শৈব কালী: বিয়াল্লিশ



কাশ্মীর শৈব দর্শনের মতে, এই রক্তাভ দৃষ্টি হলো Vimarśa Śakti-র বহিঃপ্রকাশ। শিবচেতনা নিস্তরঙ্গ; কিন্তু যখন সেই চেতনা নিজের অস্তিত্বে স্পন্দিত হয়, তখন তার চোখের মধ্যে জন্ম নেয় আত্মবোধের আগুন। অভিনবগুপ্ত বলেন, “দৃষ্টি হি বিমর্শঃ”—দৃষ্টি মানে বিমর্শ, আত্মচিন্তা। তাই কালীর চোখ চেতনায় রূপান্তরিত আগুন—যেখানে দেখা মানে সৃষ্টি করা। তাঁর চোখ রক্তাভ, কারণ বিমর্শে উত্থিত চেতনা উগ্র; এটি নির্লিপ্ত নয়, সজাগ, সচল, প্রজ্জ্বলিত। এই দৃষ্টি চেতনার সেই পর্যায়কে বোঝায়, যেখানে অভ্যন্তরীণ বোধ বহির্জগতকে আলোকিত করে।

শাক্ত দর্শনে রক্তাভ চোখ “জ্ঞানশক্তি” ও “ক্রিয়াশক্তি”-র সমবাহক। দুটি চোখ জ্ঞান ও ক্রিয়ার যুগলশক্তি—এক চোখ বোধের দীপ্তি, আর অন্য চোখ কার্যরূপ প্রকাশের প্রতীক। তৃতীয় নেত্র তাঁদের ঐক্য—চেতনার মধ্যবর্তী বিন্দু, যেখানে জ্ঞান ও ক্রিয়া একই শক্তির দুই দিক হিসেবে মিলিত হয়। তাই কালীর রক্তাভ তিন চোখ চেতনার পূর্ণতা নির্দেশ করে—বোধ, কর্ম ও ঐক্যের তিন স্তরে শক্তির জাগরণ।

মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, কালীর রক্তাভ চোখ সেই মুহূর্তের প্রতীক, যখন মানুষ নিজের অবচেতন অন্ধকারকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করে। এই দেখা মানে আত্ম-সচেতনতা; এটি Insight—যেখানে মন আর বাইরের জগৎ নয়, নিজের অন্তরকে আলোকিত করে। এই রক্তাভ দৃষ্টি তাই মানুষের আত্মবিকাশের প্রতীক—যখন জড়তা, অজ্ঞান ও ভয়কে জাগরণের আগুনে রূপান্তর করা হয়। এই চোখে রক্ত আছে, কারণ আত্মজাগরণের পথ সর্বদা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়; কিন্তু সেই যন্ত্রণা পরিশুদ্ধির, অগ্নিশুদ্ধির মতো, যা মনকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে।

কালীর রক্তাভ চোখ হলো সেই চেতনার জ্যোতি, যা অজ্ঞতার ঘুম ভেঙে দেয়। তাঁর চোখে যেমন আগুন আছে, তেমনি করুণাও আছে; সেই আগুন জগৎকে পোড়ায় না, জাগায়। এটি আত্মার ভেতরের দীপ্তি—“প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম”—ব্রহ্মই চেতনা, আর চেতনা জাগ্রত হলে রক্তিম আগুনের মতো দীপ্ত হয়। কালীর দৃষ্টি তাই ধ্বংসের নয়, জাগরণের—যে-দৃষ্টিতে দেখা মানে জানা, জানা মানে রূপান্তর, আর রূপান্তর মানে মুক্তি।

