শৈব কালী: তিরাশি



কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালী হলেন চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি, স্পন্দ ও বিমর্শের প্রকাশ। ভূতেশ্বরী কালী পঞ্চতত্ত্বে চেতনার সর্বব্যাপী উপস্থিতির প্রতীক—তিনি স্পন্দশক্তি, যার মাধ্যমে চেতনা পদার্থে রূপান্তরিত হয়। শ্মশান কালী ধ্বংস ও সৃষ্টির ঐক্য; তিনি সেই লীলাশক্তি, যেখানে লয়ই নবপ্রকাশ। দিগম্বরী কালী আকাশবসনা—নিরুপাধি চেতনার মূর্তি, যেখানে কোনো আচ্ছাদন নেই। রাত্রিকালী অবিদ্যার মধ্যেই লুকানো জ্ঞানের প্রতীক—চেতনার অন্ধকারেও তাঁর দীপ্তি জ্বলে। সিদ্ধিকালী যোগীর সিদ্ধি নয়, বরং আত্মজাগরণের দেবী—কুণ্ডলিনীর সম্পূর্ণ জাগরণের রূপ।

শূলিনী কালী ত্রিশূলধারিণী; তিন শক্তি—ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া—এই তিনের মিলনে চেতনা পূর্ণতা পায়। কপালিনী কালী শ্মশানবাসিনী; প্রলয়ের অন্তর্জ্ঞান, যেখানে চেতনা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মবোধে পৌঁছায়। প্রেতকালী মৃত চেতনার মধ্য দিয়ে জীবনের উন্মেষ, যেখানে শব থেকে শিবের অভ্যুদয়। তীক্ষ্ণকালী চেতনার তেজোময় রূপ, বিমর্শশক্তির উগ্রতা; ঘোরকালী অন্ধকার ও তমোগুণ দহন করে চেতনার বিকাশ ঘটান। বীরকালী কর্মের দেবী, ধর্মসংরক্ষার শক্তি; করালকালী মহাপ্রলয়ের রূপ—চেতনার পূর্ণ লয়। এই সকল রূপেই দেখা যায়—শিবের স্থিরতা ও শক্তির গতি একত্রে মিলিত হয়ে চেতনার মহালীলা সৃষ্টি করে।

শাক্ত তত্ত্বে কালী হলেন মহাশক্তির কার্যশক্তি—তিনি সৃষ্টি, রক্ষা, সংহার, মোক্ষ সব কিছুর আধার। ভদ্রকালী রক্ষাকরী মাতৃরূপ, যিনি ধর্মরক্ষা ও ন্যায়প্রতিষ্ঠা করেন। তারাকালী নামরূপের ওপারে টারকশক্তি, ‘ওঁ’ ধ্বনির পরম প্রকাশ। ছিন্নমস্তা কালী অহংকার ছিন্ন করে আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে “অহং ব্রহ্মাস্মি” উপলব্ধি ঘটান। মহাশক্তি কালী সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের ঐক্যরূপ; আদিকালী প্রাক্‌সৃষ্টির জননী—সমস্ত শক্তির উৎস। যোগিনী কালী সাধনার অন্তর্মুখ তপস্যাশক্তি; সঙ্কটকালী বিপদে রক্ষাকারিণী; অন্নপূর্ণা কালী জীবনের পূর্ণতার প্রতীক। মহাশক্তি কালীই আবার সমগ্র জগতের উৎসশক্তি, নিরালঙ্কার কালী মায়ার অতীত পরম সত্য, আর ক্রিয়াশক্তি কালী ব্রহ্মচেতনার কার্যরূপ। কৃষ্ণজননী কালী সেই অন্ধকারের গর্ভে জ্ঞানের জন্মদাত্রী, যিনি সময়েরও জননী।

