শৈব কালী: পঁচানব্বই



এই কারণেই কাল-সংকর্ষিণী, যিনি সময়ের শোষণকারিণী, তাঁকে শৈব আগমে (যে-জ্ঞান স্বয়ং ভগবান শিব তাঁর স্ত্রী দেবী পার্বতীকে প্রদান করেছিলেন) পরম সত্তার উপাধি বলা হয়েছে—কারণ তিনি সমস্ত শক্তির উৎস, সকল গতি ও স্থিতির হৃদয়কেন্দ্র। তিনি কেবল কালকে গ্রাস করেন না; তিনি নিজেই সময়ের চেতনা, চেতনার সময় এবং সেই পূর্ণতা-সংবিত্‌ (Pūrṇatā-saṁvit)—যেখানে সৃষ্টি ও লয়, প্রক্ষেপণ ও প্রত্যাহার, ধ্বনি ও নীরবতা—সবই এক অবিচ্ছিন্ন অদ্বৈত স্পন্দনে মিলেমিশে যায়। তাঁর মধ্যেই সময় ওঠে, প্রবাহিত হয়, নাচে এবং পুনরায় লীন হয়; তাই বলা যায়—কালী কোনো পৃথক দেবী নন, যিনি সময়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন, বরং তিনিই স্বয়ং সেই চেতনা, যার অন্তরেই সময়ের উদ্‌ভব, গতি ও লয় ঘটে।

পূর্ণতা-সংবিত্‌ (Pūrṇatā–Saṁvit) মানে হচ্ছে এমন এক চেতনা, যা নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং যার বাইরে কিছুই নেই। “সংবিত্‌” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “সম্‌ + বিদ্‌” থেকে—অর্থাৎ “সম্পূর্ণভাবে জানা”। এই জানা কোনো বস্তুকে নয়, বরং নিজের স্বরূপকেই জানে; তাই সংবিত্‌ মানে সেই আত্মবিমর্শনশীল চেতনা, যা নিজের মধ্যেই জ্ঞাত, জ্ঞান ও জ্ঞানী—তিনটি অবিচ্ছেদ্য রূপে একত্র। আবার “পূর্ণতা” মানে হচ্ছে অখণ্ডতা, অভাবহীনতা, এমন এক অস্তিত্ব, যা কোনো কিছুর দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং পূর্ণতা-সংবিত্‌ হলো সেই চেতনা, যা নিজের মধ্যেই সমস্ত সম্ভাবনা ও পরিণতি ধারণ করে—যা সব সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের ভিতর দিয়ে অপরিবর্তিত থেকে যায়।

কাশ্মীর শৈবদর্শনের ঋষিরা এই পূর্ণতা-সংবিত্‌কেই “চিতি” বা “পরম চেতনা” নামে অভিহিত করেছেন। উৎপলদেব তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.৮)-তে বলেছেন—“চিতিরনন্তা চৈক্যা পূর্ণতা চা স্বভাবতঃ”—অর্থাৎ, চেতনা অনন্ত, এক ও পূর্ণ, এবং এই পূর্ণতাই তার স্বভাব। এখানে “চিতি” কোনো সীমিত মানসিক চেতনা নয়; এটি সেই পরম আত্মবোধ, যেখানে সমস্ত জগৎ তারই প্রকাশ। অভিনবগুপ্ত এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় বলেছেন—“পূর্ণতা নাম চিতঃ স্বাতন্ত্র্যলক্ষণা”—অর্থাৎ, পূর্ণতা মানে সেই স্বাধীন চেতনা, যার দ্বারা বিশ্ব নিজেই নিজের বিকাশরূপে প্রকাশিত। এই স্বাতন্ত্র্যই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বের প্রাণ—চেতনা কোনো নিষ্ক্রিয় সত্তা নয়, সে নিজেই লীলাময় সৃষ্টিশক্তি।

