কাশ্মীর শৈব দর্শনে, এই প্রতীক আরও সূক্ষ্ম অর্থে প্রকাশিত। শৈবতত্ত্বে বলা হয়, কর্ম হলো স্পন্দ—চেতনার স্বাভাবিক কম্পন। যখন এই স্পন্দ অহং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তা বন্ধন; কিন্তু যখন তা শুদ্ধ চেতনার থেকে উদ্ভূত হয়, তখন তা লীলা। মৃতবাহুর-মেখলা-পরিহিতা কালী সেই অবস্থার প্রতীক, যেখানে চেতনা নিজের কর্মকাণ্ডকে নিজেরই স্বরূপরূপে স্বীকার করে—কোনো “অন্য” কর্তা নেই। তাঁর কোমরের কোমরবন্ধ তাই “স্বাতন্ত্র্যশক্তি”-র প্রতীক—যেখানে শিবচেতনা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ক্রিয়ারূপে বিকশিত হয়, কিন্তু কোনো আসক্তি বা ফল-প্রত্যাশা ছাড়া।
শাক্ত দর্শনে কালী-র কোমরে বাঁধা মৃতবাহুর মেখলা বা কোমরবন্ধ এক গভীর তান্ত্রিক প্রতীক, যা দেবী-শক্তির আত্মসংযম বা nigraha-śakti-র প্রতিফলন। কালী একাধারে anugraha—অর্থাৎ অনুগ্রহ, প্রসার, সৃষ্টি ও মুক্তির শক্তি এবং nigraha—সংযম, প্রত্যাহার ও রূপান্তরের শক্তি—উভয়েরই অধিষ্ঠাত্রী। তাঁর কোমরবন্ধ এই দ্বৈত শক্তির ঐক্য প্রকাশ করে, যেখানে ধ্বংস ও করুণা, সংহার ও সৃষ্টি এক অভিন্ন চেতনায় মিলিত। প্রকৃত শক্তি কখনও দমন নয়—বরং আত্ম-নিয়ন্ত্রণেই তার পূর্ণতা।
বাহু কর্মের প্রতীক, কারণ কর্মই বাহুর প্রকাশ। কিন্তু যখন কর্ম অহংকার ও আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন তা বন্ধনের কারণ হয়। কালী-র কোমরে বাঁধা মৃতবাহু সেই কর্মেরই রূপান্তরিত প্রতীক—যেখানে কর্মশক্তি আর ব্যক্তি-ইচ্ছার যন্ত্র নয়, বরং দেবী-চেতনার ইচ্ছায় নিবেদিত। মৃত বাহু মানে, কর্তার অহং মৃত্যুবরণ করেছে; কিন্তু কর্মের শক্তি রয়ে গেছে, এখন তা দেবীচেতনার অলঙ্কার। এ যেন কর্মের মৃত্যু নয়, বরং তার আত্মদীক্ষা—যেখানে “আমি করি” ভাব উবে গিয়ে “তিনি করাচ্ছেন” এই উপলব্ধি জন্মায়।
অদ্বৈত বেদান্তে এই তত্ত্ব প্রকাশ পায় নিষ্কাম কর্মযোগে। শ্রীকৃষ্ণ যেমন বলেন—“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি” (গীতা, ২.৪৮)—যোগে স্থিত থেকে কর্ম করো, ফলের আসক্তি ত্যাগ করে। দেবীর মৃতবাহু সেই অবস্থারই প্রতীক, যেখানে কর্ম চলে, কিন্তু কর্তা বিলীন। কর্ম ঘটে, কিন্তু আর কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য নেই; তা হয়ে যায় ব্রহ্মচেতনার স্বতঃস্ফূর্ত লীলা।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে এটি চেতনার nigraha-śakti—অর্থাৎ, চেতনার নিজের গতিশক্তিকে অন্তর্গতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। সেখানে শক্তি দমন নয়, বরং নিজের স্বাধীনতা (svātantrya) উপলব্ধি করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করে। কালী সেই অবস্থার দেবী—যিনি সমস্ত গতি, ক্রিয়া, প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়কে নিজের গভীর কেন্দ্রে টেনে নিয়ে এক চেতনার ঐক্যে পরিণত করেন।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে মৃতবাহুর মেখলা মানুষের অভ্যন্তরীণ রূপান্তরের প্রতীক। মানুষের “বাহু” আসলে তার কর্মপ্রবণতা—ইচ্ছা, প্রবৃত্তি, প্রতিক্রিয়া ও অভ্যাস। সাধারণত এই কর্মপ্রবণতা অবচেতন প্রেরণায় চালিত হয়—ভয়, লোভ, কামনা বা প্রতিরোধে। কিন্তু যখন চেতনা জাগে, তখন মানুষ আর এই শক্তিগুলিকে দমন করে না; সে তাদের রূপান্তর ঘটায়। মৃতবাহু মানে সেই প্রবৃত্তির মৃত্যু, যা অচেতনা ও অহংকারে আবদ্ধ ছিল; কিন্তু সেই শক্তি নষ্ট হয় না, তা দেবীর কোমরে অলঙ্কাররূপে টিকে থাকে—অর্থাৎ, সেই শক্তি এখন চেতনার অধীনে, অহংয়ের নয়, আত্মার নিয়ন্ত্রণে।
আধুনিক মনোবিশ্লেষকরা একে বলবেন “sublimation”—প্রবৃত্তির রূপান্তর। ফ্রয়েডের ভাষায়, এটি সেই প্রক্রিয়া, যেখানে নিম্ন প্রবৃত্তির শক্তি উচ্চতর উদ্দেশ্যে—সৃজনশীলতা, জ্ঞান বা আত্মোন্নতিতে রূপান্তরিত হয়। কালীর মৃতবাহু সেই রূপান্তরেরই প্রতীক—যেখানে প্রবৃত্তির মৃত্যু মানে তার নবজন্ম, চেতনার অধীনে নবরূপে উদ্ভাস।
তান্ত্রিক সাধনার প্রেক্ষিতে মৃতবাহুর কোমরবন্ধ তপস্যার প্রতীক। তপস্যা মানে দমন নয়, বরং সম্পূর্ণ চেতনায় একীকরণ। সাধক তাঁর ইন্দ্রিয়, কর্ম ও ইচ্ছার সমস্ত শক্তিকে দেবীর ইচ্ছায় নিবেদন করেন, যাতে তাঁর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা দেবত্বে মিলিয়ে যায়। মৃতবাহু তাই তপস্যার মূর্ত প্রতীক—যেখানে অহং মরে গিয়ে আত্মা মুক্তির দিকে জাগ্রত হয়।
এই মৃতবাহুর মেখলা তাই এক ভয়াবহ নয়, বরং এক মহাশান্ত অলঙ্কার—যা ঘোষণা করে: “দমন নয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ; ত্যাগ নয়, রূপান্তর।” যিনি নিজের কর্মপ্রবণতাকে অহংমুক্ত সংযমে রূপান্তরিত করতে পারেন, তিনিই দেবীচেতনার অংশীদার। কালীর এই মেখলা সেই উপলব্ধির প্রতীক—যেখানে মৃত বাহু মানে মৃত অহং, আর সেই অহং-মৃত্যুই আত্মজাগরণের সূচনা।
কালীর পদতলে যে রক্তাভ পদ্ম ফুটে আছে, তা তাঁর লীলার এক মহাগভীর দার্শনিক প্রতীক—যা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমৃতজ্ঞান, আর লয়ের মধ্য দিয়ে জাগরণের বীজ নির্দেশ করে। রক্তে-ভেজা এই পদ্ম কোনো ভয়াবহতার চিহ্ন নয়; এটি এক গূঢ় তত্ত্বের ভাষা, যেখানে মৃত্যু, রক্ত ও পদ্ম মিলিত হয়ে আত্মজাগরণের চক্র সম্পূর্ণ করে। পদ্ম সর্বদা শুদ্ধতার প্রতীক—সে কাদাজল থেকে জন্ম নেয়, কিন্তু কখনোই কাদায় মিশে যায় না। আর রক্ত মানে জীবনীশক্তি, ভোগ, ত্যাগ, দুঃখ ও রূপান্তরের প্রবাহ। কালী যখন রক্তাভ পদ্মের উপর পদার্পণ করেন, তখন তিনি প্রতীক হয়ে ওঠেন সেই চেতনার, যা জীবনের সমস্ত দুঃখ, মৃত্যু ও ক্ষয়কে অতিক্রম করে চিরন্তন জ্ঞানের অমৃতরূপে প্রস্ফুটিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, রক্তাভ পদ্মতল প্রতীক ব্রহ্মজ্ঞানের উদ্ভব—যেখানে মৃত্যুর অভিজ্ঞতাই আত্মবোধের দরজা। উপনিষদ বলেন, অসতো মা সদ্গময়।—অসৎ (মিথ্যা) থেকে আমাকে সৎ (সত্য) এর দিকে নিয়ে যাও। তমসো মা জ্যোতির্গময়—অন্ধকার (অজ্ঞানতা) থেকে আমাকে জ্যোতি (জ্ঞান) এর দিকে নিয়ে যাও। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।—মৃত্যু থেকে আমাকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যাও। (পবমান মন্ত্র, বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৩.২৮) এই প্রার্থনাটি জীবনের তিনটি মৌলিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে: মিথ্যা থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোতে, এবং নশ্বরতা থেকে শাশ্বত অমরত্বে উত্তরণ। এটি মানবাত্মার চূড়ান্ত লক্ষ্য—মুক্তি বা মোক্ষ—প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা।
কালী সেই প্রার্থনার উত্তর; তাঁর পদতলের রক্তাভ পদ্ম দেখায় যে, মৃত্যু কোনো প্রলয় নয়, বরং আত্মার জাগরণ। যখন জীব মায়াজগতের পরিচয় ত্যাগ করে, তখনই সে নিজের ব্রহ্মরূপ চিনতে পারে। সেই ত্যাগ বা “লয়”-এর মাটিতেই ফুটে ওঠে রক্তাভ পদ্ম—অমৃত জ্ঞানের প্রতীক, যা বলে, “লয়ই সৃষ্টির উৎস।” এই পদ্ম তাই মৃত্যু ও জাগরণের একত্র প্রতীক—যেখানে লয় মানে শেষ নয়, বরং সীমিত আত্মার বিলয় হয়ে অসীম চেতনায় মিলন।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে, রক্তাভ পদ্মতল হলো স্পন্দ-এর (চেতনার স্পন্দন) দৃশ্যরূপ—যেখানে নিস্তরঙ্গ চেতনা নিজের ভেতর থেকে আন্দোলিত হয়ে সৃষ্টি ও লয়ের চক্র সৃষ্টি করে। অভিনবগুপ্ত বলেন, “লয়ে চ জাগরণং”—অর্থাৎ, লয়ের মধ্যেই প্রকৃত জাগরণ। কালী সেই পরম vimarśa-শক্তি, যিনি শিবের নিস্তব্ধ চেতনাকে ক্রিয়াশীল দীপ্তিতে রূপান্তরিত করেন। তাঁর পদ্মতল রক্তাভ, কারণ এই চেতনার স্পন্দনের প্রথম প্রকাশই সময়, গতি ও জীবনের উচ্ছ্বাস। রক্ত এখানে শক্তির তরল সত্তা—যা চেতনার জাগরণকে বহন করে। আর পদ্ম সেই শক্তির শুদ্ধ প্রকাশ—যেখানে চেতনা নিজেই নিজের ভেতরে প্রস্ফুটিত হয়।
শাক্ত দর্শনে, রক্তাভ পদ্ম হলো দেবীর মহাশক্তি—যিনি মৃত্যুকেও অমৃতে রূপান্তরিত করেন। পদ্ম তাঁর হৃদয়, রক্ত তাঁর জীবন; আর উভয় মিলেই সৃষ্টি ও সংহারের এক চিরন্তন ছন্দ। সাধকের জন্য এই প্রতীক শেখায়, মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়, বরং আত্মার বিশ্রাম ও নবজাগরণ। শ্মশান তাঁর ক্ষেত্র, যেখানে জীবন ছাই হয়; কিন্তু সেই ছাইয়ের মধ্যেই ফুটে ওঠে রক্তাভ পদ্ম—চেতনার চূড়ান্ত মুক্তি। তাই দেবী মৃত্যুর উপর নৃত্য করেন, আর তাঁর পদ্মে রক্তরূপে জীবন আবার ফিরে আসে।
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, কালীর রক্তাভ পদ্মতল মানুষের psychic rebirth বা মানসিক পুনর্জন্মের প্রতীক। মৃত্যু এখানে মানসিক বিলয়—অহং, ভয়, দমিত বেদনা ও অতীতের সংস্কার—এসবের অবসান। আর পদ্ম সেই পরিশুদ্ধ চেতনা, যা এই বিলয়ের পর নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়। রক্ত মানে সেই মানসিক যন্ত্রণা ও ত্যাগ, যা ছাড়া পুনর্জন্ম সম্ভব নয়। আধুনিক মনোবিশ্লেষক যেমন বলেন, “Transformation demands the death of the old self”—কালী সেই মানসিক রসায়নের প্রতীক, যিনি পুরোনো সত্তাকে ভেঙে নতুন চেতনার জন্ম দেন।
কালীর রক্তাভ পদ্মতল হলো চেতনার মহাজাগরণ—যেখানে মৃত্যু অতিক্রম করে আত্মা জেগে ওঠে অমৃতসত্তায়। এটি সেই অবস্থার প্রতীক, যেখানে সংহারই সৃজন, অন্ধকারই আলোকের গর্ভ, আর মৃত্যু মানেই মুক্তি। তাঁর পদতলের এই রক্তাভ পদ্ম আমাদের শেখায়, ভয় কোরো না লয়কে—কারণ যে শেষ হয়ে যায়, তারই মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় চিরন্তন।
কালীর সঙ্গে যারা চিরকাল যুক্ত—সেই ডাকিনী ও যোগিনীগণ—তারা কেবল পৌরাণিক সহচরী নন; তারা দেবীচেতনার অন্তর্গত বিভিন্ন তান্ত্রিক শক্তির প্রতীক। “ডাকিনী” ও “যোগিনী” শব্দ দুটি মূলত তন্ত্রশাস্ত্রে চেতনার সূক্ষ্ম রূপভেদের ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়, যেখানে প্রত্যেকটি শক্তি চেতনার এক-একটি ক্রিয়ার, গুণের বা স্তরের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই তাঁরা বাস্তব জগতে আলাদা কোনো সত্তা নন; তাঁরা হলেন এক ও অভিন্ন দেবীচেতনার বিভাজিত শক্তিস্বরূপ—যারা মায়ার নানা রূপ ও মানবচেতনার বিভিন্ন স্তরে কাজ করেন।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, ডাকিনী ও যোগিনীরা ব্রহ্মচেতনার সেই বহুরূপী প্রকাশ। "একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।" (ঋগ্বেদ, ১.১৬৪.৪৬) অর্থাৎ, "সৎ বা সত্য একটিই, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা (বিপ্ররা) তাকে বহু প্রকারে বা বহু নামে ডাকেন।"—এক সত্য, কিন্তু নানা রূপে প্রকাশিত। ব্রহ্ম এক, কিন্তু জগৎ ও অভিজ্ঞতার ভিন্ন স্তরগুলিতে সে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও রূপে প্রকাশ পায়। এই শক্তিগুলি সেই এক চেতনার বৈচিত্র্যপূর্ণ তরঙ্গ।
ডাকিনী মানে “দ্রুতগামিনী”—যিনি চিন্তা, অনুভূতি ও কর্মের বিভিন্ন স্তরে চেতনার দ্রুত গতি সৃষ্টি করেন; আর যোগিনী মানে “যা যোগ করায়”—যিনি বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতাকে ঐক্যে মিলিয়ে দেন। এভাবে ডাকিনী ও যোগিনী অদ্বৈত ব্রহ্মের অন্তর্গত কার্যরূপ, যা মায়াকে ভেদ করে ব্রহ্মজ্ঞানের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যায়, ডাকিনী ও যোগিনীগণ হলেন বিমর্শ শক্তির অভ্যন্তরীণ রূপাবলি। শৈবতত্ত্ব বলে—শক্তি যখন নিজের স্বরূপে শিবের সঙ্গে অভিন্ন, তখন তিনি “অদ্বয়” (non-dual), কিন্তু যখন সেই একই শক্তি নিজের স্বাতন্ত্র্যবোধে বিভিন্ন ক্রিয়াশক্তিতে প্রকাশিত হন, তখনই ডাকিনী ও যোগিনীগণের সৃষ্টি। এই প্রতিটি যোগিনী আসলে চেতনার এক একটি স্পন্দ (spanda) বা কম্পন—যেখানে শিবের স্থিতি ও শক্তির গতি পরস্পরে লীলা করে। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ বলেন, “শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—শিব চিরকাল পাঁচ ক্রিয়ায় লিপ্ত: সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোভাব এবং অনুগ্রহ। এই প্রতিটি ক্রিয়া এক একটি যোগিনীশক্তির প্রকাশ—যারা কালীর সঙ্গেই ঐক্যবদ্ধ।
শাক্ত দর্শনে, ডাকিনী ও যোগিনী হলেন মহাশক্তির বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দিক—তারা চেতনার পরিসর বিস্তৃত করেন, মানুষের অন্তরস্থিত শক্তিকে জাগ্রত করেন, আর আত্মবিমুখতাকে দূর করেন। তন্ত্রে বলা হয়েছে, “যোগিন্যোঃ চেতনা-রূপাঃ”—যোগিনীরা চেতনারই রূপ। তাঁদের রূপ কখনো ভয়ঙ্কর, কখনো স্নিগ্ধ, কারণ চেতনার জাগরণের পথে কখনো কোমলতা, কখনো তীব্রতা প্রয়োজন। সাধনার স্তর অনুযায়ী এই শক্তিগুলি কাজ করে—কেউ অবচেতন মনকে পরিষ্কার করে, কেউ ইন্দ্রিয়ের সীমা ভেঙে দেয়, কেউ ধ্যানের স্থিতি রক্ষা করে। কালী এই সমস্ত যোগিনী ও ডাকিনীর মধ্যে কেন্দ্রীয় শক্তি—তিনি সেই পরম কেন্দ্র, যেখান থেকে সমস্ত শক্তি বিকিরিত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, ডাকিনী ও যোগিনীগণ মানুষের চেতনার বিভিন্ন archetype বা মানসিক আদিরূপ। কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন, মানুষের মন অসংখ্য প্রতীকি শক্তির সংমিশ্রণ—যেখানে প্রত্যেকটি শক্তি কোনো মানসিক প্রবণতা, ভয়, আকাঙ্ক্ষা বা জ্ঞানের রূপ ধারণ করে। ডাকিনী ও যোগিনী সেই শক্তিগুলির প্রতীক—যারা অবচেতনের অন্ধকার অঞ্চল থেকে উঠে এসে চেতনাকে প্রসারিত করে। কেউ ধ্বংসাত্মক শক্তির রূপে আসে—অর্থাৎ অহং, ভয় ও আসক্তি ভাঙার শক্তি; আবার কেউ রক্ষাকারিণী শক্তি—যিনি ধ্যান ও বোধে স্থিতি আনেন। এভাবে তারা আমাদের মনোজগতে এক এক করে রূপান্তরের পর্যায় নির্দেশ করে।