সিলেট ডায়েরি (২)


April 5
এক। মৎস্য কর্মকর্তার অফিসে। মাছ নিয়ে কথা হচ্ছে। রূপচাঁদা ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করছে। এই অফিসেও স্যান্ডউইচ খেতে হবে কেন? . . . আচ্ছা, এভাবে ভাবাটা কি ঠিক হচ্ছে? কেউ যদি আমার অফিসে এসে আমার কাছ থেকে কফিতে ভিজিয়ে স্বর্ণের বিস্কুট খেতে চায়, তখন আমি কী করব?


বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। হেডফোনে চলবে…যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো . . . জানি, কেউ আসবে না। এই বৃষ্টির দিনেও কারও মন কাঁদছে না। সবারই মন খুশি খুশি। সমস্যাটা কী? এই বৃষ্টিতে মন খুশি খুশি থাকবে কেন? . . . লিখছি আর গুনগুন করছি, বৃষ্টি পড়ে অঝোর ধারায় . . . পাশের মেয়েটা ফিক করে হাসল কেন? সুরে ভুল হয়নি তো? না কি বাপ্পাকে মনে মনে আই লাভ ইউ বলছে? . . . সুশান্ত, তুই অফ যা, বাপ!


ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে। এ জাদুকর পাঠককে বিষণ্ন করে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন। এমন দিনে কফির ধোঁয়ায় বিষণ্ন হতে বড্ড ইচ্ছে করে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে শ্রীজাতর কবিতা পড়া যেতে পারে। ব্যাকগ্রাউন্ডে লো ভলিয়্যুমে বাজতে থাকবে ‘সিল্ক রোড’।


কোনো ঝরঝরে গদ্য আরও এক বার পড়ে ফেলা যায়। জয় গোস্বামীর উপন্যাস কিংবা হলুদ বসন্ত কিংবা ছবির দেশে কবিতার দেশে। কিংবা মন্দাক্রান্তা সেনের ‘ঘর’ কবিতাটা পড়ে ঘরে ফেরার অনর্থক ইচ্ছেয় চাকরিকে 'ধুত্তোরি ছাই' বলে দেওয়া যেতে পারে; বার বার!


কথা চলছেই। উফফ্‌! সমুচা খেতে খেতে মাছের গল্প কেন করতেই হবে?


দুই। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। চার-ছক্কা হাঁকতে নয়, ঘুরতে। এত এত পোজ, এত এত ঢং, এত এত হাসি! আজই কিছু পোজের জন্ম হল। প্রকৃতি সবাইকে বড্ড ছেলেমানুষ করে দেয়। কিছু অভিনব ছেলেমানুষির জন্ম দিয়েছে ফেইসবুক। স্টেডিয়ামের ভেতরে গ্রিন গ্যালারি, বাইরে গ্রিন টিগার্ডেন। এত বড়ো গ্রিন গ্যালারি আর কোথাও নেই। টিগার্ডেনের ভিউ মুগ্ধ করে দেয়, শুধুই ছবি তুলতে ইচ্ছে করে। পুরো সিলেটই যেন শ্যুটিংস্পট। বৃষ্টিভেজা সিলেট নিতান্ত বেরসিক রামগরুরের ছানাকেও খালিহাতে ফেরাবে না, এটা বাজি ধরে বলতে পারি। প্রকৃতির জাদু শুধুই আফসোস বাড়িয়ে দেয়। এটা ভাবতে ভালো লাগছে, বেঁচে থাকতে হলে দরকার একটা সবুজ পাহাড়, একটা মায়াবী নদী, একটা মহৎ আকাশ আর চিরযৌবনা আমার প্রেয়সী। ওরা একটু একটু করে বড়ো হবে, অথচ বুড়ো হবে না। জীবিকার নিশ্চয়তা দিলে আমি এখানে থেকে যেতে রাজী, জীবনের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারব। এখানকার লোকজন কিছুটা চট্টগ্রামের লোকজনের মতো—এদের বিত্ত আর চিত্ত দুই-ই বেশ বড়ো। এরা প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, তাই একটু বুঝেশুনে চলতে হয়। বাংলাদেশের সবজায়গাতেই অবশ্য সাধারণ মানুষের চিত্র কম-বেশি এমনই। আমরা বড়ো আন্তরিক। কাছে আসতে একটু মুখের হাসি ছাড়া আর তেমন কিছুই লাগে না।


