প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হলো আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশ, যা মনোযোগ, বিচারবোধ, পরিকল্পনা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য দায়ী। যখন কেউ নিয়মিত মন্ত্রধ্যান বা জপ অনুশীলন করে, তখন এই অংশের স্নায়ু-কেন্দ্রগুলি অধিক সক্রিয় ও সংগঠিত হয়ে ওঠে। এর ফলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, আবেগের প্রভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা কমে এবং ব্যক্তি নিজের মানসিক অবস্থাকে সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। সহজভাবে বলতে গেলে, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের স্থিতিশীলতা বাড়লে মানুষের চিন্তা ও আচরণ আরও সমন্বিত, মনোসংযমী ও শান্ত হয়।
অন্যদিকে, লিম্বিক সিস্টেম, যা মূলত আবেগ, ভয়, আনন্দ, ও স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত—মন্ত্রের ছন্দোবদ্ধ পুনরাবৃত্তিতে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। এই অঞ্চলের মধ্যে থাকা amygdala নামক অংশ সাধারণত ভয় ও উত্তেজনার সংকেত প্রক্রিয়া করে। মন্ত্রধ্যানের সময় দেখা গেছে, amygdala-এর অতিরিক্ত উত্তেজনা প্রশমিত হয়, ফলে মানসিক অস্থিরতা কমে এবং আবেগের ভারসাম্য ফিরে আসে।
থ্যালামাস, যা মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে—ইন্দ্রিয়ের বার্তা ও স্নায়বিক তথ্য সচেতন স্তরে পৌঁছে দেয়—তা-ও মন্ত্রের পুনরাবৃত্তিতে নতুন ছন্দে কাজ করতে শুরু করে। এই ছন্দ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় মনোসংযোগ বৃদ্ধি পায় এবং বাইরের অপ্রয়োজনীয় উদ্দীপনা থেকে মস্তিষ্ক নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে থাকা কর্টিসল (cortisol) নামক স্ট্রেস-হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। কর্টিসল যখন অতিরিক্ত মাত্রায় থাকে, তখন মানুষ উদ্বেগ, চাপ, ক্লান্তি ও অনিদ্রায় ভোগে। মন্ত্রধ্যান সেই স্ট্রেস প্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করে শরীরে শান্তির সঞ্চার ঘটায়। একই সঙ্গে সেরোটোনিন (serotonin) ও ডোপামিন (dopamine)—এই দুই “সুখ হরমোন”-এর নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলস্বরূপ মনের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রশান্তি, ইতিবাচকতা ও উদারতার অনুভূতি জন্ম নেয়।
আধুনিক গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নিয়মিত মন্ত্রোচ্চারণকারী ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে ধীর তরঙ্গের সুষমতা (slow-wave coherence) বৃদ্ধি পায়, যা গভীর ধ্যান ও বিশ্রামের লক্ষণ। এই অবস্থায় মস্তিষ্কের নিউরোন বা স্নায়ুকোষগুলির মধ্যে সংযোগ আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে—একে বলা হয় নিউরোপ্লাস্টিসিটি (neuroplasticity), অর্থাৎ মস্তিষ্কের নিজেকে পুনর্গঠন ও নতুন অভ্যাস অনুযায়ী পুনরায় বিন্যস্ত করার ক্ষমতা।
মন্ত্রধ্যান শুধু মানসিক প্রশান্তিই আনে না; এটি মস্তিষ্কের স্থাপত্য ও কার্যধারাকেও পুনর্গঠন করে। শরীরের স্নায়ুতন্ত্র, হরমোনীয় ভারসাম্য ও মানসিক অবস্থা এক সমন্বিত ছন্দে আসে। এই ছন্দই শব্দব্রহ্মের প্রতিধ্বনি—যেখানে ধ্বনি, মন ও মস্তিষ্ক এক সুরেলায় গলে যায়, আর চেতনা নিজের স্বরূপে শান্ত, প্রসারিত ও দীপ্ত হয়ে ওঠে।
মন্ত্রের এই রূপান্তরমূলক শক্তি কেবল স্নায়ুবৈজ্ঞানিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। মন্ত্রের ছন্দ মনকে এক অভ্যন্তরীণ তালের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, যা ধীরে ধীরে মনকে আত্মসচেতনতার দিকে টেনে আনে। প্রাচীন ঋষিরা বলেছিলেন—“মন্ত্রণাৎ ত্রায়তে”—যে-ধ্বনি মনকে মুক্তি দেয়, তাকেই মন্ত্র বলে। এই মুক্তি কোনো বাহ্যিক মুক্তি নয়; এটি মানসিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তি—যেখানে মন নিজের অস্থিরতা থেকে মুক্ত হয়ে এক নিঃশব্দ নাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই নাদই চেতনার সূক্ষ্মতম স্তর, যেখানে শব্দ ও নীরবতা, চিন্তা ও অস্তিত্ব একাকার হয়ে যায়।
এই অবস্থাকেই উপনিষদে বলা হয়েছে “নাদব্রহ্ম”—শব্দই ব্রহ্ম, এবং সেই শব্দই চেতনার উৎস। যখন মন্ত্র পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে মন তার সমস্ত বিভক্ত চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একতান কম্পনে স্থিত হয়, তখন ব্যক্তি অনুভব করে যে, সে আর শব্দ উচ্চারণ করছে না—বরং শব্দ নিজেই তার মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। তখন ধ্বনি আর কানে সীমাবদ্ধ থাকে না; তা সারা অস্তিত্বে প্রবাহিত হয়। সেই অবস্থাতেই মন নিঃশব্দ হয়, চেতনা প্রসারিত হয়, এবং মানুষের অন্তরে ব্রহ্মস্বরূপ শান্তি ও আনন্দ জেগে ওঠে।
প্রাচীন শব্দব্রহ্ম ধারণা আজ আধুনিক নিউরোসায়েন্স ও মনোবিজ্ঞানের প্রমাণসিদ্ধ সত্যে রূপ নিচ্ছে। যা একসময় ধ্যানের অভিজ্ঞতা ছিল, তা আজ মস্তিষ্কের মানচিত্রে ধরা পড়ছে। ধ্বনি সত্যিই অবচেতন তরঙ্গকে বদলে দিতে পারে; শব্দ সত্যিই চেতনার স্তরকে উঁচু করতে পারে। মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি তাই একাধারে আধ্যাত্মিক অনুশীলন, মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপি এবং স্নায়ুবৈজ্ঞানিক পুনর্গঠন—এক জীবন্ত সেতুবন্ধন, যেখানে প্রাচীন ঋষির ধ্বনি আজ বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে প্রতিধ্বনিত হয়ে বলছে, “শব্দোহম্ ব্রহ্মাহম্”—আমি সেই শব্দ, আমি সেই ব্রহ্মচেতনা।
আধুনিক দর্শনের বিভিন্ন ধারায় শব্দব্রহ্মের প্রতিফলন গভীরভাবে দেখা যায়। ভাববাদী দার্শনিক হুসার্ল ও মের্লো-পন্তি প্রথমেই এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন যে, চেতনা কখনও প্রকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। হুসার্ল বলেছিলেন—চেতনা মানেই কোনো কিছুর চেতনা; অর্থাৎ চেতনা সর্বদা কোনো বিষয়ের দিকে নিবদ্ধ থাকে (intentionality)। আমরা যখন “গাছ” শব্দটি ভাবি, তখন গাছ সম্পর্কে চিন্তা ও “গাছ” শব্দের উচ্চারণ—এই দুই অভিজ্ঞতা আলাদা নয়, বরং একসঙ্গে ঘটে।
মের্লো-পন্তি এই ভাবনাকে আরও দেহনিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। তিনি বলেন, আমরা যখন পৃথিবী দেখি, তখন কেবল ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখি না; বরং আমরা ভাষার ভেতর দিয়ে দেখি। “লাল ফুল” দেখা মানে শুধু রং দেখা নয়—এটি এমন এক দৃষ্টির কাজ, যেখানে ভাষা, চেতনা ও দেহ মিলিত হয়ে বাস্তবতা গঠন করে। এই ভাববাদী অবস্থানেই শব্দব্রহ্মের অনুরণন শোনা যায়, কারণ শব্দব্রহ্ম বলে—চেতনা ও শব্দ অবিচ্ছিন্ন—”শব্দাত্মনা বিশ্বমিদং বভূব। স তস্য বিভূতির্নান্যঃ।।” (ভাগবত পুরাণ, ৬.১৬.৫১)—"শব্দব্রহ্মের দ্বারা এই সমস্ত বিশ্ব সৃষ্টি হলো।" এই উক্তিটি নাদব্রহ্ম (Nādabrahma) তত্ত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। চূড়ান্ত বাস্তবতা কেবল এক বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং এটি শব্দ বা স্পন্দন রূপে ক্রিয়াশীল এবং সেই আদিম স্পন্দনই হলো এই দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টির কারণ। এই বিশ্বই শব্দাত্মা ব্রহ্মের প্রকাশ। অর্থাৎ যা-কিছু প্রকাশিত, তা আসলে চেতনার শব্দরূপী স্পন্দন।
এই ভাবনাটিই গাডামার তাঁর ব্যাখ্যানবিদ্যা বা hermeneutics-এ আরও তাত্ত্বিক আকার দেন। তাঁর মতে, “ভাষার বাইরে কোনো অর্থ নেই”—অর্থাৎ, সত্য বা অর্থ কোনো বাহ্যিক সত্তা নয়, যা পরে ভাষায় ধরা পড়ে; বরং ভাষার ভেতরেই অর্থের জন্ম। যেমন “স্বাধীনতা” শব্দটি রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এক অর্থে, কবিতার প্রেক্ষিতে অন্য অর্থে ধরা দেয়। তাই ভাষা কেবল মাধ্যম নয়, অর্থেরই গর্ভ। গাডামারের বিখ্যাত উক্তি—“Being that can be understood is language”—যা বোঝা যায়, সেটিই ভাষা।
এই দৃষ্টিতে, ভাষাই সত্যের আবাস এবং এটি ভারতীয় শব্দব্রহ্মেরই সমতুল্য দৃষ্টি, যেখানে বলা হয় “বাক্য ব্রহ্মণি প্রতিষ্ঠিতা” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৩.৯.১ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬.৮.৪-৬)—বাক্ই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত, ব্রহ্মই বাক্রূপে প্রকাশিত। এই উক্তিটি সেই শব্দব্রহ্ম (Śabdabrahma)-এর ধারণার একটি দিক প্রকাশ করে। সমস্ত প্রকাশিত বাক্য, ভাষা এবং মন্ত্র—যা বেদসমূহ নাদব্রহ্মরূপা ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত—তা চূড়ান্ত বাস্তবতা বা ব্রহ্মে তার মূল ভিত্তি বা আধার খুঁজে পায়। বাক্য ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মের দিকেই ফিরে যায়। অর্থাৎ, ভাষা বা শব্দ কোনো জাগতিক সৃষ্টি নয়, বরং তা ঐশ্বরিক সত্তারই একটি প্রকাশ, যা মানবচেতনাকে সেই পরম সত্যের দিকে চালিত করে।
অন্যদিকে, বিশ্লেষণাত্মক দর্শনের প্রধান ব্যক্তিত্বদের একজন কোয়াইন (W.V.O. Quine), ভাষা ও অর্থের সম্পর্ক নিয়ে এমন এক গভীর চিন্তা উপস্থাপন করেছিলেন যা আধুনিক ভাষাতত্ত্বের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল—ভাষা ও অর্থের মধ্যে কোনো স্থায়ী বা নির্ভুল এক-এক সম্পর্ক নেই; অর্থ সবসময় পরিবর্তনশীল, প্রসঙ্গনির্ভর এবং নির্দিষ্টভাবে অনুবাদযোগ্য নয়।
তিনি তাঁর বিখ্যাত “gavagai” উদাহরণের মাধ্যমে এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। ধরা যাক, একজন নৃবিজ্ঞানী কোনো অজানা আদিবাসীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, এক আদিবাসী মানুষ খরগোশ দেখে বলে উঠল—“গাভাগাই (gavagai)!” এখন অনুবাদক বুঝতে পারছেন না, এই “গাভাগাই” শব্দের মানে কী। এটি কি “খরগোশ” মানে? না “খরগোশ দেখা”-র ঘটনাটি বোঝাচ্ছে? না কি “খরগোশের লাফানো” বা “খরগোশের পা”-এর মতো কোনো অংশকে?—এই বিভ্রান্তি থেকেই কোয়াইন দেখালেন, অর্থনির্ধারণ কখনোই চূড়ান্তভাবে সম্ভব নয়।
অর্থাৎ, শব্দের সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো একক, নির্দিষ্ট অনুবন্ধন নেই। শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক স্থির নয়, বরং তা মানুষের ব্যবহার, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, ও ভাষিক রীতির উপর নির্ভরশীল। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে সেই অর্থ বদলে যায়, কিংবা আংশিকভাবে ধরা পড়ে। কোয়াইন এই অবস্থাকে বলেছেন indeterminacy of translation—অর্থাৎ অনুবাদের অনির্ধার্যতা।
এই ধারণাটি মূলত পশ্চিমা দার্শনিক ভাষাতত্ত্বের পরিমণ্ডলে ভাষা-বাস্তবতার দ্বৈত বিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, “অর্থ” কোনো বস্তু নয়, যা আমরা ভাষায় ধরে রাখতে পারি; এটি এক প্রক্রিয়া—এক সম্পর্ক—যা ভাষা, বক্তা, শ্রোতা ও প্রেক্ষিতের আন্তঃক্রিয়ায় ক্রমাগত গঠিত ও পরিবর্তিত হয়।
যদি আমরা এই ধারণাকে ভারতীয় শব্দব্রহ্ম তত্ত্বের আলোকে দেখি, তবে দেখা যায়—কোয়াইনের তত্ত্ব আসলে অজান্তেই এক গভীর অদ্বৈত অবস্থান প্রকাশ করছে। শব্দব্রহ্ম বলে—ধ্বনি ও অর্থ আলাদা কোনো সত্তা নয়, তারা একই চেতনার দুই দিক। ধ্বনি মানে চেতনার কম্পন, আর অর্থ সেই কম্পনের দীপ্ত প্রতিফলন। অর্থের অস্তিত্ব ধ্বনির মধ্যেই, আর ধ্বনির উৎস অর্থের চেতনায়।
কোয়াইনের ভাষিক আপেক্ষিকতার ধারণা এই যে—অর্থ কখনও নির্দিষ্ট নয়, বরং ভাষা-ব্যবহারের মধ্যে গঠিত—যা ভারতীয় শব্দব্রহ্ম দর্শনের সঙ্গে এক অন্তর্নিহিত ঐক্য রচনা করে। শব্দব্রহ্মের মতে, ভাষা ও বাস্তবতা দুটি পৃথক জগত নয়, বরং তারা একই চেতনার দুই প্রকাশমাত্র। একদিকে ধ্বনি (শব্দ) হলো চেতনার চলমান তরঙ্গ, আর অন্যদিকে অর্থ হলো সেই তরঙ্গের দীপ্ত প্রতিচ্ছবি। ভাষা তাই কেবল বর্ণনা নয়—এটি সৃষ্টি, কারণ শব্দের মধ্য দিয়েই বাস্তবতা প্রকাশ পায়।
কোয়াইনের “gavagai” উদাহরণ আমাদের শেখায় যে, অর্থের কোনো চূড়ান্ত বা নিরপেক্ষ রূপ নেই; এটি সর্বদাই চেতনার ব্যাখ্যা-নির্ভর স্পন্দন। শব্দব্রহ্মও সেই একই কথা বলে—শব্দ ও অর্থের ঐক্যই পরম সত্য, এবং এই ঐক্যের ভেতরেই ভাষা ও জগতের মর্ম নিহিত। ভাষা তখন কেবল প্রকাশের মাধ্যম নয়—এটি চেতনারই স্বর, ব্রহ্মেরই প্রতিধ্বনি।
এই দর্শনের আরেক দিকপাল ডোনাল্ড ডেভিডসন (Donald Davidson) এই ধারা আরও প্রসারিত করেন। তাঁর মতে, ভাষার অর্থ কখনও এককভাবে নির্ধারিত হয় না; এটি বক্তা ও শ্রোতার পারস্পরিক ব্যাখ্যার ফলে গঠিত। অর্থ কোনো পূর্বনির্ধারিত বস্তু নয়; বরং প্রতিবার কথোপকথনের সময় নতুনভাবে জন্ম নেয়। যেমন কেউ বলে, “আজ বাতাস ভারী”—এক প্রেক্ষিতে এর মানে হতে পারে, বৃষ্টি আসছে; অন্য প্রেক্ষিতে মানে এ-ও হতে পারে যে, তার মনখারাপ। অর্থ নির্ভর করছে কথোপকথনের সংলাপ ও প্রেক্ষাপটে। তাই ডেভিডসন বলেন, “There is no such thing as a language”—ভাষা কোনো বন্ধ কাঠামো নয়, বরং এক চলমান ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া। শব্দব্রহ্মেও তাই বলা হয়—চেতনা এক স্থির সত্তা নয়, এটি এক অনন্ত স্পন্দন (spanda), যা শব্দরূপে নিজেকে প্রকাশ করে।
হুসার্ল ও মের্লো-পন্তি চেতনা-প্রকাশের ঐক্য বোঝালেন, গাডামার ভাষার ভেতরে অর্থের জন্ম দেখালেন, কোয়াইন অর্থের অনির্দিষ্টতা তুলে ধরলেন, আর ডেভিডসন অর্থের পারস্পরিকতা দেখালেন। সবশেষে তাঁদের সবাই এসে মিললেন এক প্রাচীন দার্শনিক সত্যে—ভাষা, অর্থ, চেতনা, এবং বাস্তবতা আলাদা কোনো সত্তা নয়; তারা একই ব্রহ্মচেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশমাত্র। শব্দই সেই চেতনার স্পন্দন, এবং সেই শব্দই জগৎকে অর্থ দেয়।