শেখো, তবে যার-তার কাছ থেকে নয়। যার-তার কাছ থেকে শিখলে যে-সে লোক হয়ে যাবে। গায়ে পড়ে শেখাতে আসে যে, তার ব্যাপারে সাবধান থেকো। ভালো গুরু খুঁজে পাওয়াই কঠিন, গায়ে-পড়া লোক বড়োজোর ভালো গোরু হতে পারে।
শেরপুরে এক হিন্দু কাকার সাথে পরিচয় হয়েছিল, যিনি দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে একটা চার্চে চাকরি করছেন, অনেক ফাদারের সাথেই তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। অথচ কখনোই কেউ তাঁকে বা তাঁর পরিবারের কাউকে বলেননি: তুমি খ্রিস্টান হয়ে যাও। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওই কাকার সাথে কথা বলে।
রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ। স্বামীজিগণ আমাকে বিশেষ প্রশ্রয় দেন, স্নেহ করেন। উপনিষদ, গীতা, বেদান্ত-সহ বিভিন্ন রত্নের আকর আমি ওখান থেকেই বেশি সংগ্রহ করেছি। অথচ এখন পর্যন্ত ওঁদের কেউই কখনও আমাকে রামকৃষ্ণের দীক্ষা গ্রহণ করতে বলেননি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন কিছু গুরু আছেন, যাঁদের দীক্ষিত শিষ্যগণ সবাইকে রীতিমতো বিরক্ত করে ছাড়েন তাঁদের গুরুদেবের দীক্ষা গ্রহণ করার জন্য। একদম প্রথম পরিচয়েই অপরিচিত কাউকে ওরকম বিরক্ত করতে পারেন যিনি, বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারে তাঁর অবস্থা কোনোভাবেই ভালো নয়।
গুরুকে দেখে নয়, সতীর্থদের দেখে কোনো সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসা ভালো। কুকুরের পক্ষে গর্জন করা অসম্ভব, গর্জন করা শিখতে চাইলে তাই সিংহের সাথেই মিশতে হবে। কুকুর রাস্তাঘাটেই পাবেন, সিংহের দেখা পাওয়া সহজ নয়। খারাপ স্কুল কাকে বলে? যে-স্কুলে খারাপ স্টুডেন্টরা পড়ে। শিক্ষক কেমন, সেটা বড়ো কথা নয়। খারাপ স্কুলের ভালো শিক্ষকেরা মূলত মরাছেলে নিয়ে কাঁদেন।
একটি সম্প্রদায় কেমন, তা বিচার করবেন—গুরুর জ্ঞান দেখে নয়, শিষ্যদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে। যে-সম্প্রদায়ে মিস্টার বিনের ছড়াছড়ি, সেখানে গিয়ে আপনার সময়নষ্ট বাদে আর কী লাভ হবে? গুরুর মন্ত্র দীক্ষিত শিষ্য হয়েই নেওয়া লাগে না, ভাবশিষ্য হয়েও জপ করা যায়। কিছু জনপ্রিয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টিতে খুবই উঁচু পর্যায়ের গুরুদের অবদান আছ, কিন্তু ডেসটিনি কোম্পানির মতো করে রাস্তাঘাট থেকে ধরে ধরে লোকজনকে শিষ্য বানানোর ফলে ওই সকল সম্প্রদায়ের শিষ্যদের কোয়ালিটির অবস্থা কেরোসিন!
আমার এক বন্ধু ছিল ডেসটিনি কোম্পানির পিএসডি (প্রফিট শেয়ার ডিস্ট্রিবিউটর)। ও পড়াশোনায় খারাপ ছিল না, এইচএসসি’তে মাত্র দুই বার ফেইল করে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। ও একবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের একজন ফুলব্রাইট-স্কলার অধ্যাপককে ডেসটিনির একটা প্রোডাক্ট ট্রি-প্ল্যানটেশনের হিসাব শেখাতে গিয়েছিল। সেই অধ্যাপক স্মিত হেসে আগন্তুককে চা খেতে বলে ভেতরে চলে গিয়েছিলেন। ভদ্রলোক হবার অনেক জ্বালা!
শ্রীঅরবিন্দের লেখা ‘দ্য লাইফ ডিভাইন’ কিংবা ‘সাবিত্রী: অ্যা লিজেন্ড অ্যান্ড অ্যা সিম্বল’ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ পড়েই তো বোঝা মুশকিল; তাঁর অনুসারীরা আপনাকে ভুল করেও কি কখনো বলবেন অমন গ্রন্থে দাঁত বসাতে? মস্তিষ্কের ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে ভালো না হলে ঋষি অরবিন্দ বা দ্য মাদারের কোনো সৃষ্টিই বোঝা সম্ভব নয়। স্বামী নিগমানন্দের প্রধান শিষ্য শ্রীঅনির্বাণের লেখাগুলি বুঝে বুঝে পড়তেও কারও কারও সারাজীবন খরচ হয়ে যাবে। শ্রীঅরবিন্দের ‘দ্য লাইফ ডিভাইন’-এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন শ্রীঅনির্বাণ ‘দিব্যজীবন’ নামে। বহুকষ্টে ওটা কোনোমতে বুঝলেও ‘সাবিত্রী’ আমি আজও পুরোপুরি বুঝি না। বেদ ও উপনিষদের যে-অনুবাদ শ্রীঅনির্বাণ কয়েক খণ্ডে করেছেন, তা বিদ্বৎসমাজের জন্য অমূল্য সম্পদ। ওঁদের অনুসারীদের সাথে মিশলে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন, নিজের বোধকে শাণিত করতে পারবেন। রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ, নিগমানন্দ প্রমুখ গুরুদের পায়ের কাছে পড়ে থাকতে পারেন যুগের পর যুগ, কেউ আপনাকে দলে টানতে বা অন্য কোনো কিছু নিয়েই বিরক্ত করবেন না।
অবশ্য ওসব জায়গায় যে-কেউই যান না, গিয়ে ঠিক সুবিধে করতে পারেন না।
শিষ্যদের লাইনের দৈর্ঘ্য দেখে তাঁদের মান সম্পর্কে বোঝা যায়। ‘যত মত, তত পথ’-এর চাইতে সুন্দর কথা পৃথিবীতে তেমন-একটা বলা হয়নি। কিন্তু যে-লোকটা ঝগড়া করতেই পছন্দ করে এবং করার মতো কাজ যার নেই বললেই চলে, তার কি মনে ধরবে অমন উদার দর্শন? তার মনে তো আছে: একটাই মত, একটাই পথ—যদিও গণধোলাই খাওয়ার ভয়ে মনের কথা মনেই রেখে দেয়।