এই রক্তভরা খাপ্পর তাই এক চরম সত্যের প্রতীক—মৃত্যু ও ধ্বংসই নবজীবনের মূল। এটি আমাদের স্মরণ করায়, জীবন কখনও সরলরেখা নয়, বরং চক্রাকার গতি, যেখানে শেষ মানেই আরেক শুরুর বীজ। কালী সেই চক্রের কেন্দ্রবিন্দু—যিনি অন্ধকার ও আলোর, মৃত্যু ও অমৃতের, ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্যে এক চিরন্তন সেতুবন্ধন রচনা করেন। তাই কালী একই সঙ্গে ভয়ংকর ও মুক্তিদায়িনী—তিনি আমাদের শেখান, মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করো, কারণ সেটিই জীবনের সর্বোচ্চ প্রকাশ।
বস্তুত, মহাকালী অদ্বৈত চেতনার প্রতীক—তিনি একাধারে ব্রহ্মশক্তি, বিমর্শশক্তি ও মায়াশক্তি। তাঁর কৃষ্ণ রূপ অদ্বৈতের অন্ধকার দীপ্তি—যেখানে আলো ও ছায়া, জীবন ও মৃত্যু, সৃষ্টি ও সংহার, জ্ঞান ও অজ্ঞান সব একাকার। তিনি “নিরালঙ্কার সত্য”—মায়ার অতীত, তবুও মায়ার মধ্যেই লীলা করেন। তাঁর রূপ আমাদের শেখায়, ধ্বংস কোনো ভয়ংকর প্রলয় নয়—এটি চেতনার নিজস্ব সৃজনশক্তির অংশ, যেখানে মৃত্যু মানে জাগরণ, নাশ মানে মুক্তি, আর অন্ধকার মানে ব্রহ্মের অন্তরতম দীপ্তি।
কালী কেবল এক পৌরাণিক দেবী নন, বরং এক সর্বজনীন দর্শন—অদ্বৈত বেদান্তের নির্বিশেষ ব্রহ্ম, কাশ্মীর শৈবের চিদ্বিলাস (চেতনার লীলা) ও শাক্ততত্ত্বের পরম জননী একসঙ্গে মিলে মহাকালীর রূপে প্রকাশ পেয়েছেন। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, “লয়ই সৃষ্টি, সংহারই নবজাগরণ, মৃত্যুই চেতনার মহাজাগরণ।”
মহাকালীকে “কৃষ্ণজননী” বলা হয়, এটা কোনো কাব্যিক রূপক নয়—এটি এক গভীর অধিবিদ্যক (metaphysical) সত্যের প্রতীক। এই নামটি আসলে “অন্ধকারের জননী” বা “কালো মা” বলে নয়, বরং “কৃষ্ণ” শব্দের দার্শনিক তাৎপর্যের কারণে। এখানে “কৃষ্ণ” মানে কেবল রং নয়; এটি চেতনার অতল, সর্বগ্রাহী, অবিভাজ্য ঐক্যের প্রতীক—যে-ঐক্য সমস্ত নাম-রূপকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়, কিন্তু নিজে কখনও তাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয় না।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, কৃষ্ণ বা কালো রং হল “অভেদ চেতনা”-র প্রতীক—যা সমস্ত রূপ ও বৈচিত্র্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করে, অথচ নিজে কোনো বিশেষ রূপ নয়। শঙ্করাচার্য যখন বলেন, “নিরগুণং নিরাকারে নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাবম্”—তখন এই নিরাকৃতি, নিরুপাধি চেতনারই কথা বলেন। কালো রং সমস্ত আলোককে শোষণ করে—তাই এটি প্রতীক সেই ব্রহ্মচেতনার, যিনি সমস্ত জ্ঞান, শক্তি, ভাব ও রূপকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন, কিন্তু আলাদা হয়ে থাকেন। মহাকালী সেই ব্রহ্মচেতনারই প্রকাশ, যিনি মায়ার সমস্ত আচ্ছাদন ছিন্ন করে আত্মপ্রকাশ করেন।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যায়, কৃষ্ণতা (kṛṣṇatā) মানে “অন্তর্লীন দীপ্তি”—অর্থাৎ, চেতনার এমন এক অবস্থা, যেখানে আলোক আর অন্ধকারের দ্বন্দ্ব মুছে যায়। শিব ও শক্তির যে পরম ঐক্য, সেটি কোনো উজ্জ্বল দীপ্তির নয়, বরং সেই “কালো অন্ধকার”, যেখানে চেতনা ও শূন্যতা অভিন্ন। অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেন “প্রকাশবিমর্শযোরৈক্যম্”—অর্থাৎ, আলো (প্রকাশ) ও তার আত্মবিমর্শন (বিমর্শ) যখন এক হয়ে যায়, তখন চেতনা নিজেকে চিনে “কৃষ্ণ” রূপে প্রকাশ পায়। মহাকালী তাই সেই চেতনার পরম প্রকাশ, যিনি নিজের মধ্যেই সব কিছুকে গিলে নেন—যেমন কৃষ্ণ বর্ণ সমস্ত বর্ণকে গ্রাস করে।
শাক্ত দর্শনে, তিনি “কৃষ্ণ জননী”, কারণ তিনি “কাল” বা সময়েরও জননী। কাল, অর্থাৎ সময় সমস্ত সৃষ্টি ও বিনাশের কারণ—আর কালীর নাম এসেছে সেই কাল থেকেই। তিনি মহাকালীরূপে নিজেই সময়কে সৃষ্টি করেন, পালন করেন, গ্রাস করেন। তাই তিনি কাল ও কৃষ্ণ—দুইয়েরই উৎস। কৃষ্ণ শব্দটির আদি সংস্কৃত ধাতু 'কৃষ্' (Kṛṣ) মানে টেনে নেওয়া, আকর্ষণ করা; আর “ণ” প্রত্যয়টি জ্ঞান বা চেতনার ইঙ্গিত দেয়। ফলে “কৃষ্ণ” মানে “যিনি সকলকে নিজের মধ্যে আকর্ষণ করেন”—অর্থাৎ চূড়ান্ত ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। কালী সেই আকর্ষণেরই শক্তি—তিনি সকল নাম, রূপ, গতি, ইচ্ছা, কামনা, বুদ্ধি—সব কিছুকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে এক চেতনা-অবস্থায় রূপান্তরিত করেন।
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, আধুনিক মনোবিশ্লেষণ ও দর্শনের দৃষ্টিতে “কৃষ্ণ জননী” ধারণাটি এক গভীর প্রতীকময় সত্যকে ইঙ্গিত করে। কার্ল ইয়ুং এবং তাঁর পরবর্তী বিশ্লেষকগণ এই কৃষ্ণমূর্তিকে অবচেতন মনের “unconscious mother principle” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন—অর্থাৎ, মনের সেই আদিম, সর্বগ্রাহী গর্ভযোনি, যেখানে সমস্ত দমিত অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা, ভয়, বেদনা এবং অচেনা প্রবৃত্তিগুলি আশ্রয় নেয়। এই “অন্ধকার” বা “কালো গর্ভ” কোনো ভীতিকর শূন্যতা নয়; বরং এটি মানসিক পুনর্জন্মের ক্ষেত্র, এক সৃজনশীল শূন্যতা—যেখানে পুরোনো সত্তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে নতুন চেতনার জন্ম দেয়।
ইয়ুং-এর প্রতীকমতে, অবচেতনের অন্ধকার অঞ্চলকে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং সম্মুখীন হতে হয়। এই সম্মুখীনতাই হলো রূপান্তরের সূচনা। তাই কৃষ্ণ জননী বা মহাকালী, সেই “dark womb of transformation”—যেখানে অহংকার, ভয় ও আত্মপ্রবঞ্চনার পুরোনো গঠনগুলি ভেঙে যায়, আর মনের গভীরে লুকিয়ে-থাকা বিশুদ্ধ চেতনার আলোয় এক নতুন সত্তার জন্ম হয়। এই গর্ভ অন্ধকার, কিন্তু এটি সৃজনের অন্ধকার—যেমন রাতের নিঃশব্দ গভীরতা থেকেই জন্ম নেয় ভোরের আলো।
এভাবে, মনোবিশ্লেষণ ও তন্ত্রদর্শন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। যেখানে আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলে, অবচেতনের সঙ্গে সংযোগই আত্ম-সম্পূর্ণতার পথ, সেখানে কালী সেই পথেরই প্রতীক—যিনি নিজের অন্ধকার রূপেই আমাদের শেখান, অন্ধকারকে অস্বীকার নয়, আলিঙ্গন করো; কারণ সেখানেই লুকিয়ে আছে নবজন্মের আলো।
মহাকালী কৃষ্ণ জননী—কারণ তিনি কৃষ্ণচেতনার—সেই সর্বগ্রাহী অদ্বৈত বোধের উৎস। তাঁর কৃষ্ণতা মানে চেতনার পরম গভীরতা; তাঁর মাতৃত্ব মানে সেই চেতনার থেকে উদ্ভূত সমস্ত জীব ও জগতের প্রকাশ। তিনি একাধারে সৃষ্টি ও সংহার, আলো ও অন্ধকার, ভয় ও করুণা—সব দ্বন্দ্বের পারমার্থিক ঐক্য। তাঁর অন্তর্লীন নীল দীপ্তির মধ্যেই প্রকাশিত হয় সেই পরম সত্য, যেখানে মৃত্যু, মায়া, সময়—সবই গলে যায় এক অনন্ত, কালো দীপ্তি-চেতনার মধ্যে—যা হলেন মহাকালী, কৃষ্ণ জননী, চিরশক্তির চিরস্বরূপ।