অদ্বৈত, শৈব ও শাক্ত—এই তিন দৃষ্টির সমন্বয়ে দেখা যায়, সব রূপই এক চেতনার বহুমাত্রিক প্রকাশ। অদ্বৈত বলে, তিনি নির্বিশেষ ব্রহ্ম—যিনি মায়াকে ছিন্ন করে নিজে প্রকাশিত হন। শৈব বলে, তিনি শিবের বিমর্শশক্তি—চেতনার স্পন্দরূপ স্বাধীনতা। শাক্ত বলে, তিনি পরম জননী—সৃষ্টির, সংহারের ও মুক্তির লীলা। তাই মহাকালী থেকে কপালিনী পর্যন্ত, প্রতিটি রূপই এক চেতনার এক একটি দিগন্ত—যেখানে মৃত্যু মানে জাগরণ, ধ্বংস মানে পুনর্জন্ম, আর অন্ধকার মানে অন্তর্লীন দীপ্তি। কালী হলেন সেই এক, যিনি একই সঙ্গে ব্রহ্ম, শক্তি ও আত্মা—চিরন্তন চেতনার নারীস্বরূপ, যাঁর ভয়ংকর রূপেই লুকিয়ে আছে মুক্তির চূড়ান্ত মাধুর্য।

এই ধারার মূল অর্থ হলো—কালী কোনো একরূপা দেবী নন; তিনি চেতনার নানা স্তরে নানা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। মানুষের অন্তর্দৃষ্টি, সাধনা, ভয়, প্রেম ও জ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে। তাই তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে—“একৈব কালী বহুরূপধারিণী। কালস্বরূপা পরব্রহ্মাত্মিকা।” (কালিকোপনিষদ, ১.২)। অর্থাৎ, কালী এক, কিন্তু তিনি বহুরূপধারিণী; কালরূপিণী, পরব্রহ্মাত্মিকা—চিরন্তন চেতনার অবতার।

মহাকালী সময়েরও অতীত দেবী। তিনি মৃত্যু ও জন্মের ঊর্ধ্বে চেতনার প্রতীক—যেখানে স্থির শিবচেতনা শক্তির অনন্ত গতি হয়ে প্রকাশিত। তাঁর নৃত্যই কালচক্রের উৎস, তাঁর করাল মুখেই সময় বিলীন।

দক্ষিণাকালী সংহার ও করুণার একত্র প্রকাশ। তাঁর খড়্গ অজ্ঞান ছেদন করে, আবার তাঁর হাসি মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে। মৃত্যু এখানে ভয়ের নয়, বরং নবজন্মের সংকেত।

শ্যামাকালী মাতৃমূর্তি, মাধুর্য ও ভক্তির প্রতীক। রামপ্রসাদের গানে তিনি সেই মা—রাগে ভরপুর অথচ অপরিমেয় স্নেহময়ী।

ছিন্নমস্তা আত্মবিসর্জনে আত্মবোধের প্রতীক। নিজের মস্তক ছিন্ন করে নিজের রক্তে নিজেকে পুষ্ট করেন—এ এক গভীর তত্ত্ব, যেখানে অহংকারের মৃত্যু জ্ঞানের জন্ম দেয়।

চামুণ্ডা ক্রোধরূপে অজ্ঞান বিনাশিনী। তাঁর ভয়ঙ্করতা আসলে পরিশুদ্ধির আগুন, যা দুষ্টতার ছাই থেকে সত্যকে উদ্ভাসিত করে।

শ্মশানকালী মৃত্যুর নীরবতায় অমৃতচেতনার জাগরণ। শ্মশান তাঁর ধ্যানক্ষেত্র, কারণ মৃত্যুই জীবনের পূর্ণতার স্মারক।

রক্তকালী রজোগুণের জাগ্রত দীপ্তি—সৃষ্টিশক্তি, কর্ম, ও উদ্যমের প্রতীক।

গুহ্যকালী অন্তর্জাগরণের রক্ষিতা। তিনি অবচেতন গহ্বরের মুখোমুখি দাঁড়াতে শেখান, যেখানে মুক্তির অন্তর্লোক উন্মুক্ত হয়।