যখন আবৃত্তি করতাম, তখন একটা কবিতা নির্মাণ করতে বড়ো ভালো লাগত—আপনাদের সবার প্রতি এই উদার আমন্ত্রণ . . . ছবির মতো এই দেশে একবার বেরিয়ে যান . . . কোরিয়াতে একটা ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে অনেক দেশ থেকে অফিসাররা ছিলেন। কনফারেন্সে আমার যে-প্রেজেন্টেশনটা ছিল, সেটাতে ইচ্ছে করেই নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিচয় দিয়ে কবিতার ওই উদাত্ত আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছি। যাঁরা বাইরে ট্রেনিংয়ে যান, তাঁরা এ কাজটা করতে পারেন। ওদের উপচে-পড়া ডলার কিছুতেই জলে যাবে না, এটা তো নিশ্চিত।


তিন। পেছনেই পাহাড়, পাশেই ফুলের বাগান, সারি সারি গাছ, একটু দূরেই নদী। পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখিরা ডেকে যায়। এখানে একবার ঘুমিয়ে পড়লে সেই পরম নির্ভার ঘুম আর ভাঙবেই না—মাতাল ঝড়ো হাওয়া কিংবা বৃষ্টির একটানা অবিরাম ঝরে যাওয়াতেও না। পাশের রাস্তার এবড়োখেবড়ো খানাখন্দ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে টুংটাং শব্দে রিকশা-সাইকেল চলে। ওখানটাতে শুয়ে শুয়ে শোনা যায় অপার্থিব ছন্দের ঐকতান কিংবা রাগি ক্লান্ত দুপুরের নীরবতাকে ভেঙে খানখান করে-দেওয়া ঘাটে-বাঁধা নৌকো থেকে মাঝির ডাক, ও ভাই . . . !!


কী সুন্দর শ্মশান! দেখলেই মরে যেতে ইচ্ছে করে!


পরিবার পরিকল্পনা অফিসে এলাম। মজার মজার সব কথা শুনছি। সব কথা বলা যাবে না। একটা শেয়ার করি। একজন চিকিৎসক ভদ্রমহিলা আমাদেরকে ব্রিফিং দিচ্ছেন। উনি বললেন, ফ্যামিলি প্ল্যানিং সবসময়ই ভালো বলে মনে হয় না। এই যেমন ধরেন, আমার দুই সন্তান। ছেলেটা বুয়েটে পড়ে ফোর্থ ইয়ারে। মেয়েটা গতবার ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেল। আমি তো আগে বুঝি নাই যে ওরা এত ভালো করবে। আগে বুঝলে তো আরও কয়েকটা নিতাম। দেশেরও লাভ হতো। এখন তো আর কিছু করার নাই। আপনারা যদি বেশি সন্তান নেন, তবে সবগুলোকেই মানুষ করবেন। . . . ওঁর একটা কথা এপিক হইসে: আপনারা মানুষকে অনার করবেন, তাহলে আপনারা নিজেরাও 'অনারিত' হবেন।


চার। Happiness is good food with good people.
Sylhet town stays on this rooftop!!


April 6
এক। পাহাড়ে পাহাড়ে . . . আহারে আহারে !!
পর্যটন মোটেলের পাশের পাহাড়গুলোতে . . .
তোমাদের সুইস ব্যাংকের সমস্ত টাকা দিয়ে দিলাম, তার বদলে আমি এই পাহাড়টা নেব।


দুই। হ্যাপিনেস ইজ . . . বৃষ্টিস্নাত পড়ন্ত বিকেলে চাবাগানের পাশ দিয়ে স্লোড্রাইভে যাওয়া


তিন। হযরত চাষনী পিরের মাজার ঘুরলাম। এই মাজারে অনেক বানর। এদিক-ওদিক ছুটছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, ইচ্ছেমতো ভেংচাচ্ছে, ওদের ভাষায় আমাদের হ্যালো বলেই যাচ্ছে, খাবার দিলে বেশ জেন্টলম্যানের মতো করে হাতে নিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। বাচ্চাগুলো আরও এক কাঠি সরেস, ওরা জন্ম থেকেই বান্দর! বানরও যে এত সুন্দর পোজ দিতে পারে, সেটা জানা ছিল না। একটুও আপত্তি করেনি। একেবারে আপন করে নিয়েছে! একেবারে জিভ-টিভ বের করে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে পোজ! কাহিনি বুঝলাম না। আমাকে দেখলে কি আপন আপন লাগে নাকি?


এখন ঘুরছি লাক্কাতুরা চাবাগানে। . . . বিকেলের শেষ আলো, একটু থাকো . . .


April 8
ঢাকা দক্ষিণের পথে . . . শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দিরে যাচ্ছি।


ব্রাহ্মণ্যবাদ ও উগ্র জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে ওঁর অবস্থান বিস্মিত ও মুগ্ধ করার মতো। মানুষ তার জন্মপরিচয়ের ফলে যা যা বাড়তি সুবিধা পায়, সেগুলিই তাকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দেয়। মানুষ তার কর্মপরিচয়ের দাবিতে সমাজে বেঁচে থাকুক। রাজার ছেলে কেন রাজা হবে? পালবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা গোপাল কোনো রাজপুত্র ছিলেন না। সদ্‌গুণ কখনোই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই যদি হতো, তবে রবীন্দ্রনাথের ছেলে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কেউ হতে পারতেন। এসব কথা শ্রী চৈতন্য মানুষকে বুঝিয়ে গেছেন। মানুষকে ভালোবাসা, ক্ষমা করা, মহত্ত্ব, প্রতিটি জীবের প্রতি প্রেম, এসবের দীক্ষা দিয়ে গেছেন আজীবন। তাঁকে কিংবা তাঁর দর্শন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অন্তত আড়াই লক্ষ চরণ রচিত হয়েছে। কম কথা নয় কিন্তু! উনি দর্শন-সহ বিবিধ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। ওঁর পাণ্ডিত্যের কথা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিতই লিখে গেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওঁকে পছন্দ করি ওঁর উদার মানসিকতা, মানুষকে ঘৃণা না করা এবং উগ্র শ্রেণীআভিজাত্যের বিরুদ্ধে সারাজীবন ধরে কাজ করে যাবার জন্য।


April 9
এক। রেলস্টেশনে বুকস্টল কাম ফাস্ট ফুড কর্নার দেখলে বুঝে নিতে হবে, ওতে অত বই নেই, আপনি বড়োজোর ৩০ দিনে হিব্রু ভাষা শিক্ষা জাতীয় কিছু বই-টই পেতে পারেন। এখানে লোকজন ট্রেনের অপেক্ষায় থাকার সময়ে বই পড়ে না, বাদাম চিবোয়—একা একাই, প্রায়ই। দেশভেদে মানুষ তার আচরণ বদলায়। যে আমি কোরিয়াতে থাকার সময়ে চুইংগাম খাওয়ার পর ফেলার জায়গা না পেয়ে ওটা টিস্যুতে লুকিয়ে পকেটে পুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরতাম একটা ডাস্টবিনের খোঁজে, সেই আমিই কফির কাপটা না ভেবেই ইচ্ছেমতো ছুড়ে দিই এজন্য নয় যে, এখানে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া অপরাধ হলেও প্রকাশ্যে ময়লা ফেললে কিছু হয় না, বরং এজন্য যে, আমরা দেশটাকেই ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছি, তাই যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যা ইচ্ছে তা-ই ছুড়ে ফেলা যায়। এখানে ডাস্টবিনের বাইরে ময়লা থাকে, ভেতরটার দখল মানুষের আর কুকুরের। কেউ কাউকে কামড়াবে না, এই অলিখিত চুক্তিতে ওরা ওতে ঘুমোয়। ওদের কারুরই ঘুমোনোর জায়গা নেই—বন্ধুত্বের জন্য এর চেয়ে বড়ো সাদৃশ্য আর লাগে না।


