শৈব কালী: ষোলো


অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এই “চলনাচলনাত্মা” ধারণা ব্রহ্মের মায়াশক্তি-র সমতুল্য—যেখানে অপরিবর্তনীয় ব্রহ্ম নিজের আনন্দে জগতরূপে প্রকাশিত হন, অথচ নিজে কখনো পরিবর্তিত হন না। শঙ্করাচার্য যেমন বলেন—“ব্রহ্ম সত্যম্‌, জগন্মিথ্যা”—এখানে “মিথ্যা” মানে অস্থিত নয়, বরং আপেক্ষিক, পরিবর্তনশীল। শিবচেতনার “চলনাচলনাত্মা” ভাবটিও সেই একই সত্য প্রকাশ করে—জগত পরিবর্তনশীল, কিন্তু যার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে, সেই চেতনা অপরিবর্তনীয়।

অভিনবগুপ্তের মতে, এই দুই অবস্থার মিলনই স্পন্দ—যেখানে চেতনা নিজেকে জানে, নিজেকে অনুভব করে, নিজেকে প্রকাশ করে। স্থিরতা হলো তার আত্মস্বরূপ, আর গতি হলো তার আত্মপ্রকাশ। তাই তিনি বলেন—“চেতনা যদি নিস্পন্দ হতো, তবে তা জড় হতো; কিন্তু চেতনা নিজেকে জানে, তাই সে সর্বদা স্পন্দিত।”

“চলনাচলনাত্মা” কোনো দ্বন্দ্ব নয়—এটি চেতনার চূড়ান্ত ঐক্য। এখানে শিবের নীরবতা কালী-রূপে নৃত্যে পরিণত হয়েছে, আর কালী-র নৃত্য সেই নীরবতারই ছন্দ। নীরবতা ও নৃত্য, স্থিতি ও গতি—দুটিই একই চেতনার দুই দিক।

যখন সাধক এই সত্য উপলব্ধি করেন, তখন তাঁর ভেতরে গভীর নীরবতা ও প্রবাহমান জীবন একসঙ্গে জেগে ওঠে। তখন সে বুঝে যায়—চেতনা কখনো থামে না, আবার কখনো এগিয়েও যায় না; সে সর্বদা নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ, নিজের আনন্দেই প্রবাহিত। এই আত্ম-প্রবাহিত, আত্ম-উজ্জ্বল, স্থির গতি—এই-ই শিবের প্রকৃত রূপ—চলনাচলনাত্মা শিবঃ।

যখন মানুষ এই অন্তর্লীন স্পন্দন অনুভব করতে পারে, তখন সে বুঝে যায়—প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি অনুভূতি, এমনকি শূন্যতার অনুভূতিও চেতনার এক আত্ম-কম্পন। এই উপলব্ধির মুহূর্তে দ্বৈততা বিলীন হয়ে যায়; তখন “আমি” ও “বিশ্ব”, “জীব” ও “ঈশ্বর”, “চিন্তা” ও “নীরবতা”—সব এক হয়ে যায়।

অভিনবগুপ্ত এই মুক্তিকে বলেন আত্ম-স্পন্দ উপলব্ধি (ātma-spanda-upalabdhi)—যেখানে সাধক উপলব্ধি করেন, “আমি কেবল এই দেহ বা মন নই; আমি সেই চেতনা, যার প্রতিটি নাড়নেই মহাবিশ্ব নাচছে।” মুক্তি তখন আর কোনো দূর লক্ষ্য নয়, এটি বর্তমান মুহূর্তেই ঘটে, কারণ চেতনা কখনো দূরে ছিল না—সে সর্বদা নিজের মধ্যেই নৃত্য করছে।

এইভাবেই স্পন্দ নির্ণয় শুধু একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা নয়, এটি এক অভিজ্ঞতামূলক অধিবিদ্যা (experiential metaphysics)—যেখানে মুক্তি মানে অন্য কোনো জগতে পৌঁছানো নয়, বরং নিজের হৃদয়ের সেই অনন্ত স্পন্দনকে অনুভব করা। যখন সাধক সত্যিই বুঝতে পারেন—“আমি সেই স্পন্দনই”—তখন তাঁর কাছে সব সীমা, সময়, ভয় ও মৃত্যু বিলীন হয়ে যায়।