ভবতারণী সংসার-পারাপারের করুণাময়ী নৌকা। তিনি প্রেমের তীরে জীবকে পৌঁছে দেন।

সিদ্ধিকালী সাধনার পরিণতি, যোগশক্তির পূর্ণতা।

তারা জ্ঞানের ধ্বনি, রক্ষাকারিণী; জীবকে ভয় অতিক্রম করে পার করে দেন।

ভদ্রকালী শান্তি ও শক্তির সুষম রূপ—সৌম্য অথচ অদম্য।

ঘোরকালী অচেতনতার গভীরে আলোর অগ্নি। তাঁর ভয়ংকরতা মুক্তিরই ইন্ধন।

দিগম্বরী নগ্ন সত্যের প্রতীক—অদ্বৈত চেতনার অনাবৃত দীপ্তি।

সব রূপই এক চেতনারই বহুবর্ণ প্রকাশ—মহাকালী সময়ের অতীত, দক্ষিণাকালী করুণায় সংহার, শ্যামাকালী প্রেমের মাধুর্য, চামুণ্ডা বিনাশে শুদ্ধি, ছিন্নমস্তা আত্মবিসর্জনে আত্মজ্ঞানে, গুহ্যকালী অন্তর্জাগরণে মুক্তি, শ্মশানকালী মৃত্যুর ওপারে চেতনার জাগরণ, ভবতারণী প্রেমময় পারগমন, তারা জ্ঞানের নৌকা, দিগম্বরী অদ্বৈত সত্যের উন্মোচন।

তন্ত্রের চূড়ান্ত ঘোষণা—“কালিকা তু পরং ব্রহ্ম, নানারূপা তথাপি একা।” অর্থাৎ, কালীই পরব্রহ্ম; রূপে বহু, সত্তায় এক।

এভাবেই কালী-রূপের বহুবর্ণ জগৎ এক চেতনার নৃত্য—যেখানে মৃত্যু থেকে অমৃত, লয় থেকে সৃষ্টি, ভয় থেকে ভক্তি, আর মায়া থেকে মোক্ষ—সব এক পরম চেতনার অবিরাম স্পন্দনে মিলেমিশে যায়।

এই সমস্ত রূপ এক সত্যের ভিন্ন প্রকাশ—একই চেতনার নানা ছন্দ। অদ্বৈত দৃষ্টিতে, এই বৈচিত্র্য আসলে এক অভিন্ন ব্রহ্মচেতনার বহুরূপ খেলা; কাশ্মীর শৈবে, এগুলি চেতনার অন্তর্গত স্পন্দ বা আত্মবিমর্শনের তরঙ্গ; আর শাক্ত দৃষ্টিতে, এগুলি মাতৃচেতনার লীলা—যিনি ধ্বংসে সৃষ্টির বীজ রাখেন, অন্ধকারে আলো জন্ম দেন, আর মৃত্যুর মধ্যে অমৃতের জ্ঞান জাগিয়ে তোলেন।

আধুনিক দার্শনিক ও মনোবিশ্লেষকরা (যেমন ইয়ুং, নীটশে, হাইডেগার, এরিখ ফ্রম) এই রূপগুলিকে মানবচেতনার রূপান্তরমূলক প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। কালী হলেন সেই মানসিক ও অস্তিত্বগত শক্তি, যিনি আমাদের শেখান—ভয়, মৃত্যু, ক্ষয়, অন্ধকার—সবই জীবনের পরিপূর্ণতার অংশ। তিনি মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সেই শক্তি, যিনি আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে আত্মজাগরণ ঘটান।

তাই কালীর বহুরূপিতা কোনো পৌরাণিক বৈচিত্র্য নয়—এটি একই সত্যের বহুরাগী সংগীত, যেখানে প্রতিটি রূপ চেতনার একেকটি পর্দা খুলে দেয়। সৃষ্টি, সংহার, মুক্তি—সব একই লীলার তিনটি ছন্দ, আর কালী সেই চিরন্তন ছন্দের দেবী—অন্ধকারের মধ্য থেকে যিনি চেতনার আলোক প্রকাশ করেন।

ত্রিক তত্ত্বে “কালী” কোনো একক দেবী-চিত্রের মধ্যে আবদ্ধ নন; তিনি চেতনার স্বয়ংক্রিয় স্বাধীনতা—স্বতন্ত্র্য (svatantrya)-র ধারা হিসেবে পরা, পরাপরা (পরা-অপরা) ও অপরা—এই তিন স্তরে একটানা স্পন্দিত হন।

