শৈব কালী: সাত



এখানে “দ্বৈতাভাসনা” বলতে বোঝানো হচ্ছে, চেতনা বাস্তবে দুইয়ে বিভক্ত হয় না, কিন্তু নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় এমন এক প্রতিফলন ঘটায়, যেখানে সে নিজেকে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—এই দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পায়। এই “আভাস”—অর্থাৎ, “দুইয়ের মতো প্রতীয়মান হওয়া”—বাস্তব বিভাজন নয়, বরং চেতনার অন্তর্লীন আত্ম-অভিজ্ঞতার এক ছায়া বা প্রতিফলন।

এই ব্যাখ্যাকে আরও গভীর করে তুলেছেন অভিনবগুপ্ত। তিনি ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-ভিমর্শিনী (I.42)-তে লিখেছেন—“সা হি পরমা সংবিত্‌ স্বাতন্ত্র্যময়ী, স্ববিমর্শনাত্‌ স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসম্‌ উৎপাদ্য ক্রীড়য়ৈব।” অর্থাৎ, পরম সংবিত্‌ বা চেতনা নিজের স্বাধীনতার দ্বারা, নিজেরই স্ববিমর্শন (নিজের প্রতি আত্ম-সচেতনতা) থেকে, দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে—কিন্তু তা কেবলই ক্রীড়ারূপে, এক আনন্দময় লীলারূপে। এখানে অভিনবগুপ্ত অত্যন্ত স্পষ্ট করে দেন যে, এই দ্বৈততার উৎপত্তি কোনো অজ্ঞানজনিত ত্রুটি নয়; এটি পরম চেতনার নিজস্ব স্বাধীন সৃজনশক্তির প্রকাশ—এক divine play। চেতনা নিজেরই দীপ্তিতে আত্মতৃপ্ত; সেই আনন্দে সে নিজেকে জানার ইচ্ছায় নিজেরই এক প্রতিফলন ঘটায়, যেন একক আলো নিজের ছায়া দেখছে।

এভাবে, দ্বৈতাভাসনা মানে কোনো বাস্তব দুই নয়, বরং একক চেতনার মধ্যে “আমি-এটা”-র প্রতীয়মানতা। এটি চেতনার অন্তর্গত স্বাধীনতারই ফল—স্বাতন্ত্র্যের এক ছায়ানৃত্য। পরম চেতনা যখন নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়, তখন সে নিজেকে জ্ঞাতা বলে অনুভব করে এবং সেই প্রতিফলনকে জ্ঞেয় বলে জানে। এই খেলাটাই হলো বিশ্ব, অভিজ্ঞতা ও সময়ের জন্মক্ষেত্র।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে “স্ববিমর্শন (svavimarśana)” এবং “দৈবলীলা (divine play, kṛīḍā/līlā)—এই দুটি ধারণা একে অপরের পরিপূরক। প্রথমটি চেতনার অন্তর্মুখী স্বরূপ, আর দ্বিতীয়টি তার বহির্মুখী প্রকাশ। এই দুই দিকের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় সেই জীবন্ত চেতনার রহস্য, যা শৈব তন্ত্রে কালী নামে অভিহিত—চেতনার সেই স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্পন্দিত দিক, যিনি শিবের স্থিত সংবিত্‌কে গতিশীল লীলায় রূপান্তরিত করেন।

চেতনা স্বভাবতই স্বপ্রকাশ (svaprakāśa)—সে নিজেই নিজের দ্বারা আলোকিত; তাকে জানবার জন্য কোনো বাহ্য বস্তু বা মাধ্যম প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই আত্ম-উজ্জ্বলতা কোনো স্থবির আলো নয়; এটি এক সচেতন আত্ম-চেতনা, যেখানে চেতনা নিজেকে জানার জন্য নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। এই আত্ম-প্রতিফলনের প্রক্রিয়াটিই স্ববিমর্শন (svavimarśana)—চেতনার নিজের প্রতি সচেতনতা, নিজেরই জানার ও জানবার ক্ষমতা।