এই পূর্ণতা-সংবিত্‌-এরই প্রতিফলন আমরা দেখি তন্ত্রালোকের (১.৮৭) উক্তিতে—“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—অর্থাৎ, শিব নিজেই পাঁচটি ক্রিয়া করেন—সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোধান ও অনুগ্রহ। এই পাঁচ ক্রিয়া শিবচেতনারই অন্তর্গত লীলা, কারণ তাঁর চেতনা কোনো অভাব পূরণ করতে সৃষ্টি করে না; বরং নিজের আনন্দে, নিজের পূর্ণতাকে প্রকাশ করতে করে। তাই তাঁর সৃষ্টি ও লয় উভয়ই স্বতঃস্ফূর্ত—যেমন পূর্ণ সাগর নিজের ঢেউ তুলেও শান্ত থাকে, তেমনি পূর্ণতা-সংবিত্‌ সব কিছু প্রকাশ করেও নিজের স্থির দীপ্তিতে অপরিবর্তিত থাকে।

এই ধারণার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় উপনিষদীয় বাণীতেও। ঈশোপনিষদের প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে—“পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে”—অর্থাৎ যা পূর্ণ, তা থেকেই এই পূর্ণ জগৎ প্রকাশিত হয়; তবুও সেই পূর্ণতা কখনও কমে না, বরং অবিকৃত থাকে। এই মন্ত্রের অর্থই পূর্ণতা-সংবিত্‌-এর সার—চেতনা থেকে বিশ্ব উদ্ভূত হলেও চেতনা কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, কারণ সে নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ।

অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়েছে—“সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.১)—অর্থাৎ ব্রহ্ম অনন্ত, জ্ঞানরূপ ও সত্যস্বরূপ; স্থির, নির্বিকার, এবং চির-সাক্ষী। আর কাশ্মীর শৈবতত্ত্বে বলা হয়—“চিতিরনন্তা পূর্ণা স্বাতন্ত্র্যময়ী”—চেতনা অনন্ত, পূর্ণ ও স্বাধীন; তিনি নিজের আনন্দে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় করেন। দুটির তত্ত্ব একই—একই পরম, অভেদ চেতনা—কিন্তু অদ্বৈতে তিনি নিস্তরঙ্গ দীপ্তি, আর শৈবতত্ত্বে সেই দীপ্তিই চেতনার লীলাময় স্পন্দন।

পূর্ণতা-সংবিত্‌ হলো সেই পরম চেতনা, যা কোনো অভাবের দ্বারা চালিত নয়, বরং নিজের স্বভাবগত আনন্দে সৃষ্ট ও লয় উভয়ই করে। শিব ও শক্তি এখানে দুই নয়—শিব তাঁর স্থির দীপ্তি, শক্তি তাঁর চলমান স্পন্দন। এই দুই যখন একীভূত, তখনই প্রকাশ পায় সেই মহাপূর্ণ চেতনা, যার মধ্যে সব ভেদ, সব দ্বৈততা গলে যায়। তন্ত্রালোকের (১.১) সূচনায় অভিনবগুপ্ত যেভাবে বলেছেন—“চিতিরেতা পরা দেবী স্বাতন্ত্র্যান্মহিষী শিভঃ”—চেতনা নিজেই পরা দেবী, আর তাঁর স্বাধীনতাই শিবত্ব। এই চেতনা-স্বাধীনতাই আসলে পূর্ণতা-সংবিত্‌—যেখানে জ্ঞান, কর্তা, কর্ম, ও বস্তু—সব এক অনন্ত ঐক্যে লীন হয়ে যায়।

কালী এবং ত্রিবিধ শক্তি: সমগ্র মহাবিশ্বের ক্রিয়া-প্রবাহকে বোঝানো যায় তিনটি মৌলিক শক্তির মাধ্যমে—পরা (Parā), পরা-অপরা (Parā-aparā) এবং অপরা (Aparā)। এই ত্রিবিধ শক্তিই চেতনার বিকাশের তিন স্তর এবং কালী এই তিনটিরই সর্বজনীন আধার।

পরা শক্তি হলো চেতনার অতীন্দ্রিয় ও পরম স্তর—যেখানে চেতনা নিজের নিখাদ স্বাধীনতায় স্থিত, কোনো কার্য বা গতির ঊর্ধ্বে। এই স্তরে কালী হচ্ছেন নিঃসংশয় স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya)—যেখানে কিছুই সীমাবদ্ধ নয়, সব কিছুই সম্ভাবনাময়। এখানে তিনি প্রকাশহীন সম্ভাবনার আদি দীপ্তি—চেতনার স্বরূপ, যা অনির্দেশ্য, অচল এবং সর্বশক্তিমান।

পরা-অপরা হলো মধ্যবর্তী স্তর, যা অতীন্দ্রিয় ও অভিজ্ঞতামূলক স্তরের সংযোগসেতু। এখানে কালী প্রকাশের ইচ্ছা হয়ে ওঠেন—সৃষ্টি-ইচ্ছা, সেই অন্তর্নিহিত তাড়না, যার দ্বারা পরম চেতনা নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। এটি সেই সীমারেখা, যেখানে স্থিত নীরবতা প্রথমবার সৃষ্টির দিকে গতি পেতে শুরু করে, যেমন শান্ত সমুদ্রের গভীরে প্রথম তরঙ্গের উদ্‌ভব।

তৃতীয় স্তর অপরা হলো অভিজ্ঞতামূলক বা প্রকাশিত স্তর—যেখানে কালী অনুক্রম (সময় ও কারণের ধারাবাহিকতা) রূপে আবির্ভূত হন। এখানে তিনি ঘটনাপ্রবাহ, সময়ের ধারাবাহিকতা এবং সৃষ্ট জগতের ক্রিয়াশীল শক্তি। এই স্তরে তিনি সেই কালী, যিনি মহাকাল-শক্তি—জগৎকে গতি দেন, কর্মে পরিণত করেন এবং জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে উপস্থিত থাকেন।

এই তিন স্তরই কালী-র মধ্যে অবস্থিত, কারণ তিনি চেতনার তিন কার্যকারিতা—নিষ্ক্রিয়, মধ্যস্থ ও সক্রিয়—সব একত্রে ধারণ করেন। তিনি কেবল এদের ধারক নন; তিনিই এদের সমন্বয়বিন্দু, যেখানে সকল দ্বৈততা অতিক্রম করে চেতনার পূর্ণ একতা প্রকাশিত হয়।

কালী-র এই ত্রিবিধ প্রকাশ আবার এক অন্য ত্রিত্বকে প্রতিফলিত করে—সৎ (Sat), চিত্‌ (Cit) এবং আনন্দ (Ānanda)—অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দের ঐক্য।

যখন তিনি পরা রূপে প্রকাশিত, তখন তিনি চিত্‌-আনন্দ—বিশুদ্ধ চেতনার জ্যোতি, স্বয়ং স্বাধীনতা।

পরা-অপরা রূপে তিনি সৎ-চিত্‌—সৃষ্টির ইচ্ছার দীপ্ত বীজ, যেখানে অস্তিত্ব নিজের মধ্য থেকে অভিপ্রায়ে জেগে ওঠে।

আর অপরা রূপে তিনি সৎ-আনন্দ—সৃষ্টির অভিজ্ঞতামূলক আনন্দ, কর্ম ও জগতের চেতনা-প্রবাহ।

এই সব স্তরের অন্তরেই কালী বিশুদ্ধ রূপে বিদ্যমান—শুদ্ধ চেতনা, যিনি কোনো কর্তা, বস্তু, বা জ্ঞানের শ্রেণী দ্বারা স্পর্শিত নন। এই শুদ্ধ অবস্থা হলো সেই পূর্ণ-সংবিত্‌—এক নিখুঁত চেতনা, যেখান থেকে সমস্ত প্রক্ষেপণ (projection) ও পুনঃশোষণ (involution)-এর মহাজাগতিক ছন্দ চিরন্তনভাবে প্রবাহিত।

