শৈব কালী: সাতাশ



অদ্বৈত বেদান্তে যেখানে জগৎকে “মায়া”—অর্থাৎ আপাত, নির্ভরশীল বা অনির্বচনীয় বাস্তব বলা হয়েছে, কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূল প্রতিজ্ঞা সেখানে বিপরীত: জগৎ কোনো বিভ্রম নয়, বরং চেতনার বাস্তব প্রকাশ (real manifestation of consciousness)। অভিনবগুপ্ত (তন্ত্রালোক, ১.৩৬) ও উত্পলদেব (ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা কারিকা, ১.৫.৮) উভয়েই বলেছেন—চেতনা নিজেই স্বাধীন (svātantrya-śakti), তাই সে নিজের ইচ্ছায় (icchā-śakti) প্রকাশিত হয়, জ্ঞান (jñāna-śakti) দ্বারা উপলব্ধি করে, ও ক্রিয়া (kriyā-śakti) দ্বারা জগত নির্মাণ করে। তাই জগৎ শিব থেকে পৃথক নয়; বরং তাঁরই আত্মপ্রকাশ।

যেমন ঢেউ সমুদ্র থেকে আলাদা নয়—ঢেউ সমুদ্রেরই গতি—তেমনি জগৎও শিবচেতনারই তরঙ্গ। উত্পলদেব তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা কারিকা-য় বলেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি”—চেতনা নিজের চেতনা-রূপেই বিকশিত হয়, এবং নিজের স্বাধীনতায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে (ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা কারিকা, ১.৫.৮)।

এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় অভিন্ন-অভেদবাদ (abhedābheda-vāda)—অর্থাৎ, শিব ও জগৎ সম্পূর্ণ অভিন্নও নয়, আবার সম্পূর্ণ ভিন্নও নয়। তারা একে অপরের প্রতিবিম্ব—একই চেতনার দুই দিক: অন্তর্মুখী দিকটি শিব (অবিকল্প, স্থিত), আর বহির্মুখী দিকটি শক্তি (বিমর্শ, স্পন্দন)। উভয়ে মিলে এক চিরন্তন ঐক্য, যাকে তন্ত্রে বলা হয়েছে অনুত্তর—অর্থাৎ “যার ওপরে আর কিছু নেই।” অভিনবগুপ্তের ভাষায়—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌”—অদ্বৈত চেতনা নিজের লীলায় দ্বৈততার আভাস ধারণ করে (তন্ত্রালোক, ১.৩৬)।

এইভাবে ৩৬ তত্ত্ব আসলে চেতনার ঘনীভবনের ক্রমান্বয় মানচিত্র: শিব ও শক্তির বিশুদ্ধ চৈতন্য থেকে শুরু করে মায়া-তত্ত্বে সীমা আরোপ, তারপর সময়, দিশা, জ্ঞান ও ক্রিয়া প্রভৃতি তত্ত্বের বিকাশ, এবং অবশেষে পঞ্চতন্মাত্রা ও পঞ্চমহাভূতের স্তরে পৌঁছে সেই চেতনারই স্থূল প্রতিফলন—পৃথিবী। এই নিম্নগামী ধারা চেতনার “নিগ্রহ” দিক, আর যোগ, ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে উর্ধ্বগতি (শক্তিপাত) হলো “অনুগ্রহ”—অর্থাৎ চেতনার নিজের প্রতি প্রত্যাবর্তন।

অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব—উভয়ের লক্ষ্য এক—চেতনার ঐক্য উপলব্ধি। কিন্তু বেদান্তে যেখানে মুক্তি মানে জগৎ-নিরাকরণ ও মায়ার অতিক্রম, কাশ্মীর শৈবে সেখানে বলা হয়—জগৎকেও অন্তর্ভুক্ত করে সেই চেতনার ঐক্য উপলব্ধি করা। কারণ “মায়া” এখানে বিভ্রম নয়, বরং শিবচেতনারই সৃজনশীল আচ্ছাদন। তাই বলা হয়—“সর্বং খল্বিদং শিবম্‌”—এই সমগ্রই শিব (স্পন্দকারিকা, ১.২)।

যখন অজ্ঞানতার পর্দা (মালা) সরে যায়, আত্মা উপলব্ধি করে—সে কখনোই সীমিত ছিল না; বরং সেই অসীম চেতনারই জাগ্রত তরঙ্গ। সেই মুহূর্তেই উচ্চারিত হয়—“শিভোহম্‌”—আমি-ই শিব। এই উপলব্ধি, এই প্রত্যভিজ্ঞা—নিজেকে পুনরায় চিনে ফেলা—এই মুক্তি। কারণ চেতনা কখনোই আবদ্ধ হয়নি, শুধু নিজেকে আচ্ছাদিত করেছিল যেন পুনরায় নিজেকে চিনতে পারে। এই আচ্ছাদন ও উন্মোচনের খেলাই কাশ্মীর শৈবের কালী-তত্ত্বে “নৃত্য”—চেতনার নিজের মধ্যেই আত্মবিমর্শন।

কাশ্মীর শৈব অধিবিদ্যা এক মহাজাগতিক ঐক্যের দর্শন—যেখানে অস্তিত্ব (sat), চেতনা (cit), ও আনন্দ (ānanda) কোনো পৃথক ধারণা নয়, বরং একই পরম সংবিতের তিন প্রকাশ। সেই চেতনা শিব, সেই কম্পন শক্তি, আর সেই জগৎ তাঁদেরই অবিরাম লীলা। মুক্তি মানে এই লীলার মধ্যেই নিজের পূর্ণতা চিনে নেওয়া—চেতনার নিজের মধ্যেই ফিরে যাওয়া, যেখানে আর কোনো ভেদ, কোনো সময়, কোনো সীমা অবশিষ্ট থাকে না—শুধু থাকে এক অনন্ত, স্বাতন্ত্র্যময়ী, চিরসচল, চিরনিরব শিবচেতনা, যা নিজের আলোয় নিজেই নৃত্য করে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়—পরম শিব কখনোই নিষ্ক্রিয় বা স্থবির নন; তাঁর স্বরূপই সংবিত্‌ (চেতনা) এবং সেই চেতনার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি হলো স্বাতন্ত্র্য (স্বাধীনতা)। এই স্বাধীন চেতনা কখনোই বাহ্য কারণে প্ররোচিত হয় না; বরং নিজের আনন্দে, নিজের ইচ্ছায়, নিজের মধ্যেই নিজেকে প্রকাশ ও প্রত্যাহার করে। এই আত্ম-প্রকাশ ও প্রত্যাহারের চিরন্তন নৃত্যই হলো পঞ্চকৃত্য (pañcakṛtya)—অর্থাৎ, শিবের পাঁচ divine কার্য: প্রকাশ (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোধান (tirodhāna) এবং অনুগ্রহ (anugraha)। এগুলি কোনো কালক্রমে বা পরপর ঘটমান বাহ্য ক্রিয়া নয়; এগুলি চেতনারই পাঁচ অন্তর্গত গতি, যা চিরকাল একসঙ্গে স্পন্দিত।

‘প্রকাশ’ মানে “সৃষ্টি”—কিন্তু এই সৃষ্টি কোনো বস্তু বা বাহ্য বাস্তবতার উৎপত্তি নয়, বরং চেতনার নিজের মধ্যেই নিজের সম্ভাবনার আত্ম-উন্মোচন। শিব যখন নিজের অসীম ঐক্যের গভীর নীরবতা থেকে জাগ্রত হন এবং “নিজেকে জানি”, এই চেতনা-আলোয় দীপ্ত হন, তখনই প্রকাশ ঘটে। সেই প্রকাশের মধ্যে চেতনা নিজের মধ্যেই বহুত্বের সম্ভাবনা রচনা করে; সমস্ত ধারণা, রূপ, গতি, অভিজ্ঞতা এই আত্ম-দীপ্তিরই বহির্ভাব।

