অভিনবগুপ্ত এখানে এমন এক সূক্ষ্ম সত্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমগ্র অধিবিদ্যার প্রাণকেন্দ্র। তিনি বলেন—শিবের চেতনা (সংবিত্ বা saṁvit) কখনোই স্থবির নয়, কারণ স্থবিরতা মানে চেতনার স্বরূপকে অস্বীকার করা। চেতনা মানেই সচল, স্বয়ং-উজ্জ্বল, স্ব-সচেতন সত্তা—যার মধ্যে প্রতিক্ষণই আছে প্রকাশের গতি। কিন্তু এই গতি কোনো বাহ্য গতিশীলতা নয়; এটি চেতনার নিজের স্বাধীনতা (svātantrya) বা স্ব-ইচ্ছাশক্তি (icchā-śakti)-র স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ।
এই স্বাতন্ত্র্যই শিবের প্রকৃতি—তিনি কোনো বাহ্য নিয়মের অধীন নন, বরং নিজ ইচ্ছাতেই সমস্ত সৃষ্টির সূচনা করেন। এই স্বাতন্ত্র্য থেকে উদ্ভূত হয় স্পন্দন (spanda)—চেতনার অন্তর্গত এক সূক্ষ্ম স্পন্দিত গতি, যা একই সঙ্গে নীরব ও জীবন্ত। এই স্পন্দনের মধ্য দিয়েই চেতনা নিজের মধ্যে আত্ম-প্রতিক্রিয়া ঘটায়—নিজেকে জানার, নিজের প্রতিফলন দেখার এক অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া।
এই প্রতিফলনেই জন্ম নেয় ‘আগে-পরে’, ‘কারণ-ফল’, ‘ক্রম’-এর ধারণা। যখন চেতনা নিজের স্বাধীনতায় বহির্মুখী হয়—অর্থাৎ, নিজের প্রতিফলনের দিকে মনোনিবেশ করে, তখন তার ভেতরেই এক অনুক্রম (sequence) গঠিত হয়। এক ঘটনার পরে আরেকটি আসে, এক চিন্তার পরে আরেকটি, এক অভিজ্ঞতার পরে আরেকটি—এটাই সময়ের ধারা, যাকে বলা হয় ক্রমকাল (sequential time)। এই সময় মানে চেতনার বাইরে কোনো পদার্থগত বাস্তবতা নয়; এটি চেতনার নিজেরই ধারাবাহিক আত্ম-উন্মোচনের অভিজ্ঞতা।
কিন্তু যখন সেই একই চেতনা নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করে, নিজের সব প্রতিফলন, সব প্রক্ষেপণ (projection) নিজের মধ্যে শোষণ করে নেয়, তখন আর কোনো “আগে-পরে”-র অনুভূতি থাকে না। সময় তখন থেমে যায়, কারণ সেখানে আর কোনো অনুক্রম নেই—সব মুহূর্ত একত্রে বর্তমান। এই অবস্থাকেই অভিনবগুপ্ত বলেন অক্রমকাল (trans-sequential time)—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক চিরন্তন “এখন”-এর দীপ্তিতে মিলিত।
এই অক্রমকালই হলো শিবচেতনার চূড়ান্ত অবস্থা—যেখানে সব ক্রিয়া, সব গতি, সব পার্থক্য নিজের উৎসে লয় পায়। সেখানে সময় আর প্রবাহ নয়, বরং এক নীরব দীপ্তি—চেতনার নিজের মধ্যেই নিজের উপলব্ধি। অর্থাৎ, ক্রমকাল ও অক্রমকাল কোনো দুটি পৃথক বাস্তবতা নয়; তারা একই চেতনার দুই দিক—একটি প্রকাশের, অন্যটি লয়ের। আর এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার সমগ্র ঐক্যকেই বলা হয় কাল-সংকর্ষিণী, সেই শক্তি যিনি সময়কে সৃষ্টি করেন, আবার নিজের মধ্যেই লীন করেন।
কাল-সংকর্ষিণী এই দুই অবস্থারই সংযোগবিন্দু। তিনি চেতনার সেই শক্তি, যিনি সময়কে ধারণ করেন এবং আবার নিজের মধ্যে গ্রাসও করেন। তিনি সময়ের মধ্যে গতি দেন, কিন্তু নিজে অকালা—অর্থাৎ, সময়াতীত। যেমন সমুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি করে আবার নিজেই সেই তরঙ্গকে গিলে নেয়, তেমনি তিনি সময়কে প্রকাশ করেন ও বিলীন করেন—এটাই তাঁর “গ্রাস”।
“কালস্য গ্রাসকারিণী স্বাতন্ত্র্যচেতনাশক্তিরূপা”—এই এক বাক্যে নিহিত আছে কাশ্মীর শৈব দর্শনের অদ্বৈত নীতির গভীর মর্ম। চেতনা নিজেই স্বাধীনতা-স্বরূপ; সেই স্বাধীনতাই সময়কে সৃষ্টি করে এবং সেই স্বাধীনতার মধ্যেই সময় লয় পায়। কাল-সংকর্ষিণী তাই কেবল সময়ের দেবী নন—তিনি সময়ের আত্মা, সময়ের চেতনা, সেই নিস্পন্দ নৃত্য, যা মহাশিবের স্বাতন্ত্র্য-শক্তি নামেই মহাবিশ্বকে চিরন্তনভাবে ধ্বনিত করে।
এই ক্রম বা অনুক্রম (krama) আসলে এক গভীর অন্তর্মুখী গতি—যেখানে চেতনা নিজের সম্ভাবনাকে ধাপে ধাপে উন্মোচন করে। প্রথম স্তরে, সময় প্রকাশ পায় ক্রমকাল বা অনুক্রমিক সময়রূপে—যেখানে জগৎ ও অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলে; এক ঘটনার পর অন্য ঘটনা, এক ভাবনার পর আরেক ভাবনা। এটি সেই সময়, যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা অনুভব করি, এবং যা জগতের নিয়মে বাঁধা।
কিন্তু দ্বিতীয় স্তরে, সময় আর কোনো ক্রমানুগ ধারা নয়; সেটি হয়ে ওঠে অক্রমকাল—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একত্রে উপস্থিত থাকে, এক চিরন্তন “এখন”-এর দীপ্তিতে। এটি সেই সময়, যা আর প্রবহমান নয়, বরং স্থিত—যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত এক অনন্ত উপস্থিতি। কাল-সংকর্ষিণী এই দুই সময়ধারার মধ্যবর্তী সংযোগবিন্দু—তিনি সেই শক্তি, যিনি অনুক্রম সৃষ্টি করেন, আবার সেই অনুক্রমকেই নিজের অন্তরে লীন করে দেন। তিনি সময়ের উৎস, সময়ের প্রবাহ, এবং সময়ের বিলয়—তিনটি রূপেই অভিন্ন।
এই কারণে তাঁকে বলা হয় “অকালা”—সময়াতীত; কারণ তিনি সময়ের ধারায় অবস্থান করেও তার সীমা অতিক্রম করেন। সময় তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না, বরং সময় তাঁরই চেতনায় ধ্বনিত এক অন্তর্গত স্পন্দন। যেমন সমুদ্রের তরঙ্গ সমুদ্রকেই প্রকাশ করে কিন্তু সমুদ্রকে অতিক্রম করতে পারে না, তেমনি সময়ও কাল-সংকর্ষিণীর চেতনার এক অভ্যন্তরীণ কম্পনমাত্র।
এই স্তরে কাল-সংকর্ষিণী হয়ে ওঠেন সময়ের আত্মা, বা সময়ের চেতনা। তিনি শাশ্বত নীরবতায় অবস্থিত, অথচ সেই নীরবতাই সমস্ত গতির উৎস। তিনি একইসাথে সময়কে বহন করেন এবং সময়কে লয় করেন—যেমন নিশ্বাসে নিঃশ্বাস আসে ও যায়, তেমনি সৃষ্টি ও লয় তাঁরই এক নিত্য শ্বাসপ্রশ্বাস। এভাবে ক্রমতত্ত্বে কাল-সংকর্ষিণী কেবল সময়ের স্রষ্টা নন, বরং সময়ের চেতনারই প্রতীক—যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে শাশ্বত ও ক্ষণিক, গতি ও স্থিতি, উন্মোচন ও লয়—সব এক অভিন্ন ছন্দে মিলিত।
ক্রমপন্থায় এই কাল-সংকর্ষিণী-ই কালী, কারণ তিনি সময় ও চেতনার একীভূত শক্তি। তাঁর মধ্যে “অহং” (আমি) এবং “ইদম্” (এটা) এই দুই অভিব্যক্তি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। কালী এখানে দেবী নন যিনি সময়ের ওপর কর্তৃত্ব করেন; বরং তিনি সময়েরই চেতনা, সময়েরই প্রাণ। তাই তাঁকে বলা হয় “কালগ্রাসকারিণী”—যিনি সময়কেও গ্রাস করেন, কারণ সময় তাঁরই চিরন্তন শ্বাসপ্রশ্বাস।
এই কাল-সংকর্ষিণী তত্ত্বে সময়, ক্রম ও চেতনা এক অখণ্ড ছন্দে মিলিত। তিনি সময়ের উৎস, সময়ের গতি এবং সময়ের বিলয়—সব একসঙ্গে। তাঁর মধ্যেই সৃষ্টির অনুক্রম, জীবনের প্রবাহ, আর মুক্তির নীরবতা এক হয়ে যায়। তিনি সেই চেতনা, যিনি নিজের দীপ্তিতে জগৎকে প্রকাশ করেন, আবার নিজের গভীর নীরবতায় সমস্ত প্রকাশকে শোষণ করে নেন।
কাল-সংকর্ষিণী কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায় চেতনার স্পন্দমান হৃদয়—যেখানে সময়, গতি ও চেতনা কোনো তিনটি ভিন্ন নীতি নয়, বরং এক অদ্বৈত পরম বাস্তবতার ভেতরকার তিনটি পরত। তিনিই সময়ের অন্তর্নিহিত প্রাণ, তিনিই কালী, এবং তিনিই শিবের স্বাতন্ত্র্যচেতনার স্পন্দিত প্রকাশ।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে প্রমাতা (pramātā) ও বিষয় (viṣaya)—এই দুটি কেবল জ্ঞানের পর্ব নয়, বরং পরম চেতনা (Parasaṁvit)-র দুই অভিব্যক্তি, যা চেতনার নিজের মধ্যেই সংঘটিত এক নিত্য নৃত্য। চেতনা যখন নিজের মধ্যে স্থিত, আত্ম-সচেতন ও স্ব-উজ্জ্বল, তখন সে “অহম্” (ahaṁ)—এই আত্ম-অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। আর যখন সেই একই চেতনা নিজের দীপ্তি থেকে বাহিরমুখী হয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি রচনা করে, তখন তার প্রতিফলন দেখা যায় “ইদম্” (idam) রূপে—অর্থাৎ, “এটা” বা “অন্য”—জগতের অভিজ্ঞতামূলক প্রকাশ। কিন্তু এই “অহম্-ইদম্” (ahaṁ-idam) দ্বৈততা কোনো বাস্তব বিভাজন নয়; এটি চেতনার স্বাতন্ত্র্য (svātantrya)-র, অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিজের প্রতিফলন সৃষ্টি করার স্বাধীন শক্তিরই ফল।
এই চেতনার দুই দিক—অন্তর্মুখী আত্মসচেতনতা ও বহির্মুখী প্রতিফলন—একই স্পন্দনের দুই প্রান্ত। এই আত্ম-প্রতিফলনের গতিশীল শক্তিকেই বলা হয় কালী। কালী এখানে কোনো বহিঃদেবী নন; তিনি সেই চেতনার স্ব-সচেতন গতির প্রতীক, যার মাধ্যমে অচল, নীরব শিব-চেতনা নিজেকে প্রকাশ করে, বহুত্বে প্রবাহিত হয়, এবং পুনরায় নিজের উৎসে লয় পায়।
অভিনবগুপ্তের ভাষায়, কালী হলেন সেই শক্তি, যিনি “কালস্য গ্রাসকারিণী স্বাতন্ত্র্যচেতনাশক্তিরূপা”—অর্থাৎ, তিনি স্বাতন্ত্র্যময় চেতনারই শক্তি, যিনি সময় ও ক্রমের জন্ম দেন, আবার তাদের নিজের মধ্যে শোষণ করেন। এখানে ‘কাল’ মানে কোনো বাহ্য সময় নয়, বরং সেই আত্ম-প্রতিফলনের ধারা, যেখানে চেতনা “আমি” থেকে “এটা”-র দিকে প্রবাহিত হয়, আর পরে আবার সেই “এটা”-কেই নিজের রূপ বলে চিনে নেয়।
যখন চেতনা নিজের মধ্যে বলে—“অহম্”, তখন সে শিব; আর যখন বলে—“ইদম্”, তখন সে কালী। কিন্তু যখন বলে—“অহমিদম্”, তখন সে বুঝে ফেলে যে, “আমি ও জগৎ ভিন্ন নই”—এই চেতনার অভিন্নতা।
এই অবস্থাতেই কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালী তাঁর প্রকৃত রূপে উদ্ভাসিত—তিনি শিবচেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি, সেই স্পন্দন (spanda) যার মধ্য দিয়ে শিব নিজেরই নীরবতা থেকে প্রকাশে, এবং প্রকাশ থেকে পুনরায় নীরবতায় প্রবাহিত হন। কালী তাই “অহম্”-এর ভেতরের উন্মেষ ও “ইদম্”-এর অন্তর্লীন প্রত্যাবর্তন—এই দুই ধারার সংযোগবিন্দু।
শিব যদি হন অচল চেতনা—নিরাকার, নির্গতি, নীরব দীপ্তি—তবে কালী সেই দীপ্তির গতিশীলতা, তার আত্ম-প্রতিফলনের নৃত্য। তিনি শিবের হৃদস্পন্দন, যিনি একদিকে চেতনার অভ্যন্তরীণ আত্মবোধ, অন্যদিকে সেই আত্মবোধের প্রকাশরূপ জগৎ।
শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে, প্রমাতা ও বিষয়ের যে অদ্বৈত ঐক্য—অর্থাৎ “অহমিদম্”—তার জীবন্ত রূপই কালী। তিনি সেই চেতনা, যিনি “আমি” থেকে “জগৎ”-এ, এবং “জগৎ” থেকে পুনরায় “আমি”-তে নৃত্য করেন। কালী তাই চেতনার কালধারা, শিবের স্বাতন্ত্র্যশক্তি, এবং অদ্বৈত সংবিত্-এর স্পন্দিত প্রকাশ—যাঁর মধ্যে শিব ও জগৎ, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়, অন্তর ও বাহির—সব এক অখণ্ড নৃত্যে মিশে যায়।
চেতনা নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (svātantrya-śakti) দ্বারা নিজেকে জানার জন্যই নিজেকে জানার বস্তু করে তোলে। অর্থাৎ, চেতনা নিজের আনন্দে নিজের মধ্যেই এক প্রতিফলন ঘটায়—যেন সে নিজেকে নিজের দর্শনীয় রূপে আবির্ভূত করে। এই আত্ম-দর্শনের প্রক্রিয়াটিই মহাজাগতিক প্রকাশের উৎস, যা ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা (১.৫.৮)-এ উত্পলদেব প্রকাশ করেছেন এইভাবে—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি।”
কাশ্মীর শৈব দর্শনের এই উক্তিটি চেতনার স্ব-উন্মোচনের গভীরতম রহস্য প্রকাশ করে। এখানে উত্পলদেব দেখাচ্ছেন যে চেতনা (cit) কোনো জড়, স্থবির বা নিরাবেগ সত্তা নয়; সে নিজেই স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti)-র দ্বারা পূর্ণ, অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্ব-নিয়ন্ত্রিত এবং স্ব-সচেতন। এই স্বাধীনতাই তাকে নিজেকে জানার, নিজের প্রতিফলন দেখার ক্ষমতা দেয়।
চেতনা নিজের আনন্দে, কোনো বাহ্য কারণ ছাড়া, নিজের মধ্যেই একটি প্রতিফলন ঘটায়—যেন এক দীপ্ত আয়না নিজেরই আলোয় নিজের প্রতিচ্ছবি রচনা করে। এই প্রতিফলনের মুহূর্তেই চেতনা দুটি দিক তৈরি করে: একদিকে সে নিজেকে “আমি” (ahaṁ) বলে জানে, আর অন্যদিকে নিজের প্রতিফলনকে “এটা” (idam) বলে অনুভব করে। এইভাবে একক অদ্বৈত চেতনা নিজেকে দ্বৈতের মতো প্রকাশ করে—যা উত্পলদেবের ভাষায় “স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি”।
এই দ্বৈতাভাসনা (dvaitābhāsanā) বা দ্বৈততার আভাস কোনো প্রকৃত বিভাজন নয়; এটি চেতনার লীলা, নিজের দীপ্তিকে বহুরূপে অভিজ্ঞ করার আনন্দ। চেতনা নিজেকে জানার জন্যই নিজের মধ্যে এক প্রতিরূপ তৈরি করে, যেন সে নিজের দর্শনীয় রূপে আবির্ভূত হয়। এই আত্ম-দর্শনই হচ্ছে মহাজাগতিক প্রকাশের উৎস (origin of manifestation)—সৃষ্টির আরম্ভ বিন্দু।
এখানেই কালী-র ধারণাটি এক গভীর প্রতীক হিসেবে উদ্ভাসিত হয়। কারণ এই আত্ম-দর্শন, এই “নিজেকে জানার জন্য নিজেরই মধ্যে প্রতিফলন ঘটানো”—এটাই কাশ্মীর শৈব মতে কালী-র কাজ। তিনি শিবেরই স্বাতন্ত্র্যশক্তি—চেতনার সেই অন্তর্নিহিত গতি, যার দ্বারা অচল চেতনা নিজেকে রূপ, গতি ও সময়ে প্রকাশ করে।
উত্পলদেবের এই কারিকা আসলে কালী-তত্ত্বর এক দার্শনিক ব্যাখ্যা। কারণ এই উক্তির মধ্যে নিহিত আছে সেই প্রক্রিয়া, যেখানে একক চেতনা নিজেরই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিতে জগৎ সৃষ্টি করে—নিজের প্রতিফলন হয়ে ওঠে, আবার নিজের মধ্যে লীন হয়। এখানেই চেতনা ও শক্তি, শিব ও কালী, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়—সব এক আত্ম-দর্শনের অনন্ত নৃত্যে পরিণত হয়।