এই অবস্থায় কালী নীরব, অথচ সর্বশক্তিময়। তিনি এক দীপ্ত স্তব্ধতা—যেখান থেকে সৃষ্টি ও লয় একযোগে উদ্‌ভূত হয়, যেমন নিঃশব্দ হৃদস্পন্দনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের সংগীত। এই স্তব্ধ দীপ্তি (Śānta Prakāśa) হলো চেতনার অন্তর্লীন আলো, যা একই সঙ্গে অবিকৃত ও স্পন্দিত, স্থিত ও গতি।

“শান্ত প্রকাশ” (Śānta Prakāśa) শব্দযুগল কাশ্মীর শৈবদর্শনের এক গভীর ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব, যা “চেতনার সর্বোচ্চ অবস্থা”—অর্থাৎ নির্বিকার দীপ্তি বা শান্ত আলোকরূপ পরমচৈতন্যকে নির্দেশ করে।

“প্রকাশ (Prakāśa)” মানে হলো আলোক, দীপ্তি, চেতনা, আত্মপ্রকাশ। এটি শিবতত্ত্বের মূল স্বরূপ—চেতনা নিজেকে ও বিশ্বকে আলোকিত করে। কিন্তু এই আলোক সর্বদা কোনো বস্তুর দিকে প্রক্ষেপিত নয়; নিজের মধ্যেই স্বপ্রকাশমান, আত্মনিষ্ঠ, কোনো উদ্দেশ্য বা গতি-বিশিষ্ট নয়। যখন এই প্রকাশ নিজের অন্তঃস্থিত স্বরূপে স্থিত হয়—যেখানে কোনো আন্দোলন, কামনা, বিভেদ বা ক্রিয়া নেই—তখন সেই অবস্থাকেই বলা হয় শান্ত প্রকাশ।

অর্থাৎ, শান্ত প্রকাশ হলো চেতনার স্থিত, অব্যাহত, অনুৎপাদিত জ্যোতি, যেখানে চেতনা শুধু নিজেরই উপস্থিতিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। এটি সেই “প্রকাশ” যা স্পন্দ (চেতনার কম্পন) বা বিমর্শ (স্ববিমুখ প্রতিফলন) এর আগের স্তরে থাকে—অর্থাৎ পরম নিস্তরঙ্গ, তবুও জীবন্ত।

কাশ্মীর শৈবতত্ত্বে বলা হয়—শিবের প্রকৃতি দ্বিমুখী:

প্রকাশ (Prakāśa)—চেতনার আলোক বা সচেতনতা।

বিমর্শ (Vimarśa)—সেই আলোকের আত্ম-অবগত প্রতিফলন বা স্বজ্ঞা।

“শান্ত প্রকাশ” হলো এই দুইয়ের প্রথম ও অন্তঃস্থ ঐক্যাবস্থা—যেখানে প্রকাশ নিস্পন্দ, আর বিমর্শ এখনও পৃথক হয়নি। এই অবস্থায় চেতনা নিজের স্বরূপে শান্ত, কিন্তু নিস্তেজ নয়; বরং সেই শান্তি নিজেই এক গভীর দীপ্তি, যা থেকে পরবর্তী সমস্ত স্পন্দ, সৃষ্টি ও লীলা উৎসারিত হয়।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৫৬)-এ এই শান্ত প্রকাশকে “চিদাকাশ” বা “বিশুদ্ধ চৈতন্য-আকাশ” নামে উল্লেখ করেছেন—“শান্তঃ প্রকাশো হি শিবঃ, ন তু তামসো ন নিরর্থকঃ।” অর্থাৎ, শিবের প্রকাশ শান্ত—তিনি কোনো তমস বা জড়তা নন, বরং নিস্তব্ধ আলোকরূপ চেতনা।

শান্ত প্রকাশ মানে সেই অবস্থা, যেখানে চেতনা নিস্তরঙ্গ কিন্তু সম্পূর্ণ সচেতন; যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জানা—সব এক নিঃশব্দ দীপ্তিতে বিলীন। এটি শিবচেতনার মৌল অবস্থান—যেখানে থেকে সমস্ত সৃষ্টি-লীলা উদ্ভূত হয়, এবং যেখানে শেষে সব লয় লাভ করে।

এভাবে, সমস্ত অধিবিদ্যাগত স্তর—পরা, পরা-অপরা, অপরা—শেষপর্যন্ত একত্রে বিলীন হয় কাল-সংকর্ষিণী-র সত্তায়। তিনি সেই এক অদ্বয় নীতি, যিনি নিজের মধ্য থেকে বহুত্ব সৃষ্টি করেন, আর নিজের মধ্যেই সব ফিরিয়ে নেন। তাঁর এই শক্তি হলো স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya)—চেতনার নিঃশর্ত স্বাধীনতা, যা কখনও স্থবির নয়, বরং চিরসক্রিয় আত্ম-প্রকাশ।

যখন এই স্বাধীনতা সৃষ্টির দিকে প্রবাহিত হয়, তখন আমরা দেখি বিশ্ব ও সময়ের উন্মেষ; আর যখন তা নিজের কেন্দ্রে ফিরে আসে, তখন সব শব্দ, গতি ও চিন্তা বিলীন হয়ে যায়—উদ্‌ভাসিত হয় সেই চূড়ান্ত স্থিতি, যেখানে জানা ও করণ, প্রকাশ ও প্রত্যাহার, ভিন্ন নয়। সেখানে কালী নিজেই সময়, শক্তি ও চেতনার একাকার স্বরূপ—যিনি অদ্বৈত পরমসত্তা, অকাল, অনাদি, অনন্ত।

কাল-সংকর্ষিণী—এই নামেই কালী-র সেই চেতনারূপ সত্তা নির্দেশিত, যিনি একাধারে সৃষ্টি ও লয়ের জীবন্ত প্রতীক। তিনি দ্বিমুখী কর্ম সম্পাদন করেন—প্রথমত, নিজের মধ্যেই বহুত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে জগৎ-প্রপঞ্চের অনুক্রম স্থাপন করেন; দ্বিতীয়ত, পরম সত্তার পঞ্চকৃত্য (pañcakṛtya)—সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোধান (tirodhāna) এবং অনুগ্রহ (anugraha)—এই পাঁচটি চিরন্তন ক্রিয়ার অন্তর্নিহিত নীতিকে প্রকাশ করেন। এভাবেই কালী হলেন উভয় ধারা—অবতরণমূলক (descending) ও আরোহণমূলক (ascending)—এর এক অবিচ্ছিন্ন গতিশক্তি।

অর্থাৎ, তিনি যেমন বহির্মুখী সৃষ্টির উৎস, তেমনই অন্তর্মুখী লয়ের কেন্দ্র। তাঁর সত্তা একই সঙ্গে সৃষ্টি (sṛṣṭi) ও ভাসা (bhāsā)—অর্থাৎ, তিনি সেই এক বিন্দু, যেখানে সৃষ্টির আরম্ভ (সৃষ্টি) ও আলোকের প্রকাশ (ভাসা) এক হয়ে যায়। সৃষ্টির মধ্যে তিনি দীপ্ত, কারণ সমস্ত উদ্‌ভব তাঁরই চেতনা থেকে উত্থিত; আর দীপ্তির মধ্যেই তিনি স্থিত, কারণ সেই আলোকই তাঁর স্বরূপ।

তিনি স্বরূপে চেতনা—যা সব কিছুর ভিত্তি; অবস্থায় সামঞ্জস্য—যেখানে কোনো ভেদ বা দ্বন্দ্ব নেই; আর প্রকৃতিতে বাণী—অর্থাৎ সেই আদিম পরা বাক্‌ (Parā Vāk), যার মধ্যে সমস্ত শব্দ ও অর্থ, সমস্ত জগতের প্রকাশের সম্ভাবনা নিদ্রিত অবস্থায় বিরাজমান।

এই অর্থে কালী কেবল সময় বা শক্তির দেবী নন; তিনি হলেন ব্রহ্মচেতনার আত্ম-ধ্বনি (ātma-dhvani)—সেই পরম নীরবতা, যার গভীরে মহাবিশ্বের প্রতিটি তরঙ্গ এক অনন্ত “সো’হং” উচ্চারণ করে: “আমি সেই।”