মানুষের বয়স বাড়ে বয়সে না, অভিজ্ঞতায়। মানুষের অভিজ্ঞতা কিছুই না করে আপনাআপনিই তৈরি হয় না, প্রতিটি ভুল সিদ্ধান্তই মানুষের অভিজ্ঞতা তৈরি করে। মানুষের কোনও সিদ্ধান্তই কখনও ভুল হয় না, যতক্ষণ না সেই সিদ্ধান্ত কোনও দুর্ঘটনা ডেকে আনে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সব সিদ্ধান্তই সঠিক সিদ্ধান্ত। এমনকি একটি ভুল সিদ্ধান্তও, যা এই মুহূর্তে ভুল মনে হচ্ছে, তা যদি আগামীতে কোনও সুফল বয়ে আনে, তবে সেটিই সঠিক সিদ্ধান্ত। ভুল-ঠিক বলে আসলে কিছু হয় না। আমাদের প্রতিটি কাজের ফলই আমাদেরকে জানায় যে আমাদের কোন সিদ্ধান্তটি ঠিক, আর কোনটি ভুল ছিল। এমনকি একই কাজ দুজন মানুষ হুবহু একইরকমভাবে করে গেলেও তার ফলটা যে একইরকম হবে, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। একজন উচ্চতায় খাটো মানুষ যে টুলটিতে দাঁড়িয়ে সিলিংয়ের উপর থেকে অনায়াসে আচারের বয়ামটি পেড়ে আনতে পারে, সেই একই টুলের উপরে দাঁড়িয়ে একজন লম্বা মানুষ মাথায় আঘাত পেতে পারে, এমনকি অসতর্কতায় সিলিং-ফ্যানের সাথে কোনও দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। আমার কাকিমা অনেক লম্বা মানুষ, বিছানার উপরে উঠে মশারি টানতে তাঁর সমস্যা হয়, তো কাকু কাকিমার চাইতে একটু বেঁটে হওয়ায় তাঁর উপরেই প্রতিদিন মশারি টাঙাবার দায়িত্ব হোক, চাপ হোক এসে পড়েছিল। কাকিমা হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি মশারি টাঙাতে গেলেই একটা কিছু দুর্ঘটনা বাধিয়ে বসবেন, হয়তো সেই ধারণা থেকেই জোরপূর্বক কাকুর ঘাড়ে এমন ‘অমানবিক দায়িত্ব’টি চাপানো হয়েছিল। একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি মশারি তুলতে গিয়ে মনের ভুলে সিলিং-ফ্যানের দিকে হাত গিয়ে মুহূর্তেই কাকুর দুটো আঙুল একেবারে আলাদা হয়ে গেল! তারপর থেকে কাকিমাই রোজ মশারি টাঙান, অবশ্য তা-ও জানি না টাঙান কি না, হয়তো অন্য কোনও ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু কাকু যে আর মশারি টানতে জাননি এরপর থেকে, শুধু এটুকু জানি। মানুষের অভিজ্ঞতালাভের একটি পথই খোলা, তা হচ্ছে, যতটা সম্ভব নতুন নতুন কাজের সাথে যুক্ত হওয়া, নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে শেখা। একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে ভুলের পরিমাণও বেড়ে যায়, হয়তো কখনও কখনও অনেক কষ্টও সহ্য করতে হয়, অনেকের কাছে বোকা বনে যেতে হয়, কিন্তু এটাও নিশ্চিত যে পরবর্তীতে অন্য কোথাও সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি কমতে থাকে, কমতে কমতে একটা সময় সেই ভুলের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় চলে আসে। আবার আমরা নতুন সিদ্ধান্ত নিই, পুরনো ভুল থেকে শেখা অভিজ্ঞতা হয়তো নতুন সব সিদ্ধান্তেই কাজে লাগে না, কিন্তু ভুল করতে পারার ও ভুলকে মেনে নিতে পারার মানসিক শক্তিটা বহুগুণ বেড়ে যায়। মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় কোনও কিছু শেখার কিংবা ভুল করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং সে ভাবে, এইটিই কোনও কার্যকরী ফল দেবে, সেই ভাবনা থেকে। আপাতদৃষ্টিতে অনেক সঠিক সিদ্ধান্তও যেমনি ভবিষ্যতে দুর্ভোগ ডেকে আনে, তেমনি এমন অনেক সিদ্ধান্ত আছে, যেটির ব্যাপারে আমরা তেমন গুরুত্ব না দিয়ে দায়সারাভাবে কাজটা করে গেলেও পরবর্তীতে সেখান থেকেই ভালো কিছু বের হয়ে আসে। কোন ঘটনাটা আমাদের জীবনে পরিবর্তন আনে, সেটি একটি ম্যাজিকের মত। আবার একই কাজ পরিস্থিতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন ফলও দিতে পারে। যে ব্যক্তি যত কষ্ট পায়, সে ব্যক্তি তত শেখে, এটা ভুল। যে ব্যক্তি নিজের সিদ্ধান্তের উপর যত বেশি অন্ধবিশ্বাসী হয়, সে ব্যক্তি তত কষ্ট পায়। যে ব্যক্তি তার সব সিদ্ধান্তেই সাফল্য-ব্যর্থতার পরিমাণ সমান সমান দেখে, তার সুখ-দুঃখের পরিমাণও সমান সমান হয়। আমার বাল্যকালের দুই সহপাঠিনী এইচএসসির প্রথম বর্ষেই বাবা-মায়ের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কিন্তু দুজনের একই কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি ফল এনেছে। একজন বিয়ের পর আগের চাইতে সুন্দর হয়েছে, যে বখাটে ছেলেটির হাত ধরে একটা সময় সে পালিয়ে গিয়েছিল, সেই বখাটে ছেলেই আজ তার দুই সন্তানের বাবা, একজন সফল ব্যবসায়ী। আমার সহপাঠিনীও ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স করল, অনেক ভালো রেজাল্ট করেও স্বামীর সাথে শ্বশুরের ব্যবসায় বসে পড়েছে, চাকরিতে ঢোকার তেমন কোনও চিন্তা তার নেই। এদিকে ছেলেমেয়েরা দুজনেই স্কুলে পড়ে। বড়ো ছেলে পড়ে ক্লাস সিক্সে, ছোটো মেয়েটা ক্লাস টু’তে পড়ছে। ওদের এখন অন্য চিন্তা, হয়তো আরও বড়ো কিছু করার কথা ভাবছে, শ্বশুরও নিজের ছেলেবউকে ঘরে বসিয়ে না রেখে ছেলের সাথে ব্যবসায় টেনে নিয়েছেন। অথচ সে যখন এই ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করে, তখন তার বাড়িতে সেই বখাটে ছেলেটিকে তার বাবা-মায়ের সামনে এনে দাঁড় করাবার মতো তেমন কিছুই ছিল না। ছেলেটিকে দেখতে মনে হতো, নেশাটেশা করে, কিন্তু পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে কোনওমতে ঘষে মেজে, আর এখন সেই ছেলেকেই তার শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়িসহ বাড়ির সকলেই পারলে খাবারটা পর্যন্ত মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। ওদিকে আরেক সহপাঠিনীর করুণ দশা। দশ বছর আগে যে বিশাল বড়োলোকের ছেলের সাথে সে এককাপড়ে হাতধরে বেরিয়ে গিয়েছিল, আজ দশ বছর পর সেই একই কাপড়ে, আর বাড়তি আরও দুটো মুখ সাথে নিয়ে সে তার বাবার কাছে ফিরেছে। শ্বশুরের কোটি টাকা থাকলেও স্বামী বেকার গাঁজাখোর, প্রতি রাতে বাড়ি ফিরে বউকে বেধড়ক পেটানোই তার মূল কাজ। অথচ সে যখন পালিয়ে গিয়েছিল, তখন তার স্বামী-ছেলেটির চেহারা এত নিষ্পাপ, এত সুদর্শন ও এতটাই উজ্জ্বল উজ্জীবিত ছিল যে, সে-ছেলেকে দেখে বোঝারই উপায় ছিল না, ভবিষ্যতে সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে নেশার জগতে পা বাড়াবে। এদিকে আমার সহপাঠিনীটি স্বামীর হাতে প্রতিদিন মার খেয়ে খেয়ে শারীরিক ও মানসিক, উভয় দিক দিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে, শ্বশুরালয়ের চাপে পড়াশোনাটাও আর চালিয়ে নেয়াও সম্ভব হয়নি! নিজের সাথে সাথে নিজের সন্তান দুটিকে নিয়েও এখন তার মনে পাহাড়সম দুশ্চিন্তা। যে শ্বশুরের কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে একটা সময় ওর খুব দেমাগ ছিল, সেই শ্বশুরও নাকি অন্য আরেকটা পিচ্চি কলেজপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে করে ওর শাশুড়ির কাছ থেকে আলাদা আছে, মাঝে মাঝে শুধু মাসের বাজার আর খরচাপাতি দিতেই নাকি বাসায় আসে এক-আধ বার। একইসময়ে একইভাবে দুজন মানুষ একই সিদ্ধান্ত নিয়েও সময়ের সাথে সাথে কীভাবে দুটি পথ সম্পূর্ণ বেঁকে দুটি উলটো দিকে চলে গেল, একই কাজ কী করে দুটো ভিন্ন ফলাফল বয়ে আনল, তা সে সময় হয়তো দুজনের কারুরই মাথায় ছিল না। একজন কেবল তার ভালোবাসাকে সঙ্গী করে নতুন পথে পা বাড়াবার সাহস পেয়েছিল, আরেকজন হয়তো তখন ভেবেছিল, সে সব পেয়েছে একইসাথে; ভেবেছিল হয়তো, স্বামীর সৌন্দর্যের সাথে সাথে হয়তো শ্বশুরের অর্থও তার ভবিষ্যতকে নিরুদ্বিগ্ন করল, নিশ্চিত করল। পরের অংশ…আমরাও ভেবেছিলাম সে সময়ে যে, স্মিতা কী সুন্দর একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে দেখ, আর বলাবলি করতাম, ওর শ্বশুরের নাকি অনেকগুলো বাড়ি, একটা মার্কেটে কতগুলো দোকান, কতশত ব্যবসা এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অথচ দেখ, বনানী কী নেশাখোরের মতো দেখতে একটা ছেলেকে বিয়ে করল, দেখলেই কেমন গা গুলিয়ে আসে, ওই ছেলের মধ্যে যে ও কী এমন পেল, তা ও-ই ভালো জানে! না আছে চেহারা, না আছে টাকা। তার উপর পড়াশোনাও তেমন কিছু করে না বলার মতো। শুনেছি, শ্বশুরটা নাকি খেতখামার না কি যেন মাছের ব্যবসা করে! তখন বনানীর দিকে তাকাতাম আর এরপর তাকাতাম স্মিতার দিকে। একইসাথে দুজনকে নিয়েই আলোচনা হতো। তখন ভাবতাম, স্মিতাটা জিতে গেল, আর বনানীটা একটা আস্ত বলদ যাকে বলে! কিন্তু আমরা যে কতটা ভুল ভাবতাম, সেটা সময়ই আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে। স্মিতা এমন একটা ছেলের হাত ধরেছিল, যাকে পাবার সাথে সাথে সে আর্থিক নিশ্চয়তাও পেয়েছিল তখন, কিন্তু বনানী শুধুই তার ভালোবাসাকেই আঁকড়ে পড়ে ছিল, ওর ভালোবাসাই ছিল ওর আস্থা, ওর সম্পদ। আজ এত বছর পর যখন ওদের দুজনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো পথে দেখি, তখন অবাক হই আর ভাবি, মানুষ বর্তমানটাতে কতটাই না ভুল ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকে। এখানে একটা কথা বলে দেওয়া ভালো। উপরের ঘটনাটি আমাদের ভাবনা এবং অনুমানের মতো করেও ঘটতে পারত কিন্তু! আসলে কাউকে, কারও অবস্থাকে, কারও ভবিষ্যতকে জাজ করার আমরা কেউই না। সময়ই সব বলে দেয় সময় হলে। সবচাইতে ভালো হচ্ছে, ঘটনাকে চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করা। সেটি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যে জীবনে আমরা বাঁচিইনি, কিংবা এখনও বাঁচছি না, সে জীবন নিয়ে মতামত না দেওয়াই ভালো। কার কোথায় ব্যথা, কার কোথায় সুখ, সে খোঁজ জানে কেবল সে নিজে, কখনওবা জানে সময়।