শৈব কালী: পঞ্চাশ



মহাকালী: ইনি কেবল এক দেবী নন, তিনি সময়ের নিজস্ব রূপ—চিরন্তন মহাশক্তির প্রকাশ, যিনি জন্ম ও মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে আছেন। দশ মহাবিদ্যার মধ্যে তিনি প্রথম, কারণ তাঁর মধ্যেই নিহিত সমস্ত কালের, সমস্ত শক্তির, সমস্ত অস্তিত্বের মূলসূত্র। তাঁর নামের মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে মহাবিশ্বের গভীরতম সত্য—মহাকাল মানে সময়ের পরম চেতনা, আর মহাকালী সেই চেতনার সক্রিয় শক্তি, যিনি সময়কেও অতিক্রম করেন।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, মহাকালী হলেন কালাতীত ব্রহ্মচেতনার প্রতীক—যিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়েরও অতীত। সময় এখানে কোনো পরিমাপক নয়, বরং মায়ারই এক তরঙ্গ। ব্রহ্মচেতনা এই সময়ের ধারাকে ধারণ করে, কিন্তু তাতে আবদ্ধ নয়। তিনি সেই চেতনা, যিনি সৃষ্টির পূর্বেও আছেন এবং লয়ের পরেও অবশিষ্ট থাকেন। এই অবস্থাকে উপনিষদ বলে—“যে ছিল, আছে এবং থাকবে”—অর্থাৎ “সৎ”। মহাকালী সেই সৎ চেতনা, যিনি সমগ্র জগতের গতি-প্রবাহকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন, তবু নিজে অনন্ত স্থির। তাঁর রূপ আমাদের শেখায়, সময় কোনো ভয়ংকর প্রলয় নয়; এটি চেতনার নিজস্ব লীলা, এক অনন্ত স্পন্দনের ছন্দ।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, মহাকালী হলেন শিবচেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি-র চূড়ান্ত রূপ। শিব যখন “মহাকাল”—অর্থাৎ নিস্তরঙ্গ, কালাতীত চেতনা—তখন কালী সেই চেতনার গতিশীল দীপ্তি, যা সময় ও স্থানের সীমাকে লঙ্ঘন করে চেতনার অসীম সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে। অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেছেন “অকাল-কালিক সংযোগ”—অর্থাৎ, যেখানে কাল (সময়) ও অকাল (কালাতীত) একে অপরের মধ্যে লীন। মহাকালী সেই মুহূর্তের প্রতীক, যখন চেতনা নিজের স্বরূপে ফিরে এসে সময়কেও নিজের মধ্যে শোষণ করে নেয়। তাঁর নৃত্যই সময়ের গতি, তাঁর নীরবতা সময়ের অন্তর্ধান।

শাক্ত দর্শনে, মহাকালী হলেন “কালমাতা”—যিনি সময়েরও জননী। তিনি সৃষ্টি করেন সময়কে, আবার সময়ের মধ্য দিয়েই সমস্ত কিছু গ্রাস করেন। সময়ের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি পরিবর্তন তাঁরই শ্বাসপ্রশ্বাস। তিনি সেই মা, যিনি জন্ম দেন এবং শেষেও নিজের সন্তানদের বুকে টেনে নেন। তাই তিনি ভয়ংকর নন, বরং পরম করুণাময়ী; কারণ তাঁর গ্রাসই মুক্তি, তাঁর লয়ই পরম শান্তি।

মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিতে, মহাকালী সেই চেতনার প্রতীক, যা মৃত্যু ও ক্ষয়কে ভয় নয়, প্রাকৃতিক সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানী এরিখ ফ্রম বা কার্ল ইয়ুং যেভাবে মৃত্যুচেতনাকে আত্মরূপান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখিয়েছেন, মহাকালী সেই ভাবনারই রূপায়ণ—তিনি আমাদের শেখান, সময়ের সীমা মেনে নয়, সেই সীমাকে অতিক্রম করে দেখতে। তিনি সেই অন্তর্জাগরণের প্রতীক, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে—আমরা সময়ের মধ্যে বাস করি না, সময়ই আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।

মহাকালী হলেন চিরন্তন ‘এখন’-এর প্রতীক। তিনি সেই ব্রহ্মচেতনা, যেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ একমুহূর্তে মিশে যায়। তিনি সময়ের গ্রাসকারিণী, কিন্তু তাঁরই বক্ষে সময়ের জন্ম। শিব ও মহাকালী তাই দুই নন—তাঁরা এক চেতনার দুই দিক: শিব নিস্তরঙ্গ কাল, কালী তার স্পন্দমান শক্তি। তাঁদের ঐক্যই ব্রহ্মের সর্বোচ্চ প্রকাশ—যেখানে সময় ও কাল, সৃষ্টি ও লয়, মৃত্যু ও অমরত্ব একাকার হয়ে যায় পরম চেতনার নৃত্যে।

দশ মহাবিদ্যা: সমষ্টিগতভাবে এটি একটিমাত্র পরম চেতনার দশটি ভিন্ন বিকিরণ—যেখানে একেক দেবী সেই চেতনার একেক স্তর, একেক মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা এবং একেক দার্শনিক সত্যের প্রতীক। শাক্ত-তন্ত্রে বলা হয়, দেবী একা নন—তিনি মহাশক্তি, আর এই দশ রূপ সেই শক্তির দশ দিগন্ত, যা মানুষকে অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে আত্মসচেতনতার দীপ্তিতে নিয়ে যায়। অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এরা ব্রহ্মচেতনার দশ প্রকাশ; কাশ্মীর শৈব দর্শনে তারা পরাশক্তির দশ স্পন্দন, আর মনোবিজ্ঞানের ভাষায়—চেতনার অন্তর্গত দশ archetypal dimension, যা ব্যক্তির অন্তরযাত্রাকে সম্পূর্ণ করে।

“মহাশক্তি” শব্দটি শাক্ত, শৈব ও অদ্বৈত তিন দর্শনেই চেতনার সর্বোচ্চ, স্বয়ংসম্পূর্ণ গতিশীল সত্তাকে বোঝায়। কাশ্মীর শৈব-মতে, তিনি হলেন পরাশক্তি—শিবের স্ববিমর্শন (Vimarśa), অর্থাৎ চেতনার সেই স্বচেতন প্রতিফলন, যা নিজের মধ্যেই বিশ্ব সৃষ্টি করে। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তে এই একই মহাশক্তিকে বলা হয় মায়া—যিনি ব্রহ্মের অচিন্ত্য শক্তি, যার দ্বারা নিরাকার ব্রহ্ম নাম-রূপধারী জগৎরূপে প্রকাশিত হন।

কিন্তু তন্ত্র ও কাশ্মীর শৈব প্রেক্ষিতে মায়া কোনো বিভ্রম নয়, বরং চেতনার সৃজনাত্মক উচ্ছ্বাস। অভিনবগুপ্ত বলেন, “শক্তিরূপা হি চিত্তস্বরূপা”—শক্তিই চেতনার প্রকৃত রূপ। এই চেতনা যখন নিজেকে চিনতে চায়, তখনই পরাশক্তি মহাশক্তি হয়ে প্রকাশিত হন—অর্থাৎ চেতনার আত্মপ্রেমের প্রকাশ। তাঁর থেকেই জগৎ, কাল, দিক, মন, ইন্দ্রিয়, এবং জীবন সব কিছুই এক একটি তরঙ্গরূপে উদ্ভূত হয়। তাই তাঁকে বলা হয় “মহাশক্তি কালিকারূপা”—যিনি চেতনার স্পন্দ, প্রকাশ ও লয়—এই তিন ক্রিয়ার উৎস।

মহাশক্তি চেতনার সেই স্তর, যেখানে শিব ও শক্তি, প্রকাশ ও বিমর্শ, জ্ঞান ও ক্রিয়া এক অবিচ্ছেদ্য ঐক্যে মিশে যায়। তিনি একইসাথে সৃষ্টি ও সংহার, সময় ও কালাতীত, আলো ও অন্ধকার। মানবমনের গভীরে এই মহাশক্তিই অবচেতন সৃষ্টিশক্তি, যিনি স্বপ্ন, কল্পনা ও জাগরণের মধ্যে অবিরত রূপ পরিবর্তন করেন। মনস্তাত্ত্বিক অর্থে মহাশক্তি হলো সেই আত্ম-সচেতন শক্তি (archetypal Creative Force)—যিনি পুরাতন সত্তাকে ধ্বংস করে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেন।

অদ্বৈত বেদান্তে “মহাশক্তি” বা “মায়াশক্তি” কথাটি বোঝায় সেই একমাত্র শক্তিকে, যার দ্বারা নিরাকার ব্রহ্ম এই দৃশ্যমান জগৎরূপে প্রকাশিত হয়। ব্রহ্ম নিজে নিস্তরঙ্গ, চিরনির্বিকার, পরম চৈতন্য; কিন্তু তাঁর ভেতরেই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে—এই সম্ভাবনাই মায়া বা মহাশক্তি। তাই বলা হয়, “মায়া ব্রহ্মাশ্রিতা”—মায়া ব্রহ্মের আশ্রয়ে থাকে; তিনি নিজে স্বতন্ত্র কিছু নন, ব্রহ্মচেতনারই অন্তর্গত গতি।

প্রথমে এই শক্তিকে মানুষ অবিদ্যা বা অজ্ঞান বলে মনে করে, কারণ তিনি জগতের নাম-রূপ, বৈচিত্র্য ও দ্বৈততার কারণ। আমরা দেখি—অসীম ব্রহ্ম নানা রূপে বিভক্ত হয়ে আছে: আমি, তুমি, গাছ, আকাশ, তারা। এই বিভক্তি মায়ারই খেলা। কিন্তু যখন জ্ঞানের আলো জ্বলে, তখন বোঝা যায়—এই মায়াই আসলে ব্রহ্মের নিজের আনন্দময় প্রকাশ। তাই শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৭.১৪) বলেন—“দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া; মামেব য প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।” অর্থাৎ, “এই আমার মায়াশক্তি দেবী, গুণত্রয়াত্মিকা ও দুর্লঙ্ঘনীয়; কিন্তু যিনি আমার আশ্রয় নেন, তিনিই এই মায়াকে অতিক্রম করেন।” এখানে “মায়া” মানে কোনো ভ্রম নয়, বরং ঈশ্বরের চেতনা শক্তি, যিনি একইসাথে আচ্ছাদক (covering) ও উদ্ঘাটক (revealing)—তিনি আড়ালও করেন, আবার জ্ঞানরূপে নিজেকে প্রকাশও করেন।

কাশ্মীর শৈবদর্শনের ব্যাখ্যায় এই একই শক্তিকে বলা হয় স্পন্দ—চেতনার নৃত্য বা স্পন্দন। এখানে শিব হলেন স্থিত চেতনা (প্রকাশ), আর শক্তি তাঁর আত্মবিমর্শন (বিমর্শ)। যখন চেতনা নিজের মধ্যেই হালকা তরঙ্গ তোলে, তখন সৃষ্টি শুরু হয়। এই তরঙ্গ বা কম্পনই স্পন্দ, এবং সেটিই মহাশক্তির কাজ। তিনি চেতনার ভেতরে এক অনন্ত নৃত্য—যেখানে সৃষ্টি ও লয়, উদয় ও বিলয়, আলো ও অন্ধকার, সব একত্রে প্রবাহিত।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, মহাশক্তি সেই চিত্‌—যিনি সত্তা (Sat), চিত্‌ (Chit) ও আনন্দ (Ānanda)-এর একত্রিত গতি। চিত্‌ নিজে স্থির নয়; তিনি নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে চায়, এবং সেই আত্মবিমর্শনই মহাশক্তির প্রকাশ। এই চিত্‌-আনন্দরূপ প্রবাহের মাধ্যমেই ব্রহ্ম জগতে প্রতিফলিত হয়—যেন নিস্তরঙ্গ সাগরে ঢেউ উঠছে, কিন্তু সাগর নিজে অপরিবর্তিত।

শাক্ততন্ত্রে এই শক্তিই কালী—চেতনার কালরূপ। তিনি সেই শক্তি, যিনি মৃত্যু, ধ্বংস, অন্ধকার ও রূপান্তরের মধ্য দিয়েই জীবনের নতুন জন্ম ঘটান। কালী আসলে সময়ের দেবী; তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমস্ত রূপই ক্ষণস্থায়ী, এবং প্রতিটি বিনাশই এক নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। এই কারণেই তাঁকে “মহাশক্তি” বলা হয়—কারণ তিনি কেবল জগৎ সৃষ্টি করেন না, সেই সৃষ্টির ধারাকে নবায়িতও করেন।

তাই দেখা যায়, অদ্বৈত, শৈব ও শাক্ত—তিনটি দর্শনেই মহাশক্তির মূল সত্তা এক: তিনি চেতনার গতি, ব্রহ্মের নৃত্য, অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত ছন্দ। তিনি একদিকে আমাদের অজ্ঞানতায় আচ্ছাদিত করেন, যাতে অভিজ্ঞতার নাটক সম্ভব হয়; আবার অন্যদিকে, জ্ঞানের জ্যোতিতে তিনিই পরম আত্মরূপে উদ্‌ভাসিত হন। মহাশক্তিই সেই অন্তর্গত নৃত্যশক্তি—যিনি ব্রহ্মকে জাগিয়ে তোলেন, জগৎকে সৃষ্টি করেন, এবং সবশেষে আবার চেতনার নিস্তরঙ্গে বিলীন হয়ে যান।

মহাশক্তি তাই কোনো “অন্য” দেবতা নন; তিনি চেতনার অন্তঃস্থ কম্পন, সেই নিঃসীম চৈতন্যের আত্ম-উল্লাস, যা কখনো বিশ্বে, কখনো মননে, কখনো নীরব আত্মবিম্বে রূপান্তরিত হয়। তাঁর নৃত্যই জগৎ; তাঁর স্থিতিই ব্রহ্ম; তাঁর লয়ই মুক্তি।

কালী প্রথম মহাবিদ্যা। তিনি সময়, মৃত্যু ও রূপান্তরের প্রতীক। তাঁর কৃষ্ণবর্ণ চেতনাকে নির্দেশ করে, যা সমস্ত রঙ ও রূপকে গ্রাস করে; তাঁর খড়্গ জ্ঞানের প্রতীক, যা অজ্ঞানকে দগ্ধ করে; তাঁর গলাগাথা মুণ্ডমালা স্মৃতি ও অতীত অভিজ্ঞতার প্রতীক, যা জ্ঞানরূপে রূপান্তরিত হয়েছে। অদ্বৈত দৃষ্টিতে তিনি নির্গুণ ব্রহ্মের গতি—যিনি সমস্ত দ্বন্দ্বের অতীত। কাশ্মীর শৈব মতে তিনি স্পন্দের প্রথম স্পর্শ, চেতনার প্রথম কম্পন; মনোবিজ্ঞানে তিনি “shadow”-এর সম্মুখীন হওয়ার সাহস—অচেতন অন্ধকারকে চেনা ও আলোকিত করা।

দ্বিতীয় হলেন তারা—তিনি চেতনার রক্ষাকারিণী, যিনি জীবকে “অজ্ঞানের পার” করে দেন। তাঁর নামের অর্থই ‘যিনি পার করান’। কালী যেখানে অন্ধকারের মুখোমুখি করে, তারা সেখানে সেই অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখান। তাঁর করুণার নীল আলো মানসিক ভারসাম্যের প্রতীক—ভয় ও বিভ্রান্তির মধ্যে দিশা। শৈব দর্শনে তিনি নাদ বা শব্দচেতনা, যার মাধ্যমে সৃষ্টি প্রথম উচ্চারণ নেয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে তিনি অন্তর্জ্ঞান—intuition—যা মানুষকে সংকটের মধ্যে সঠিক পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করে।

তৃতীয় হলেন ষোড়শী বা ত্রিপুরসুন্দরী বা ললিতাম্বা—তিনি জগতের সৌন্দর্য, আনন্দ ও পূর্ণতার প্রতীক। তাঁর তিন পুরী মানে ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়ার তিন স্তর। যখন এই তিনের ঐক্য ঘটে, তখন প্রকাশিত হয় সমবিত্তি বা সম্পূর্ণতা। অদ্বৈত বেদান্তে তিনি সেই ব্রহ্মজ্ঞান, যা জানে “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—সবই ব্রহ্ম। শৈব মতে তিনি চেতনার আনন্দস্বভাব, যেখানে শিব ও শক্তি অবিচ্ছিন্ন। মনোবিজ্ঞানে তিনি self-acceptance—নিজের সৌন্দর্য, ভয়, ব্যর্থতা, শক্তি—সব কিছুকে এক সঙ্গে গ্রহণ করার জ্ঞান।

চতুর্থ হলেন ভুবনেশ্বরী—তিনি স্থান বা আকাশের দেবী, চিদাকাশের প্রতীক। তাঁর চেতনা হলো অনন্ত পরিসর, যেখানে সব কিছু ঘটে কিন্তু কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। অদ্বৈতে তিনি সাক্ষীচেতনা—যিনি কেবল প্রত্যক্ষ করেন; শৈব দর্শনে তিনি বিশুদ্ধ স্পন্দের ক্ষেত্র, vibration-space; মনোবিজ্ঞানে তিনি মানসিক “open awareness”, যেখানে মানুষ নিজের চিন্তা, অনুভূতিকে বিচার না করে দেখতে শেখে—mindfulness।

পঞ্চম ভৈরবী—তিনি ভয়ংকর কিন্তু মুক্তিদায়িনী। তাঁর উগ্রতা আসলে অজ্ঞান ও ভয়ের বিরুদ্ধে শক্তির প্রকাশ। তিনি চেতনার রক্ষাকারিণী অগ্নি, যিনি পরিশুদ্ধ করেন। অদ্বৈত মতে এটি তপস্যার প্রতীক—নিজেকে সত্যের আগুনে দগ্ধ করা। শৈব মতে তিনি কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ; মনোবিজ্ঞানে তিনি সেই cathartic release—যেখানে দমিত আবেগ ভেদ করে মুক্তি পায়।

ষষ্ঠ রূপ ছিন্নমস্তা—তিনি নিজের মস্তক নিজেই ছেদন করেন, আর সেই কাটা মাথা নিজেই পান করেন। এই দৃশ্য বাহ্যত ভয়ংকর, কিন্তু তা বোঝায় আত্মবোধের জন্ম—যখন অহংকে উৎসর্গ করে চেতনা নিজেকে স্বচেতন করে। অদ্বৈত দৃষ্টিতে এটি অহংবিলয়ের প্রতীক—‘আমি’ ভেদ করে ‘আমি ব্রহ্মাস্মি’ উপলব্ধি। শৈব দর্শনে তিনি স্ববিমর্শন—চেতনার নিজের দিকে প্রত্যাবর্তন; মনোবিজ্ঞানে এটি ego-transcendence—নিজেকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা।