অন্নপূর্ণা কালী: ইনি কালীর সেই কোমল, পুষ্টিদায়িনী ও করুণাময় রূপ, যিনি ভক্তজীবনের আহার, সন্তুষ্টি ও পূর্ণতার দেবী। “অন্নপূর্ণা” শব্দটি দুটি মূল থেকে এসেছে—অন্ন (অর্থাৎ খাদ্য, জীবনের রস) এবং পূর্ণা (অর্থাৎ পরিপূর্ণতা, তৃপ্তি, সম্পূর্ণতা)। তাই অন্নপূর্ণা কালী কেবল ভৌত খাদ্যের দেবী নন; তিনি হলেন সেই পরম চেতনা, যিনি আত্মা ও জগৎ উভয়কেই পুষ্ট করেন—শরীরকে অন্নে, মনকে শান্তিতে, আর আত্মাকে জ্ঞানে।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে অন্নপূর্ণা কালী সেই পরম ব্রহ্মচেতনার পোষণরূপা শক্তি—যিনি নিজ থেকেই জগৎকে ধারণ, পালন ও পূর্ণতা প্রদান করেন। উপনিষদে এই তত্ত্বের ভিত্তি পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (ভৃগুবল্লী অংশে) বলা হয়েছে—“অন্নং ব্রহ্ম”—অর্থাৎ, অন্ন বা খাদ্যই ব্রহ্ম, কারণ সমস্ত জীবনের স্থিতি ও বিকাশ অন্নের উপর নির্ভরশীল। এখানে “অন্ন” কেবল ভৌত আহার নয়; এটি সেই পোষণশক্তি, যা সমগ্র সৃষ্টির জীবনধারাকে রক্ষা করে।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্রহ্ম কোনো নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব নয়; তিনি স্বয়ং প্রকাশমান শক্তিরূপে জগতে পোষণ করেন। সেই শক্তিরই দেবীমূর্তি অন্নপূর্ণা কালী। কালী এখানে ধ্বংসের প্রতীক নন, বরং ধ্বংস ও সৃষ্টির পরম সমন্বয়—যিনি জগৎকে তাঁর পূর্ণতার মাধ্যমে ধারণ করেন।
শ্রী শঙ্করাচার্য তাঁর অন্নপূর্ণা স্তবে লিখেছেন—“অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে শঙ্করপ্রাণবল্লভে।” অর্থাৎ, “হে অন্নপূর্ণা! তুমি সর্বদা পূর্ণ, শঙ্করের প্রাণপ্রিয়া।” এই “সদাপূর্ণতা” আসলে ব্রহ্মস্বরূপ পরিপূর্ণতার প্রতীক—যেখানে কিছুই অপূর্ণ নয়, কিছুই ঘাটতি নয়। ঈশা উপনিষদের শান্তিপাঠ মন্ত্র—“পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্ পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।”—এই একটিমাত্র মন্ত্রের মধ্যেই অদ্বৈত বেদান্তের সমগ্র তত্ত্বসংহিতা নিহিত। এখানে “পূর্ণ” মানে কেবল সম্পূর্ণতা নয়; এটি সেই অসীম, অভেদ, অভাবহীন চেতনা, যা কারণ ও কার্য উভয়কেই ধারণ করে।
প্রথমে বলা হয়েছে—পূর্ণমদঃ, অর্থাৎ “সেই” (অদৃশ্য কারণ) পূর্ণ। এই “সেই” মানে অব্যক্ত ব্রহ্ম—যিনি সকল সত্তার উৎস, কিন্তু নিজে কোনো পরিবর্তনের মধ্যে প্রবেশ করেন না। তিনি “নিত্যমুক্ত, নির্বিকার, অচিন্ত্য”—যাঁর মধ্যে সব কিছু নিহিত, তবু যিনি কিছু দ্বারা সীমাবদ্ধ নন।
তারপর বলা হয়েছে—পূর্ণমিদম্, “এই (দৃশ্যমান জগৎ) পূর্ণ।” অর্থাৎ, জগৎও ব্রহ্ম থেকে আলাদা নয়; এটি তাঁরই প্রকাশ বা প্রতিফলন। কারণ যদি ব্রহ্ম সত্যিই অসীম হন, তবে তাঁর বাইরে কিছুই থাকতে পারে না। তাই “এই পৃথিবী, জীবন, প্রকৃতি—সবই ব্রহ্মের পূর্ণতাই।” এই উপলব্ধিই ঈশা উপনিষদের মূল বাণী—“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং”—সব কিছুই ঈশ্বর দ্বারা পরিব্যাপ্ত।
এর পরের অংশ—পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে, “পূর্ণ থেকে পূর্ণের উৎপত্তি হয়।” এখানে সৃষ্টি বলতে কোনো নতুন কিছুর উৎপত্তি নয়, বরং চেতনার প্রকাশ বোঝানো হয়েছে। যেমন সূর্য আলো সৃষ্টি করে না—আলো সূর্যেরই প্রকাশ। তেমনি ব্রহ্ম কোনো কিছুকে বাইরে থেকে সৃষ্টি করেন না; জগৎ তাঁরই দীপ্তি। এই তত্ত্বকে বলা হয় বিবর্তবাদ (Vivartavāda)—যেখানে কার্য (জগৎ) কারণ (ব্রহ্ম)-এর বিকৃতি নয়, বরং তারই প্রকাশমান নাম-রূপ।
চতুর্থ অংশ—পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে, “পূর্ণ থেকে পূর্ণ সরিয়ে নিলেও পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে।” এই উক্তি ব্রহ্মের অসীমতা ও অখণ্ডতা-র যুক্তিগত প্রমাণ। অসীম থেকে অসীম অপসারিত হলেও যা অবশিষ্ট থাকে, সেটি অসীমই থাকে। তাই ব্রহ্ম থেকে অসংখ্য জগৎ, প্রাণ, ও অভিজ্ঞতা উদ্ভূত হলেও, তাঁর পূর্ণতা কখনও হ্রাস পায় না। তিনি যেমন ছিলেন—তেমনই পূর্ণ, কারণ তাঁর স্বভাবই “অপরিবর্তনীয় চিরসত্তা।”
শঙ্করাচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে বলেন—“পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে ইতি—কারণরূপে আপন্নমপি ব্রহ্ম কার্যরূপে পূর্ণত্বাত্ ন হীয়তে।” অর্থাৎ, ব্রহ্ম যখন কার্যরূপে প্রকাশিত হন, তখনও তাঁর পূর্ণতা অক্ষুণ্ণ থাকে। কার্য ও কারণের এই ঐক্যই অদ্বৈত বেদান্তের ভিত্তি।
অদ্বৈতের ভাষায়, এই মন্ত্রে “পূর্ণতা” মানে সত্তার অবিভাজ্য ঐক্য। কারণ (ব্রহ্ম) ও কার্য (জগৎ)-এর মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই—যা আছে, তা কেবল নাম-রূপের আভাস। যেমন স্বর্ণ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন অলঙ্কার স্বর্ণ থেকে ভিন্ন নয়, তেমনি জগৎও ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়।
এই মন্ত্রের আধ্যাত্মিক দিক হলো আত্মোপলব্ধি। “পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্”—এই উপলব্ধি কেবল তত্ত্ব নয়, এটি অভিজ্ঞতা। যখন সাধক উপলব্ধি করেন যে, “আমি পূর্ণ ব্রহ্মস্বরূপ”—তখন সব অভাববোধ, আকাঙ্ক্ষা ও ভয় লয় পায়। আত্মজ্ঞান তখনই ঘটে, যখন মানুষ বুঝতে পারে—সে কিছু থেকে বঞ্চিত নয়, সে নিজেই পূর্ণ।
এখানে “পূর্ণতা” মানে অভাবহীন অস্তিত্ব, সীমাহীন চেতনা, অভেদ অনুভব। এই উপলব্ধি থেকেই অদ্বৈত বেদান্ত বলে—“ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, বাকি সব তার প্রকাশ।” সেই ব্রহ্ম চেতনা কখনও ক্ষীণ হয় না, কখনও বিভক্ত হয় না; জগৎ তাঁরই অনন্ত পরিপূর্ণতার রূপে প্রসারিত।
এই শান্তিপাঠ মন্ত্র আসলে ঘোষণা করছে—যা-কিছু তুমি দেখছ, তা পূর্ণ; যা-কিছু তুমি নও, তা-ও পূর্ণ; কারণ ব্রহ্মের বাইরে কিছুই নেই। এই পূর্ণতা থেকেই জগৎ আসে, সেই পূর্ণতায়ই টিকে থাকে, এবং সেই পূর্ণতাতেই লয় পায়।
এই দর্শনেরই জীবন্ত প্রতিমূর্তি অন্নপূর্ণা কালী—তিনি সেই মাতৃচেতনা, যিনি পূর্ণ ব্রহ্ম থেকে জগৎকে পুষ্ট করেন, আবার সেই জগৎকেই নিজের পূর্ণতায় ধারণ করেন। তাঁর দান কখনও কমে না, কারণ তিনি পূর্ণ থেকে দেন, আর পূর্ণের মধ্যে কোনো হ্রাস নেই।
“পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্…” মন্ত্রটি কেবল শান্তিপাঠ নয়; এটি সেই অদ্বৈত ব্রহ্মচেতনার মহামন্ত্র, যেখানে সব ভেদ লয় পায় এক চিরন্তন সত্যে—“যা পূর্ণ থেকে জন্ম নেয়, তা পূর্ণই থাকে; আর যা লয় পায়, তা পূর্ণতায়ই ফিরে যায়।”
এইভাবেই অন্নপূর্ণা কালী ব্রহ্মের অখণ্ড পরিপূর্ণতার প্রতীক, যিনি কেবল ধ্বংস বা শূন্যতার দেবী নন—তিনি পুষ্টি ও লালনরূপা মাতৃচেতনা। শাক্ত তত্ত্বে কালী ও অন্নপূর্ণা দুই বিপরীত নয়, বরং একই শক্তির দুই ভঙ্গি—একদিকে সংহার (কালরাত্রি), অন্যদিকে পালন (অন্নপূর্ণা)। অদ্বৈত বেদান্তে এই দুই রূপই শেষপর্যন্ত এক আত্মসত্তায় মিলিত; ব্রহ্মই ধ্বংসও করেন, ব্রহ্মই পোষণও করেন।
“অন্নং ব্রহ্ম” ও “অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে” এই দুই উক্তি মিলে ঘোষণা করে—অন্নপূর্ণা কালী হলেন সেই পূর্ণচেতনার জীবন্ত প্রতিমূর্তি, যিনি সমস্ত প্রাণে পুষ্টি, জীবনে ধারাবাহিকতা, আর চেতনায় পরিপূর্ণতা এনে দেন। তিনি ব্রহ্মের সেই মাতৃরূপ, যার মধ্যে ধ্বংসও আশ্রয় খোঁজে, আর সৃষ্টি পায় তার নিরবচ্ছিন্ন আহার।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে, অন্নপূর্ণা কালী হলেন বিমর্শশক্তি-র পোষণদায়িনী দিক—যিনি চেতনার স্বাভাবিক লালন ও প্রকাশকে প্রতিনিধিত্ব করেন। শৈব তত্ত্বে বলা হয়, চেতনা নিজের আনন্দের লীলায় প্রকাশিত ও পালিত হয়; এই “পালন”ই অন্নপূর্ণা কালীর শক্তি। তাঁর অন্ন আসলে চিদ্রস—চিদ্রস—চেতনার রস। এই রসই সমস্ত জীবনে সঞ্চারিত হয়ে সৃষ্টি ও স্থিতিকে সম্ভব করে। অভিনবগুপ্ত এই শক্তিকে বলেছেন “পূর্তিশক্তি”—যেখানে ব্রহ্মচেতনা নিজের মধ্যেই সমস্ত অভাব পূর্ণ করে। অন্নপূর্ণা কালী তাই সেই শক্তি, যিনি শূন্যতার মধ্যেও পূর্ণতা অনুভব করান এবং ক্ষুধাকে রূপান্তরিত করেন তৃপ্তির জ্ঞানে।
শাক্ত দর্শনে, অন্নপূর্ণা কালী হলেন মহামায়ার “মাতৃরূপিণী করুণা”—যিনি সন্তানকে ক্ষুধার কষ্ট থেকে রক্ষা করেন, কেবল ভৌতিক অর্থে নয়, আধ্যাত্মিক অর্থেও। তাঁর হাতে অন্নের পাত্র মানে জ্ঞানরসের কূপ—যেখান থেকে ভক্ত আত্মা তৃপ্তি পায়। তিনি শেখান, আহার কেবল শরীরের নয়—মন ও আত্মারও। তাই তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে, “অন্নং পরম ব্রহ্ম রূপম্”—অর্থাৎ, অন্ন আসলে ব্রহ্মেরই প্রতিরূপ, কারণ চেতনা নিজেই জীবরূপে পুষ্ট হয় এবং সেই চেতনারই এক প্রকাশ হলো আহার। অন্নপূর্ণা কালীর কৃপা মানে, জীব যেন নিজের ভেতরের অভাববোধ থেকে মুক্ত হয়—তিনি শেখান, সন্তোষই আসল পূর্ণতা।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে, অন্নপূর্ণা কালী মানুষের “nurturing আদি-রূপ (archetype)”—অর্থাৎ, সেই মাতৃশক্তি, যা জীবনের ভেতরে নিরাপত্তা, শান্তি ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষ তখনই স্থিতিশীল হয়, যখন সে ভালোবাসা ও আশ্রয়ের বোধে পরিপূর্ণ। অন্নপূর্ণা কালী সেই আশ্রয়বোধের অন্তর্গত প্রতীক—তিনি শেখান, সত্যিকারের তৃপ্তি বাহ্যিক আহারে নয়, অন্তরের শান্তিতে। তাঁর কৃপায় জীব বুঝতে শেখে, “আমি পূর্ণ”—এবং সেই আত্মসন্তুষ্টিই তাকে মুক্তি দেয় ভয়, অভাব ও অস্থিরতা থেকে।
অন্নপূর্ণা কালী ধ্বংসকারিণী নয়, বরং জীবনধারিণী; তিনি লীলাময় চেতনার পোষণ ও পূর্ণতার রূপ। তাঁর হাতে অন্ন মানে জীবনের পরম রস; তাঁর হাসি মানে চেতনার তৃপ্তি। তিনি শেখান—ক্ষুধা থেকে জাগে সৃষ্টি, আর তৃপ্তি থেকেই আসে মুক্তি। তাঁর কণ্ঠে যেন শোনা যায় এক চিরন্তন আহ্বান—“আমি অন্ন, আমি পূর্ণতা—যেখানে অভাব নেই, সেখানেই আমি।”
যোগিনী কালী: ইনি হলেন চেতনার সেই গভীর, অন্তর্মুখী ও তপস্যাময় রূপ, যিনি মনকে বাহির থেকে ফিরিয়ে আত্মার অন্তঃলোকের দিকে নিয়ে যান। “যোগিনী” শব্দটি এসেছে “যুজ্” ধাতু থেকে, যার অর্থ—সংযোগ, ঐক্য বা মিলন। তাই যোগিনী কালী সেই শক্তি, যিনি জীবের সীমিত চেতনাকে পরম চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেন, বিচ্ছিন্নতাকে ঐক্যে রূপান্তর করেন।
যোগের মূল অর্থই এই—বাহ্য থেকে অন্তরে প্রত্যাবর্তন। পতঞ্জলি যোগসূত্র (১.২)-এ বলা হয়েছে, “যোগঃ চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ”, অর্থাৎ “চিত্তের সমস্ত গতি ও স্পন্দনের নিবৃত্তিই যোগ।” যখন মনের বিকার থেমে যায়, তখন চেতনা নিজের স্বরূপে স্থিত হয়। এই অবস্থাই যোগিনী কালীর ক্ষেত্র—তিনি সেই নীরবতার জননী, যিনি চিত্তের সমস্ত তরঙ্গকে প্রশমিত করে মনকে নিজের উৎসে ফিরিয়ে নেন। তাঁর তপস্যা কোনো বাহ্যিক কৃচ্ছসাধন নয়; এটি অহংকার ও মনোবিক্ষেপের বিলয়। তিনি সাধকের ভেতরকার বিভ্রান্ত মনকে নিজের মূল চৈতন্যে স্থিত করে দেন।
অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে, যোগিনী কালী হলেন ব্রহ্মচেতনার অন্তঃসংযোজক শক্তি, যিনি মন ও আত্মার মধ্যকার পর্দা সরিয়ে দেন। কারণ মনের দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা ও ভয়ই আত্মানুভবের অন্তরায়। যখন যোগিনী কালী সেই পর্দা বিদীর্ণ করেন, তখন মনের সমস্ত গতি স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং আত্মা নিজেকে নিজের মধ্যেই চিনে ফেলে।
“যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেভয়া”—এই শ্লোকটি গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের (আত্মসংযম যোগ) অন্তর্গত, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ যোগীর মননশীল স্থিতি বা “সমাধি”-র প্রকৃত রূপ ব্যাখ্যা করছেন। এখানে বলা হচ্ছে সেই অবস্থার কথা, যখন চিত্ত বা মন সমস্ত বিক্ষেপ, আকর্ষণ ও বিকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মধ্যে শান্ত ও স্থির হয়ে যায়। এই “উপরমতা” বা নিবৃত্তিই যোগের চূড়ান্ত লক্ষণ, আর সেই স্থিতিই মুক্তির দোরগোড়া।
“উপরমতে” শব্দটি এসেছে “উপরম” ধাতু থেকে, যার অর্থ থেমে যাওয়া, স্থির হয়ে যাওয়া, নিবৃত্ত হওয়া। “চিত্তম্” মানে মন বা অন্তঃকরণ—যার মধ্যে ইচ্ছা, স্মৃতি, কল্পনা, বুদ্ধি ও অহং একত্রে কাজ করে। “নিরুদ্ধম্” মানে সংযত বা নিবৃত। আর “যোগসেবয়া” মানে যোগের ধারাবাহিক অনুশীলনের দ্বারা। অর্থাৎ, মন তখন স্থির হয় যখন যোগ—অর্থাৎ আত্মসংযম, মনন, ধ্যান ও ভক্তি—নিয়মিতভাবে পালন করা হয়। এই অবস্থায় মন আর বাইরের জগতে ছুটে যায় না, বরং নিজের কেন্দ্রের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
পতঞ্জলি যোগসূত্রে (১.২) বলা হয়েছে—“যোগঃ চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ”—চিত্তের বৃত্তিগুলির নিবৃত্তিই যোগ। গীতার এই শ্লোক সেই সূত্রের জীবন্ত প্রতিধ্বনি। মন যখন ইন্দ্রিয়-প্রবাহ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, যখন চিন্তার গতি স্তব্ধ হয়, তখন চেতনা নিজের মূল দীপ্তিতে জেগে ওঠে। এই চিত্তনিরোধ মানে মনকে ধ্বংস করা নয়; বরং মনকে এমনভাবে স্বচ্ছ করে তোলা, যাতে আত্মার আলো সেখানে বিকৃত না হয়। শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন—চিত্তনিরোধ মানে তার বিলোপ নয়, বরং তার প্রকৃত স্বরূপে স্থিতি। অর্থাৎ, মন তখন আর স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নয়; সে ব্রহ্মচেতনারই স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব।