এই ব্যাখ্যাটি মূলত সায়ণাচার্যের ঋগ্বেদভাষ্য থেকে জনপ্রিয় হয়েছে। ঋগ্বেদের (৩.৬২.১০)—যেখানে গায়ত্রী মন্ত্র আছে—তার ভাষ্যে “গায়ত্রী” শব্দের অর্থ করতে গিয়ে সায়ণ বলেছেন, এটি এমন এক ছন্দ বা মন্ত্র, যা জপকারীর রক্ষাকারিণী। তাঁর ভাষ্যে “গায়নরূপ জপকারীকে ত্রায়তে”—এই ভাবার্থে গায়ত্রী শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়।
তা ছাড়া, নারায়ণীয় উপনিষদ (১.৪) এবং মহানারায়ণ উপনিষদ-এর গায়ত্রী-ধ্যান অংশেও “গায়ত্রী ত্রায়তে”—এই ধারণা দেখা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, গায়ত্রী দেবী তাঁর উপাসককে সকল দুঃখ থেকে রক্ষা করেন। আরও পরে, গোপালতাপনীয় উপনিষদ, স্কন্দপুরাণ, এবং শ্রীভাগবত পুরাণ (ষষ্ঠ স্কন্ধ, অষ্টম অধ্যায়)-এর গায়ত্রী-মাহাত্ম্য অংশে এই একই ধাতু-অর্থ (“ত্রায়তে”: রক্ষা করা) পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
অর্থাৎ, “গায়ন্তং ত্রায়তে ইতি গায়ত্রী” কোনো মূল ঋচা (ঋক্ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ স্তোত্র, মন্ত্র বা শ্লোক) নয়, বরং এটি একটি ব্যুৎপত্তিগত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা—যা মন্ত্রবিজ্ঞানের ধারায় পরবর্তী ঋষি ও ভাষ্যকারগণ প্রচলিত করেছেন।
গায়ত্রী কেবল একটি ছন্দ বা মন্ত্র নয়, বরং এক জীবন্ত শক্তি, যিনি সাধকের চেতনার রক্ষাকারিণী। তাঁর জপ মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে, ভয় ও অজ্ঞান থেকে মুক্তি দেয়, এবং জ্ঞানের সূর্যালোক জাগিয়ে তোলে। তাই পরম্পরায় বলা হয়—গায়ত্রী ধ্বনি “জপকারীকে রক্ষা করে”—কারণ তিনি কেবল বাহ্যিক বিপদ থেকে নয়, অন্তরের অজ্ঞান থেকেও রক্ষা করেন।
“গায়ন্তং ত্রায়তে ইতি গায়ত্রী” কোনো একক বেদবাক্য নয়; এটি ভারতীয় ভাষ্য-ঐতিহ্যের এক আধ্যাত্মিক ব্যুৎপত্তি, যা প্রাচীন ঋষিদের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত—যে মন্ত্র সত্যিকার অর্থে চেতনার রক্ষাকবচ, সেই মন্ত্রই “গায়ত্রী।”
“ওঁ” হলো ব্রহ্মের আদিস্পন্দন, সেই প্রণব ধ্বনি যা সৃষ্টির সূচনাতেই চেতনার কম্পন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। “ভূঃ”, “ভুবঃ”, “স্বঃ”—এই তিনটি পদ মহাবিশ্বের তিন স্তর নির্দেশ করে: পৃথিবী (স্থূল জগৎ), আকাশ বা মধ্যভূমি (প্রাণ ও মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্র), এবং স্বর্গ বা সূক্ষ্ম জগত (চেতনার বিশুদ্ধ স্তর)। এর পরের অংশ—“তৎ সবিতুর্বরেণ্যং”—মানে “আমরা সেই সর্বোৎকৃষ্ট, পরম দীপ্তিময় দেবতাকে ধ্যান করি, যিনি সব কিছুতে প্রাণসঞ্চার করেন।” এখানে “সবিতৃ” শব্দটি “সাভিতৃ”—সূর্যের আরেক নাম—যিনি কেবল আলো দেন না, বরং জীবন, শক্তি ও জ্ঞানের উৎস।
