ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বা আদর্শিক বয়ানকে শক্তিশালী করার প্রবণতা আজ এক গভীর বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ যেন এক ভয়াবহ স্যাটায়ার—আগে বিপর্যয় কামনা করতে হয়, তারপর তার ধ্বংসাবশেষকে কাজে লাগিয়ে বাহ্যিকভাবে নৈতিকতার দাবিদার হবার কাজটি কৌশলে সারতে হয়। আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, বহু জাতিই মানুষের মৃত্যুকে এক ভয়ংকর ট্র্যাম্প-কার্ডের মতো ব্যবহার করছে—নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব বাড়ানোর জন্য—মানুষের জীবনের ন্যূনতম মূল্যকে অবহেলা করে। সামাজিক মাধ্যম ভরে উঠছে যত আক্রমণাত্মক মন্তব্যে—প্রেয়িং ম্যান্টিস আর ব্ল্যাক উইডো মাকড়সার মতো, যারা শোক আর যন্ত্রণা থেকে খাদ্য আর পুষ্টি গ্রহণ করছে। এই দুই প্রাণীর প্রতীকী ব্যাপারটি একটু ভেঙে বলি।
প্রেয়িং ম্যান্টিস—Praying Mantis—এই পতঙ্গের সামনের দুই-পা এমনভাবে বাঁকানো থাকে, যেন সে হাতজোড় করে প্রার্থনা করছে। এ এক অপেক্ষমাণ শিকারি। ম্যান্টিস শান্তভাবে বসে থাকে, হাতজোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে, কিন্তু হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার ধরে। তাই এটি প্রতীকীভাবে বোঝায় ভুয়া শান্তিপ্রিয়তা বা মিথ্যা ভদ্রতা—বাইরে থেকে শান্ত ও ভক্তিপূর্ণ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মারাত্মক শিকারি। আত্মকেন্দ্রিকতা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক এই ম্যান্টিস। স্ত্রী ম্যান্টিস মিলনের পর পুরুষকে খেয়ে ফেলে। তাই এটি ব্যবহৃত হয় সম্পর্কের সুযোগসন্ধানী বা ধ্বংসাত্মক দিক বোঝাতে। রাজনীতিতে এই রূপকটি খুব জনপ্রিয়। যেসব ব্যক্তি বা দল বাইরে থেকে নীতিবান বা ন্যায়পরায়ণতার ভান করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানুষের ক্ষতিসাধন করে লাভবান হয়—তাদের ম্যান্টিসের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ব্ল্যাক উইডো (Black Widow Spider) নিয়ে জানা যাক। এটি প্রলোভন ও ধ্বংসের প্রতীক। স্ত্রী ব্ল্যাক উইডো সুন্দর ও রহস্যময়, কিন্তু মিলনের পরে পুরুষটিকে খেয়ে ফেলে। তাই এ প্রাণীটি প্রলোভন, ভয়ংকর আকর্ষণ, আর মৃত্যুর ফাঁদের প্রতীক। এই মাকড়সা বাঁচতে নিজের সঙ্গীকেই গ্রাস করে। ফলে এটি প্রতীকীভাবে বোঝায় ক্ষমতালোভ ও আত্মরক্ষাকে—অন্যের জীবন বা বিপর্যয় ব্যবহার করে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখা। যেসব পরাশক্তি বা রাজনৈতিক নেতা শোক, দুর্যোগ বা মৃত্যুকে ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা বা প্রভাব ধরে রাখে, তাদেরকে “ব্ল্যাক উইডো” বলা হয়।
প্রেয়িং ম্যান্টিস ও ব্ল্যাক উইডো-কে একসাথে ব্যবহার করার মানে হলো—বাইরে থেকে ধার্মিকতা, নীতি বা সহমর্মিতার ভান করা, অথচ ভেতরে ভেতরে অন্যের দুর্যোগ ও যন্ত্রণাকে শোষণ করে লাভবান হওয়া।
Sexual cannibalism প্রক্রিয়ায় এরা যেমন নিজের সঙ্গীকে ভক্ষণ করে বেঁচে থাকে, তেমনি রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানীরা অন্যের কষ্টকে কৌশলে ব্যবহার করে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করে। এটা করতে গিয়ে তারা কেবল নিষ্ঠুরতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং প্রবেশ করে নৈতিক অন্ধত্বের গভীরে। এভাবেই ঘৃণা আর বিভাজন ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ ভুলতে থাকে যে, মৃত্যু নিছকই এক পরিসংখ্যান নয়, বরং অপূরণীয় এক মানবিক ক্ষতি।
আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, কেবল একটি দেশ বা অঞ্চল নয়—পুরো পৃথিবীই ভুগছে এই রোগে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক প্রচার, শরণার্থী শিবিরে মানবিক সংকটকে ক্ষমতার প্রদর্শনীতে রূপান্তর, কিংবা দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধ্বংসাবশেষকে সহানুভূতি কেনাবেচার হাতিয়ার বানানো—সবই এই প্রবণতার ভয়ংকর দিকচিহ্ন। কূটনৈতিক পরিভাষা আর শান্তির বুলি ঝলমলে শোনালেও বাস্তবতার কাছে প্রায়ই এগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। যন্ত্রণা থেকে শিক্ষা নেবার বদলে যন্ত্রণা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার হাতিয়ার।
Schadenfreude (শাডেনফ্রয়ডে) একটি জার্মান শব্দ। Schaden মানে ক্ষতি বা অনিষ্ট। Freude মানে আনন্দ বা সুখ। তাই Schadenfreude-র মানে দাঁড়ায়: অন্যের ক্ষতি, দুঃখ বা বিপদ দেখে নিজের মনে আনন্দ পাওয়া। উদাহরণ: কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে আশেপাশের কেউ হেসে ওঠা। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যর্থতা দেখে গোপনে আনন্দ পাওয়া। শত্রুর বিপর্যয়কে উপভোগ করা।
এটিকে একধরনের অসুস্থ আনন্দ হিসেবে ধরা হয়। রাজনীতি, যুদ্ধ বা সামাজিক সংঘাতে প্রায়ই দেখা যায়—অন্যের ট্র্যাজেডিকে কেউ কেউ নিজের স্বার্থ বা মানসিক তৃপ্তি হিসেবে ব্যবহার করে। গণতান্ত্রিক মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে এটি যায় না। চলুন দেখি, কেন মানুষ অন্যের দুঃখে আনন্দ পায়; Schadenfreude-এর মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবা যাক।
১. তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব (Comparative Superiority): মানুষ প্রায়ই নিজের অবস্থান অন্যের সঙ্গে তুলনা করে। যদি অন্য কেউ হোঁচট খায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ব্যর্থ হয়, তবে নিজের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো মনে হয়। এই তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিই অচেতনভাবে আনন্দ জাগায়। উদাহরণ: প্রতিযোগী পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে আমরা মনে করি—“ভালো হয়েছে, অন্তত আমি তার চেয়ে এগিয়ে।”
২. ঈর্ষা ও হিংসা প্রশমিত করা (Relief from Envy): অন্যের সফলতা অনেক সময় আমাদের মধ্যে হিংসা জাগায়। যখন সেই সফল মানুষ ব্যর্থ হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন আমাদের হিংসা সাময়িকভাবে প্রশমিত হয়। ফলস্বরূপ, ভিতরে ভিতরে আনন্দ অনুভূত হয়। উদাহরণ: যাকে দেখে সবসময় মনে হতো, সে “পারফেক্ট”, হঠাৎ তার কেলেঙ্কারি প্রকাশ হলে অদৃশ্য আনন্দ পাওয়া।
৩. ন্যায়বোধের ভ্রান্তি (Justice or Deservedness): কেউ যদি অহংকারী, প্রতারক বা অন্যায়কারী মনে হয়, তবে তার ক্ষতি দেখে মনে হয়, সে “যোগ্য শাস্তি” পেয়েছে। এটাকে বলা হয় “Deserved Schadenfreude।” এতে মানুষ নৈতিক স্বস্তি পায়। উদাহরণ: এক দুর্নীতিবাজ নেতাকে জেলে যেতে দেখে সাধারণ মানুষের খুশি হওয়া।