তখন চেতনা নিজের মধ্যেই জেগে থাকে, আর সেই আত্মজাগরণের নীরবতাই পরিণত হয় মহাবিশ্বের সঙ্গীতে। এই সঙ্গীতের নামই “স্পন্দ”—শিবের চিরন্তন হৃদস্পন্দন—যা সব কিছুকে জাগিয়ে রাখে, সব কিছুর মধ্যে প্রবাহিত হয়, এবং যার অনন্ত নৃত্যের ছন্দেই প্রকাশিত হয়েছে এই বিশ্ব।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায় পরম শিব (Parama Śiva) হলেন এমন এক চূড়ান্ত বাস্তবতা, যিনি একইসাথে নিস্তব্ধ ও স্পন্দিত, নীরব তবু সজীব, অচল কিন্তু তবুও চলমান। তিনি কোনো ব্যক্তিগত দেবতা নন, যিনি রূপ বা পূজার আকারে সীমাবদ্ধ; তিনি সেই অদ্বিতীয় চেতনা, যার ভেতরেই সমস্ত অস্তিত্ব, জ্ঞান ও শক্তি একাকার হয়ে আছে।

অভিনবগুপ্ত ও ক্ষেমরাজ এই পরম শিবকে ব্যাখ্যা করেছেন এমন এক চেতনা হিসেবে, যিনি স্বয়ং-উজ্জ্বল (svayam-prakāśa)—নিজের আলোয়ই জাগ্রত, এবং স্বয়ং-সচেতন (svayam-vimarśa)—নিজেরই অস্তিত্বকে জানেন। তাঁর কোনো বাহ্য কারণ নেই, কারণ তিনিই কারণের কারণ। তিনি স্বয়ং-সিদ্ধ (svataḥ-siddha)—নিজেই নিজের প্রমাণ, নিজেরই ভিত্তি। এই স্বয়ংজাগ্রত দীপ্তির মধ্যেই নিহিত আছে তাঁর স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya) বা পরম স্বাধীনতা, যার ফলে তিনিই নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টি করেন, স্থিত করেন, লয় ঘটান, আচ্ছাদন করেন এবং অনুগ্রহ করেন—এই পাঁচ ক্রিয়া (pañca-kṛtya) পরম শিবের স্বাভাবিক ছন্দ।

এই চেতনা তাই কখনো স্থবির নয়; তিনি চিরজাগ্রত, কিন্তু সেই জাগরণ কোনো বাহ্যিক আন্দোলন নয়। তাঁর “গতি” স্থানান্তর নয়, বরং তাঁর নিজস্ব অন্তর্লীন জীবন্ততা (inner aliveness)। এজন্যই তাঁকে বলা হয় স্পন্দতত্ত্ব (Spanda-tattva)—অর্থাৎ এমন চেতনা, যার নীরবতাও স্পন্দিত, যার স্থিরতাও সজীব। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ ঘোষণা করেন—“ন হি শিবো নাভভেত্‌ স্পন্দাত্মা।”—“শিব কখনোই স্পন্দনহীন নন।” অর্থাৎ, তাঁর নীরবতাই জীবনের উৎস; তাঁর ভেতরেই সমস্ত গতির সম্ভাবনা, সমস্ত সময়, রূপ, চিন্তা ও অভিজ্ঞতা চিরনিদ্রিত অবস্থায় থাকে—যেমন বীজের মধ্যে সম্পূর্ণ বৃক্ষ নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকে।

