সংগীতের শক্তি




প্রাণীর হৃদয় ও আত্মার উপর সংগীতের আকর্ষণের মতো প্রভাব আর কিছুই নেই। আদিসময় থেকে, যখন পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো গড়ে উঠছিল, আজকের নৈতিকতার দাবিদার আধুনিক যুগ পর্যন্ত—সংগীত মানুষের জীবনকে কোমল করেছে, তার প্রকাশকে মহৎ উদ্দেশ্যে চালিত করেছে, আর তার আবেগকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

প্রথম যুগে পৃথিবীর সন্তানেরা শিখেছিল প্রকৃতির শাশ্বত সংগীত অনুকরণ করতে—পাখির গান, বাতাসের ক্রন্দন, শিলাবদ্ধ তীরে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ, রাতের পশুপাখির ডাক—এসব মিলেমিশে সৃষ্টি করেছিল এক রহস্যময় ছন্দ, যাকে সত্যিকার অর্থেই বলা যায় প্রকৃতির অসীম সিম্ফনি। সৃষ্টির শক্তিগুলো চিরকাল সংগীতময়। তাদের সেই রহস্যময় সুর নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ভেসে বেড়ায়, নিয়ে আসে ঐশ্বরিক গাথা। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, গঠিত ও অগঠিত সমস্ত প্রকৃতি মুগ্ধ বিস্ময়ে শোনে সেই মহান অজানার অন্তহীন সিম্ফনি।

আরেক ধরনের সংগীত আছে—জীবনের সংগীত। মানবহৃদয়ের ধ্বনি, হাসির উল্লাস, দুঃখের কান্না—সব মিলেমিশে গড়ে ওঠে এক রহস্যময় অর্কেস্ট্রা, যেটি অনেকসময় অশ্রুত থেকেও অদৃশ্য সুরে অনন্তকাল জুড়ে ধ্বনিত হয়, পৌঁছে যায় ঐশ্বরিক পদপ্রান্তে। মানুষের স্বভাব প্রকাশিত হয় জীবন্ত সংগীতে।

দক্ষ গিটারিস্ট যখন অবচেতন ভঙ্গিতে গিটারের কর্ডে আঙুল চালান, তখন আসলে তার আত্মার অভিব্যক্তিই ঢেলে দেন—সেই যন্ত্র থেকে বেজে ওঠে দিব্যসুর, যা সংগীতশিল্পীর গভীরতম চিন্তা ও আত্মার অন্তর্গত সিম্ফনিকে জীবন্ত করে তোলে।

একটি বেহালার গভীর আর্তস্বর যেন বলে ওঠে শিল্পীর মনের কথা। যে-হৃদয় ভেঙে গেছে শোকে, সেখান থেকে উঠে আসে এমন মধুর সুর, যা অন্য হৃদয়ের তারে অনায়াসে স্পর্শ করে। আর যে-মন মহৎ, তার সুর হয় গভীর ও ভারী থিমে পরিপূর্ণ।

জীবন আসলে এক সংগীতই—এমন এক ভাষা, যা সর্বজনীনভাবে বোধগম্য। এর বেসুরো সুর মানুষের ঘৃণার প্রতিচ্ছবি, আর এর সুরেলা সংগতি হলো পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রতীক।

মানবাত্মা নিজের সত্তার সপ্ততারের বীণায় বাজায় স্বর্গীয় সুর। প্রতিটি চিন্তা ও কাজ আসলে জীবন্ত সংগীতের এক-একটি নোট। কিন্তু যখন জীবন ভ্রান্ত হয়, মনুষ্যপ্রকৃতি ভারসাম্য হারায়, তখন যন্ত্র বেসুরো হয়ে যায়—কারণ তখন সেই যন্ত্রের চাবিতে আর মাস্টারের হাত থাকে না।

যেমন একটি বেহালা মৃতপ্রায় পড়ে থাকে যতক্ষণ না শিল্পীর কোমল আঙুল থেকে তার অন্তর্নিহিত আত্মা জেগে ওঠে, ঠিক তেমনি মানুষের দেহও একেকটি যন্ত্র মাত্র, আর প্রতিটি জীবের অন্তরের আত্মা তার দেহকে ব্যবহার করে এক মহত্তর যন্ত্রে পরিণত করতে, যাতে তার সুর ধ্বনিত হয়ে মিশে যায় মহাবিশ্বের সংগীতে।

যখন মানুষের জীবন কপটতায় ভরে যায়, হৃদয় নিঃস্পৃহ হয়ে যায়, তখন তার ভেতরের কিবোর্ড থেকে যা বের হয়, তা কেবলই অসংগতি আর বেসুরো শব্দ। তখন যন্ত্রের তার ছিঁড়ে যায়, চাবি ভেঙে যায়, আর যে-হাত সুর তুলতে চায়, তা পৃথিবীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

যারা দীর্ঘকাল সাধনা করেছে, দুঃখ সয়েছে, কষ্টের আগুনে পুড়েছে—তাদের আত্মা হয়ে ওঠে এক পুরোনো বেহালার মতো—দুঃখ ও অভিজ্ঞতার বছরগুলো তাদের সুরকে যেন কোমল ও গভীর করেছে। তারা হয়ে ওঠে এক মহান শিল্পীর হাতে-গড়া মাস্টারপিস। প্রতিটি বছরের সঙ্গে তাদের সুর আরও মধুর হয়, আর শিল্পীর হাত থেকে বেরোয় আরও নিখুঁত সংগতি। শেষপর্যন্ত মহান সংগীতজ্ঞের হাতে তারা ঢেলে দেয় মহিমাময় সিম্ফনি—যেখানে প্রতিটি সুর আত্মার প্রতিভার প্রতিফলন।

সংগীত এক বিস্ময়কর শক্তি। এটি কঠোর হৃদয়কেও গলিয়ে দেয়, কঠিন মুখের রেখাগুলো কোমল করে দেয়, বহুদিন ধরে যারা কষ্ট ভোগ করেছে…তাদের মনে এনে দেয় শান্তি। যেমন একটি শিশু ঘুমপাড়ানি গানের মৃদুসুরে ঘুমিয়ে পড়ে, তেমনি মানুষের আত্মাও বিশ্রাম খুঁজে পায়—নিজের ভেতরের সংগীতে, আর প্রকৃতির চিরন্তন সুরে।