সত্য যে কঠিন

১। ভাবুন, খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে স্নান সেরে শুচিশুভ্র হয়ে সাগরতীরে দাঁড়িয়ে উপরের আকাশে নিজেকে মেলে ধরে ঊষার কোলে হারিয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তের যে-আনন্দ, তার তুলনা কোথায়?

২। ঈশ্বরকে সারাক্ষণই ছুঁয়ে থাকলে এ জীবনে অদৃষ্টের চাকাও দিক বদলে ফেলে; অথচ মানুষের এমনই প্রকৃতি যে, এই সহজ কথাটি বুঝতে না-জানি তার কত জন্মজন্মান্তর পার হয়ে যায়!

৩। প্রতিপ্রভাতে এ মাটিতে হয় নব সূর্যোদয়, আর তখন সাগরতীরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, একটা অজ্ঞাত-অজানা অমর আলোর দূতী হয়ে কে যেন নেমে আসছে আমাদের এই প্রত্যহের ধুলিধূসর সুখ-দুঃখের জীবনের সীমান্তে...

৪। পরমেশ্বরের কাছে নিজেকে দিয়ে দেওয়া—জীবনের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করে সেই একজনের হয়ে যাওয়া—দিনে দিনে তিলে তিলে এই মহাসত্যই যেন এ জীবনের প্রতি মুহূর্তের কর্মে-চিন্তায়-আবেগে-অনুভবে রং ধরে বিকশিত হয়ে ওঠে...চারপাশের আলোক হয়ে ওঠে বাতাসের মতন। আমাদের এ জীবন কেন হবে না স্বর্গ আর মর্ত্যের মাঝে আশ্চর্য এক সেতু?

৫। সে আসে—আবার কখন যেন চকিত চমকে চলে যায়! এই দেহে-মনে-প্রাণে তাকে ধারণ করা বড়ো কঠিন—দুশ্চর তপস্যার ধন সে। দেবতার আলোর ওই পরশ এ নশ্বর আধারে থাকে শুধু ক্ষণিকের জন্য।

৬। এ সৃষ্টির সবচেয়ে আশ্চর্য বস্তু—মানুষ...প্রতি সূর্যোদয়ের সাথে সাথে যে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে কৃতসংকল্প। সহস্র জটিল আবর্তের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেয়েও নিজের দুর্ভাগ্যের দ্বারে বসে সে হা-হুতাশ করে না। কাঁধে বিপুল বোঝা নিয়ে সে পথ চলেছে—তবু চেতনাকে তুলে ধরে কোনো সুদূর এক নক্ষত্রের ইশারায়।

৭। এই পৃথিবীতে বড়ো যারা হয়, জগতের ছোটো ছোটো সুখদুঃখের দোলায় দোলে না তাদের হৃদয়। কোনো তুচ্ছ বস্তুর মোহ তাদের পারে না বাঁধতে। প্রতিদিনের ব্যথাবেদনার হাহাকার হৃদয় ছাপিয়ে দু-চোখের মণিতে জ্বলে শুধু এক ভাবীকালের স্বপ্নদ্যুতি।

৮। হাজার পথ ঘুরে, অজস্র মোড়ে, অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম—জীবনের মূলমন্ত্রের নাম: শান্তম্!

যা-ই ঘটুক, যা-ই করি না কেন, উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে নিদ্রায়-জাগরণে যেন না ভুলি—এ সংসারের সমস্ত রহস্যের কিনারায় পৌঁছে যেতে পারি শুধু শান্ত হয়ে শান্তিতে থাকতে পারলে!

শান্তম্‌ই আনন্দময়ের সিংহদ্বারের চাবিকাঠি...

৯। মানুষের প্রকৃতি রাতরাতি পালটে যায় না!

কত-না হাতুড়ির ঘা খেয়ে খেয়ে মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন আসে—সময় লাগুক, সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাক! ক্ষতি কী? মৃত্যুর কাঁটাতার ডিঙিয়ে ভাবীকালের মায়ের সোনার মন্দিরের দুয়ারে পৌঁছানোটা কে ঠেকাবে?

১০। লোক, না পোক!

মানুষ সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরে সেজে আছে, কিন্তু তার ভেতরে সেই আদিম পশুর সিংহাসনটি যেন আজও অটুট...অনড়...অম্লান!

তবুও এই মানুষই একদিন হবে দেবতার চেয়েও বড়ো। এ মাটি হবে স্বর্গভূমি। এই মহা-আশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি আমরা!

মহত্তর জীবনে ঝাঁপ দেওয়া কি সহজ কথা! এ সংসারে মাত্র কয়েকজনের হৃদয় নিজ অহংকারকে ছাপিয়ে দিব্যজীবনের জন্য আগুনের পরশমণি পায়!

১১। সত্য বড়ো কঠিন। তাই চিত্তকেও—কাজটা খুব কঠিন হলেও—সত্যকেই বরণ করতে শিখতে হয়। এ মাটিতে অবস্থান করে এক তিনি ছাড়া আর কিছুই চাইবার মতো ধন নেই! এ তনু-মন-প্রাণ ঢেলে তাঁকে চাইলে একদিন সকলকেই পাওয়া যাবে আপন আত্মার আত্মীয়রূপে...তিনি যে সবার মাঝেই আছেন!


১২। সারাভুবনের ভালোবাসা জমা হয়ে আছে মায়ের বুকখানিতে…তাই তো তিনি বিশ্বজননী!

অথচ তিনি নিঃসঙ্গ—একা...জগৎজোড়া হৃদয় তাঁর, তাঁর মতন একা এ পৃথিবীতে কে আর!