পুরো দেশ ঘুরে দেখার সময় নেই, অথচ সে দেশের মানুষ কে কেমন, কী করে, কী ভাবে, কী খায়, জানতে চান? ওদের রেলস্টেশনটা একবার ঘুরে আসুন। দু-ঘণ্টা কাটান, সব জানা হয়ে যাবে। বাজি ধরে বলতে পারি, এর বাইরে কোনো ধরনের মানুষ সে দেশে নেই। সন্ত থেকে শয়তান, সবই পাবেন। মানুষের বিচিত্রতা আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। আপনার কাছে যে-কাজটি করার কোনো অর্থই নেই, সে কাজটিই কেউ খুব গুরুত্ব দিয়ে করছে। এখানে অদ্ভুত সব ধান্দায় লোকজন ঘোরাফেরা করে। এই মাঝরাতে যারা জেগে থাকে, তারা নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ নয়। সাধারণ মানুষের কাজ, রাত ১০টার মধ্যে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। রাত মানুষকে অন্য মানুষ করে দেয়। রাতের মানুষকে দিনের মানুষের পাল্লায় মাপতে যাওয়াটা বড্ড বোকামি। স্টেশনে রাত বাড়ে, বাড়ে বিচিত্রতা। রাত বড়ো রহস্যময়। এ রহস্যের ক্ষমতা অসীম।


একটা ছোট্ট পুতুলের মতন মেয়ে ওর খেলনাটা উঁচু করে ধরে এগিয়ে এল। ওর নরোম গাল দুটো টেনে দিচ্ছি, এমন সময়ে দেখলাম, পুলিশ একটা লোককে কী যেন জিজ্ঞেস করছে, আর ও কী-একটা যেন পাশে ছুড়ে ফেলে দিয়েই ভোঁ দৌড়। দেখলাম, ওটা গাঁজার পুরিয়া। দু-জন অতিরূপসী তরুণী কী এক খুনসুটিতে মেতেছে। ওদের দেখছি, ভালো লাগছে, আর খুব করে চাইছি, ট্রেনটা আরও দেরিতে আসুক। হুমায়ূন আহমেদের গৌরীপুর জংশন'টা আবারও পড়তে ইচ্ছে করছে। এখুনিই!


বাইকে চেপে স্টেশন থেকে ফিরছি। একটা রাস্তার কথা বলি। নির্জন রাস্তা, সামনে-পেছনে কেউ নেই, আলোও নেই। আছে কিছু জ্বলজ্বলে চোখ। ওগুলো বেড়ালের। আধাভৌতিক কিছু ছায়া। ওগুলো রাতজাগা গাছের। কয়েক টুকরো তীব্র পিলে-চমকানো চিৎকার। ওগুলো শেয়ালের। এরকম আরও অনেক কিছু। পুলিশ থামাল। আমরা কথা বলছিলাম আর ওরা জেরা করছিল। কেন জানি ওরা বেশি কিছু বলেনি। আমরা ওদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম খুব স্বাভাবিকভাবে। তাই হয়তো। সাধারণ মানুষ পুলিশ জেরা করলে ভয় পাবে, এরকম রিলাক্সড থাকবে না। এটাই নিয়ম। নিয়মভাঙা মানুষ খুব একটা সুবিধের হয় না। ওরা আমাদের সুবিধের ভাবেনি।


