শৈব কালী: ছয়



এখানে “দ্বৈতাভাসনা” মানে কোনো বাস্তব বিভাজন নয়; এটি চেতনার আনন্দময় ক্রীড়া—নিজেকে দেখা, নিজেকে জানার লীলা। এই লীলার ফলেই সৃষ্টি হয় প্রমাতা ও বিষয়, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, কিন্তু দু-জনেই শেষপর্যন্ত এক চেতনারই ভিন্ন প্রতিফলন। যখন চেতনা এই প্রতিফলনের সীমা অতিক্রম করে নিজের ঐক্য উপলব্ধি করে, তখন ঘটে প্রত্যভিজ্ঞা (pratyabhijñā)—নিজেকে নিজের মধ্যেই চিনে নেওয়া, বা “অহং শিবঃ”—আমিই শিব—এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাই প্রমাতা ও বিষয় কোনো দ্বৈত সত্তা নয়; তারা একক চেতনার অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী দিক—যেখানে দেখা ও দর্শন, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, সবই মিলেমিশে এক অখণ্ড আত্ম-সচেতন নৃত্যে পরিণত হয়। শেষমেশ এই সম্পর্কের সমাধান ঘটে প্রত্যভিজ্ঞা-য় (self-recognition)—যেখানে জানা যায়, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় দু-জন নয়, বরং এক চেতনার দুই প্রতিফলন; “আমি-ই সেই”—এই স্বীকৃতি-ই চেতনার চূড়ান্ত মুক্তি।

জগতের উৎপত্তি কোনো বাইরের কারণ, কোনো সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বা পদার্থতাত্ত্বিক নীতির ফল নয়; এটি চেতনার নিজেরই আত্ম-বিস্তার। চেতনা নিজেকে অনুভব করার আনন্দেই “আমি” ও “তুমি”, “বস্তু” ও “চেতনা”, “জগৎ” ও “ঈশ্বর”—এই সব দ্বৈততার রূপে নিজেকে প্রকাশ করে। এবং, এই প্রকাশের মধ্যে থেকেই জন্ম নেয় অভিজ্ঞতার সমগ্র জগৎ—যেখানে প্রতিটি অনুভূতি, চিন্তা, ক্রিয়া, ও উপলব্ধি সেই এক পরম চেতনারই বহুবিধ প্রতিচ্ছবি।

উত্পলদেবের সূত্রটি তাই আমাদের শেখায় যে, দ্বৈততা কোনো বাস্তব বিভাজন নয়, বরং একক চেতনার স্বেচ্ছামূলক আত্মপ্রকাশ। জ্ঞান, জ্ঞাতা, ও জ্ঞেয়—এই তিনের ভেদই চেতনার খেলায় গঠিত, এবং সেই চেতনা যখন নিজের মধ্যেই ফিরে আসে, তখন সমস্ত ভেদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই আত্মপ্রত্যাবর্তনই কাশ্মীর শৈব দর্শনে প্রত্যভিজ্ঞা—নিজেকে নিজের মধ্যে চিনে ফেলা, এবং উপলব্ধি করা যে, যা-কিছু আছে, সবই সেই এক চেতনারই স্বরূপ।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের গভীরতম স্তরে যখন বলা হয়—“শিবঃ সংবিত্‌ স্বাতন্ত্র্যময়ী”—তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, “শিব হলেন সংবিত্‌ (চেতনা), যিনি স্বাতন্ত্র্যময়ী (স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ)”। অর্থাৎ, শিব কোনো দেবতা বা আলাদা সত্তা নন; তিনি সেই সর্বব্যাপী, স্বয়ং-উজ্জ্বল চেতনা, যিনি নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিতে (icchā-śakti) অসীম থেকে সীমিত, অচল থেকে চলমান, নিরাকার থেকে রূপময় হয়ে ওঠেন। এই চেতনা নিজে একইসাথে প্রকাশ (prakāśa) ও বিমর্শ (vimarśa)—অর্থাৎ, আলো ও আত্মসচেতনতা। “প্রকাশ” হলো তাঁর দীপ্তি, যা সব কিছু উদ্‌ভাসিত করে; আর “বিমর্শ” হলো সেই দীপ্তির নিজের প্রতি সচেতনতা—নিজেকে দেখা, নিজেকে জানা। যখন এই দীপ্তি ও আত্মসচেতনতা একে অপরের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে মিলিত হয়, তখনই চেতনা জীবন্ত, স্পন্দমান, সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে।

এখানে ‘শিব’ কোনো রূপধারী দেবতা নন; তিনি পরম চেতনা (Parama Saṁvit)—এক স্বয়ং-উজ্জ্বল, সর্বব্যাপী, অবিভক্ত সচেতন বাস্তবতা। ‘সংবিত্‌’ (Saṁvit) অর্থ চেতনা বা জ্ঞানের মৌল স্বরূপ—যা কেবল জানে না, বরং নিজের জানা-প্রক্রিয়ার প্রতিও সচেতন। আর ‘স্বাতন্ত্র্যময়ী’ (Svātantryamayī) বোঝায় সেই চেতনার অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা—যেখানে কোনো বাহ্য কারণ বা উপাদান নেই; তিনি নিজেই নিজের কারণ, নিজের ইচ্ছায়, নিজের শক্তিতে কার্য সম্পাদন করেন।

অভিনবগুপ্ত এই ধারণা ব্যাখ্যা করতে বলেন, শিবের চেতনা কখনো স্থবির নয়; তার স্বভাবই বিমর্শ (Vimarśa)—নিজেকে জানার অন্তর্লীন গতি। এই আত্ম-সচেতন গতি থেকেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ঘটে। তাই তিনি বলেন, শিবই সংবিত্‌, এবং সেই সংবিত্‌ই স্বাতন্ত্র্যময়ী—অর্থাৎ, শিবের চেতনা স্বাধীনতায় নিজেকে প্রকাশ করে। এই ধারণাই পরে কালী-তত্ত্বে রূপ নেয়—এখানেই কাশ্মীর শৈব দর্শনের সর্বোচ্চ নন্দন ও দার্শনিক ঐক্য প্রকাশ পায়। যখন বলা হয়—“কালী শিবের স্বাতন্ত্র্য-শক্তি (Svātantrya-śakti)”, তখন এর অর্থ এই নয় যে, কালী কোনো পৃথক দেবী, যিনি শিব থেকে আলাদা কোনো সত্তা। বরং তিনি সেই একই চেতনার গতিশীল দিক, যা নিজের স্থির, অবিচল দীপ্তি (śiva-prakāśa) থেকে আত্মপ্রকাশের আনন্দে কম্পিত হয়ে ওঠে।

শিবের প্রকৃতি চেতনা, এবং সেই চেতনার অন্তর্গত ধর্মই স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য। এই স্বাধীনতা যখন নিজের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করে, তখনই তা শক্তি হয়ে ওঠে; এবং সেই শক্তির সবচেয়ে গভীর, স্পন্দিত, জাগ্রত রূপই কালী। শিব এখানে নিস্তরঙ্গ, নির্বিশেষ, স্থিত চেতনার প্রতীক—তিনি নিঃশব্দ দীপ্তি, অনন্ত সম্ভাবনা। আর কালী সেই দীপ্তির নৃত্যমান শক্তি—যিনি স্থিতিকে গতি দেন, নীরবতাকে ধ্বনিতে রূপ দেন, এবং নিদ্রিত সম্ভাবনাকে মহাজাগতিক প্রকাশে পরিণত করেন।