পরা স্তরে চেতনা নিখাদ, অবিভক্ত, নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ; এখানে শিব ও শক্তির মধ্যে কোনো ভেদ নেই—চেতনা কেবল স্বপ্রভায় জাগ্রত। এই অবিভক্ত দীপ্তিতেই মহাকালীর নিস্তরঙ্গ মহিমা ধরা পড়ে: তিনি কালকেও অতীত করে দেন, কারণ কাল তো ভেদবুদ্ধির অনুরণন; যেখানে ভেদ নেই, সেখানে কালেরও প্রাসঙ্গিকতা নেই। তাই পরা স্তরে কালী সংহারিণী নন, বরং ভেদের পূর্ববর্তী পূর্ণতা—যেখানে সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সম্ভাবনা হিসেবে গুঞ্জরিত, কিন্তু এখনও পৃথক কার্যকলাপে বিভক্ত হয়নি। এই অবস্থাকে শৈবরা “উন্মেষ-নিমেষ”-এর অতীত নীরবতা বলে; কালী সেখানে চেতনার নিরাবরণ সাক্ষ্য, যিনি “আমি” ও “অন্য”—এই দ্বন্দ্ব জন্মাবার আগেই সব কিছুকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন।

পরাপরা স্তরে সেই নীরব পূর্ণতা নিজেরই লীলায় সঞ্চারিত হতে থাকে। এখানে চেতনা একদিকে অবিভক্ত স্বরূপ স্মরণ করে, অন্যদিকে প্রকাশের রসাস্বাদে নানা রূপ ধারণ করে। এই মধ্য স্তরেই কালী করুণাময়ী দক্ষিণাকালী ও স্নেহময়ী শ্যামাকালীর প্রতীকে অনুভূত হন—খড়্গে অবিদ্যা ছেদন, আবার বরমুদ্রায় আশ্রয়; সংহারে পুরাতন জড়তা ভেঙে, সঙ্গে সঙ্গে নতুন সৃষ্টির বীজ বপন। এই স্তরে “স্পন্দ” (spanda)—চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত কম্প—নানা তত্ত্ব, শক্তি ও ভাবরূপে প্রসারিত হয়: বুদ্ধি-মন-ইন্দ্রিয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়, ভাষা ও অর্থ পরস্পরকে ডেকে আনে, রস ও রাগ, ভয় ও ভক্তি, ক্রোধ ও করুণা—সবই এক চৈতন্যের ভিন্ন ভিন্ন ঢেউ। কাশ্মীর শৈব মত বলে, মুক্তি মানে এখান থেকে পালানো নয়, বরং এই ঢেউগুলোকেই তাদের আদি-সাগর হিসেবে চিনে নেওয়া—প্রত্যভিজ্ঞান (pratyabhijñā), স্বরূপ-স্বীকৃতি।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের আলোকে “ধ্বংস” শব্দটি কেবল বিনাশ বা নাশন নয়, বরং পরিশোধন বা বিশুদ্ধিকরণ—অর্থাৎ যা অবিদ্যার আচ্ছাদনে চেতনাকে আবৃত করে রেখেছে, তার দহন। এই কারণেই বলা হয়, কালী ধ্বংস করেন না—তিনি দগ্ধ করেন; আর তাঁর দহনই মুক্তির সূচনা।

এই দহন প্রক্রিয়া তিনটি মৌলিক আচ্ছাদন বা মলা (mala)-এর উপরে কাজ করে—আণব মলা, মায়ীয় মলা, এবং কার্ম মলা।

আণব মলা (āṇava mala) হলো চেতনার সীমাবোধ—“আমি ক্ষুদ্র, আমি অসম্পূর্ণ”—এই বিভ্রান্তি। এটি সেই সূক্ষ্ম অহংকার, যা নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ শিবচেতনার স্মৃতি হারিয়েছে। কালী যখন এই আণব মলাকে দগ্ধ করেন, তখন মানুষ উপলব্ধি করে—সে কখনো ক্ষুদ্র নয়; সে চেতনারই অংশ নয়, বরং চেতনা স্বয়ং।