‘স্থিতি’ হলো প্রকাশিত জগতের ধারাবাহিকতা ও ভারসাম্য। যদি প্রকাশ কেবল মুহূর্তমাত্র স্থায়ী হতো, তবে কোনো অভিজ্ঞতা বা বিশ্ববোধ গঠিত হতো না। তাই স্থিতি সেই শক্তি, যা চেতনার প্রকাশিত রূপগুলিকে সাময়িক স্থায়িত্ব দেয়, যেন সময়, নিয়ম, কারণ-ফল এবং বস্তু-সম্পর্কের ধারণাগুলি টিকে থাকতে পারে। স্থিতি চেতনার সংরক্ষণশক্তি—যেখানে প্রকাশিত রূপগুলি একমুহূর্তের স্থায়িত্বে অর্থ ও পরিপূর্ণতা পায়।

‘সংহার’ মানে ধ্বংস নয়, বরং প্রত্যাবর্তন। যেমন ঢেউ সমুদ্র থেকে উঠে আবার সমুদ্রেই ফিরে যায়, তেমনি সব প্রকাশ, সব ভাব, সব অভিজ্ঞতা শেষপর্যন্ত নিজের উৎস—চেতনার মধ্যেই লয় পায়। এটি “প্রতিসংহৃতি”—অর্থাৎ, সেই অন্তর্মুখী গতি, যেখানে বহুত্ব থেকে ঐক্যে প্রত্যাবর্তন ঘটে। সংহার তাই নিঃশেষতা নয়, বরং বিশ্রাম; এটি চেতনার আত্ম-অন্তর্গমন, যেখানে জগৎ আবার শিবের নীরবতায় বিলীন হয়।

‘তিরোধান’ হলো গোপনতা বা আত্ম-আবরণ। এই পর্যায়ে চেতনা নিজের পূর্ণ দীপ্তি আড়াল করে রাখে এবং নিজেকে সীমিত জীবসত্তা হিসেবে অনুভব করে। এটি সেই শক্তি, যার দ্বারা অসীম সংবিত্‌ নিজেকে সীমিত জ্ঞান, দেহ, ইন্দ্রিয় ও মানসিক গণ্ডির মধ্যে অভিজ্ঞতা করে। এই তিরোধানই মায়া বা অবিদ্যার দার্শনিক ভিত্তি—কিন্তু এটি কোনো ভ্রান্তি নয়, বরং শিবেরই লীলা; তিনি নিজের অসীমতাকে লুকিয়ে সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে নিজের দীপ্তি উপভোগ করেন।

অবশেষে আসে ‘অনুগ্রহ’—যা এই তিরোধানের বিপরীত দিক, অর্থাৎ, আত্ম-উন্মোচন বা পুনরুজ্জীবন। এখানে চেতনা নিজের সীমাবদ্ধতা ভেদ করে আবার নিজের প্রকৃত স্বরূপে জেগে ওঠে। অনুগ্রহ মানে করুণা নয়, বরং চেতনার নিজের মধ্যেই নিজের বোধের উদয়—যেখানে সীমিত জীব পুনরায় উপলব্ধি করে, “আমি শিব”—এই প্রত্যভিজ্ঞা। এটি সেই মুহূর্ত, যখন অন্ধকার নিজেই আলোক হয়ে ওঠে; যখন জীব, জগৎ ও ঈশ্বরের ভেদ বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং অবশিষ্ট থাকে কেবল এক ঐক্যবোধ—চেতনার নিখুঁত আত্মজাগরণ।

এই পাঁচ ক্রিয়া একসাথে চেতনার চিরন্তন স্পন্দনরূপে বিরাজমান—একদিকে প্রকাশের উন্মেষ, অন্যদিকে প্রত্যাবর্তনের লয়; একদিকে বহির্ভাব, অন্যদিকে অন্তর্লয়। শিব এই দুই প্রবাহের মধ্যে চিরস্থায়ী সামঞ্জস্য; তিনি একই সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা ও ভোক্তা, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, উৎস ও লয়স্থান।

প্রকাশ চেতনার দীপ্তি, স্থিতি তার ভারসাম্য, সংহার তার বিশ্রাম, তিরোধান তার আত্ম-গোপনতা এবং অনুগ্রহ তার পুনরুজ্জীবন। এই পাঁচের মিলেই প্রকাশিত হয় পরম শিবের লীলা—চেতনার সেই চিরন্তন পরিক্রমা, যেখানে সৃষ্টি ও লয়, আলো ও অন্ধকার, গতিশীলতা ও নীরবতা—সব এক অভিন্ন ঐক্যে মিশে যায় এবং সংবিত্‌ চিরকাল নিজের মধ্যে নিজের নৃত্য উপভোগ করে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে “ধারণা (dhāraṇā), রূপ (rūpa), গতি (gati), অভিজ্ঞতা (anubhava)”—এই চারটি শব্দ পরম চেতনার আত্ম-প্রকাশের ক্রমান্বয় স্তরকে সূক্ষ্মভাবে নির্দেশ করে। এগুলি কোনো বাহ্য জগৎ-সংক্রান্ত ধারণা নয়, বরং চেতনার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ গতি বা স্ব-উন্মোচনের চার ধাপ।

ধারণা (Dhāraṇā) মানে ধারণ করা, স্থাপন করা বা একটি সম্ভাবনার বীজরূপে উপলব্ধ হওয়া। চেতনার গভীরতম স্তরে, যখন এখনও কোনো পৃথক রূপ বা চিন্তা প্রকাশ পায়নি, তখন সমস্ত কিছু এক অনন্ত সম্ভাবনা রূপে অবস্থান করে—যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, জ্ঞান—সব এক অবিভক্ত সম্ভাবনার গর্ভে। এই অবস্থায় চেতনা নিজের মধ্যেই নিজেকে ধারণ করে, যেন নিঃশব্দ অন্তর্লীন বীজে সমস্ত প্রকাশের সম্ভাবনা নিহিত। এটি সেই স্তর, যাকে অভিনবগুপ্ত বলেন “আদি-সংবিত্‌”—চেতনার মৌল স্তব্ধতা।

এরপর আসে রূপ (Rūpa)—অর্থাৎ, সেই ধারণার বহির্ভাব, বা অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার দৃশ্যমান রূপলাভ। রূপ মানে আকার নয়, বরং চেতনার প্রতিফলিত স্বরূপ। যখন চেতনা নিজের আলোয় নিজের সম্ভাবনাকে চিত্ররূপে প্রকাশ করে, তখনই রূপ জন্মায়। এই রূপ দৃশ্যমান বস্তু নয়, বরং অভ্যন্তরীণ চেতনার প্রতিফলন—যেমন স্বপ্নে দেখা দৃশ্যের কোনো বাহ্য অস্তিত্ব না থাকলেও, তা সম্পূর্ণ বাস্তব বলে অনুভূত হয়। রূপ হলো চেতনার সেই রূপান্তর, যার দ্বারা অরূপ শিব দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রকাশিত হন।

গতি (Gati) হলো সেই রূপের স্পন্দন বা প্রাণপ্রবাহ—চেতনার গতিশীলতা, যার দ্বারা প্রকাশের প্রক্রিয়া ক্রমাগত উন্মোচিত হয়। চেতনা স্থির নয়; সে নিজেই নিজের মধ্যে প্রবাহিত। এই গতি মানে স্থানিক গমন নয়, বরং চেতনার স্ব-অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন—অবিচ্ছিন্ন সচেতনতার ধারা, যা নিজেই সময়রূপ ধারণ করে। গতি-ই কাল-চেতনার উৎস—যার ফলে ঘটনা, অনুক্রম, কারণ-ফল এবং ক্রমবোধ জন্মায়। গতি মানে চেতনার স্পন্দন (spanda)—যে শক্তিই মহাবিশ্বকে প্রাণ দেয়, যা ছাড়া কোনো অনুভব, কোনো চিন্তা, কোনো অস্তিত্ব সম্ভব নয়।

অবশেষে আসে ‘অভিজ্ঞতা’ (Anubhava)—অর্থাৎ, সেই সম্পূর্ণতা, যেখানে ধারণা, রূপ ও গতি একত্রে মিলিত হয় চেতনার প্রত্যক্ষ অনুভবে। এটি জ্ঞানের শেষ ধাপ নয়, বরং জ্ঞানের এক জীবন্ত পরিপূর্ণতা—যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান আর পৃথক থাকে না। অভিজ্ঞতা মানে সেই “একাত্ম উপলব্ধি”, যেখানে চেতনা নিজেই নিজের প্রকাশকে প্রত্যক্ষ করে এবং জানে—“আমি-ই এই সব।”

এই চারটি ধাপ—ধারণা, রূপ, গতি, অভিজ্ঞতা—আসলে শিব-সংবিত্‌-এর অন্তর্নিহিত গতি। শিব প্রথমে নিজের সম্ভাবনাকে ধারণা-রূপে ধারণ করেন, তারপর সেই সম্ভাবনাকে রূপ-এ প্রতিফলিত করেন, সেই রূপে গতি সঞ্চার করেন এবং অবশেষে সেই গতির মধ্যেই পূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই ধারায় চেতনা নিজের মধ্যেই জগৎ সৃষ্টি করে, অনুভব করে এবং আবার নিজেই নিজের মধ্যে তা লীন করে।

অতএব, এই চারটি পরিভাষা—ধারণা, রূপ, গতি, অভিজ্ঞতা—শুধু মানসিক বা বৌদ্ধিক অবস্থা নয়; এগুলি পরম সংবিত্‌-এর স্বাভাবিক লীলার চার গতি।

ধারণা হলো নীরব সম্ভাবনা, রূপ হলো সেই সম্ভাবনার দীপ্ত প্রকাশ, গতি হলো সেই দীপ্তির ছন্দ, আর অভিজ্ঞতা হলো সেই ছন্দের চূড়ান্ত আত্ম-সাক্ষাৎ।

এভাবেই চেতনা বা সংবিত্‌ নিজের মধ্যেই নিজের রূপ, গতি ও অভিজ্ঞতার পরিপূর্ণ মহাজাগতিক ছন্দ রচনা করে—যেখানে প্রকাশ ও লয়, স্থিতি ও পরিবর্তন, একতা ও বহুত্ব—সব এক অভিন্ন, অদ্বৈত নৃত্যের স্পন্দনে মিশে যায়।

কাশ্মীর শৈবদর্শনের গভীরতম তত্ত্বে “প্রতিসংহৃতি (pratisaṁhṛti)” এবং “চেতনার আত্ম-অন্তর্গমন (cetanāra ātma-antar-gamana)”—এই দুটি পরিভাষা একই প্রক্রিয়ার দুটি দিক। উভয়ই বোঝায় সেই অন্তর্মুখী গতি, যার মাধ্যমে চেতনা নিজের প্রকাশিত রূপগুলিকে পুনরায় নিজের মধ্যে লীন করে নেয়। এটি ধ্বংস বা নিঃশেষ নয়, বরং ঐক্যে প্রত্যাবর্তন (return to unity)—যেখানে বহুত্ব, বিভাজন, শব্দ, রূপ, ধারণা—সব মিলিয়ে যায় তাদের উৎসে, সেই পরম সংবিত্‌ বা শিব-চেতনায়।

“প্রতিসংহৃতি” ও “চেতনার আত্ম-অন্তর্গমন” একই মৌল প্রক্রিয়ার দুই দিক, কিন্তু তাদের দার্শনিক অভিমুখ ভিন্ন। প্রতিসংহৃতি মানে চেতনার বহির্মুখ প্রকাশের প্রত্যাহার, আর আত্ম-অন্তর্গমন মানে সেই প্রত্যাহারের পরিণতি—চেতনার নিজের উৎসে অন্তর্মুখী প্রবেশ। অর্থাৎ, প্রথমটি “বাহির থেকে ভিতরে ফেরা”, দ্বিতীয়টি “ভিতর থেকে নিজের গভীরে প্রবেশ”।