্লোরড সেক্টরগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নানাধরনের সীমাবদ্ধতা আছে তো! কথা হলো, বিদেশি ডোনেশন ঠিকভাবে খরচ করা হচ্ছে তো? এটা বোঝার জন্য এদের মনিটরিং বাড়াতে হবে। কে বাড়াবে? বাড়ছে না কেন? এর দায় কিন্তু আমাদেরও। চোর চুরি করে বলে বলে শুধু চেঁচালে তো হবে না। দেখতে হবে, চুরির ভাগ পাহারাদারও পাচ্ছে কি না? চোরের সাফল্য নিয়ে পাহারাদার চোরের চাইতেও বেশি উদ্বিগ্ন কি না? চুরি চলতেই থাকুক, এটা কিন্তু শুধু চোরই চায় না। আমি ব্যাবসা করলে আমিও কিন্তু চেষ্টা করতাম চুরি করতে। ব্যাবসায় চুরির মূলমন্ত্রই হল, পারলে ঠেকাও! ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ মুভিটা দেখেছেন না? ব্যাবসাও ওরকম। চোরকে ধর্মের কাহিনি শোনাবেন কেন? না কি ধর্মের কাহিনি শোনালেই আপনার লাভ বেশি? থাক, বাদ দিই। কথা বললে কথা চলতেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে। অত নিরীক্ষায় যাব না। মোটাদাগে এইটুকুই বলব—এনজিওগুলোকে বাদ দিয়ে দিন, দু-চোখ বন্ধ করুন। ভাবুন তো, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে সব কিছু ঠিকঠাক চলবে তো? চলবে না বোধ হয়। এনজিও বন্ধ করে দাও, করতে হবে…বলে হইচই করলে তো হবে না। পারলে বিকল্প বুদ্ধি বের করুন।
এসব এনজিও’র কাজের ধরন খুবই বৈচিত্র্যময়। এমন অনেক অভিনব কাজ ওরা করে, যেগুলো চোখে না দেখলে আপনি ভাবতেও পারবেন না যে, এমন কিছুও করা যায়। ঘুরে ঘুরে এদের কাজ দেখলে, ওখানকার মানুষগুলোর সাথে কথা বললে জীবনের গল্প লেখার অনেক রসদই জুটে যাবে। আহ্! ওদের সাথে ঘুরে ঘুরে কিছুদিন কাটাতে পারতাম! একটানা না হোক, অন্তত মাঝে মাঝে হলেও . . .