মায়ীয় মলা (māyīya mala) হলো বিভাজনের মোহ—“আমি” ও “অন্য”, “সৃষ্টি” ও “ঈশ্বর”, “শুভ” ও “অশুভ”—এই দ্বৈততার ভ্রম। এই আচ্ছাদনই মানুষকে ভেদবুদ্ধির ফাঁদে আটকে রাখে। কালী এই মলাকে জ্বালিয়ে দেন অগ্নিশিখার মতো—তাঁর খড়্গ যখন বিভাজনের মূলকেই ছেদ করে, তখন সাধক দেখে—সবই এক চেতনার প্রকাশ, কেবল ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গরূপে।

কার্ম মলা (kārma mala) হলো কর্মফলের আসক্তি ও সীমাবদ্ধতা। মানুষ ভাবে—“আমি করি, তাই আমি ফল পাবো”—এই কর্তা-ভাব ও ফললিপ্সাই কার্ম মলার দাসত্ব। কালী এখানে জ্ঞানের অগ্নিরূপে প্রবেশ করেন; তিনি কর্তার অহংকে দগ্ধ করে দেন, যাতে কর্ম থাকে, কিন্তু আসক্তি না থাকে। ফলত, সাধক জগতে কর্ম করে, কিন্তু তার দ্বারা আবদ্ধ হয় না।

এই তিন মলা দগ্ধ হলে, চেতনা আর নিজেকে দেহ, মন বা ব্যক্তিত্বের সীমায় আবদ্ধ মনে করে না; বরং উপলব্ধি করে—জগৎ তারই প্রকাশ, নিজের মধ্যেই সব ঘটছে। তাই কাশ্মীর শৈব মতে, কালী মুক্তির প্রতীক, কিন্তু জগত থেকে পালানোর নয়—জগতে থেকেই আত্মপ্রকাশের মুক্তি। তাঁর আগুন জগতকে ভস্ম করে না; জগতকে পবিত্র করে তোলে, যেমন স্বর্ণকে আগুন বিশুদ্ধ করে।

কালী “ধ্বংসের দেবী” নন; তিনি সেই জ্ঞানাগ্নি, যা অজ্ঞানকে দগ্ধ করে আত্মাকে উন্মুক্ত করে। তাঁর ধ্বংস মানে অন্ধকারের অবসান, তাঁর রুদ্ররূপ মানে অন্তরের আলোকজাগরণ। তিনি শেখান—মুক্তি মানে পরিত্যাগ নয়, বরং প্রত্যক্ষ উপলব্ধি—চেতনা নিজের অবিভক্ত সত্তাকে চিনে নেয়, কিন্তু জগৎকে ত্যাগ না করেই।

অপরা স্তর হল চেতনার সবচেয়ে বহির্মুখ বা স্থূল প্রকাশের স্তর। এখানে সেই অনন্ত, নিরাকার, সর্বব্যাপী চেতনা নিজের স্বাতন্ত্র্যশক্তি সীমিত রূপে প্রকাশ করে। শুদ্ধ চেতনা এখন কাল, দেশ ও নিয়তির আবরণে আবদ্ধ হয়ে ব্যক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই সীমাবদ্ধতার আবরণকেই কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয় কণচুক (kañcuka)—অর্থাৎ চেতনার উপর আরোপিত সূক্ষ্ম আচ্ছাদন।

এই কণচুক বা আবরণ পাঁচ প্রকার—কাল, বিদ্যা, রাগ, নিয়তি এবং কালা। এই পাঁচটি আচ্ছাদন মিলে চেতনার অসীম স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে “জীব” বা ব্যক্তিসত্তা তৈরি করে।

কাল-কণচুক চিরন্তন চেতনার অনন্তকালীনতা ভেঙে সময়বোধ সৃষ্টি করে—এখানেই “আগে-পরে”-র ধারণা জন্ম নেয়।

বিদ্যা-কণচুক অসীম জ্ঞানের পরিবর্তে আংশিক উপলব্ধি সৃষ্টি করে—মানুষ পুরো সত্য নয়, কেবল কিছু অংশ বোঝে।

রাগ-কণচুক আসক্তি জাগায়—চেতনা যা নিজেরই প্রকাশ, তাকে আলাদা কিছু ভেবে আকর্ষণ বা বিতৃষ্ণা অনুভব করে।