ওসব শেষে-টেশে ক্বীন ব্রিজের নিচে এলাম। সুরমার পাড়ে বসে আছি। আশপাশের কেউ কেউ জেগে আছে, ওরা জাগেই; কোনো ধান্দায় নয়, এমনিতেই। ওরা দেখে রাতের নদী। রাতের নদীও কাউকে কাউকে বদলে দেয়। এখানে ওরা আসে বদলে যেতে। কেউ কেউ বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে বদলে যেতে ভালোবাসে। ব্রিজের ওদিকটায় নষ্ট শরীর ঘিরে কিছু নষ্ট তরুণের মাতলামি। নষ্ট কেন বললাম? শরীর নষ্ট হয় নাকি? এ নষ্ট সমাজে শুধু প্রকাশ্য নষ্ট শরীরই নষ্ট শরীর। এর পাশেই কুকুরগুলো নোংরা ঘাঁটছে। ফুটপাথে নেই-ঘর মানুষগুলো শুয়ে আছে। নদীর জলের ছায়ায় চাঁদের সাথে রাতের বাতিগুলোর মিতালি চলছে।


এইভাবে একেকটা পুরোনো রাত কেটে যায়।


পাশের দোকানে চা খেতে এলাম। কালচে রঙের অতিজঘন্য চা। কুকুর সবচাইতে বিশ্রী ময়লাটা খাবে, তবুও এ চা খাবে না। সে চা আমরা খাচ্ছি বড়ো আয়েশ করে। মাথায় বাজছে ‘ইত্যাদি’-র তুতুতু তুতু তারা, মর্জিনার বাপ মার্কা মারা . . . এ অসময়ে এ গান ক্যান বাজে? হুদাই!


বাইকটা আবারও চলছে। কিছু স্বীকৃত মাথা-খারাপ মানুষ রাস্তার মাঝখানটায় নাচছে। বাইক থামল। এখন ক্বীন ব্রিজের ওপরে হাঁটছি। ব্রিজের রেলিং ধরে নিচে বয়ে-যাওয়া রাতের নদীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা এরকম, আগে জানতাম না। মনে হতে থাকে, আমিই নদী। গাড়ি ছুটে যায়, ব্রিজ কেঁপে যায়।


এ রাতে যদি বাড়ি ফিরে না যাই, তবে কী হবে? কেউ তো আর আমার প্রতীক্ষায় নেই!!!


দুই। এমন একটা রাতে ২০-২৫ কিলোমিটার ভুল পথে বাইক চালিয়ে আসাটাকে মনে হতে থাকে এ মুহূর্তের সবচাইতে ঠিক কাজ। আমরা মহানন্দে ভুল করতে করতে ছুটতে থাকলাম। কিছু কিছু ভুল থাকে, যেগুলো না করতে পারার আফসোসেই জীবন কেটে যায়। তিরের মতন করে ছুটে আসা ঠান্ডা হাওয়া কাটতে কাটতে সামনের দিকে ভেসে যাওয়াটাই সবচাইতে আনন্দের মনে হতে থাকে। জীবন তো এখানেই! একটু পর ভুলে ঠিক পথ ধরে যাবার আফসোসে গলা ছেড়ে বেসুরো গলায় গাইতে গাইতে মনে হতে থাকে, এ ভুল সুরও তো আরেকটা সুর, যেমনি করে ভুল পথও আরেকটা পথ।


একটু আগেই 'আজ জ্যোৎস্না রাতে, সবাই গেছে বনে'-কে ‘ফাইনাল কাউন্টডাউন'-এর সুরে করলাম। খারাপ লাগেনি অতটা। বাংলাদেশি সিনেমার একটা গানের সুরে অন্য একটা গান করছি, অতি বিশ্রী স্বরে ও সুরে। ‘পড়ে না চোখের পলক'-কে গাইছি ‘ওই চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ’-এর সুরে, সাথে কিছু লাইন দিয়ে সেটাকে র‍্যাপ-সং করে ফেলছি। কখনো কখনো বিশ্রীভাবে গান গাইতে এত ভালো লাগে কেন?