“ভর্গো দেবস্য ধীমহি”—এই বাক্যাংশে নিহিত আছে সাধকের অন্তর্জগতের পরিশুদ্ধির আহ্বান। “ভর্গ” মানে শুদ্ধ আলো, সেই দীপ্তি যা অজ্ঞান ও অন্ধকার দূর করে। “ধীমহি” মানে আমরা ধ্যান করি, আমরা আত্মসাৎ করি। তাই গায়ত্রী মন্ত্রে ধ্যান মানে কোনো বাহ্যিক দেবতার পূজা নয়, বরং নিজের অন্তরচেতনার দীপ্তির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া। শেষ অংশ—“ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াত্”—মানে “যিনি আমাদের বুদ্ধিকে প্রেরণা দিন, জ্ঞানের পথে পরিচালিত করুন।” এই অংশেই মন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য—অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, মূঢ়তা থেকে জ্ঞানের দিকে, সংকীর্ণতা থেকে মুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া।
গায়ত্রী মন্ত্রে সূর্য কেবল জ্যোতির নক্ষত্র নয়; তিনি অন্তর্জ্ঞান ও আত্মপ্রকাশের প্রতীক। সূর্যের আলো যেমন পৃথিবীকে জাগিয়ে তোলে, তেমনি গায়ত্রী মন্ত্রের আলো মানবমনকে জাগায়—অবচেতনের অন্ধকার ভেদ করে বোধ, নৈতিকতা ও সত্যের উপলব্ধি ঘটায়। উপনিষদে সূর্যকে বলা হয়েছে “দৃশ্য ব্রহ্ম”—অর্থাৎ দৃশ্যমান আলোকরূপে প্রকাশিত পরম চেতনা। সেই চেতনারই আহ্বান গায়ত্রী মন্ত্রে—যেন তার দীপ্তি মানুষের অন্তরে প্রতিফলিত হয়, চিন্তায়, বুদ্ধিতে ও কর্মে জ্ঞানের সুষমা নিয়ে আসে।
গায়ত্রী ছন্দ ২৪ মাত্রার, যা শ্বাসের প্রাকৃতিক ছন্দের সঙ্গে একদম সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ছন্দে জপের সময় শ্বাস, হৃদস্পন্দন ও চিন্তার গতি এক ছন্দে মিশে যায়, ফলে মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের মধ্যে এক সুরময় ঐক্য সৃষ্টি হয়। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানও দেখিয়েছে, মন্ত্রোচ্চারণের নিয়মিত পুনরাবৃত্তি মস্তিষ্কের তরঙ্গরীতিকে (brainwave) স্থিতিশীল করে, মনোযোগ ও আত্মসংযম বৃদ্ধি করে এবং মানসিক উদ্বেগ হ্রাস করে।
গায়ত্রী মন্ত্র তাই কেবল একটি প্রার্থনা নয়, বরং চেতনার বিজ্ঞান—যেখানে শব্দ, শ্বাস, ও মন একত্রে কাজ করে। এটি মানুষের ভিতরকার সূর্যকে জাগিয়ে তোলে—যে-সূর্য বাইরের আকাশে নয়, বরং অন্তর্জগতে উদিত হয়। এর জপ মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, সত্য, আলো ও জ্ঞান কোনো বাহ্যিক প্রাপ্তি নয়; তারা অন্তরের দীপ্তিরই প্রকাশ। তাই গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ মানে নিজের আত্মার সূর্যকে ধ্যান করা—যিনি অজ্ঞানতার অন্ধকারে আলোক এনে বলেন, “তোমার চেতনা-ই দেবতা, তোমার বুদ্ধিই প্রার্থনা, আর তোমার হৃদয়ই মন্দির।”
“ওঁ”, “হ্রীং”, “নমঃ শিবায়” ও “গায়ত্রী মন্ত্র”—এই চারটি ধ্বনি আসলে চেতনার চার স্তর নির্দেশ করে—
“ওঁ” হলো সৃষ্টির আদি ধ্বনি,
“হ্রীং” হলো শক্তির প্রেমময় প্রকাশ,
“নমঃ শিবায়” হলো আত্মসমর্পণ ও শুদ্ধতার জাগরণ,
“গায়ত্রী” হলো আলোক, জ্ঞান ও চেতনার বিস্তার।
এরা একত্রে মানুষকে বাহ্যিক শব্দ থেকে অন্তর্জাগতিক নীরবতায়, অজ্ঞান থেকে প্রজ্ঞায়, বিভাজন থেকে ঐক্যে নিয়ে যায়। শব্দ এখানে কেবল উচ্চারণ নয়, এটি চেতনার সেতুবন্ধন—যার মাধ্যমে মানুষ নিজের মধ্যের দেবত্বকে চিনতে শেখে।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি এক ধরনের জ্ঞানগত প্রতিসংঘাত চক্র (cognitive feedback loop) তৈরি করে—একটি ছন্দময় প্রতিধ্বনি, যা মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম (যা আবেগ ও স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে) এবং প্রীফ্রন্টাল কর্টেক্স (যা যুক্তি, মনোযোগ ও আত্মসংযম নিয়ন্ত্রণ করে) এর মধ্যে এক সূক্ষ্ম সমতা স্থাপন করে। যখন মন্ত্রধ্বনি নিয়মিতভাবে পুনরাবৃত্ত হয়, তখন সেই ধ্বনি ধীরে ধীরে অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করে এবং সঞ্চিত মানসিক বিকার, ভয়, অপরাধবোধ, হতাশা ও আবেগজনিত সংকোচের স্তরগুলো আলগা হয়ে যেতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় অবচেতনের “ছায়া”—যা মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইউং-এর ভাষায় মানুষের অবদমিত অনুভূতি ও অচেনা মানসিক দিকগুলির প্রতীক—ধীরে ধীরে উন্মুক্ত ও পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে।
আধুনিক নিউরোসায়েন্সের গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দ—যেমন ৪ থেকে ৮ হার্জ, যা “থিটা ফ্রিকোয়েন্সি” নামে পরিচিত—মস্তিষ্কে একধরনের সমলয় প্রভাব (synchronization effect) সৃষ্টি করে। এতে মস্তিষ্কের দুই অংশ, অর্থাৎ বাম ও ডান হেমিস্ফিয়ার, সমন্বিতভাবে কাজ করতে শুরু করে, ফলে জন্ম নেয় এক গভীর একাত্ম মনোযোগ (focused awareness) ও শান্ত সচেতনতা। MRI ও EEG পরীক্ষায় দেখা গেছে, মন্ত্রোচ্চারণ বা একঘেয়ে শব্দের ধ্যানমগ্ন প্রবাহের সময় অ্যামিগডালা (যা ভয়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে) শান্ত হয়ে যায়, আর ফ্রন্টাল লোব-এ “গামা কোহেরেন্স” বৃদ্ধি পায়—যা আনন্দ, স্বচ্ছতা, করুণা ও অন্তর্নিবিষ্ট প্রশান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত।
এইভাবে প্রাচীন নাদযোগের “অন্তর্নাদ” তত্ত্ব আজ বৈজ্ঞানিকভাবে নতুন ব্যাখ্যা পাচ্ছে। নাদযোগে যেমন বলা হয়, ধ্বনি মনকে পরিষ্কার করে ও অবচেতনকে আলোকিত করে, তেমনি আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানও দেখাচ্ছে—শব্দের ছন্দ মস্তিষ্কের রসায়ন পরিবর্তন করে—ফলে মানসিক প্রশান্তি, আবেগের ভারসাম্য এবং আধ্যাত্মিক উন্মুক্তি ঘটে।
অর্থাৎ, যাকে প্রাচীন ঋষিরা বলেছিলেন “অনাহত নাদ”—চেতনার নিঃশব্দ অন্তরধ্বনি—আজ বিজ্ঞান সেটিকেই নতুন ভাষায় ব্যাখ্যা করছে “নিউরাল রেজোন্যান্স” বা “ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্ট” হিসেবে। নাদযোগের ধ্বনি-ধ্যান তাই কেবল আধ্যাত্মিক অনুশীলন নয়, বরং মনোবৈজ্ঞানিক পরিশুদ্ধি ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক সমতা প্রতিষ্ঠার এক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। মন্ত্র বা ধ্বনির পুনরাবৃত্তি মনের ঘন অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে ভিতরের আলো জাগিয়ে তোলে, আর মানুষকে নিয়ে যায় সেই গভীর স্থিতির অবস্থায়, যেখানে মন নিস্তব্ধ হলেও চেতনা স্পন্দিত থাকে—যেমন নাদযোগে বলা হয়, “শব্দেই নীরবতার জন্ম।”
নাদযোগের লক্ষ্য কেবল শ্রবণ বা সংগীত নয়; এর উদ্দেশ্য চেতনার উৎসে ফিরে যাওয়া। যখন সাধক অনাহত নাদে স্থির হয়, তখন সমস্ত চিন্তা, রূপ ও শব্দ বিলীন হয়ে যায়, কেবল চেতনার দীপ্তি অবশিষ্ট থাকে। তখন জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জানন—এই তিনের ভেদ মুছে যায়, আর প্রকাশ পায় সেই সত্য, যেখানে চেতনা ও ধ্বনি এক হয়ে যায়।
নাদযোগ হলো শব্দের মধ্য দিয়ে নিস্তব্ধতায় পৌঁছানোর পথ। এখানে বাহ্যিক ধ্বনি ধীরে ধীরে অন্তর-অনুরণনে রূপ নেয়, আর সেই অনুরণন শেষে বিলীন হয় সেই ব্রহ্মে, যিনি নিজেই পরম নাদ। তখন সাধক উপলব্ধি করে—ধ্বনি আর চেতনা এক, ব্রহ্মই নাদ, আর নাদই ব্রহ্ম—এই উপলব্ধিই নাদযোগের পরম লক্ষ্য।
অন্যদিকে ‘মায়াব্রহ্ম’ মানে সেই ব্রহ্ম, যিনি জগৎরূপে প্রকাশিত—নাম-রূপ-মায়া-প্রপঞ্চের মধ্যেই তিনি বিকশিত। ভাগবত এখানে বোঝাতে চায়—মানুষ যদি একাগ্রভাবে যে-কোনো এক দিকে নিবিষ্ট হতে পারে, তবে সেই নিষ্ঠাই তাকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। কিন্তু যে-নিষ্ঠা শব্দব্রহ্মে, অর্থাৎ দেবনাম বা বৈদিক নাদে, তা সরাসরি পরমচেতনায় পৌঁছে দেয়, কারণ শব্দই ব্রহ্মের প্রথম রূপ।
তন্ত্র ও উপনিষদে বলা হয়েছে—“নাদব্রহ্ম” বা “শব্দব্রহ্ম” হলো সেই পরম স্পন্দন, যেখান থেকে সৃষ্টি শুরু হয়। মৈত্রী উপনিষদ (৬.২২) স্পষ্টভাবে বলে যে ব্রহ্মের দুটি রূপ রয়েছে: একটি শব্দ-ব্রহ্ম (Śabda-Brahman), যা শব্দের আকারে প্রকাশিত ব্রহ্ম (নিম্নতর রূপ) এবং অন্যটি পর-ব্রহ্ম (Para-Brahman), যা অব্যক্ত ও নিরাকার (সর্বোচ্চ রূপ)।
শব্দই ব্রহ্ম, কারণ সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ ধ্বনি। সেই ধ্বনি থেকেই ভাষা, ভাব, চিন্তা ও জগৎ সৃষ্টি হয়। তাই শব্দের সঙ্গে সংযোগ মানে মূল চেতনার সঙ্গে সংযোগ। শঙ্করাচার্যের মতে, সাধকের প্রথম কাজ হলো শব্দব্রহ্মে নিষ্ঠা স্থাপন করা—অর্থাৎ বেদ, উপনিষদ, ওঁ-কার বা ঈশ্বরনাম শুনে, চিনে, অনুভব করে মনকে স্থির করা। শব্দব্রহ্ম মানে এখানে বৈদিক জ্ঞানের স্তর, যা ধীরে ধীরে মানুষকে নিয়ে যায় পরব্রহ্ম বা সরাসরি অভিজ্ঞতার স্তরে। তিনি বলেন—“শব্দব্রহ্মনিষ্ঠাতো পরব্রহ্মলাভঃ”—শব্দব্রহ্মে স্থিতি হলে পরব্রহ্মে পৌঁছনো সহজ হয়। যেমন নদীর জল প্রথমে তরঙ্গিত, তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে সাগরে মিশে যায়—তেমনি শব্দের ধ্বনি ধীরে ধীরে মিলে যায় নীরব পরব্রহ্মে।
কাশ্মীর শৈব দর্শন এই ধারণাটিকে আরও এক ধাপ গভীরে নিয়ে যায়। এখানে শব্দব্রহ্ম মানে চেতনার স্পন্দন (Spanda)—যা প্রথমে শব্দ, পরে ভাব, শেষে নিঃশব্দ চৈতন্যে মিশে যায়। অভিনবগুপ্ত বলেন—“নাদঃ কুণ্ডলিনী শক্তিঃ”—শব্দই কুণ্ডলিনী, কুণ্ডলিনিই পরাশক্তি। অর্থাৎ শব্দই সেই জীবন্ত শক্তি, যিনি সৃষ্টির সব স্তরে কম্পিত। বগলামুখী বা কালী যেমন শব্দ স্তব্ধ করে সত্য প্রকাশ করেন, তেমনি শব্দব্রহ্মে নিষ্ঠা মানে শব্দের ভেতরে থাকা সেই নীরব ব্রহ্মকে চেনা।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এই নিষ্ঠা মানে মনোযোগের পরম প্রশিক্ষণ—যেখানে মন একটি ধ্বনির সঙ্গে একাত্ম হয় এবং নিজের বিচ্ছিন্নতা হারায়। শব্দজপ বা মন্ত্রচর্চা তখন কেবল ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং গভীর মনোনিবেশ ও আত্মসংহতির প্রক্রিয়া। শব্দ যখন নিরবচ্ছিন্নভাবে মনকে বেঁধে রাখে, তখন মন তার ছড়িয়ে-থাকা চিন্তার গতি হারায় এবং একাগ্রতা জন্মায়—এই একাগ্রতাই ব্রহ্মানুভবের প্রথম পদক্ষেপ।
“শব্দব্রহ্মণি নিষ্ঠা” এই বাক্যটি কেবল বৈদিক মন্ত্রপাঠের অনুশাসন নয়; এটি এক গভীর চেতনতত্ত্বের ঘোষণা। এটি বলে—সত্যে পৌঁছাতে শব্দকেই সেতু করে নিতে হবে, কারণ শব্দই প্রথম প্রকাশ, আর নীরবতাই শেষ গন্তব্য। যখন কেউ শব্দের মধ্যে দিয়ে সেই নীরবতাকে অনুভব করতে শেখে—তখন শব্দব্রহ্ম থেকে পরব্রহ্মে উত্তরণ ঘটে এবং শব্দ নিজেই হয়ে ওঠে মুক্তির পথ। “শব্দব্রহ্মণি নিষ্ঠা” মানে সেই চেতনা-অবস্থা, যেখানে শব্দই সাধনা, শব্দই জ্ঞান, শব্দই ব্রহ্ম, আর শব্দের অন্তঃস্থ নীরবতাই মুক্তি।