এই পরম শিবের দুটি চিরসহচর দিক রয়েছে—প্রকাশ (Prakāśa) ও বিমর্শ (Vimarśa)। প্রকাশ মানে তাঁর উজ্জ্বল দীপ্তি, যার আলোয় সব কিছু জানা যায়, আর বিমর্শ মানে সেই দীপ্তির নিজের প্রতি সচেতনতা—“আমি আছি”, “আমি জানি”, “আমি চিরন্তন।” প্রকাশ ছাড়া বিমর্শ অন্ধ, আর বিমর্শ ছাড়া প্রকাশ নিস্তরঙ্গ। এই দুইয়ের ঐক্যেই জন্ম নেয় জীবন্ত চেতনা—যা একইসঙ্গে জানা ও জ্ঞাত, জ্যোতি ও জ্ঞান।

শিব কোনো একপাক্ষিক নীরব অস্তিত্ব নন; তিনি এক অদ্বয় বাস্তবতা (nondual reality)—যেখানে চেতনা ও তার প্রকাশ, শিব ও শক্তি, স্থিরতা ও গতি—সব একাকার। শক্তি শিব থেকে আলাদা নয়; তিনি নিজেই শক্তিরূপে প্রকাশিত হন। যেমন সূর্যের আলো সূর্য থেকে আলাদা নয়, বরং সূর্যেরই স্বাভাবিক বিকিরণ—তেমনি শক্তি শিবেরই স্বরূপ, তাঁরই স্পন্দন।

এই ঐক্যের অভিজ্ঞতাই ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা (১.৫.৮)-এ প্রকাশিত—“চিদানন্দোঽহম্‌, চিদানন্দো ভগবান্‌।”—“আমি চিদানন্দ—চেতনা ও আনন্দের ঐক্য, এবং ভগবানও সেই চিদানন্দ।”

এখানে “আমি” ও “ভগবান” আলাদা কোনো সত্তা নয়; তারা একই চেতনার দুই প্রতিফলন। সাধক যখন নিজের মধ্যে এই “চিদানন্দ” অনুভব করেন, তখন তাঁর উপলব্ধি হয়—“আমি শিব”—শিবোহম্‌। এই অবস্থায় জানা যায়, চেতনা ও ঈশ্বর, ব্যক্তি ও পরম—সবই এক।

অভিনবগুপ্ত বলেন, পরম শিব হলেন আনন্দ-সংবিত্‌-ঘন (ānanda-saṁvit-ghana)—এক পরম আনন্দময় চেতনার ঘনসত্তা, যেখানে সব ভেদ, সব নাম, সব রূপ মিশে গেছে। তিনি সময় ও স্থানের সীমা অতিক্রম করেও সব কিছুর মধ্যে বিরাজ করেন—যেমন আকাশ নিজে সীমাহীন, অথচ সর্বত্র উপস্থিত।

এই উপলব্ধিই কাশ্মীর শৈব দর্শনের চূড়ান্ত জ্ঞান—যেখানে দেখা যায়, শিব ও জগৎ, নীরবতা ও স্পন্দন, আত্মা ও ঈশ্বর—সব এক এবং অভিন্ন। শিবই সেই পরম চেতনা, যিনি নিজের মধ্যে নিজের আনন্দে চিরন্তনভাবে জেগে আছেন। এই চেতনার নামই পরম শিব—চলনাচলনাত্মা, যিনি একইসঙ্গে নিস্তব্ধ ও স্পন্দমান, এক নীরব নৃত্যরূপে বিশ্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

স্পন্দকারিকা-র প্রথম সূত্রটি—“চিত্তসত্তাসত্ত্বাত্‌ সর্বমিদং স্পন্দতে”—কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমগ্র তত্ত্বতন্ত্রের এক জীবন্ত কেন্দ্রবিন্দু। এর অর্থ, “চেতনার অস্তিত্বের কারণেই সব কিছু স্পন্দিত”—অর্থাৎ, এই জগৎ নিজে থেকে চলে না; প্রতিটি গতি, প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি অভিজ্ঞতা আসলে চেতনারই অন্তর্লীন নাড়নের প্রকাশ। এখানে “চিত্তসত্তা” বলতে বোঝানো হয়েছে পরম চৈতন্য—যা সমস্ত অস্তিত্বের ভিতরকার প্রাণ, যা নিজের উপস্থিতির মাধ্যমেই জগৎকে জাগিয়ে রাখে। যেমন হৃদস্পন্দনই শরীরের জীবনচিহ্ন, তেমনি “স্পন্দ” চেতনার জীবনচিহ্ন—চেতনা জেগে থাকলেই বিশ্ব জেগে থাকে।

Self-reflexive awareness বা স্বপ্রত্যবমর্শ (svapratyavamarśa) কাশ্মীর শৈব দর্শনে চেতনার সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও গভীর বৈশিষ্ট্য। সহজভাবে বললে, এটি এমন এক সচেতনতার স্তর, যেখানে চেতনা শুধু জানেই না, সে জানেও যে, সে জানে।

অর্থাৎ, সাধারণ জ্ঞানে আমরা কোনো কিছু “জানি”—যেমন, “আমি ফুল দেখছি”, “আমি শব্দ শুনছি”—কিন্তু self-reflexive awareness-এ সেই “আমি” নিজেকেই জেনে ফেলে, যেন আলো নিজেরই দীপ্তি অনুভব করে। উৎপলদেব এই ধারণাকে প্রথম সুসংহতভাবে প্রকাশ করেন ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা-য়, যেখানে তিনি বলেন—“অহং চিদানন্দঘনঃ”—আমি সেই চেতনা-আনন্দ-ঘন সত্তা। এখানে “অহং” মানে ব্যক্তিগত ‘আমি’ নয়, বরং সেই আত্ম-চেতনা, যা নিজের উপস্থিতিকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে।

অভিনবগুপ্ত এই তত্ত্বকে আরও বিশ্লেষণ করে স্পন্দ-বিবৃতি-তে বলেন—“স্পন্দঃ নাম স্বপ্রত্যবমর্শলক্ষণঃ চিদিচ্ছাশক্তির ঈষৎ চলনঃ।” অর্থাৎ, “স্পন্দ” হলো চেতনার সেই সূক্ষ্ম গতি, যেখানে সে নিজের দিকেই ফিরে তাকায়—নিজের অস্তিত্বকে নিজেই প্রত্যক্ষ করে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে—যেমন একটি আয়না অন্য বস্তুকে প্রতিফলিত করে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজেকেও প্রতিফলিত করে। সেই নিজেরই প্রতিফলন দেখা—এই মুহূর্তই self-reflexive awareness। চেতনা জানে, “আমি জানি”—এই জ্ঞানই তার নিজস্ব দীপ্তি, তার স্বাতন্ত্র্য।

অদ্বৈত বেদান্তেও এর মিল পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.২৩)-এ বলা হয়েছে—“আত্মা বেদ্যং না, দ্রষ্টা হি”—আত্মাকে কেউ জানে না; আত্মাই দ্রষ্টা। অর্থাৎ, আত্মা নিজেই সেই চেতনা, যা নিজের জ্ঞানস্বরূপে জেগে থাকে।

এই “self-reflexive awareness”-এর মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, চেতনা কখনও নিষ্প্রাণ বা স্থবির নয়। সে যেমন সব কিছুকে জানে, তেমনি নিজেরই উপস্থিতিকে অনুভব করে। তাই কাশ্মীর শৈব দর্শনে শিবকে বলা হয়—“চলনাচলনাত্মা”—একই সঙ্গে স্থির ও গতিময়।

শেষপর্যন্ত, এই self-reflexive awareness-এর উপলব্ধিই মুক্তির অভিজ্ঞতা—যখন মানুষ উপলব্ধি করে, “আমি সেই চেতনা, যা জানে এবং নিজের জ্ঞানকেই জানে।” এই জাগরণেই দ্বৈততা লুপ্ত হয়ে যায়, আর চেতনা নিজেকে নিজের মধ্যেই চিনে ফেলে—যাকে কাশ্মীর শৈব দর্শন বলে প্রত্যভিজ্ঞা, আর অদ্বৈত বেদান্ত বলে আত্ম-সাক্ষাত্কার।

এই “স্বপ্রত্যবমর্শ” (self-reflexive awareness)-ই কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূল উপলব্ধি—চেতনা কেবল আলো নয়, সে নিজেই জানে যে, সে আলো। যেমন একটি প্রদীপ অন্যকে আলোকিত করার পাশাপাশি নিজেকেও আলোকিত করে, তেমনি চেতনা নিজেরই অস্তিত্বকে অনুভব করে, নিজেরই মধ্যে জেগে থাকে। এই আত্ম-সচেতন আলোকিত হওয়াই “স্পন্দ”—চেতনার নিজের মধ্যে নিজেকে দেখা, নিজের আলোয় নিজেরই প্রতিফলন ধরা পড়া।

অভিনবগুপ্ত বলেন, এই আত্ম-প্রতিফলনই শিবের প্রথম লীলা। শিব বাইরে কিছু সৃষ্টি করছেন না; বরং নিজের আনন্দে নিজের মধ্যেই কম্পিত হচ্ছেন। এই সূক্ষ্ম কম্পনই পরবর্তীতে সৃষ্টির প্রথম সম্ভাবনা—কারণ যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে আন্দোলিত হয়, সেখানেই রূপ, ধ্বনি, কাল, ও স্থানরূপে জগতের প্রতিভাস শুরু হয়।

যেমন নিস্তব্ধ জলাশয়ে হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় ঢেউ ওঠে, তেমনি পরম নীরব চেতনা নিজের আনন্দে তরঙ্গায়িত হয়—এই তরঙ্গই স্পন্দ। এই স্পন্দ থেকেই সব গতি, সব প্রাণ, সব অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই গতি স্থানান্তর নয়; এটি চেতনার অন্তর্লীন সচেতনতা—নড়ে, অথচ নড়ে না; জাগে, অথচ স্থির থাকে।

স্পন্দকারিকা-র এই প্রথম সূত্র আসলে ঘোষণা করছে—জগৎ কোনো জড় প্রপঞ্চ নয়; এটি চেতনার নৃত্য। প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভূতি—সবই চেতনারই আত্ম-স্পন্দন। চেতনা নিস্পন্দ হলে, বিশ্বও নিস্তেজ; আর চেতনা জেগে থাকলেই বিশ্ব প্রাণে ভরে ওঠে। এভাবেই, “চিত্তসত্তাসত্ত্বাত্‌ সর্বমিদং স্পন্দতে”—এই একটি সূত্রের মধ্যেই নিহিত আছে সমগ্র স্পন্দতত্ত্ব-এর সারাংশ—চেতনা নীরব নয়; সে নিজের মধ্যেই নাচে, আর সেই নৃত্যই মহাবিশ্ব।

এই নাচ কোনো বাহ্যিক ক্রিয়া নয়; এটি প্রকাশ (prakāśa) ও বিমর্শ (vimarśa)-র অন্তর্গত সমন্বয়। প্রকাশ হলো চেতনার স্ব-আলোকিত স্বরূপ—যা সব কিছু উদ্ভাসিত করে, আর বিমর্শ হলো সেই আলোর নিজের প্রতি প্রত্যাবর্তন, নিজেরই সজাগ সচেতনতা।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ বলেন—“প্রকাশবিমর্শাত্মা শিবঃ”—অর্থাৎ, শিব সেই চেতনা, যিনি একাধারে দীপ্তি ও আত্ম-সচেতনতা। যদি প্রকাশ থাকে, কিন্তু বিমর্শ না থাকে, তবে তা জড়, কারণ সেই আলো নিজের অস্তিত্ব জানে না; আর যদি বিমর্শ থাকে, কিন্তু প্রকাশ না থাকে, তবে কোনো কিছু প্রকাশই ঘটবে না। এই দুইয়ের মিলেই চেতনা জীবন্ত—এবং এই জীবন্ত চেতনার অন্তর্লয়িত ছন্দই স্পন্দন।