নাজিমগড় রিসোর্টস-এ ঘুরতে এলাম। চারদিকটা এত সুন্দর! সারি সারি গাছ, মাঝখানে রাস্তা। টিলায় টিলায় সাজানো-গোছানো নানান কিছু। গার্ড ভাইয়ের সাথে গল্প জমিয়ে ফেললাম। এখানে এক রাত থাকতে লাগে কমপক্ষে এগার হাজার ছয় টাকা। দেখলেই থাকতে ইচ্ছে করে! কিন্তু . . .


যেখানে থাকি, সেখানে ফিরলাম। গল্প করার কেউ নেই, ওই চাঁদটা ছাড়া . . . এই মোম-জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি . . .

কৈফিয়ত। 'একরাত' কথাটি দেখে যাঁদের মনে হয়েছিল, এই লেখায় কিছুমিছু ইয়েটিয়ে আছে, তাঁদেরকে উত্তম-সুচিত্রার 'একটি রাত' দেখে হতাশ হবার পরামর্শ দিচ্ছি।


তিন। হ্যাপিনেস ইজ . . . চাঁদনি রাতে পুকুরঘাটের একেবারে নিচের দিকের সিঁড়িতে বসে রুপোলি জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা।


পুকুরপাড় ঘেঁষে ঘন গাছের সারি। প্রকাণ্ড থালার মতন পুকুরের স্বচ্ছ শরীর। রেশ-ধরানো একটানা ঝিঁঝির ডাক। কিছু রাতের পাখির কিচিরমিচির। কচি ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পোকাগুলোর লুকিয়ে লুকিয়ে চলা। মাছেদের বুদ্‌বুদের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি। ছোটো ছোটো গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখার সুখ। শাদা বিল্ডিংয়ের পলেস্তারা খসে খসে ফ্রেসকোর আমন্ত্রণ। একেকটা ছোড়া পাথরের আঘাতে ওপরের ঢেউয়ের কেটে কেটে যাওয়া। জলের টুপটাপ শব্দ।


বড়ো গোলমেলে সময় এ সময়। ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবার সময় এ সময়। আশ্রয় দিতে পারব না জেনেও প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে জাগার সময় এ সময়।


চার। হ্যাপিনেস ইজ . . . মাইক্রোতে ফুল ভলিয়্যুমে গান ছেড়ে কলিগরা সবাই মিলে চেঁচিয়ে নাচতে থাকা!


একটু আগে এক আগুনজ্বলা সুন্দরীকে রিক্সায় যেতে দেখলাম। পুরাই মাথানষ্ট টাইপের কঠিন বিউটি! মাথাটা এখনও ঘুরাণ্টি দিতাসে! একটা মেয়ে এত সুন্দরী হবে ক্যান? জাস্ট অ্যাবসার্ড! জ্যামে ছিলাম, মেয়েটা তাকিয়ে ছিল। (আসলেই ছিল। এক্কেরে সত্যি! সানি লিওন আফার কসম!) নাজিমগড় রিসোর্টস আর শুকতারা ন্যাচার রিট্রিট দেখে ফিরছি। চোখে এমনিতেই নেশা লেগে আছে, তার উপরে ক্যাটরিনাকে ল্যাংমারা ছিলোটি পুরি! আমার আর স্বর্গের অপ্সরা দেখার দরকার নেই, সিলেটি কইন্যা আমার মাথা আওলাইয়া দিল। এখন নরকে যেতে আর বাধা নেই।
Content Protection by DMCA.com