শিব ও কালী আলাদা নন; তাঁরা এক চেতনার দুই পরিপূরক দিক—শিব হলেন চেতনার “হওয়া”, কালী হলেন সেই চেতনার “হওয়া-র অনুভব”। যেমন একটি দীপের শিখা ও তার আলো আলাদা নয়—শিখা হচ্ছে দীপ্তির স্থিত রূপ, আর আলো তার বিস্তৃত প্রতিফলন—তেমনি শিব ও কালী। এই দৃষ্টিতে, কালী কেবল তন্ত্রের এক ভয়ংকর দেবী নন; তিনি চেতনার অন্তর্গত স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক—যার মধ্যেই নিহিত সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোধান ও অনুগ্রহের মহাজাগতিক চক্র। তিনি সেই “স্পন্দন” (spanda) যার মধ্য দিয়ে শিব নিজের নীরব দীপ্তি থেকে প্রকাশিত জগতের রূপ নেন, আবার সেই রূপকেই নিজের মধ্যে গ্রাস করে নেন।

শিব হলেন একক, স্ব-উজ্জ্বল চেতনা, আর কালী সেই চেতনার স্পন্দিত প্রকাশ—শিব সংবিত্‌, কালী তার স্পন্দন; শিব অচল, কালী তার চলন; শিব নীরব, কালী তার ধ্বনি; শিব সম্ভাবনা, কালী তার প্রকাশ। এই ঐক্যই অদ্বৈত তত্ত্বের জীবন্ত অভিজ্ঞতা—যেখানে স্থিতি ও গতি, নীরবতা ও প্রকাশ, ব্রহ্ম ও শক্তি—সব এক অনন্ত চেতনার নৃত্যে মিলিত হয়ে যায়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে “শিব-প্রকাশ” (Śiva-prakāśa) শব্দটির অর্থ কেবল “শিবের আলো” নয়; বরং এটি এমন এক দার্শনিক ধারণা, যা চেতনার স্ব-উজ্জ্বল, আত্ম-সচেতন দীপ্তি-র প্রতীক। শিব এখানে কোনো সত্তা নন, বরং এক সর্বব্যাপী, স্বপ্রকাশমান চেতনা (svaprakāśa-saṁvit)—যিনি নিজেই জানেন, নিজেই জানা হন, এবং সেই জানার ক্রিয়াটিও তিনিই। এই ‘স্ব-দীপ্ত চেতনা’-র মধ্যেই মহাবিশ্বের সমস্ত সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে।

কালী-তত্ত্বে এই শিব-প্রকাশ ধারণা আরও এক স্তরে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কালী হচ্ছেন সেই শক্তি, যিনি শিব-প্রকাশকে স্পন্দন (spanda) দেন—অর্থাৎ, তিনি স্থিত দীপ্তিকে গতিতে পরিণত করেন। যেখানে শিব-প্রকাশ হলো চেতনার নিস্তরঙ্গ উজ্জ্বলতা, সেখানে কালী সেই উজ্জ্বলতার সচেতন কম্পন।

অভিনবগুপ্ত এই দিকটি বোঝাতে বলেন—শিব হলেন prakāśa (আলো), আর শক্তি বা কালী হলেন vimarśa (আত্ম-সচেতনতা)। আলো যদি কেবল আলোই থাকে, তবে সে জানে না যে, সে আলোকিত; কিন্তু যখন সেই আলো নিজের দীপ্তি সম্পর্কে সচেতন হয়, তখনই প্রকাশ ঘটে—এটাই বিমর্শ, আর বিমর্শের জীবন্ত রূপই কালী। অর্থাৎ, শিব-প্রকাশ হলো চেতনার নীরব দীপ্তি, আর কালী হলো সেই দীপ্তির আত্ম-জাগরণ—যেখানে আলো নিজের প্রতিফলনে নিজেরই রূপে আবির্ভূত হয়।

এই প্রেক্ষিতে, কালী শিব-প্রকাশের প্রাণস্পন্দন, তিনি সেই শক্তি, যিনি শিবের স্থির দীপ্তিকে বহুবর্ণ সৃষ্টির আলোয় বিস্তার দেন, যিনি নীরব পরম চেতনার অন্তর্গত সম্ভাবনাকে জগৎরূপে অনুবাদ করেন। তাই বলা যায়—Śiva-prakāśa হলো চেতনার স্বরূপ (being of consciousness), আর Kālī হলো সেই চেতনার ক্রিয়া (becoming of consciousness)।

