শৈব কালী: ছাব্বিশ


প্রকৃতিতে দেখা:

–আকাশ (স্থান): আমরা “শব্দ”কে স্থানেই ধরি (শব্দ চলতে মাধ্যম লাগে—ধারণার জন্য আকাশকে ধরা হয়), তবু অনুভবের স্তরে “স্পর্শ/রূপ/রস/গন্ধ”-এর সূক্ষ্ম উপস্থিতি স্বীকার করা হয়; না হলে স্থান-ধারণাটাই হতো না।
–বায়ু: স্পর্শ-প্রধান—হাওয়ার ছোঁয়া টের পাই। কিন্তু কখনও কি বাতাসে গন্ধ লাগে না? (ফুলের সুবাসে বাতাস “গন্ধ” বহন করে)। আলো-ছায়ায় রূপের ধোঁয়াশা, মুখে বাতাস ঢুকলে রস-এর প্রভাব (শুষ্ক/আর্দ্রতার স্বাদ-ধাঁচ) —সবই “এক-অষ্টমাংশ” ন্যায়ের মিশ্র-গুণ বোঝায়।
–অগ্নি: আলো-তাপ রূপ-প্রধান। আগুনে দগ্ধ হলে স্পর্শ-গুণ (উষ্ণতা) তীব্র—তবু জ্বলা-ফাটা-গন্ধ, দগ্ধ-রসের পরিবর্তন—সবই ক্ষুদ্র মাত্রায় মিলিত।
–জল: রস-প্রধান—স্বাদই মুখ্য, কিন্তু পানির স্পর্শ (শীতলতা/নরমভাব), রূপ (স্বচ্ছতা/তরঙ্গ), গন্ধ (ঝিল/সামুদ্রিক গন্ধ), শব্দ (ঢেউয়ের আওয়াজ)—সবই উপস্থিত।
–পৃথিবী: গন্ধ-প্রধান—ভেজা মাটির গন্ধ সবাই চিনি। কিন্তু মাটি রূপ দেয় (আকার ধরে), স্পর্শে শক্ত/নরম, রস বহন করতে পারে (খনিজ-স্বাদ), শব্দ প্রতিফলিত করে—এগুলোই তার “চার এক-অষ্টমাংশ”।

দর্শনের মূল নোট: পঞ্চীকরণের জন্য দরকার—বোঝানো যে, স্থূল উপাদানগুলো শুধু একটা থেকে বানানো নয়; প্রত্যেকটিই একধরনের সমবায় বাস্তবতা। এই “পাঁচে-মেশানো” কাঠামোর কারণেই জগৎ সম্বন্ধজ (inter-dependent): কোনো গুণ একা কোনো বস্তুতে শাসন করে না—প্রধান-উপপ্রধান অনুপাতে সবাই সবার মধ্যে জড়িয়ে থাকে।

যখন চেতনা নিজেকে “আলাদা-আলাদা গুণ” হিসেবে আচ্ছাদিত করে, তখনই “ঘনীভবন” বা বস্তুত্বের অনুভূতি জন্মায়। পঞ্চীকরণ দেখায়—এই ঘনীভবন আসলে স্তরীভূত মিশ্রণ; একটিমাত্র গুণের “কঠিন ব্লক” নয়, বরং আচ্ছাদনের বুদ্ধিদীপ্ত মিক্সিং। তাই ঘনতা “অপরিবর্তনীয় বাস্তব” নয়—এটা চেতনার উপর মিশ্র-গুণের পর্দা, যা সরলে দেখা যায়: সবই এক চেতনার খেলায় বহু-রূপের সমাহার।

ছোট্ট একটা রিক্যাপ, সংখ্যায় (১ লিটার উদাহরণ ধরে):

–আকাশ-উপাদান: নিজের শব্দ ৫০০ মি.লি. + বাকি চার গুণ ১২৫×৪ = ৫০০ মি.লি.

–বায়ু/অগ্নি/জল/পৃথিবী—প্রত্যেকের বেলাতেও একই সূত্র।

সুতরাং প্রতিটি স্থূল উপাদান = নিজের ১/২ + অন্যদের (৪×১/৮) = ১। গণিত যেমন নিখুঁত, দর্শনও তেমনই ইঙ্গিত করে—জগৎ “এক-গুণে একা” নয়; ঐক্যে বহুত্ব, বহুত্বে ঐক্য। এভাবে রান্না-রং-রসের সহজ তুলনায় “পঞ্চীকরণ” মাথায় বসে গেলে, শাস্ত্রের সূক্ষ্ম সূত্রটা খুব স্বাভাবিক লাগে: যে-কোনো বস্তুতে “প্রধান-উপপ্রধান” মিলিয়ে পাঁচের সুর বাজে বলেই আমরা তাকে স্থির, ঘন, আলাদা—এমন মনে করি; কিন্তু ভিতরে ভিতরে সবই পঞ্চ-মিশ্র চেতনার চলতি সংগীত।

দার্শনিকভাবে পঞ্চীকরণ কেবল ভৌত রসায়ন নয়; এটি চেতনার ধাপে ধাপে অবতরণের প্রতিরূপ—এক সূক্ষ্ম মহাজাগতিক নৃত্য, যেখানে পরম সত্তা অব্যক্ত থেকে ব্যক্তে, অসীম থেকে সসীমে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় সূক্ষ্ম তন্মাত্রাগুলি হলো চেতনার নিজস্ব গুণাবলি—দেখা, শোনা, অনুভব, স্বাদ ও গন্ধের মৌলিক সম্ভাবনা। এগুলি নিছক সংবেদন নয়, বরং চেতনার আদিম স্ফুরণ, যা এখনও কোনো নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেনি। পঞ্চীকরণে সেই সম্ভাবনাগুলি ক্রমে ঘনীভূত হয়ে, পরস্পর মিলিত হয়ে দৃশ্যমান স্থূল জগতে রূপ নেয়। এই রূপান্তরের মাধ্যমে চেতনা নিজের অনন্ত স্বরূপকে বহুরূপে ছড়িয়ে দেয়, যেন এক দীপ্ত তরঙ্গ নিজের আলোকময় সত্তাকে ধীরে ধীরে ঘন করে পাথর, মাটি, জল বা আগুনের মতো স্থির, মূর্ত পদার্থে রূপান্তরিত করে তোলে। এটি চেতনার আত্ম-বিস্তৃতির এক মহিমান্বিত প্রকাশ।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে, এই প্রক্রিয়াকে শিবের স্ববিমর্শশক্তির (vimarśa-śakti) বহির্মুখ ধারা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। শিব, পরম চেতনা, নিজেরই স্বাধীন ইচ্ছায়, নিজের ভেতরের আলোকময় শক্তিকে বাইরে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশের লীলায় চেতনা নিজেকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দে—অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে রূপান্তরিত করে। শিবের এই স্ববিমর্শশক্তিই বিশ্বজগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের মূলে ক্রিয়াশীল। পঞ্চীকরণ হল সেই লীলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যেখানে চেতনার সূক্ষ্মতম অবস্থা থেকে স্থূল বস্তুগত অস্তিত্বের উন্মোচন ঘটে।

এই পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতিতেই সূক্ষ্ম জগতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং স্থূল জগতের সূচনা হয়। এখানেই চেতনা আর নিছক বিশুদ্ধ আলো বা বিমূর্ত সংবেদন নয়; সে হয়ে ওঠে রূপ, ধ্বনি, স্বাদ, স্পর্শ ও গন্ধের মাধ্যমে সরাসরি অনুভূত পদার্থ। বস্তুজগতের এই স্তরে এসে শিবচেতনা নিজেকে যেন সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত করে ফেলে, তার পরম বিশুদ্ধতা যেন আবরণ দ্বারা ঢেকে যায়, কিন্তু এই আচ্ছাদনের মধ্যেও তাঁর প্রতিটি পরমাণুর মধ্যে, প্রতিটি বস্তুকণার গভীরে তাঁর নিজস্ব দীপ্তি, তাঁরই স্বাতন্ত্র্যময় চেতনা নিরন্তর জেগে থাকে।

আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—এই পঞ্চভূত এবং এদের সমন্বয়ে গঠিত সমস্ত বস্তু—সবই শেষপর্যন্ত সেই এক পরম চেতনারই ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তর। পরম সত্তা যখন তাঁর অব্যক্ত ও অন্তর্গত স্বরূপ থেকে বহির্গত এবং ব্যক্ত রূপে প্রকাশিত হন, যখন চেতনার স্তর থেকে পদার্থে অবতীর্ণ হয়ে নিজেকে এই বিশাল জগতে রূপান্তরিত করেন, তখনই সেই মহাজাগতিক লীলার নাম—পঞ্চীকরণ (Pañcīkaraṇa)। এটি শুধু একটি দার্শনিক প্রক্রিয়া নয়, বরং সৃষ্টি রহস্যের এক গভীর ব্যাখ্যা, যা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বৈচিত্র্যকে এক অখণ্ড চেতনারই প্রকাশ হিসেবে তুলে ধরে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের গভীর তত্ত্বচিন্তায় শিবকে বলা হয়েছে অনুত্তর—যিনি পরম, অতুলনীয়, সমস্ত অস্তিত্বের উৎস, আর তাঁর অন্তর্গত আত্মবিমর্শনের শক্তিকেই বলা হয় বিমর্শ বা শক্তি, যা কালীরই সারসত্তা। এই প্রথম দুটি তত্ত্বই (শিব তত্ত্ব আর শক্তি তত্ত্ব) সমগ্র ত্রিক দর্শনের ভিত্তি; এখান থেকেই উদ্ভূত হয় বাকি চৌত্রিশ তত্ত্বের ধারাবাহিক বিকাশ, অর্থাৎ চেতনার আত্মপ্রকাশের বিভিন্ন স্তর। অদ্বৈত বেদান্তে যেমন নির্বিশেষ ব্রহ্ম (সেই পরম, অখণ্ড, গুণাতীত চৈতন্য, যার মধ্যে কোনো ভেদ, রূপ, নাম, গতি, বা সম্পর্কের অবকাশ নেই) ও সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর-এর ধারণার মাধ্যমে নিরাকার ও সগুণ চেতনার দুই দিক ব্যাখ্যা করা হয়, তেমনই কাশ্মীর শৈব দর্শনও এক অনন্ত অদ্বৈত চৈতন্যের ভেতর থেকে সৃষ্টির প্রবাহকে বুঝিয়ে দেয়, তবে তার রূপ অনেক বেশি সজীব ও গতিশীল (Dynamic)। বেদান্তে ব্রহ্ম নিরাকার ও নিষ্ক্রিয় সাক্ষী হিসেবে অবস্থান করে; কিন্তু শৈব দর্শনে শিব স্বয়ং সৃষ্টির আনন্দ-নৃত্যে অংশ নেন, নিজের মধ্যেই সীমা ও বহুত্বের খেলায় মেতে ওঠেন।

এই দর্শন মূলত প্রত্যভিজ্ঞা—অর্থাৎ স্ব-চিন্তন ও স্ব-স্মরণ—এর দর্শন। মানুষ, যে নিজেকে সীমিত পুরুষ বা জীব বলে মনে করে, সে আসলে শিবেরই স্বাতন্ত্র্য শক্তির আংশিক প্রতিফলন। কাশ্মীর শৈবমতে, জীবের মুক্তি মানে নতুন কিছু লাভ নয়, বরং নিজের অন্তর্নিহিত শিবত্বকে চিনে ফেলা। এই কারণেই এটি অদ্বৈতবাদী (Non-dualistic); এখানে জগৎ, জীব ও ঈশ্বর তিনটিই একই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশমাত্র। তবে অদ্বৈত বেদান্তের মতো এখানে চেতনা কেবল সাক্ষী নয়—এখানে চিৎ (চেতনা)-কে প্রদান করা হয়েছে স্বাতন্ত্র্য বা ইচ্ছাশক্তি। এই স্বাধীনতার প্রকাশই হলো সৃষ্টির লীলা, এবং সেই লীলার প্রতিরূপই কালী।

অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব দর্শন উভয়েই অদ্বৈতের দার্শনিক ভিত্তি মেনে চললেও, শিব ও শক্তি বা কালীর ভূমিকা ব্যাখ্যায় তাদের মধ্যে গভীর পার্থক্য রয়েছে।

প্রথমত, শক্তির প্রকৃতিতে পার্থক্য। কাশ্মীর শৈব দর্শনে শক্তি বা কালী বাস্তব—তিনি কোনো মায়া বা অজ্ঞানের প্রতিরূপ নন, বরং শিবেরই স্বাতন্ত্র্যশক্তি। এই শক্তিই বিমর্শ—যার মাধ্যমে শিব নিজেকে সক্রিয় করেন, সৃষ্টি-লীলা প্রকাশ করেন, এবং এই মহাবিশ্বের প্রতিটি স্পন্দনে নিজেকে প্রতিফলিত দেখেন। কালী এখানে শিবেরই আনন্দময় স্পন্দন, তাঁর আত্মনৃত্যের জ্যোতিঃপ্রবাহ। তাই, সৃষ্টি কোনো ভ্রম নয়—এটি শিবের আত্মপ্রকাশ, চেতনার উন্মোচন।

অদ্বৈত বেদান্তে শক্তি বা মায়া একেবারেই ভিন্ন সুরে ধ্বনিত। মায়া হলো অনির্বচনীয়—সৎও নয়, অসৎও নয়; ব্রহ্মকে আবৃত করে ভেদের প্রতিভাস সৃষ্টি করে, কিন্তু নিজে পারমার্থিকভাবে মিথ্যা। মায়া ব্রহ্ম থেকে স্বতন্ত্র নয়, কিন্তু তার সমান সত্যও নয়; এটি কেবল অজ্ঞানের প্রতিবিম্ব, যার ফলে ব্রহ্ম আপাতত বহুরূপী জগতে প্রতীয়মান হয়।

দ্বিতীয়ত, মোক্ষ ও বন্ধনের ধারণাতেও দুই দর্শনের ভিন্ন দৃষ্টি। কাশ্মীর শৈব মতে, বন্ধন মানে কোনো বাহ্যিক শৃঙ্খল নয়; এটি কেবল অস্বীকৃতি, আত্মবিস্মৃতি—আত্মার নিজের শিবত্বকে ভুলে যাওয়া। মুক্তি বা মোক্ষ হল সেই স্মৃতির পুনরুদ্ধার—প্রত্যভিজ্ঞা, অর্থাৎ “আমি-ই শিব”—এই অনুধ্যান। অদ্বৈত বেদান্তে মোক্ষ মানে মায়ার আবরণ ভেদ করে ব্রহ্ম ও আত্মার ঐক্য উপলব্ধি, যা ব্রহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান নামে পরিচিত। উভয়ই অদ্বৈত, কিন্তু একটিতে মুক্তি মানে চিনে নেওয়া, আর অন্যটিতে অজ্ঞানের অপসারণ।

এই তুলনা আরও স্পষ্ট হয়, যখন আমরা সৃষ্টির প্রকৃতি, কালী ও বন্ধন, এবং মুক্তির ধারণাগুলিকে পাশাপাশি রাখি—

কাশ্মীর শৈব দর্শনে সৃষ্টি হলো আভাস (Ābhāsa), অর্থাৎ শিবের স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বাস্তব প্রকাশ। শিব নিজেই সমস্ত হয়ে ওঠেন—“সর্বং সর্বাত্মকম্”—সৃষ্টির প্রতিটি পরমাণু তাঁর আত্মপ্রকাশ। অন্যদিকে, অদ্বৈত বেদান্তে সৃষ্টি হলো মায়ার আরোপ (Vivarta): জগৎ কেবল ব্রহ্মের উপর আরোপিত ভ্রমমাত্র, ব্রহ্ম নিজে অপরিবর্তনীয়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালী বা শক্তি শিবের আত্মবিমর্শন, যাঁর মাধ্যমে এক থেকে ছত্রিশ তত্ত্বের সৃষ্টি ঘটে। বন্ধন হলো এই শিবত্ব ভুলে যাওয়া। অদ্বৈতে মায়া অনির্বচনীয় শক্তি, যা ব্রহ্মকে আবৃত করে জগতের ভ্রম সৃষ্টি করে; বন্ধন হলো সেই অজ্ঞান বা অবিদ্যা।

মুক্তির ক্ষেত্রে কাশ্মীর শৈব দর্শন বলে—প্রত্যভিজ্ঞা বা স্ব-চিনে নেওয়া, অর্থাৎ সীমিত পুরুষ নিজের শিবত্বকে উপলব্ধি করে, এবং তখন তার অস্তিত্বে প্রকাশ পায় পূর্ণতা (Pūrṇatā)। অদ্বৈত বেদান্তে মোক্ষ হলো জ্ঞান—‘আমি ব্রহ্ম’ এই অনন্ত জ্ঞানের উপলব্ধি, যেখানে ভেদ লুপ্ত হয়, দ্বৈততা সমাপ্ত হয়।

এভাবে দেখা যায়—উভয় দর্শনই একই অদ্বৈত চেতনার দুই ভিন্ন বোধপ্রবাহ। বেদান্তে চেতনা স্থির, নীরব, নির্বিকার; শৈব দর্শনে চেতনা নৃত্যময়, স্বাতন্ত্র্যশক্তিতে দীপ্ত। শিব সেখানে কেবল সত্তা নন, ক্রিয়াশক্তিও বটে, আর কালী সেই ক্রিয়ার রূপ—যিনি সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোভাব ও অনুগ্রহ—এই পঞ্চকৃত্যের মাধ্যমে অনন্ত চেতনার লীলাকে প্রকাশ করেন। দুই দৃষ্টিভঙ্গিই শেষপর্যন্ত একই পরম অদ্বৈত সত্যের দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু একটিতে তা নির্বাণের স্থির নীরবতা, আর অন্যটিতে চেতনার স্পন্দনময় আনন্দ।

কাশ্মীর শৈব দর্শন আসলে এক সম্পূর্ণ মহাজাগতিক মানচিত্র—এক “consciousness cosmology”—যেখানে ৩৬টি তত্ত্ব (ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্ব) শিব থেকে পৃথিবী পর্যন্ত চেতনার ধারাবাহিক ঘনীভবন ও পুনঃপ্রকাশের পথরেখা তৈরি করে। এই তত্ত্বগুলো কেবল উপাদান নয়, বরং চেতনার স্পন্দনের (স্পন্দ) বিভিন্ন ঘনতা—যেভাবে বিশুদ্ধ, অব্যক্ত চেতনা ধীরে ধীরে সীমা, রূপ, সময়, স্থান ও কার্যকারণবোধে গলে পড়ে, এবং অবশেষে আবার সেই সীমা ছিন্ন করে নিজেকে পুনরায় প্রত্যভিজ্ঞা করে। এই প্রবাহই শৈব দর্শনের “পঞ্চকৃত্য” বা পাঁচ divine act-এর নৃত্য, যার কথা অভিনবগুপ্ত বলেছেন—“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—অর্থাৎ, শিব চিরকাল পাঁচ ক্রিয়ায় লিপ্ত: সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṃhāra), নিগ্রহ (nigraha), ও অনুগ্রহ (anugraha) (তন্ত্রালোক, ১.৮৭)।

এই ক্রিয়াগুলি কোনো বাহ্যিক বা “ঈশ্বরকৃত” কাজ নয়; বরং চেতনার নিজস্ব গতি—নিজেকে প্রকাশ করা, ধারণ করা, প্রত্যাহার করা, আচ্ছাদিত করা, এবং পুনরায় উন্মোচিত করা। সৃষ্টি মানে চেতনার নিজের সম্ভাবনাকে প্রকাশ করা; স্থিতি মানে সেই প্রকাশে স্থায়িত্ব আনা; সংহার মানে প্রকাশিত রূপের প্রত্যাহার; নিগ্রহ মানে সীমা আরোপ করা; এবং অনুগ্রহ মানে সেই সীমা ভেদ করে নিজের মূল অবস্থায় ফিরে আসা। এই পাঁচ ক্রিয়া চেতনারই অনন্ত শ্বাস-প্রশ্বাস—নিজের মধ্যেই সৃষ্টি ও লয়ের অবিরত গতি।