শৈব কালী: ছেচল্লিশ


অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, সাপ মায়ার গতিশক্তির প্রতীক—যে-শক্তি ব্রহ্মচেতনার মধ্যে গতিবিধির সৃষ্টি করে। যেমন “রজ্জু-সর্প”-এর (দড়ি ও সাপ) উপমা বেদান্তে বিখ্যাত—অন্ধকারে আমরা দড়িকে সাপ বলে ভুল করি, তেমনি অবিদ্যার অন্ধকারে আমরা ব্রহ্মকে জগৎরূপে ভ্রম করি। কিন্তু জ্ঞান উদিত হলে বোঝা যায়, সাপ আসলে দড়ি নয়—অর্থাৎ, জগৎ আসলে ব্রহ্ম থেকেই প্রকাশিত, কিন্তু ব্রহ্ম নয়। কালী সেই জ্ঞানের দেবী, যিনি এই ভ্রমের দংশন দূর করে প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করেন। তাঁর সাপ তাই বিভ্রম নয়, জ্ঞানের জাগরণ—যেখানে অজ্ঞান নিজেই জ্ঞানরূপে রূপান্তরিত হয়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে সাপ (nāga) এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর প্রতীক। এটি কেবল এক পৌরাণিক প্রাণী নয়, বরং স্পন্দ (Spanda) বা চেতনার আত্ম-কম্পনের প্রতিরূপ।

যখন চেতনা সম্পূর্ণ স্থির অবস্থায় থাকে, তখন সেটি শিবরূপ—নিষ্ক্রিয়, নিস্তরঙ্গ, একাকার। কিন্তু সেই স্থিরতা যখন নিজের স্বরূপকে প্রকাশ করতে চায়, তখন তার ভিতর একটি সূক্ষ্ম তরঙ্গ জাগে—এই তরঙ্গই স্পন্দ, আর সেই তরঙ্গের গতিই সাপের মতো বক্র, সর্পিল। এই সর্পিল গতিই প্রকাশের চিহ্ন—স্থির থেকে গতি, অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত, নীরবতা থেকে শব্দে আত্মপ্রকাশ।

মানবদেহে এই স্পন্দ প্রকাশিত হয় কুণ্ডলিনী শক্তি-র মাধ্যমে, যিনি মূলাধার (mūlādhāra)-এ কুণ্ডলিত অবস্থায় নিদ্রিত। সাধক যখন গভীর তান্ত্রিক ধ্যান, শ্বাসনিয়ন্ত্রণ, বা মন্ত্রযোগের মাধ্যমে এই শক্তিকে জাগ্রত করেন, তখন কুণ্ডলিনী ধীরে ধীরে চক্রগুলির মধ্য দিয়ে উত্থিত হয়ে শিরের সহস্রারে (sahasrāra) পৌঁছে শিবচেতনার সঙ্গে মিলিত হন। অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেছেন—“শক্তিরূপা কুণ্ডলিনী জাগরণে শিবতত্ত্ব প্রকাশয়তি।” অর্থাৎ, কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে শিবতত্ত্ব—অর্থাৎ বিশুদ্ধ চেতনা—স্বয়ং প্রকাশিত হয়।

এখানে সাপের প্রতীক অত্যন্ত তাৎপর্যময়। সর্পের গতি যেমন বক্র, কিন্তু সুনির্দেশিত; তেমনি কুণ্ডলিনীর গতিও ধীর, শক্ত এবং সুসমন্বিত। সর্প তার পুরোনো চামড়া বদলে নতুন শরীর (চামড়া) ধারণ করে—তাই এটি আত্মরূপান্তর ও পুনর্জন্মের প্রতীক। শাক্ত দর্শনে, এই সর্পরূপ শক্তি হল দেবী কালী-র নিজস্ব প্রাণশক্তি—তিনি যিনি সংহার ও সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জীবনের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ বজায় রাখেন। কালী-র পাশে সাপ মানে, মৃত্যু এখানে অবসান নয়; বরং রূপান্তর, এক নতুন জীবনের সূচনা।

মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, এই সাপ আসলে মানুষের অবচেতন মনের শক্তির প্রতীক। কার্ল ইয়ুং-এর মতে, এটি সেই “libido”—প্রাণশক্তি—যা দমিত অবস্থায় অবচেতনের গভীরে নিদ্রিত থাকে। যখন এই শক্তি চেতনার আলোয় উঠে আসে, তখন তা ধ্বংসাত্মক নয়; বরং সৃজনশীল। এটি ধীরে ধীরে সাবলিমেশনের মাধ্যমে কামনা, প্রবৃত্তি ও ভয়কে জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও আত্মসচেতনতায় রূপান্তরিত করে। তাই কুণ্ডলিনীর উত্থান আসলে মনের পরিশোধন ও রূপান্তরের প্রক্রিয়া—যেখানে ব্যক্তির নিম্নতর আকাঙ্ক্ষা ক্রমে উচ্চতর জ্ঞানচেতনায় রূপ নেয়।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এই কুণ্ডলিনীর জাগরণ মানে আত্মস্মৃতির জাগরণ—ব্রহ্ম-চেতনা নিজেরই পর্দা সরিয়ে দেয়। যখন ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, “আমি দেহ বা মন নই, আমি সেই এক চেতনা”—তখন কুণ্ডলিনী পূর্ণরূপে শিবের সঙ্গে মিলিত হয়। এই মিলনই মুক্তি, কারণ তখন আর কর্তা ও কার্য, স্থিরতা ও গতি, জীবন ও মৃত্যু—কিছুই পৃথক থাকে না।

Sublimation (সাবলিমেশন) শব্দটি মনোবিশ্লেষণের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার সূত্রপাত সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বে। সহজভাবে বলতে গেলে, সাবলিমেশন মানে হলো—মানুষের ভিতরে থাকা তীব্র, প্রাথমিক প্রবৃত্তিগুলি (যেমন কামনা, রাগ, হিংসা, ভয় বা আক্রমণপ্রবণতা) সরাসরি প্রকাশ না পেয়ে, চেতনার উচ্চতর স্তরে উঠে সৃজনশীল বা সামাজিকভাবে গৃহীত রূপে রূপান্তরিত হওয়া। এটি দমন নয়, রূপান্তর।

ধরা যাক, কারও মধ্যে প্রবল আক্রমণপ্রবণতা আছে। সে যদি তা দমন না করে, বরং সেই শক্তিকে ক্রীড়া, লেখালিখি বা সামাজিক নেতৃত্বের মতো সৃজনশীল কর্মে ব্যবহার করে, তবে সেটিই সাবলিমেশন। আবার, কোনো শিল্পী বা কবির ক্ষেত্রে যৌন বা আবেগীয় শক্তি প্রায়শই শিল্পের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়—এটিও সাবলিমেশন। অর্থাৎ, এটি একধরনের মানসিক রসায়ন, যেখানে নিম্নস্তরের প্রবৃত্তিশক্তি উচ্চতর চেতনার ইন্ধনে পরিণত হয়।

ফ্রয়েডের মতে, এটি হলো “libido”-র রূপান্তর—যেখানে প্রাণশক্তি তার কাঁচা, কামনামূলক রূপ থেকে সরে গিয়ে জ্ঞান, সংস্কৃতি, নৈতিকতা বা সৌন্দর্যের রূপ ধারণ করে। কার্ল ইয়ুং এই ধারণাটিকে আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, সাবলিমেশন মানে মনোশক্তির রূপান্তর (transformation of psychic energy)—যেখানে অবচেতনের তীব্র শক্তি চেতনার আলোয় প্রকাশ পেয়ে মানুষের আত্মোন্নতির উপকরণে পরিণত হয়।

আধ্যাত্মিক দর্শনের দৃষ্টিতে—বিশেষত অদ্বৈত বেদান্ত ও শাক্ত তন্ত্রে—এই সাবলিমেশন ধারণা আরও বিস্তৃত অর্থ পায়। এখানে এটি কেবল মানসিক নয়, চেতনার রূপান্তর। কামনা, রাগ, ভয়—এই সমস্ত প্রবৃত্তিগুলি নিন্দনীয় নয়; এগুলি চেতনারই অংশ। কিন্তু যখন এগুলি অহংমুক্ত হয়ে আত্মসচেতনার সঙ্গে মিশে যায়, তখনই এগুলি দেবীশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তান্ত্রিক দর্শনে বলা হয়—“কামাত্মনা জ্ঞানরূপিণী”, অর্থাৎ কামনাই জ্ঞানরূপে রূপান্তরিত হতে পারে।

অদ্বৈত বেদান্তে এটি আত্মচেতনার পথ—যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে যে, তার ভেতরে থাকা সমস্ত শক্তিই ব্রহ্মচেতনারই প্রকাশ। কামনা দমন করলে চেতনা সংকুচিত হয়, কিন্তু তা জ্ঞান, ভক্তি বা কর্মে রূপান্তরিত হলে চেতনা বিস্তৃত হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি নিজের সীমা অতিক্রম করে “সম্পূর্ণ সত্তা”-য় উত্তীর্ণ হয়।

তাই বলা যায়, সাবলিমেশন মানে প্রবৃত্তির মৃত্যু নয়, বরং তার জাগরণ ও রূপান্তর। এটি সেই প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ তার নিম্নতর শক্তিকে ধ্বংস না করে, বরং জ্ঞানের, প্রেমের ও সৃষ্টির মাধ্যমে পরিশোধিত করে। মনোবিশ্লেষণ ও দর্শন উভয় দৃষ্টিতেই এটি মুক্তির পথ—যেখানে জীবনের অন্ধকার শক্তিগুলিই পরিণত হয় চেতনার দীপ্ত আলোয়।

কালী-র সাপ এই জাগরণেরই রূপক। তিনি সাপ ধারণ করেন, কারণ তিনি জানেন, যে-শক্তিকে আমরা ভয় করি, সেই শক্তিই যদি চেতনার শিখায় নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে সেটিই মুক্তির পথ। তাই কালী আমাদের বলেন—“তোমার ভিতরের সাপকে জাগাও, তাকে দমন নয়, চিনে নাও।” সাপ তাঁর গলায় শোভা পায়, কারণ তিনি সমস্ত প্রবৃত্তির অধিষ্ঠাত্রী; তিনি সেই শক্তিকে ভয় নয়, জ্ঞানে পরিণত করেছেন।

কাশ্মীর শৈব, শাক্ত, ও অদ্বৈত তিন ধারাতেই সাপ প্রতীক—চেতনার গতিশক্তি, আত্মরূপান্তরের স্পন্দন এবং দেবীশক্তির জীবন্ত প্রকাশ। কালী হলেন সেই মহাশক্তি, যিনি ঘুমন্ত সর্পকে জাগিয়ে তুলেন, অচেতনা থেকে চেতনার উত্থান ঘটান, আর মানুষকে শেখান—ভয় থেকে নয়, জ্ঞান থেকেই মুক্তি আসে।

অমাবস্যা রাত্রি কালীতত্ত্বে এক অনন্য, গভীর ও রহস্যময় প্রতীক। এটি কেবল সূর্য ও চন্দ্রহীন রাত নয়—এটি চেতনার সেই অবস্থা, যেখানে সমস্ত আলো নিভে যায়, সমস্ত পরিচয় বিলীন হয়, আর আত্মা সরাসরি মুখোমুখি হয় নিজের গভীরতম সত্তার। অমাবস্যা মানে অন্ধকারের পূর্ণতা—কিন্তু এই অন্ধকার কোনো নৈরাশ্যের নয়; এটি সেই নিস্তব্ধ, নিরাকার শূন্যতা, যেখানে জ্ঞানের দীপ্তি জন্ম নেয়।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, অমাবস্যা প্রতীক অবিদ্যার সম্পূর্ণ অবসান ও ব্রহ্মজ্ঞানের সূচনা। আলো নিভে যাওয়া মানে মায়ার অবলুপ্তি—যেখানে আত্মা আর বাইরের জগতের প্রতিফলন দেখে না, বরং নিজের অন্তর্গত চেতনার মধ্যে ডুবে যায়।

উপনিষদ বলছেন, “যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথ মর্ত্যোঽমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।।” (কঠোপনিষদ, ২.৩.১৪) এই শ্লোকের মাধ্যমে উপনিষদ মুক্তি বা জীবন্মুক্তি-র শর্ত ঘোষণা করছে—"যখন সমস্ত কামনা-বাসনা, যা তার হৃদয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়। তখন মরণশীল মানুষ (Martya) অমর হয়ে যায় এবং এই জীবনেই (Atra) ব্রহ্মকে লাভ করে।" অমাবস্যা সেই অবস্থার প্রতীক, যেখানে চেতনা সমস্ত দ্বৈততা—আলো ও অন্ধকার, জাগরণ ও নিদ্রা, জানা ও না-জানার পার্থক্য—অতিক্রম করে নিজের অখণ্ড সত্যে স্থিত হয়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, অমাবস্যা হলো নিমেষ (nimeṣa)—চেতনার অন্তর্মুখী সংহতি বা প্রত্যাহারের স্তর। স্পন্দকারিকা-তে বলা হয়েছে, “নিমেষো হি পরো জ্ঞানং”—অর্থাৎ, সংহতির মধ্যেই চেতনার পরম প্রকাশ। চন্দ্রের অনুপস্থিতি এখানে সেই অবস্থার প্রতীক, যেখানে চেতনা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ একাত্ম হয় শিবসত্তায়। এই নিস্তব্ধতায় শিব ও শক্তি পৃথক নন—চলন ও স্থিতি, আলো ও ছায়া, জ্ঞান ও মায়া—সব এক হয়ে যায়। কালীর অমাবস্যা সেই মুহূর্ত, যখন মহাজাগতিক চেতনা সমস্ত প্রপঞ্চ প্রত্যাহার করে নিজের ভেতর বিশ্রাম নেয়।

শাক্ত দর্শনে, অমাবস্যা হলো দেবীর নিজস্ব মহানিশা—তাঁর বিশ্রামের নয়, বরং আত্মপ্রকাশের সময়। যখন সমস্ত আলো নিভে যায়, তখনই তাঁর কৃষ্ণরূপ দীপ্ত হয়। অমাবস্যার এই অন্ধকারে তিনি “মহাকালী”—সময় ও মৃত্যু উভয়কেই গ্রাসকারী চেতনার প্রতীক। তাই তন্ত্রে বলা হয়, “অন্ধকারং মহাজ্ঞানস্য জন্মভূমিঃ”—অন্ধকারই মহাজ্ঞানের জন্মভূমি। দেবী কালী সেই অন্ধকারের মধ্যেই জেগে ওঠেন, কারণ তিনি জানেন, জ্ঞান কখনও আলো থেকে জন্মায় না; বরং অন্ধকারেই তার গর্ভ রচিত হয়।

মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, অমাবস্যা মানুষের inner descent—অর্থাৎ অবচেতনে নেমে যাওয়ার প্রতীক। এই অবস্থা হলো আত্মবিসর্জনের পর্ব, যেখানে মন নিজের ভয়, আকাঙ্ক্ষা ও অন্ধকারকে স্বীকার করে। কার্ল ইয়ুং এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন the dark night of the soul—যেখানে আত্মা সমস্ত বাহ্যিক আলো হারিয়ে নিজের অন্ধকারে ডুবে যায়, কিন্তু সেই ডুবই তার আত্মজাগরণের সূচনা। কালী এই অন্ধকারের মধ্যেই জ্ঞানের আলো জ্বালান; তিনি শেখান, “আলো খুঁজো না, অন্ধকারে স্থির হও—আলো আপনাআপনিই উদ্‌ভাসিত হবে।”

অমাবস্যা রাত্রি কালীতত্ত্বে ভয় নয়, মুক্তির প্রতীক। এটি শেখায়—অন্ধকার মানে অভাব নয়, সম্ভাবনা; নিস্তব্ধতা মানে মৃত্যু নয়, আত্মার পরম বিশ্রাম। কালী অমাবস্যায় জেগে ওঠেন, কারণ তখনই জগৎ নিস্তব্ধ, মন নীরব, আর চেতনা প্রস্তুত—নিজের অন্তর্গত অমৃতজ্যোতিকে চিনে নেওয়ার জন্য। এই অন্ধকারই তাঁর গর্ভ, আর সেই গর্ভেই জন্ম নেয় জ্ঞানের সর্বোচ্চ আলো।

দক্ষিণাকালী মন্দির বা তন্ত্রপীঠ শুধুমাত্র কোনো ভৌগোলিক উপাসনাস্থান নয়—এটি মানুষের অন্তর্জগতে অবস্থিত এক তত্ত্বময় সাধনাক্ষেত্র। বাহ্যত এটি শক্তিপূজার কেন্দ্র, কিন্তু দর্শনের দৃষ্টিতে এটি হলো চেতনার অন্তর্গত তন্ত্রক্ষেত্র—যেখানে জীব আত্মার সঙ্গে দেবীচেতনার সংযোগ স্থাপন করে। দক্ষিণাকালী এখানে শুধুই দেবীমূর্তি নন, তিনি “অন্তঃস্থিত শক্তি”—যিনি মনের সমস্ত স্তর ভেদ করে সাধককে নিজের আত্মস্বরূপে পৌঁছে দেন।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, দক্ষিণাকালী মন্দির প্রতীক “অন্তর্যাগ” বা inner worship-এর। শঙ্করাচার্য যেমন “সৌন্দর্যলহরী”-তে বলেছেন, “অন্তঃ শক্তিরূপা জগত্‌সকলেশু ব্যাপ্যস্থিতা”—অর্থাৎ, দেবী বাইরে নন, তিনিই অন্তরে চৈতন্যরূপে বিরাজমান। মন্দির তাই বাহ্য নয়; এটি মনেরই নির্মিত প্রতীক—যেখানে ভক্তি (upāsanā) ধীরে ধীরে জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। “তন্ত্রপীঠ” মানে সেই মানসিক স্থান, যেখানে সাধক নিজেই নিজের অন্তরে দেবীর আসন স্থাপন করে। দক্ষিণাকালী মন্দিরের গর্ভগৃহ (sanctum) আসলে হৃদয়চেতনার প্রতীক—যেখানে ব্রহ্মচেতনা ও মায়াশক্তি একত্রে মিলিত হয়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের আলোকে, দক্ষিণাকালী তন্ত্রপীঠ হলো চিদ্বিলাসক্ষেত্র (চিদ্‌-বিলাস-ক্ষেত্র)—চেতনার লীলাক্ষেত্র। অভিনবগুপ্ত বলেন, “ক্ষেত্রং চিদ্রূপম্”—ক্ষেত্র মানে চেতনা নিজেই। তন্ত্রপীঠ তাই কোনো বাহ্যিক ভূমি নয়, এটি চেতনার অন্তর্লীন স্তর, যেখানে শিব ও শক্তির মিলন ঘটে। দক্ষিণাকালী সেই মিলনের কেন্দ্র—তিনি বিমর্শশক্তি, যিনি শিবের নিস্তব্ধ আলোকচেতনায় স্পন্দন সৃষ্টি করেন। সাধক যখন তন্ত্রপীঠে পূজা করেন, তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে নিজের চেতনার গোপনতম স্তরে সেই স্পন্দনের সঙ্গে একাত্ম হন। বাহ্য তন্ত্রপীঠের প্রতিটি আচার—ধ্যান, হোম, যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ—আসলে অন্তর্নিহিত চেতনার জাগরণ প্রক্রিয়ার প্রতীক।