কালীর রূপতত্ত্বের প্রতিটি অঙ্গই দর্শনের এক-একটি গভীর প্রতীক। তাঁর ভঙ্গি, অলঙ্কারহীনতা, সহচরী এবং পরিবেশ কেবল তান্ত্রিক কল্পচিত্র নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত প্রক্রিয়াগুলির দৃশ্যরূপ। অদ্বৈত বেদান্ত, কাশ্মীর শৈব এবং শাক্ত দর্শনের সমন্বিত আলোকে এই প্রতীকগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—কালীর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি মানুষের অন্তর্গত আত্মজাগরণের ক্রমিক স্তর প্রকাশ করছে; ভয়, মায়া, সংস্কার, কর্ম এবং চেতনার মুক্তি—সব একে অপরের সঙ্গে একধারায় জড়িয়ে আছে।
কালীর ভঙ্গি (মুদ্রা) তাঁর সমগ্র তত্ত্বের এক জীবন্ত প্রতিমা—একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর ও স্নিগ্ধ, রুদ্র ও করুণাময়, সংহারিণী ও মাতৃস্বরূপা। তাঁর দেহভঙ্গি যখন ভৈরবী, চোখ উন্মত্ত, কেশ উড়ন্ত, এবং সারা দেহে অগ্নিসদৃশ উত্তাপের প্রকাশ—তখন মনে হয়, যেন সৃষ্টির সমস্ত স্থবিরতা, সমস্ত অবচেতন জড়তা, সমস্ত মায়াবদ্ধ অজ্ঞানকে তিনি ছিন্ন করতে উদ্যত। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর তেজের মধ্যেই তাঁর মুখে এক মৃদু হাস্য—যা সৃষ্টির সর্বাধিক রহস্যময় সৌন্দর্য প্রকাশ করে। এই দ্বৈত প্রকাশের মধ্যেই নিহিত আছে অদ্বৈত তত্ত্বের গভীর শিক্ষা—ধ্বংস আর সৃষ্টি, রুদ্রতা আর করুণা, ভয় আর আনন্দ—সবই এক পরম চেতনার দুটি তরঙ্গ মাত্র।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, কালীর এই ভৈরবী রূপ অজ্ঞান ও মায়ার বিনাশের প্রতীক। তাঁর “ভয়ঙ্করতা” মানে মায়ার পর্দা ছিঁড়ে ফেলা—যেখানে চেতনা নিজেকে সীমাবদ্ধ পরিচয় থেকে মুক্ত করে “আমি ব্রহ্ম” উপলব্ধিতে জাগে। তাই তিনি ভয়ঙ্কর, কারণ তিনি বিভ্রম ভেঙে দেন; আবার করুণাময়, কারণ সেই ভাঙনের মধ্যেই মুক্তি নিহিত। তাঁর মৃদু হাস্য এই গভীর করুণার প্রতীক—যা জানায়, সংহারও আসলে ঈশ্বরের লীলা, মায়ার পরিসমাপ্তির আনন্দ।
এই শ্লোকটি—“দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ। ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোঽক্ষর উচ্যতে।।” (ভগবদ্গীতা, ১৫.১৬)—অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব উভয় দর্শনের এক গভীর অধিবিদ্যক সূত্রকে প্রকাশ করে। কৃষ্ণ এখানে যে দুটি “পুরুষ”-এর কথা বলছেন—ক্ষর এবং অক্ষর—তা আসলে এক চেতনার দুই রূপ, দুই দিক, দুই ভঙ্গি।
ক্ষর পুরুষ, অর্থাৎ পরিবর্তনশীল, বিকারগ্রস্ত, মায়াবদ্ধ জীবসত্তা। “সর্বাণি ভূতানি”—সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ, পৃথিবী, জল, অগ্নি, আকাশ—এই সমস্তই ক্ষররূপ, কারণ তারা জন্মে, বৃদ্ধি পায়, ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং বিলীন হয়। এই ক্ষরই প্রকৃতির গতিশীল দিক—চেতনা যখন মায়ার সংস্পর্শে আসে, তখন সে রূপ ধারণ করে, সীমাবদ্ধ হয়, কর্মে যুক্ত হয়। তাই ক্ষর মানে সীমিত আত্মবোধ—যা নিজের ভিতরে ব্রহ্মসত্তাকে ভুলে বাহ্যিক নাম ও রূপের আসক্তিতে জড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে অক্ষর পুরুষ হলেন সেই “কূটস্থ”—অপরিবর্তনীয়, স্থিত, নির্লিপ্ত চেতনা, যিনি সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যেও অচঞ্চল ও শুদ্ধ থেকে যান। “কূটস্থ” শব্দের অর্থ—যাঁকে নাড়ানো যায় না, যিনি আগুনে পোড়েন না, সময়ে ক্ষয় হন না। শঙ্করাচার্যের ভাষ্যে তিনি সেই আত্মা, যিনি সমস্ত ক্রিয়ার সাক্ষী—যিনি করেন না, কেবল দেখেন। এই অক্ষর পুরুষই সত্যিকার আত্মা—চেতনার অপরিবর্তিত স্তর, যা চিরস্থায়ী ও সর্বব্যাপী।
অদ্বৈত বেদান্ত বলে—ক্ষর ও অক্ষর উভয়ই এক ব্রহ্মের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ক্ষর হল ব্রহ্মের মায়াবৃত অবস্থা, যেখানে চেতনা নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্ন ভাবে। আর অক্ষর হল সেই একই ব্রহ্ম, যিনি মায়া অতিক্রম করে নিজের শুদ্ধ চৈতন্যরূপে প্রতিষ্ঠিত। এই দুইয়েরও পরেই আছেন “পুরুষোত্তম”—যিনি ক্ষর ও অক্ষর উভয়েরও উৎস। তিনি একাধারে কর্ম ও নিষ্ক্রিয়তার, গতি ও স্থিতির, মায়া ও চেতনার ঐক্য। সৃষ্টির স্তরে তিনি ক্ষর; আত্মার স্তরে তিনি অক্ষর; আর সত্যের স্তরে তিনি উভয়েরই অতীত—নির্বিশেষ ব্রহ্ম।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে একই তত্ত্ব প্রকাশিত হয় “প্রকাশ” ও “বিমর্শ”-এর ঐক্যে। “ক্ষর” পুরুষ হল শক্তি—চলমান, রূপান্তরমুখী, স্পন্দিত; আর “অক্ষর” পুরুষ হল শিব—চিরস্থিত, অচল, নিস্তরঙ্গ চেতনা। কিন্তু শৈব-মতে এরা আলাদা নন। যেমন শিব ছাড়া শক্তি অচল, তেমনি শক্তি ছাড়া শিব নিষ্প্রাণ। অভিনবগুপ্ত এই সম্পর্ককে বলেন—“প্রকাশবিমর্শযোরৈক্যম্ ঈশ্বরঃ”—অর্থাৎ, শিবের স্থির আলোক ও শক্তির গতিশীল স্ববিমর্শ যখন একত্রে মিলিত হয়, তখনই ঈশ্বর বা চেতনার পূর্ণতা প্রকাশিত হয়। ক্ষর ও অক্ষর তাই দুই বিপরীত নয়—দুই দিক, যেমন তরঙ্গ আর সমুদ্র একে অপরের অভিন্ন প্রকাশ।
মনস্তাত্ত্বিক স্তরে, এই শ্লোক মানুষের ভিতরকার দুই অবস্থার কথাও বলে। “ক্ষর” মানে আমাদের পরিবর্তনশীল মন, অনুভূতি, চিন্তা, ভয়, কামনা—যা প্রতিক্ষণ রূপান্তরিত হয়। আর “অক্ষর” মানে সেই গভীর অন্তর্নিহিত চেতনা, যে নিরীক্ষক—যে সবকিছু দেখে, অনুভব করে, কিন্তু প্রভাবিত হয় না। আধুনিক মনোবিশ্লেষণ যাকে বলে “the observing self” বা “witness consciousness”—গীতা সেই তত্ত্বই প্রকাশ করেছে সহস্র বছর আগে। মানুষের মুক্তি আসে তখনই, যখন সে নিজের ক্ষর অংশ—মন, দেহ, ইন্দ্রিয়, কামনা—অতিক্রম করে নিজের অক্ষর স্বরূপ, অর্থাৎ, শুদ্ধ আত্মচেতনা উপলব্ধি করে।
এই দুই পুরুষের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ আসলে এক চিরন্তন সত্য ঘোষণা করেছেন—সৃষ্টি ও লয়, জীবন ও মৃত্যু, পরিবর্তন ও স্থিতি—সব এক চেতনার খেলা। ক্ষর মানে প্রকাশ, অক্ষর মানে অন্তর্লীনতা; দুটোই এক ঈশ্বরচেতনার দুই দিক। তাই তিনি শেষে বলেন—“উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ। যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।।” (ভগবদ্গীতা, ১৫.১৭)—যা গীতার পুরুষোত্তম যোগ-এর চূড়ান্ত পরিণতি, যেখানে কৃষ্ণ পূর্ববর্তী শ্লোকে উল্লিখিত “ক্ষর” ও “অক্ষর”—এই দুই পুরুষের সীমাকে অতিক্রম করে এক তৃতীয়, সর্বোচ্চ চেতনার কথা ঘোষণা করছেন—“উত্তম পুরুষ” বা পরমাত্মা।