অভিনবগুপ্ত বলেন, চেতনা যদি কেবল “আলো” হতো, কিন্তু সেই আলো নিজের আলোক হওয়া জানত না, তবে তা জড়ের মতো নিস্তরঙ্গ ও নির্জ্ঞান হতো। তাই শিব কেবল প্রকাশ (prakāśa) নন; তিনি বিমর্শ (vimarśa)—অর্থাৎ, সেই আত্ম-সচেতন গতি, যার মধ্যেই প্রকাশ জীবন্ত হয়। শিব হলেন স্থিত সংবিত্‌—নিরবচ্ছিন্ন দীপ্তি; আর শক্তি—বিশেষত কালী হলেন সেই দীপ্তির স্পন্দিত প্রতিচ্ছবি, যেখানে নীরবতা সুরে রূপ নেয়, স্থিতি হয়ে ওঠে গতি, আর দীপ্তি প্রকাশে পরিণত হয়।

এই স্ববিমর্শন-এর মাধ্যমেই চেতনা নিজের মধ্যে নিজের প্রতিফলন ঘটায়। চেতনা যখন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে, তখন সে নিজেরই এক আভাস সৃষ্টি করে—“আমি” (অহম্‌, subject, প্রমাতা) ও “এটা” (ইদম্‌, object, বিষয়)—এই দুই দিক তখন অভিজ্ঞতার রূপে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এটি কোনো বাস্তব বিভাজন নয়; এটি একক চেতনার মধ্যকার আত্ম-দর্শনের খেলা, একধরনের divine play।

এই কারণেই উত্পলদেব বলেন, চেতনা নিজের চেতনা-রূপেই বিবর্তিত হয়, নিজের স্বাধীনতায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। আর অভিনবগুপ্ত এই তত্ত্বটিকে আরও বিশ্লেষণ করে বলেন, পরম সংবিত্‌ বা চেতনা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায়, নিজের স্ববিমর্শন দ্বারা, দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে—কিন্তু তা কেবল আনন্দময় ক্রীড়া, এক দৈবলীলা।

এই দ্বৈতাভাস কোনো অজ্ঞানজনিত ত্রুটি নয়; বরং এটি পরম চেতনার আনন্দময় আত্মপ্রকাশ। চেতনা নিজে পূর্ণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মুক্ত, কিন্তু সেই পূর্ণতার আনন্দেই সে নিজেকে জানার জন্য নিজেই নিজের প্রতিফলন ঘটায়। এই আত্ম-প্রতিফলনের ছায়ায় জন্ম নেয় জগৎ, অভিজ্ঞতা, সময় ও স্থান—যা আসলে এক অদ্বৈত চেতনার নৃত্যরূপ বহুরূপী প্রকাশ।

এই চেতনার লীলার জীবন্ত প্রতীকই কালী। তিনি সেই স্বাতন্ত্র্যচেতনাশক্তিরূপা—যিনি শিবের অচল দীপ্তিকে নিজের স্পন্দনে প্রকম্পিত করেন। কালী তাই “সময়ের গ্রাসকারিণী”—তিনি সময় সৃষ্টি করেন, আবার সময়কেই নিজের মধ্যে লীন করেন। যেমন চেতনা নিজের স্বাধীনতায় বহির্মুখী হয়ে “আগে-পরে”, “কারণ-ফল”, “ঘটনা–ক্রম”-এর ধারায় প্রকাশিত হয়—এটাই ক্রমকাল (sequential time); আবার যখন চেতনা নিজের মধ্যে প্রত্যাবর্তিত হয়, সমস্ত প্রক্ষেপণ শোষণ করে, তখন সময় থেমে যায়, আর প্রকাশিত হয় অক্রমকাল (trans-sequential time)—এক চিরন্তন বর্তমানের দীপ্তি।