৪. সামাজিক বন্ধন ও গ্রুপ সাইকোলজি: কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা নিজেদের দলীয় সংহতি আরও মজবুত মনে করি। এটা “ingroup-outgroup dynamics” থেকে আসে। এতে নিজের গ্রুপের প্রতি একধরনের একাত্মতা তৈরি হয়। উদাহরণ: খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের পরাজয় দেখে উল্লাস করা।
৫. গোপন ভয় ও দুর্বলতার প্রক্ষেপণ: আমাদের ভেতরে নিজের ব্যর্থতার ভয় থাকে। অন্যকে ব্যর্থ হতে দেখে মনে হয়—“আমি একা নই, অন্যেরও এমন হয়।” এটা আমাদের ভেতরের ভয়কে সাময়িকভাবে হালকা করে।
৬. বিনোদনমূলক Schadenfreude: কখনো কখনো আমরা শুধু হাস্যরসের কারণে অন্যের ছোটোখাটো দুর্ঘটনায় আনন্দ পাই। যেমন: কৌতুক ভিডিয়োতে কারও হোঁচট খাওয়া বা পড়ে যাওয়া দেখে হাসা। যদিও এতে গভীর বিদ্বেষ থাকে না, তবু এটি Schadenfreude-র সহজ রূপ।
Schadenfreude হলো মানুষের ভেতরের তুলনা, হিংসা, ন্যায়বোধ, দলীয় মনস্তত্ত্ব এবং ভয়ের প্রতিফলন। এটি স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া হলেও, অতিরিক্ত হলে সমাজে ঘৃণা, বিভাজন ও অমানবিকতা ছড়ায়।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিবেশে schadenfreude—অন্যের দুঃখে আনন্দ নেওয়া—আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। গাজা, ইয়েমেন, কঙ্গো বা ইউক্রেন—যেখানেই হোক না কেন, অন্যের বিপর্যয়কে রাজনৈতিক হাতিয়ার বা প্রচারণার উপাদান বানানো আমাদের নৈতিক ভাঙনের প্রমাণ। দমনমূলক শাসনব্যবস্থায় যেমন দেখা যায়, তেমনি আজ “গণতন্ত্র”-এর দাবিদার দেশগুলিতেও এই মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে।
আরেকটি ব্যাপার সমানভাবে উদ্বেগজনক; তা হলো বিরোধী মতকে দ্রুত নীরব করার প্রবণতা। যখন প্রতিবাদকে সহিংসতায় দমন করা হয়, বা মতপ্রকাশের কারণে হত্যা সংঘটিত হয়, তখন মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা যাদের দায়িত্ব, তারাও একই দমননীতির আশ্রয় নেয়। আবার, নিরাপত্তা বা নৈতিক বিশুদ্ধতার নামে দমনমূলক পদক্ষেপও ন্যায্যতা পায়। দুই দিকই একে অপরের ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে—প্রতিটি পক্ষই নিজেদের তৈরি ভয়ের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।
এক কঠিন সত্য আজ আমাদের সামনে: আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড়ো শত্রু কোনো বাইরের শক্তি নয়, বরং সম্মিলিত নৈতিক আত্মতুষ্টি। আমরা এমন এক বিশ্ব গড়েছি, যেখানে মানুষ আনন্দের সঙ্গে ট্র্যাজেডিকে কাজে লাগায় ব্যক্তিগত স্বার্থে, তারপর ভান-ধরা ভক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের ধার্মিক ঘোষণা করে। ফলে আলোচনার ক্ষেত্র ভরে যায় বিষে, সহানুভূতির শেকড় যায় শুকিয়ে।
যদি আমরা এই স্রোত থামাতে চাই, তবে প্রথমেই মানবিকতার ভিত্তিকে পুনর্দখল করতে হবে। স্বীকার করতে হবে—অন্যের জীবনের দামে কোনো রাজনৈতিক বিজয়ই গ্রহণযোগ্য নয়। বিপর্যয় থেকে ফায়দা না তুলে, সত্যিকারের জবাবদিহির দাবি জানিয়ে আমরা মুক্ত হতে পারব এই শোষণ আর বিভ্রমের চক্র থেকে। মনে রাখতে হবে, কোনো হারানো জীবনই কেবল ট্র্যাজেডি বা কমেডির প্রতীক নয়—এটি অপূরণীয় ক্ষতি। যতদিন তা স্বীকার করা হবে না, তা নিয়ে আন্তরিক সম্মিলিত প্রয়াসে কাজ করা হবে না, ততদিন আমরা আটকে থাকব আমাদের নিজেদের তৈরি ধ্বংসাত্মক কল্পনার ছায়ায়।