শৈব কালী: ছত্রিশ



“মা ভৈঃ” কোনো নৈতিক উপদেশ নয়, এটি চেতনার আত্ম-প্রত্যভিজ্ঞার মন্ত্র। অদ্বৈত বেদান্তে এটি আত্মার অভয়বাণী—“আমি ব্রহ্ম, অতএব মৃত্যুভয় নেই।” কাশ্মীর শৈবে এটি শিব-চেতনার স্বীকৃতি—“আমি-ই চৈতন্য, সীমাহীন স্বাধীনতা।” আর শাক্ত দর্শনে এটি মাতৃচেতনার করুণা—“ভয় কোরো না, কারণ ভয়ও আমারই রূপ।” এই তিন দৃষ্টির মিলনে “মা ভৈঃ” হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সত্য—ভয় তখনই লুপ্ত হয়, যখন আমরা উপলব্ধি করি: “যা-কিছু আছে, সবই আমিই—আর সেই আমিই মা।”

কালীর প্রসারিত জিহ্বা থেকে ঝরে পড়া রক্ত তান্ত্রিক, অদ্বৈত, শৈব ও শাক্ত দর্শনের এক গভীর প্রতীক—যা কেবল হিংসা বা ভয় নয়, বরং চেতনার নিজস্ব আত্ম-রূপান্তর প্রক্রিয়ার রূপক। এই রক্ত হল চেতনারই জীবন্ত প্রতিফলন, যেখানে মৃত্যু ও জীবন, সংহার ও সৃজন, ভয় ও মুক্তি—সব মিশে যায় এক অভিন্ন স্রোতে।

অদ্বৈত বেদান্তে রক্ত মানে প্রাণ, আর প্রাণ মানে চেতনারই গতি। কিন্তু ব্রহ্মচেতনা নিজে কখনও রক্তাক্ত নয়; রক্ত সেখানে মায়ার প্রতীক, যা ব্রহ্মের মধ্য দিয়ে ক্রিয়াশীল। কালী এই ব্রহ্ম-মায়ার মূর্ত প্রতীক—তিনি সেই শক্তি, যিনি অবিদ্যা ও অহংকারকে ছিন্ন করে দেন, আর সেই ছিন্নতার রক্তধারা জ্ঞানোন্মেষের প্রতীক। অদ্বৈত-দৃষ্টিতে এই রক্ত মানে অজ্ঞানের দহন, আত্মপরিচয়ের ক্ষয়। যেমন উপনিষদে বলা হয়েছে, “যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথ মর্ত্যোঽমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।।” (কঠোপনিষদ ২.৩.১৪) অর্থাৎ, "যখন মানুষের হৃদয়ে আশ্রয়-নেওয়া সমস্ত কামনা-বাসনা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয়, তখনই মর্ত্য মানুষ অমর (অমৃত) হয়ে যায় এবং এই জীবনেই ব্রহ্মকে লাভ করে।"—যখন অন্তরের সমস্ত কামনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখনই আত্মা জেগে ওঠে। কালীর রক্ত সেই কামনা ও আসক্তির ক্ষয়; এটি অহংকারের রস, যা জ্ঞানাগ্নিতে গলে চেতনার দীপ্তিতে মিশে যায়। তাই এই রক্ত ভয়ংকর নয়; এটি মুক্তির প্রতীক—অহংকারের আত্মবিলয় ও পরম আত্মার উদ্‌ভাস।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে রক্ত চেতনার স্পন্দ (spanda)—অর্থাৎ চৈতন্যের নিজস্ব গতি, তার স্পন্দিত জীবন্ততা। শিব হলেন স্থিত, আর শক্তি সেই স্থিতির কম্পন। কালী সেই শক্তির চরম রূপ, যেখানে চেতনা নিজেই নিজের তীব্র স্পন্দনে রূপ নেয় রক্তের ধারায়। এই রক্তের প্রবাহ মানে চেতনার আত্ম-বিস্তার—জগতের সৃষ্টি ও লয় দুই-ই সেই এক প্রবাহে। তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ অভিনবগুপ্ত বলেন, “শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—শিব চিরকাল পাঁচ ক্রিয়ায় লিপ্ত—সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোভাব ও অনুগ্রহ। কালী সেই পাঁচ ক্রিয়ার একত্র প্রকাশ। রক্তের ঝরনায় সংহারের চিহ্ন থাকলেও, তার মধ্যেই অনুগ্রহের ধারা প্রবাহিত—যেখানে সংহারই সৃষ্টির বীজ। শৈবদৃষ্টিতে রক্ত মানে চেতনার লীলাময় স্বরূপ; তিনি ধ্বংস করেন না, রূপান্তর ঘটান।