শিবের প্রকাশ কেবল দীপ্তি নয়; কালী সেই দীপ্তির স্পন্দন, সেই চলমান ধ্বনি, যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে জানে, নিজের রূপে প্রকাশিত হয়, এবং পুনরায় নিজের নিস্তরঙ্গ শিব-প্রকাশে ফিরে যায়। এই দ্বন্দ্বহীন চক্র—প্রকাশ ও প্রত্যাহারের, দীপ্তি ও স্পন্দনের—অন্তর্গত ঐক্যই হলো কালী-দৃষ্টি, যেখানে শিব-প্রকাশ কখনোই স্থবির নয়; সে সর্বদা জীবন্ত, চঞ্চল, স্বতঃস্ফূর্ত, এবং নিজেরই চেতনার নৃত্যে অনন্তভাবে জাগ্রত।

এই আত্ম-সচেতন দীপ্তির সৃষ্টিশীল স্পন্দনই কাশ্মীর শৈব মতের কেন্দ্রীয় নীতি, এবং সেই স্পন্দনই এক অর্থে কালী—যিনি চেতনার স্বাধীনতা ও জীবন্ত প্রকাশের রূপক প্রতিমূর্তি। কারণ এই চেতনা কখনও স্থবির নয়; তাঁর অন্তর্নিহিত স্বভাবই হলো স্বাতন্ত্র্য (svātantrya)—অর্থাৎ, নিজের মধ্যেই পূর্ণ স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাই চেতনার সত্য রূপ; কোনো বাহ্য কারণ ছাড়া, কোনো অন্য শক্তির উপর নির্ভর না করে, নিজেরই ইচ্ছায় (icchā) তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন, সৃষ্টি করেন, আবার নিজের মধ্যেই লয়ও করেন।

অভিনবগুপ্তের এই উক্তি—“স্বাতন্ত্র্যমেব শৈবস্য তত্ত্বম্‌”—কাশ্মীর শৈব দর্শনের হৃদয়বিন্দু হলেও, এর প্রকৃত অর্থ সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ হয় কালী-তত্ত্ব-এর আলোয়। কারণ, শিবের স্বাতন্ত্র্য বা পরম স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত নীতি নয়; সেটিই যখন জীবন্ত, স্পন্দিত, সৃজনশীল রূপে প্রকাশিত হয়, তখন তাকে বলা হয় কালী।

শিব এখানে নিস্তরঙ্গ সংবিত্‌ (pure consciousness)—তিনি নিঃশব্দ, স্থির, অচল দীপ্তি; কিন্তু তাঁর স্বভাবই স্বাধীনতা (svātantrya), অর্থাৎ স্ব-ইচ্ছাশক্তিতে স্বতঃস্ফূর্ত সৃজন। এই স্বাধীনতারই প্রাণশক্তি, কম্পন ও আত্মপ্রকাশ হলো শক্তি, এবং সেই শক্তির পরম, তান্ত্রিক রূপই কালী। তাই অভিনবগুপ্তের উক্তি “শক্তিঃ স্বাতন্ত্র্যম্‌, স্বাতন্ত্র্যমেব শৈবস্য তত্ত্বম্‌”—কালী-দৃষ্টিতে দাঁড়ায় এইভাবে: কালীই শিবের স্বাতন্ত্র্য, শিবের স্বাধীন চেতনা-শক্তির জীবন্ত প্রতিমূর্তি।

শিব যদি হন প্রকাশ (prakāśa)—চেতনার নিস্তরঙ্গ আলোক-স্বরূপ, তবে কালী হলেন বিমর্শ (vimarśa)—সে আলোর নিজের প্রতি সচেতনতা। আলো কেবল তখনই “আলো” হয়ে ওঠে, যখন তা নিজের দীপ্তি জানে—এই জানাটাই কালী। তিনি সেই মুহূর্ত, যখন শিব নিজের দীপ্তিকে অনুভব করেন, নিজেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে জগৎরূপে বিকশিত হন।