কালী এই দুই অবস্থারই মিলনবিন্দু। তিনি সময়কে ধারণ করেন, আবার সময়কে গ্রাসও করেন; তিনি জগতের চলমানতার মূলেও আছেন, আবার চেতনার স্থিত নীরবতাতেও বিরাজমান। এই দ্বৈততার সেতুবন্ধনই তাঁর লীলা—যেখানে চেতনার স্ববিমর্শন (নিজেকে জানার অন্তর্লীন গতি) এবং দৈবলীলা (নিজেকে প্রকাশ করার বহির্মুখী প্রবাহ) একই বাস্তবতার দুই দিক।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে স্ববিমর্শন হলো চেতনার অন্তর্মুখী সচেতনতা—যেখানে সে নিজের ভেতর নিজের সত্তাকে দেখে; আর দৈবলীলা হলো সেই অভ্যন্তরীণ আত্মদর্শন যখন প্রকাশে রূপ নেয়—যেখানে চেতনা নিজের অসীম সম্ভাবনাকে বহির্জগতে নৃত্যের মতো উদ্‌ভাসিত করে।

এই দুই মিলেই কালী—তিনি একাধারে স্ববিমর্শনের গভীর নিস্তব্ধতা এবং দৈবলীলার প্রাণময় গতি। তাঁর মধ্যেই শিবের সংবিত্‌ জেগে ওঠে, নীরব দীপ্তি পরিণত হয় প্রকাশের নৃত্যে, আর চেতনার অদ্বৈত সত্য ছড়িয়ে পড়ে সৃষ্টির প্রতিটি স্পন্দনে। কালী তাই কেবল তন্ত্রের দেবী নন; তিনি চেতনার সেই স্বয়ংক্রিয়, স্বাধীন, আনন্দময় আত্ম-দর্শন—যেখানে জানা, দেখা, সৃষ্টি ও লয়—সব এক অনন্ত স্ববিমর্শনের লীলায় মিলেমিশে যায়।

তাই বলা যায়, অভিনবগুপ্ত ও উত্পলদেব উভয়েরই বক্তব্যের কেন্দ্রে রয়েছে এই সত্য যে, চেতনার স্বাধীনতা থেকেই সমস্ত দ্বৈততার প্রতীয়মানতা সৃষ্টি হয়। যখন চেতনা নিজের স্বাতন্ত্র্যে বহির্মুখী হয়, তখন “আমি” ও “এটা” জন্ম নেয়; আর যখন সেই চেতনা নিজের উৎসে প্রত্যাবর্তিত হয়, তখন সেই সমস্ত প্রতিফলন শোষিত হয়ে যায়—দ্বৈততা বিলীন হয়, প্রকাশিত হয় এক অদ্বৈত ঐক্য।

এই অবস্থাতেই ঘটে প্রত্যভিজ্ঞা—নিজেকে নিজের মধ্যে চিনে নেওয়া। তখন উপলব্ধি হয়, “আমি” ও “এটা”, “জ্ঞাতা” ও “জ্ঞেয়”—সবই একক সংবিত্‌-এর লীলামাত্র। দ্বৈতাভাসনা তাই কোনো বন্ধন নয়; এটি চেতনার নিজেরই আনন্দময় আত্ম-উন্মোচন, যা পুনরায় নিজ উৎসে লয় পেলে অদ্বৈত উপলব্ধিতে পরিণত হয়।

এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিই কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূল হৃৎস্পন্দন—যেখানে সৃষ্টি ও প্রত্যাহার, বিভাজন ও ঐক্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা—সব মিলেমিশে দাঁড়ায় এক জীবন্ত চেতনার নৃত্যরূপে। আর সেই চেতনারই জীবন্ত প্রতীক কালী—যিনি এই দ্বৈতাভাসনার খেলায় শিবের স্থিত চেতনাকে গতিতে, নীরব দীপ্তিকে ধ্বনিতে, ও অদ্বৈত সত্যকে সৃষ্টিময় বহুত্বে রূপান্তরিত করেন।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যানুযায়ী, চেতনার যে-আত্ম-প্রতিফলন—অর্থাৎ, চেতনা যখন নিজেকেই জানে, নিজেকে উপলব্ধি করে, নিজের দিকে ফিরে তাকায়—সেই আত্ম-সচেতন স্পন্দনকেই বলা হয় কালী। এখানে কালী কেবল পৌরাণিক অর্থে এক ভয়ঙ্কর দেবী নন; তিনি এক গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক সত্তা। কাশ্মীর শৈবধর্মের প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনে, কালীকে পরম স্বয়ং-চেতন শক্তি হিসেবে দেখা হয়, যিনি পরম শিবের নিস্তরঙ্গ, নিরাকার দীপ্তি-রূপ চেতনার সক্রিয় প্রকাশ। এই স্বয়ং-চেতনাই (svātantrya) বিশ্বের সমস্ত কার্য নির্বাহ করেন।

অদ্বৈত কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালীকে দেখা হয় সেই পরম চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti) হিসেবে—অর্থাৎ, সেই আত্মসচেতন, স্বাধীন শক্তি যিনি চিরনিস্তরঙ্গ শিব-চেতনার অন্তর্লীন দীপ্তিকে নৃত্যে, ক্রিয়ায় ও প্রকাশে রূপ দেন। শিব নিজে হলেন নীরব আলোক, বিশুদ্ধ অস্তিত্ব (prakāśa); কিন্তু কালী সেই আলোর আত্ম-চেতনা, তাঁর vimarśa—যেখানে চেতনা নিজেকেই জানে, নিজেকেই অনুভব করে, এবং সেই আত্ম-বোধের আনন্দে মহাজাগতিক লীলায় রূপ নেয়। তাই কাশ্মীর শৈব তত্ত্ব বলে—“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ” (তন্ত্রালোক, ১.৮৭)—অর্থাৎ, শিব সর্বদা পঞ্চকৃত্যে নিযুক্ত; কিন্তু এই ক্রিয়াগুলি আসলে কালী-শক্তিরই আত্মপ্রকাশ।

শিব অচল দীপ্তি, কালী সেই দীপ্তির গতি; শিব মৌন, কালী তাঁর নৃত্য। তাই কালীকেই বলা হয় পঞ্চকৃত্য-পরায়ণা শক্তি—তিনি নিজেই সেই স্বাতন্ত্র্য-চেতনা, যিনি নিজের মধ্যে অনন্তভাবে সম্পন্ন করেন সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṃhāra), নিগ্রহ বা তিরোভাব (nigraha/tirobhāva) ও অনুগ্রহ (anugraha)। এই পাঁচ ক্রিয়া কোনো বাহ্যিক কর্ম নয়, বরং চেতনারই নিত্য স্পন্দন; কালী এই স্পন্দনেরই আদিরূপ, যিনি শিবের নীরব দীপ্তিকে ক্রিয়াশক্তিতে পরিণত করেন।

সৃষ্টির স্তরে কালী হলেন সেই মুহূর্তের মূর্ত প্রতীক, যখন চেতনা নিজের নীরব দীপ্তি থেকে নিজেকে উন্মোচন করে। তাঁর উৎস শিবের অন্তর্নিহিত নীরবতা—যেখানে কোনো গতি নেই, কোনো দ্বৈততা নেই, কেবল বিশুদ্ধ উপস্থিতি (śuddha-prakāśa)। সেই নীরব দীপ্তিতেই কালী প্রথম কম্পন তোলে; তাঁর স্বয়ংচেতনা (svasaṃvedana)-র এক সূক্ষ্ম স্পন্দন থেকেই শুরু হয় প্রকাশের ধারা। তাই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বের দৃষ্টিতে, সৃষ্টি কোনো ex nihilo বা “শূন্য থেকে কিছু উৎপন্ন হওয়া” নয়; বরং এটি চেতনার নিজেরই আত্ম-উন্মোচন। চেতনা নিজেকে জানার, অনুভব করার এবং প্রতিফলিত করার ইচ্ছাতেই জগতের আবির্ভাব ঘটে।

যেমন দীপ্তি নিজেরই অন্তর্গত শক্তিতে আলো দেয়, তার বাইরে থেকে নয়, তেমনি কালী তাঁর আনন্দময় চেতনার ছন্দে নিজেই নৃত্য শুরু করেন। এই নৃত্যই সৃষ্টি। তাঁর প্রতিটি স্পন্দন এক একটি রূপ, প্রতিটি ছন্দ এক একটি কাল বা দিকের উদ্‌ভব। কালী কোনো কিছুর উৎপত্তিকারিণী হিসেবে নয়, বরং নিজের আনন্দ-চেতনার তরঙ্গে অসংখ্য রূপে বিকশিত হন। এই রূপসমূহই আমাদের চোখে প্রকাশিত বিশ্ব—যা আসলে চেতনারই আত্মবিম্ব।

উত্পলদেব ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.৮)-এ বলেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি।” এই শ্লোকটি কাশ্মীর শৈব চিন্তায় এক মৌল তত্ত্ব স্থাপন করে: চেতনা নিজের চেতনা-রূপেই বিবর্তিত হয়; অর্থাৎ, সে নিজের থেকেই বহু রূপে প্রকাশিত হয়, এবং নিজের স্বাধীনতা (svātantrya)-র দ্বারা দ্বৈততার এক আভাস সৃষ্টি করে। এই আভাসই হচ্ছে অভিজ্ঞতার ভিত্তি—যেখানে চেতনা নিজেকে “আমি” ও “এটা” রূপে অভিজ্ঞ করে।

কালী সেই আত্মবিমর্শনশক্তি (vimarśa-śakti)—অর্থাৎ, চেতনার সেই দিক, যা নিজের অস্তিত্বকে জানে, নিজের আলোকে প্রত্যক্ষ করে, এবং সেই আত্ম-জ্ঞানেই জগৎ সৃষ্টি করে। শিবের মৌন আলোক, যাকে বলা হয় prakāśa—নিষ্ক্রিয়, অচল, বিশুদ্ধ দীপ্তি; কিন্তু সেই দীপ্তি যখন নিজের প্রতিফলনে সজীব হয়, তখনই জন্ম নেয় কালী। তিনিই সেই চেতনার অন্তর্গত স্পন্দন, যিনি এই মৌন আলোর উপর নৃত্য শুরু করেন, আর সেই নৃত্য থেকেই প্রকাশিত হয় মহাবিশ্বের সমস্ত মাত্রা।

তাঁর এই নৃত্য এক ছন্দিত আত্মপ্রকাশ—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ এক এক স্তরের উন্মোচন। প্রথম পদক্ষেপেই সময় (kāla) প্রবাহিত হয়—অসীম চেতনা যখন নিজেকে ধারাবাহিকতার আকারে অভিজ্ঞ করে। দ্বিতীয় পদক্ষেপে স্থান (deśa) জাগে—অসীম চেতনা নিজের প্রসারকে সীমারূপে উপলব্ধি করে। তৃতীয় পদক্ষেপে বস্তু (vastu) আবির্ভূত হয়—চেতনার ঘন প্রতিফলন, যেখানে অভিজ্ঞতার বীজ রূপ নেয়। এবং চতুর্থ পদক্ষেপে মন (citta) জন্ম নেয়—যেখানে সেই প্রতিফলিত রূপগুলো চেতনার অন্তর্গত পরিসরে সংগঠিত হয়ে চেতনার আনন্দের লীলায় অংশগ্রহণ করে।