কালীর রক্তদশন বা রক্তরঞ্জিত দাঁত তাঁর রূপের অন্যতম ভয়াবহ কিন্তু গভীরতম প্রতীক—যা মায়া, সংস্কার ও অহংকারের দহনশক্তিকে প্রকাশ করে। তাঁর দাঁত রক্তে রঞ্জিত, কারণ তিনি জীবনের সমস্ত ভয়, আসক্তি ও অবিদ্যা—এই মায়াবদ্ধতার প্রতীকী দেহকে গ্রাস করেছেন। এই গ্রাস কোনো হিংসা নয়; এটি চেতনার অগ্নিকর্ম—যেখানে অবচেতন, অজ্ঞান ও অতীত সংস্কারের বন্ধনগুলি দহন হয়ে মুক্ত চেতনার দীপ্তিতে রূপান্তরিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই রক্তদশন হলো অবিদ্যা-ভক্ষণ-এর প্রতীক। মায়া আমাদের চেতনার উপর যে-পর্দা ফেলেছে, কালী সেই পর্দাকে ছিঁড়ে ফেলেন এবং দাঁতের দংশনশক্তি সেই ছেদনকার্যই বোঝায়। শঙ্করাচার্য বলেন, “অবিদ্যা নাশনং জ্ঞানম্”—জ্ঞানই মায়ার বিনাশ। কালী যখন তাঁর রক্তদন্তে এই মায়ার পর্দা চিবিয়ে ছেদন করেন, তখন তিনি আসলে চেতনার মধ্যে জমে থাকা সমস্ত ভ্রান্তি, পরিচয় ও সীমাবদ্ধতাকে গলিয়ে দেন। তাঁর এই রক্তদশন তাই আত্মজ্ঞান লাভের পথের প্রতীক, যেখানে অহংকার ভেঙে যায়, কিন্তু আত্মার দীপ্তি টিকে থাকে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, এই রক্তদশন বিমর্শশক্তি-র উগ্র রূপ—চেতনার অন্তর্নিহিত অগ্নিশক্তি, যা স্থবিরতা ও আচ্ছাদন ছিন্ন করে। শিবচেতনা নিস্তব্ধ, কিন্তু যখন শক্তি সেই স্থিত চেতনাকে আন্দোলিত করে, তখন চেতনা নিজের অন্ধকার দিককে গ্রাস করে জ্যোতিতে রূপান্তরিত করে। অভিনবগুপ্ত বলেন, “চিদ্রূপায়া শক্তির্ভক্ষণে মোক্ষঃ”—চেতনা যখন নিজের অন্ধকারকে ভক্ষণ করে, তখনই মুক্তি আসে। কালীর রক্তদাঁত সেই ভক্ষণশক্তির প্রতীক, যা সমস্ত অজ্ঞান ও জড়তাকে গ্রাস করে চেতনাকে নিজের মুক্ত রূপে প্রকাশ করে।

শাক্ত দর্শনে রক্তদশন মানে সংস্কারদহনশক্তি—দেবী-শক্তির সেই উগ্র দিক, যা অতীত কর্ম, আসক্তি, ভয় এবং দমন করা কামনাগুলিকে দগ্ধ করে পরিশুদ্ধ করে তোলে। কালী এভাবে আত্মার চিকিৎসক—তিনি অমৃত দেন না, আগে বিষ দহন করেন। তাঁর দাঁত তাই রক্তরঞ্জিত, কারণ তিনি জীবের দুঃখ, পাপ, ভয়, আর জড়তার রক্ত পান করেছেন। এই রক্ত পান মানে ত্যাগ নয়, বরং রূপান্তর—তিনি দুঃখকেও শক্তিতে রূপান্তরিত করেন।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে, কালীর রক্তদশন মানুষের মানসিক শুদ্ধির প্রতীক। মনের গভীরে জমে থাকা “সংস্কার”—অর্থাৎ দমিত স্মৃতি, অভ্যাস, আকাঙ্ক্ষা ও অপরাধবোধ—এসবই মানুষের চেতনাকে ভারাক্রান্ত করে রাখে। কালী সেই অবচেতন স্তরে প্রবেশ করেন, এই দমনকৃত শক্তিগুলিকে গ্রাস করে তাঁদের আলোয় রূপান্তরিত করেন। তাঁর দাঁতের দহন মানে সেই প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ নিজের অতীতকে স্বীকার করে, ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং আত্মবোধের আগুনে সব দুঃখ ও বন্ধনকে পুড়িয়ে মুক্ত হয়।

কালীর রক্তদশন কোনো ভয়ংকর বিকৃতি নয়; এটি আত্মশুদ্ধির প্রতীক, মায়া ও সংস্কারের দহনরূপী আগুন। এই দাঁতের রক্ত মানে দুঃখের অবশেষ, যা দগ্ধ হয়ে এখন জ্ঞানের আলোতে পরিণত হয়েছে। কালী সেই চেতনার রূপ, যিনি গ্রাস করেন মায়াকে, দহন করেন অজ্ঞানকে এবং রক্তের রঙে অমৃতের দীপ্তি সৃষ্টি করেন। তাঁর রক্তদশন আমাদের শেখায়—অন্ধকারকে ভয় কোরো না, তাকে গ্রহণ করো; কারণ সেই অন্ধকারই তোমার ভিতরের আগুনকে জাগিয়ে তুলবে।

কালীর ত্রিনেত্র তাঁর চেতনার সর্বজ্ঞ দীপ্তির প্রতীক। এই তিন চোখ কোনো অলৌকিক বৈশিষ্ট্য নয়; এটি সময়, জ্ঞান ও চেতনার ত্রিমাত্রিক ঐক্যের গভীর দর্শনকে প্রকাশ করে। তাঁর তিনটি চোখ—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক; কিন্তু এর অন্তর্গত অর্থ হল—সময়ের সীমা অতিক্রম করে একক চেতনার চিরবর্তমান উপস্থিতি।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, কালীর ত্রিনেত্র “তুরীয় চেতনা”-র চিত্র। মানুষ সাধারণত তিন অবস্থায় থাকে—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। কিন্তু ব্রহ্মচেতনা এই তিনের অতীত, চতুর্থ—যাকে বলা হয় তুরীয়। এই চতুর্থ অবস্থায় সময় ও পরিবর্তন বিলীন, সেখানে কেবল “অস্তি, ভাতি, প্রিয়ম্”—চেতনার নিত্য উপস্থিতি। তাই কালীর তিন চোখ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমন্বিত প্রতীক, আর সেই চোখের মধ্যবর্তী তৃতীয় নেত্র “তুরীয় চেতনা”—যেখানে সব কালের একত্ব ঘটে। শঙ্করাচার্য বলেন, “কালত্রয়াতীতং ব্রহ্ম”—ব্রহ্ম হলেন সেই যিনি তিন কালের অতীত; কালীর তৃতীয় চোখ সেই ব্রহ্মদৃষ্টির প্রকাশ।

“অস্তি, ভাতি, প্রিয়ম্‌ (Asti, Bhāti, Priyam)”—এই তিনটি শব্দ অদ্বৈত বেদান্তে সত্তা-চৈতন্য-আনন্দ (sat-cit-ānanda)-এর ত্রিত্বস্বরূপ সত্যের সরল ও গভীর প্রকাশ।

‘অস্তি’ (asti) মানে “আছে” বা অস্তিত্ব—যা কোনো কিছুর বাস্তব সত্তাকে নির্দেশ করে। সমস্ত জগৎ, সমস্ত অনুভব, সমস্ত চিন্তার ভিতরেই এই “আছে”-বোধটি অটল। কিছু না থাকলেও “আছি”—এই অভিজ্ঞতা কখনও লুপ্ত হয় না। এই অমোঘ “আছে”-ই ব্রহ্মের সৎ দিক, পরম অস্তিত্ব।

‘ভাতি’ (bhāti) মানে “জ্বলে” বা “প্রকাশিত হয়”—এটি চেতনার দিক, যা সমস্ত অভিজ্ঞতাকে আলোকিত করে। দেখা, জানা, অনুভব করা—এই সবই সম্ভব, কারণ এক চৈতন্য সর্বদা উদ্‌ভাসমান। এই “ভাতি”-ই ব্রহ্মের চিত্—যা জগতের প্রতিটি জ্ঞানে স্ব-প্রকাশমান।

‘প্রিয়ম্‌’ (priyam) মানে “প্রিয়তা” বা “আনন্দ”—অস্তিত্ব ও চেতনার যে প্রাকৃতিক তৃপ্তি, সেটিই আনন্দ। যেখানেই আমরা কোনো কিছু ভালোবাসি, সেখানে মূলত এই প্রিয়ত্ব বা আনন্দেরই ঝলক দেখা যায়। কিন্তু সেই আনন্দ কোনো বস্তুর নয়—সেটি আত্মার স্বভাব। তাই তৈত্তিরীয় ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলে—“আত্মানন্দো ব্রহ্ম”—আনন্দই ব্রহ্ম।

এই তিনটি—অস্তি, ভাতি, প্রিয়ম্—একত্রে বাস্তবের মৌলিক তত্ত্ব। যে-জগৎকে আমরা নানা নাম ও রূপে দেখি, তার সব রূপই পরিবর্তনশীল, কিন্তু এই তিনটি গুণ কখনও বিলুপ্ত হয় না। যা-কিছু আছে, তা “অস্তি”; যা-কিছু অনুভূত হয়, তা “ভাতি”; আর যা-কিছু কাম্য বা প্রিয়, তা “প্রিয়ম্‌।” নাম ও রূপ পরিবর্তিত হয়, কিন্তু অস্তি-ভাতি-প্রিয়ম্‌ সর্বদা একই থাকে—এটাই ব্রহ্মস্বরূপ।

“অস্তি, ভাতি, প্রিয়ম্‌” মানে সেই ব্রহ্ম, যিনি আছেন (সৎ), যিনি জানেন (চিত্) এবং যিনি আনন্দ (আনন্দ)। সমস্ত জগৎ এই তিন দিকেই তাঁর প্রকাশ, আর মুক্তি মানে এই উপলব্ধি যে—“আমি” সেই অস্তি-ভাতি-প্রিয়ম্‌ স্বরূপ চেতনা, যিনি সর্বত্র, সর্বদা, অপরিবর্তনীয়ভাবে বিরাজমান।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, ত্রিনেত্র শিবের ত্রিনয়ন তত্ত্বের প্রতীক, যা তিন শক্তির—ইচ্ছা (Icchā), জ্ঞান (Jñāna) ও ক্রিয়া (Kriyā)—ঐক্যের প্রতীক। কালী হলেন শিবচেতনার বিমর্শশক্তি; তাঁর চোখ তিনটি এই তিন শক্তির প্রতীক, যা চেতনার পূর্ণতা তৈরি করে। প্রথম চোখ জ্ঞানের দৃষ্টি—যা জানে; দ্বিতীয় চোখ ক্রিয়ার দৃষ্টি—যা করে; আর তৃতীয় চোখ ইচ্ছাশক্তির কেন্দ্র—যা উভয়কে একত্র করে। এই তিন দৃষ্টি মিলেই চেতনা সম্পূর্ণ হয় এবং তার ফলেই সৃষ্টির লীলা সম্ভব। অভিনবগুপ্ত বলেন, “তিন চোখ মানে তিন শক্তির ঐক্য—যেখানে চেতনা নিজের স্বাতন্ত্র্য জাগ্রত করে।”

শাক্ত দর্শনে, ত্রিনেত্র হলো দেবী-শক্তির সর্বব্যাপী সচেতনতার প্রতীক। তিনি সময়েরও অতীত, কারণ তিনিই কাল—তিনিই সৃষ্টি, পালন ও সংহার। তাঁর তিন চোখ তিন ক্রিয়া—সৃষ্টি (Sṛṣṭi), স্থিতি (Sthiti) ও লয় (Saṃhāra)। যখন তাঁর তৃতীয় চোখ জ্বলে ওঠে, তখন পুরোনো জগৎ ভস্ম হয়, আর নতুন জগৎ জন্ম নেয়। এই চোখ ধ্বংসের নয়, পুনর্জন্মের। তাঁর তিন চোখে লুকিয়ে আছে চেতনার সেই পরম সত্য—“লয়ই সৃষ্টি, সংহারই নবজাগরণ।”

মনস্তাত্ত্বিকভাবে, কালীর ত্রিনেত্র মানুষের সম্পূর্ণ সচেতনতার প্রতীক। দুই চোখ বাহ্যজগৎ দেখে—অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় ও মন যা উপলব্ধি করে; কিন্তু তৃতীয় চোখ অন্তর্জগৎ দেখে—অর্থাৎ, চেতনা নিজেকে উপলব্ধি করে। এই তৃতীয় দৃষ্টি মানে self-reflective awareness বা আত্মসচেতনতা—যেখানে মানুষ নিজের মধ্যে থাকা সাক্ষীচেতনাকে চিনতে শেখে। যখন এই অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত হয়, তখন মানুষ কেবল বর্তমান নয়, অতীত ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতেও নিজের অবস্থান উপলব্ধি করে; সে সময়ের ধারায় নয়, সময়ের উৎসে দাঁড়ায়।

কালীর ত্রিনেত্র হলো সর্বজ্ঞ চেতনার রূপ—যেখানে জ্ঞান, ক্রিয়া ও ইচ্ছা; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—সব একীভূত হয়ে যায়। তাঁর চোখে দীপ্ত সময়ের রহস্য, আর তৃতীয় চোখ সেই রহস্যের অন্তর্গত সত্য—চিরন্তন চেতনা, যা কখনও শুরু হয়নি, কখনও শেষও হবে না। তাই কালীর ত্রিনেত্র আমাদের শেখায়—চোখ খুলে বাইরে দেখো, কিন্তু অন্তরচোখ খুলে নিজের মধ্যেও দেখো; কারণ যা ছিল, যা আছে, যা হবে—সবই এই এক চেতনার মধ্যেই অবিচ্ছিন্নভাবে দীপ্ত।

কালীর কোমরে মৃত মানুষের বাহু দিয়ে গঠিত কোমরবন্ধ—যাকে বলা হয় মৃতবাহুর মেখলা—তাঁর সবচেয়ে গভীর তান্ত্রিক প্রতীকগুলির একটি। এটি কেবল ভয়াবহ অলঙ্কার নয়; এটি শরীর, কর্ম ও অহংকারের সীমা অতিক্রম করার শক্তির প্রতীক। বাহু মানে কর্মেন্দ্রিয়—যাদের মাধ্যমে আমরা জগতে কাজ করি। আর মৃতবাহু মানে সেই কর্মশক্তি, যা এখন আর “আমি করি” এই অহংবোধে পরিচালিত নয়। কালী এই মৃত বাহু ধারণ করে দেখান যে, সত্যিকারের শক্তি কেবল তখনই উদ্‌ভাসিত হয়, যখন কর্তা-বোধ (doership) বিলীন হয়ে যায় এবং সমস্ত কর্ম ব্রহ্মচেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে পরিণত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই মৃতবাহু-গঠিত কোমরবন্ধ মানে কর্মের ফলাাশ্রয় ত্যাগ। শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে বলেন, “যস্য নেহংকৃতো ভাবো, বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে”—যার মধ্যে ‘আমি কর্তা’ ভাব নেই, তার কর্ম কখনও তাকে বেঁধে রাখে না। কালী এই অবস্থার জীবন্ত প্রতীক। তাঁর মৃতবাহুর কোমরবন্ধ সেই জ্ঞানের প্রতীক, যেখানে “আমি কর্তা” ধারণা মৃত হয়েছে; দেহ ও কর্ম তখন চেতনার যন্ত্রমাত্র। এই মৃত্যু ধ্বংস নয়, মুক্তি—যেখানে কর্ম হয়, কিন্তু কর্তার অহং থাকে না। তাই কালী বলেন না, “কাজ কোরো না,” বরং বলেন, “কাজ করো, কিন্তু কর্তার মতো নয়—সাক্ষীর মতো।”