শাক্ত দর্শনে রক্তই মহাশক্তির অমৃতরূপ—মৃত্যুর রস, যা জীবনকেও পুষ্ট করে। কালী যখন জিহ্বায় রক্ত ধারণ করেন, তখন তা নিজের সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং অস্তিত্বের চক্র পূর্ণ করার জন্য। তাঁর রক্ত মানে “রস”, যা চেতনার আস্বাদন; এটি সেই দিব্যরস, যা সকল প্রাণ, সকল গতি, সকল আকাঙ্ক্ষায় প্রবাহিত। "রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্ধ্বা আনন্দী ভবতি।।" (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.৭) অর্থাৎ, নিশ্চয়ই তিনিই (পরমাত্মা) রস-স্বরূপ (আনন্দময়)। এই জীব (অয়ং) সেই রসকে (আনন্দকে) লাভ করে নিশ্চয়ই আনন্দিত হয়।—শিবই রস। কালী সেই রসের উগ্র প্রকাশ—যিনি মৃত্যুর রক্তকেও জীবনের অমৃতে রূপান্তরিত করেন। তাঁর রক্ত আসলে চেতনার পুনরাবির্ভাব, যেখানে মৃত্যু নিজেই জীবনের পুষ্টি হয়ে ওঠে।

এই রক্তের মাহাত্ম্য আরও এক দিক দিয়ে গভীর। এটি অহংকারের মৃত্যু এবং আত্মবোধের পুনর্জন্মের প্রতীক। ছিন্নমুণ্ডের মুখ থেকে ঝরা রক্ত কালী নিজের মুখে গ্রহণ করেন—এর অর্থ, ব্যক্তি-চেতনার সমস্ত সীমা, সমস্ত ‘আমি’-ভাব, পরম চেতনার মধ্যে শোষিত হয়ে যায়। এটি একধরনের আত্মোপলব্ধির পুনর্গমন—যেখানে “আমি” কেবল “তাঁরই” মধ্যে মিশে যায়। শাক্ততত্ত্বে একে বলে “মহাভোগ”—চেতনার নিজেরই রস আস্বাদন।

মনোবিশ্লেষক কার্ল ইয়ুং এই প্রতীকের সরাসরি বিশ্লেষণ করেননি, তবে তাঁর রূপান্তরমূলক প্রতীকতত্ত্ব (symbolic transformation)-এর আলোকে এই চিত্রকে ব্যাখ্যা করা যায়। ইয়ুং-এর মতে রক্ত মানুষের মানসিক জীবনীশক্তি বা libido-র প্রতীক—যা আত্মার গভীর স্তরে ত্যাগ, যন্ত্রণা এবং পুনর্জন্মের ইঙ্গিত বহন করে (Symbols of Transformation, Collected Works, Vol. 5)। এই দৃষ্টিতে, কালী যখন রক্তপান করেন, তা বোঝায় মনের অবচেতন অন্ধকার দিক—যাকে ইয়ুং “Shadow” বলেছেন—তার সঙ্গে চেতনার মেলবন্ধন। সেই মুহূর্তে মন নিজের ভয়, মৃত্যু ও অন্ধকার প্রবণতাকে অস্বীকার না করে গ্রহণ করে, এবং এই গ্রহণই রূপান্তরের সূচনা ঘটায়। তাই কালীর রক্ত এখানে কোনো হিংসার প্রতীক নয়; বরং এটি আত্মবিসর্জন ও আত্মজাগরণের প্রতীক—যেখানে চেতনা নিজের অন্তর্গত অন্ধকারকে গ্রাস করে আলোকিত করে তোলে।

কালীর জিহ্বা থেকে পড়া রক্ত মহাশক্তির নিজস্ব আত্ম-প্রকাশ—অদ্বৈত দৃষ্টিতে এটি মায়া থেকে ব্রহ্মচেতনার উন্মেষ; শৈব দৃষ্টিতে এটি চেতনার স্পন্দিত স্বরূপ; আর শাক্ত দৃষ্টিতে এটি শক্তির অমৃতরস। এই রক্তের ধারায় মৃত্যু ও জীবন, সংহার ও সৃষ্টি, মায়া ও ব্রহ্ম—সব একাকার হয়ে যায়। কালী সেই রক্তধারায় আমাদের শেখান—ধ্বংসও করুণা, মৃত্যুও অমৃত, আর অন্ধকারই চেতনার গভীরতম দীপ্তি।

কালীর গায়ের রং নিয়ে তন্ত্র, কাশ্মীর শৈবদর্শন ও অদ্বৈত বেদান্ত—তিনটি ধারাই এক গভীর প্রতীকমূলক ঐক্যরেখায় এসে মিশে যায়। কালীর রূপ কখনো গাঢ় নীল (নীলমেঘশ্যামা), কখনো কৃষ্ণবর্ণা, আবার অনেক তান্ত্রিক ব্যাখ্যায় ঘন-অন্ধকার কালো। এই বিভিন্ন রূপের পেছনে যে-তত্ত্ব লুকিয়ে আছে, সেটি আসলে “চেতনার অনন্ততা ও অগম্যতার বর্ণভাষা”। এই "বর্ণভাষা" সেই সীমাবদ্ধতার স্বীকারোক্তি, যেখানে চেতনাকে বোঝার জন্য আমরা ভাষা ব্যবহার করি, কিন্তু জানি যে, সেই ভাষা কখনোই চেতনার অনন্ত স্বরূপ এবং অগম্যতাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না।

তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে—কালীর কৃষ্ণরূপ মানে অসীম চেতনার প্রতীক, যেমন গাঢ় রাত্রি সমস্ত রংকে নিজের মধ্যে গ্রাস করে। রং হল সীমা, কিন্তু কৃষ্ণ সেই সীমাকে অতিক্রম করে সব কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। কালিকা পুরাণ, রুদ্রযামল তন্ত্র ও মহানির্বাণ তন্ত্র-এ বলা হয়েছে—তিনি “অকালমূর্তি”, অর্থাৎ সময় ও রূপের অতীত। তাই তাঁর রং অন্ধকার, কারণ তিনি সেই চেতনার প্রতীক, যাকে কোনো আলো সীমাবদ্ধ করতে পারে না। এই কৃষ্ণতা নিস্তরঙ্গ শূন্য নয়; এটি অনন্ত সম্ভাবনার গর্ভ—যেমন বীজ থেকে সব রং ও রূপ উদ্ভূত হয়, কিন্তু বীজ নিজে রংহীন।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে এই কৃষ্ণতা বা নীলাভ অন্ধকার হল চিত্তত্ত্বের অনুত্তরাবস্থা—পরম চৈতন্য বা পরম শিবের অবস্থা—যেখানে আলো ও অন্ধকার, রূপ ও অরূপ সবই মিলিত। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ বলেন, “চিত্‌ স্বপ্রকাশা, তমসো ন তদ্ব্যতিরেকে”—"চৈতন্য (চিৎ) স্বয়ং-প্রকাশিত, এবং অন্ধকার (তমস) তার (চিতের) অনুপস্থিতি ছাড়া আর কিছু নয়।" অর্থাৎ, চেতনা নিজেই আলোকস্বরূপ, তবে তার গভীরতম, অন্তর্গত স্বরূপে সেই আলোও এমন এক নাশহীন অন্ধকারের মতো, যা পরম শুদ্ধ। এই শুদ্ধতা আসে তার অদ্বৈত অবস্থা থেকে, যেখানে কোনো প্রকার ভেদ বা দ্বৈততা নেই, কোনো প্রতিফলনও নেই, যা মূল সত্তাকে খণ্ডিত করতে পারে। এই অবস্থায় চেতনার আলোক এমন নিরাকার ও অসীম যে, তাকে সাধারণ দৃষ্টিতে অন্ধকার বলে প্রতীয়মান হতে পারে, কিন্তু এটি অজ্ঞানতার অন্ধকার নয়, বরং চরম জ্ঞানের এক অনির্বচনীয় অবস্থা।

এই গভীর দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, দেবী কালীর কৃষ্ণবর্ণ দেহকে কেবল একটি প্রতীকী রূপ হিসেবে দেখা হয়। এটি নিছক কালো রং নয়, বরং সৃষ্টির পূর্বে বিদ্যমান সেই আদিম, অচ্ছেদ্য ঐক্য এবং অনন্ত শূন্যতার প্রতীক, যা সমস্ত ভেদ ও বৈচিত্র্যের ঊর্ধ্বে। কালীর এই কৃষ্ণদেহ আসলে 'চিৎ'-এর স্বয়ম্ভূ প্রকাশ, যা নিজের আলোকেই আলোকিত এবং যেখানে কোনো প্রকার বিভেদ প্রবেশ করতে পারে না।

এখানে শিব এবং শক্তি অবিচ্ছিন্ন, অর্থাৎ সৃষ্টির পুরুষ এবং প্রকৃতি তত্ত্ব একীভূত হয়ে রয়েছে। তারা পৃথক সত্তা নয়, বরং একই পরম সত্তার দুটি অভিন্ন দিক। শিব হলেন স্থিতি ও নির্বিকার চেতনার প্রতীক, আর শক্তি হলেন গতি ও ক্রিয়ারূপিণী। কালীর এই রূপে এই শিব আর শক্তি এতটাই একীভূত যে, তাদের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ কল্পনা করা যায় না, যেমন অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি অবিচ্ছেদ্য। এই অচ্ছেদ্য ঐক্যই মহাকালীর স্বরূপ, যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের সমস্ত ধারণা বিলীন হয়ে যায় এক অসীম, আদিহীন ও অন্তহীন সত্তায়।

অদ্বৈত বেদান্তে কৃষ্ণতা মানে ব্রহ্মের অবিকল, অগোচর, নিরাকার অবস্থা। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেন, “যস্য প্রকাশেন প্রকাশ্যং তস্য ন প্রকাশো ভবতি”—যার দ্বারা সব কিছু প্রকাশিত হয়, তাকে আর কেউ প্রকাশ করতে পারে না। তাই ব্রহ্ম চিরন্তন ‘অপ্রকাশিত’—এবং সেই অপ্রকাশিতই তন্ত্রে “কালো” বলে প্রতীকী। কালী সেই অপ্রকাশিত ব্রহ্ম-চেতনার রূপায়ণ—তিনি নিজে দৃশ্যমান, অথচ যিনি দৃশ্যমানতার উৎস। তাঁর কালো রূপ সেই ব্রহ্মচেতনার স্মারক, যা রং, রূপ, নাম—সব কিছুর অতীত।

কালীর কৃষ্ণরূপ তাই অন্ধকার নয়—এটি অদ্বৈত চেতনার অরূপ উজ্জ্বলতা। তন্ত্র বলে, “কালো, কারণ তিনি কালেরও অতীত”; শৈব দর্শন বলে, “কালো, কারণ তিনি অনুত্তর, চিতের অগোচর গহ্বর”; আর বেদান্ত বলে, “কালো, কারণ তিনি ব্রহ্ম—যিনি সব রঙের প্রত্যক্ষ কারণ, অথচ নিজে রঙের অতীত।”

এজন্যই তাঁর শরীর নীলাভ-কৃষ্ণ, কখনো ঝলমলে অগ্নিশিখার মতো দীপ্ত, আবার কখনো অরূপ রাতের মতো নিস্তব্ধ—যেমন চেতনা কখনো প্রকাশ, কখনো লয়। কালীর কৃষ্ণতা সেই মহাশূন্যের প্রতীক, যেখানে সব রূপ মিশে যায়; আর সেই মহাশূন্যই ব্রহ্ম, চিত্‌, অনুত্তর—যার মধ্যে সমস্ত জগত, সমস্ত সময়, সমস্ত আলো অবলীন হয়ে যায় এক অসীম, অদ্বৈত শান্তিতে।

কালীর রক্তভরা খাপ্পর (খুলি-পাত্র) আসলে মৃত্যুভয় বা বিভীষিকার প্রতীক নয়; এটি চেতনার অনন্ত প্রবাহ, জীবনশক্তির চক্রাকার পুনর্জন্ম, এবং সময়ের অবিরাম ক্ষয়ের গভীর ইঙ্গিত। অদ্বৈত, শৈব ও শাক্ত দর্শনের দৃষ্টিতে এই খুলিপাত্র হলো আত্মোৎসর্গের প্রতীক—যেখানে ব্যক্তি “আমি” বা সীমাবদ্ধ সত্তা নিজের রক্ত, অর্থাৎ নিজের প্রাণ ও অহংকে উৎসর্গ করে পরম চেতনায় বিলীন হয়। এটি কোনো দেহগত বলি নয়, বরং অহং, আসক্তি ও ভয়ের আত্মবিলয়—যার মধ্য দিয়েই সত্যিকার জাগরণ ঘটে।

অদ্বৈত বেদান্তে এই খাপ্পর চিহ্নিত করে সেই মুহূর্ত, যখন জীবাত্মা নিজের পৃথকত্বের ভ্রম ত্যাগ করে পরম ব্রহ্মে মিশে যায়। রক্ত এখানে ‘অহংকারের রস’, যা ব্রহ্মজ্ঞানের অগ্নিতে শুদ্ধ হয়। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এটি “প্রত্যভিজ্ঞা”-র প্রতীক—নিজেকে শিবচেতনা হিসেবে চিনে নেওয়া। খাপ্পরের রক্ত তাই “বিমর্শশক্তি”-র প্রবাহ, যেখানে চেতনা নিজের গভীরতম স্তরে আত্মবিমুখ হয়ে আবার নিজেকেই চিনে নেয়।

শাক্ত তত্ত্বে এই রক্তভরা খুলি দেবীর করুণা ও অনুগ্রহের প্রতীক। তিনি জীবন ও মৃত্যুর রস একই সঙ্গে ধারণ করেন। রক্ত মানে প্রাণশক্তি, যা কালী নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে সকল ভয় ও দ্বৈততাকে রূপান্তর করেন। খাপ্পরটি যেন জীবনের সেই পাত্র, যেখানে মৃত্যু ও সৃষ্টি একসঙ্গে মিশে যায়—যেখানে ধ্বংসই সৃষ্টির উৎস।

মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এই প্রতীক আরও গভীর। ফ্রয়েড বা জুং-এর বিশ্লেষণে এটি অবচেতনের অন্ধকারে এক আত্মসন্ধান—যেখানে মানুষ নিজের দমিত আকাঙ্ক্ষা, ভয় ও বেদনার মুখোমুখি হয়। কালী সেই অন্ধকারের দেবী, যিনি আমাদের শেখান নিজের Shadow বা ‘ছায়া’-সত্তাকে অস্বীকার নয়, বরং গ্রহণ করতে। কারণ যতক্ষণ না আমরা আমাদের ভিতরের অন্ধকারকে স্বীকার করি, ততক্ষণ পূর্ণতা সম্ভব নয়।