এই আত্ম-সচেতন দীপ্তির কম্পনই স্পন্দ (spanda)—যেখানে স্থিত চেতনা আনন্দের ছন্দে নৃত্য করতে শুরু করে। কালী সেই স্পন্দনের মহাশক্তি—যিনি স্থিতিকে গতি দেন, নীরবতাকে ধ্বনিতে রূপ দেন, আর শিবের নিস্তরঙ্গ সম্ভাবনাকে সীমাহীন প্রকাশে পরিণত করেন। তাই কালী কোনো সৃষ্টির দেবী নন; তিনি স্বয়ং সৃষ্টির চেতনা, যাঁর স্পন্দনেই মহাবিশ্বের উদ্ভব, স্থিতি ও লয় ঘটে।

অতএব, শিব ও কালী আলাদা দুই দেবতা নন—তাঁরা এক চেতনার দুই অবিচ্ছেদ্য দিক: শিব হলেন নিস্তরঙ্গ দীপ্তি (static illumination), আর কালী সেই দীপ্তির গতিশীল কম্পন (dynamic pulsation)। শিব হলেন “হওয়া” (being), কালী হলেন সেই “হওয়া-র অনুভব” (becoming)। শিব সম্ভাবনা, কালী তার প্রকাশ; শিব নীরবতা, কালী তার উচ্চারণ।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালী কোনো পৌরাণিক প্রতিমা নয়, বরং স্বয়ং চেতনার স্বাতন্ত্র্য-রূপ—যিনি সময়, গতি ও প্রকাশের মধ্যে দিয়ে অচল চেতনাকে জীবন্ত করেন। জগৎ কোনো বাহ্য সৃষ্টিকর্তার নির্মাণ নয়—এটি কালী-শক্তিরই আত্ম-উন্মোচন, শিব-চেতনার আনন্দলীলার প্রতিফলন। এই দৃষ্টিতে, কালী-তত্ত্বই “স্বাতন্ত্র্যমেব শৈবস্য তত্ত্বম্‌”-এর জীবন্ত অর্থ—যেখানে শিবই বিশ্ব, এবং বিশ্বই কালী-শক্তির চিরন্তন, অদ্বৈত নৃত্য।

চেতনারই এই আত্ম-প্রতিফলন থেকে জন্ম নেয় দ্বৈতাভাসনা (dvaitābhāsanā)—অর্থাৎ, চেতনা যখন নিজের স্বরূপকে জানার আনন্দে নিজের মধ্যেই একটি প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে, তখন সেই একক চেতনার মধ্যেই “আমি” (subject, প্রমাতা) ও “এটা” (object, বিষয়) এই দুটি দিক প্রকাশিত হয়। এটি কোনো প্রকৃত বিভাজন নয়; বরং এক অখণ্ড চেতনারই দুই মুখ—একটি অন্তর্মুখী, অপরটি বহির্মুখী। প্রথমটি হলো আত্মসচেতনতার প্রতিফলিত ধারা, যেখানে চেতনা নিজেকে “আমি” বলে অনুভব করে; দ্বিতীয়টি সেই প্রতিফলনের অবজেক্টিভ প্রকাশ, যেখানে চেতনা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে “এটা” বলে অনুভব করে।

কাশ্মীর শৈব মতে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সত্তাগত (ontological) ভেদ নেই; তারা একই চেতনার দুটি ভঙ্গি মাত্র। উত্পলদেব তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা (১.৫.৮)-এ এই রহস্যটিকে অত্যন্ত সংক্ষেপে প্রকাশ করেছেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি।” অর্থাৎ, চেতনা নিজস্ব চেতনা-রূপের মধ্যেই বিবর্তিত হয়, এবং নিজের স্বাধীনতায় (স্বাতন্ত্র্যে) দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে।