শৈব কালী: চৌদ্দ



তাই কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালী হলেন চিদ্‌জননী (চেতনার জননী), আর অদ্বৈত বেদান্তে তিনি ব্রহ্মশক্তি বা মায়া—যিনি ব্রহ্মের নামরূপ প্রকাশ ঘটান। দুই ক্ষেত্রেই তিনি মা, কারণ—তিনিই সমস্ত অস্তিত্বের গর্ভ, তিনিই সময়ের ধারা, তিনিই জীবের মধ্যে আত্মস্মরণের শক্তি।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রলোক-এ বলেন—“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—অর্থাৎ শিবের মধ্যে এই পাঁচ ক্রিয়া চিরন্তন; কিন্তু এই পাঁচ ক্রিয়া বাস্তবে কালী-শক্তিরই নৃত্য। সৃষ্টি তাঁর স্পন্দন, স্থিতি তাঁর ভারসাম্য, লয় তাঁর নিস্তব্ধতা, তিরোভাব তাঁর আত্ম-বিস্মরণ, আর অনুগ্রহ তাঁর আত্ম-জাগরণ।

এই কারণেই তাঁকে “মা কালী” বলা হয়—তিনি সব কিছুর জন্মদাত্রী, কিন্তু তাঁর মাতৃত্ব কেবল শারীরিক নয়; এটি চেতনার মাতৃত্ব। তিনি জন্ম দেন, ধারণ করেন, লালন করেন, ও শেষে সমস্তকে নিজের নীরব আলিঙ্গনে ফিরিয়ে নেন।

কালী “মা”, কারণ তিনিই—চেতনার উৎস, বিশ্বরূপ জননী, সময়ের গ্রাসকারিণী এবং আত্মার মুক্তিদাত্রী। তাঁর বুকে সৃষ্টি ও লয়, বিস্মরণ ও স্মরণ, জীব ও ঈশ্বর—সব মিলেমিশে আছে এক অনন্ত চেতনার করুণাময়, নৃত্যময় মাতৃত্বে।

শিবকে “বাবা” বলা হয়, যেমন কালীকে বলা হয় “মা”—এই দুই সম্বোধনের মধ্যে কেবল ভক্তির অনুভব নয়, নিহিত আছে এক গভীর দর্শন। কাশ্মীর শৈব ও অদ্বৈত বেদান্ত উভয়েই শিবকে ব্যাখ্যা করেছে চৈতন্যের আদিস্বরূপ হিসেবে—যিনি সব কিছুর মূল, কিন্তু কিছুই করেন না; যিনি সর্বব্যাপী, কিন্তু কোথাও আবদ্ধ নন। তাঁর কোনো ইচ্ছা নেই, কারণ তিনি সম্পূর্ণ; কোনো গতি নেই, কারণ সমস্ত গতি তাঁর থেকেই। তিনি সেই নীরব দীপ্তি—prakāśa—যার মধ্যে সব কিছু প্রকাশিত হয়, আর যার মধ্যেই সব কিছু ফিরে যায়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়, শিব ও শক্তি এক, অবিচ্ছেদ্য। শিব হলেন নিষ্পন্দ প্রকাশ, আর কালী বা শক্তি হলেন স্পন্দিত বিমর্শ। উত্পলদেব ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.৮)-এ বলেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে”—চেতনা নিজের মধ্যেই বিবর্তিত হয়, নিজের স্বাধীনতায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। শিব সেই চেতনার ভিত্তি—তিনি নীরব সাক্ষী, যার মধ্যে সমস্ত সম্ভাবনা নিদ্রিত, আর কালী সেই সম্ভাবনার জাগরণ। শিবের নীরবতাই কালীকে নাচতে শেখায়, আর কালী-র নৃত্যই শিবকে দৃশ্যমান করে তোলে।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ বলেন—“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—অর্থাৎ, শিবের মধ্যে সৃষ্টির পাঁচটি ক্রিয়া—সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ ও অনুগ্রহ—চিরকাল চলমান। কিন্তু এই পাঁচ ক্রিয়া বাস্তবে কালী-শক্তির নৃত্য। শিব এখানে পটভূমি, কালী তাঁর ছন্দ। শিব যেমন স্থির, তেমনি আশ্রয়দাতা; তাঁর নীরব অস্তিত্বের উপরই কালী-রূপ চেতনা নৃত্য করে। তাই কাশ্মীর শৈব দর্শনে শিবকে বলা হয় পরম পুরুষ, কিন্তু “পুরুষ” মানে এখানে কোনো লিঙ্গবাচক দেবতা নয়—এটি চৈতন্যের অপরিবর্তনীয়, নিত্য সাক্ষী-রূপ। যেমন আকাশ সব কিছুকে ধারণ করে, তেমনি শিব ধারণ করেন সমস্ত অস্তিত্ব, সমস্ত সময় ও সমস্ত শক্তিকে। তিনি কিছুই করেন না, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি ছাড়া কিছুই ঘটে না।

অদ্বৈত বেদান্তও একই সত্য অন্য ভাষায় বলে। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.১)-এ বলা হয়েছে—“সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম”—ব্রহ্মই সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত। এই ব্রহ্মই শিব, যিনি নিজের মধ্যেই প্রকাশমান, যিনি জগতকে বহন করছেন কিন্তু কখনো জগতের দ্বারা পরিবর্তিত হন না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৭.৩)-এ বলা হয়েছে—“যঃ আত্মা সর্বানন্তরঃ”—“যিনি সব কিছুর মধ্যে অবস্থান করেন, কিন্তু যাঁর মধ্যে কেউ অবস্থান করতে পারে না।” এই চিরন্তন আত্মাই শিব—নিরাকার, অবিনশ্বর, সর্বব্যাপী। তিনি সৃষ্টির পিতা নন কোনো মানবিক অর্থে, বরং সেই চেতনার পিতা, যার উপস্থিতিতে বিশ্ব, প্রাণ ও অভিজ্ঞতা সম্ভব হয়।

এইজন্য শিবকে “বাবা” বলা হয়—কারণ তিনি হলেন সেই আশ্রয়, সেই আদ্যসত্তা, যার বুকে সমস্ত সৃষ্টি নিরাপদে বিশ্রাম নেয়। মা কালী আমাদের জন্ম দেন, আর বাবা শিব আমাদের ধারণ করেন। মা হলেন চেতনার গতি, সৃষ্টির স্পন্দন; বাবা হলেন চেতনার স্থিতি, সেই নিস্তব্ধ দীপ্তি, যেখানে সব গতি মিলিয়ে যায়।

অভিনবগুপ্ত বলেন—“শিবঃ শক্তিসমায়োগাত্ যৎ তত্ত্বং সর্বমিশ্বরম্‌”—শিব ও শক্তির ঐক্যেই ঈশ্বরত্ব প্রকাশিত। শিব ও কালী আলাদা নন; তাঁরা একই চেতনার দুই দিক। শিব হলেন সেই নীরব সমুদ্র, আর কালী তাঁর তরঙ্গ; শিব হলেন আকাশ, আর কালী তাঁর বজ্রনৃত্য; শিব হলেন আত্মা, আর কালী তাঁর আত্মবিম্ব।

তাই তাঁরা “মা” ও “বাবা” নামে পরিচিত—একই চেতনার দুটি ছায়া, দুটি অভিব্যক্তি। মা কালী চেতনার উষ্ণতা, করুণা ও নৃত্য; শিব বাবা চেতনার স্থিরতা, আশ্রয় ও নীরব দীপ্তি। একে অপরকে ছাড়া তাঁদের অস্তিত্ব নেই, যেমন দীপ্তি ও আলো আলাদা নয়। তাঁদের মিলনেই জগতের জন্ম, অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা, এবং আত্মস্মরণের মুক্তি।

শিবকে “বাবা” বলা মানে—তাঁর সেই নীরব, আশ্রয়দাতা, সর্বব্যাপী চেতনার রূপকে স্বীকার করা, যিনি আমাদের সকল অভিজ্ঞতার পটভূমি। মা হলেন সৃষ্টির মুখ, বাবা সেই অচল অন্তর—তাঁদের যুগলই প্রকাশ করে এক পরম সত্য, যেখানে নৃত্য ও নীরবতা, গতি ও স্থিতি, করুণা ও চেতনা মিশে আছে এক অখণ্ড, অদ্বৈত পরম চেতনার মধ্যে।

মনে রাখতে হবে—বিভাজন বা দ্বৈততা বাস্তব নয়, এটি কেবল অভিজ্ঞতার স্তরে দেখা যায়। আমরা যেভাবে “আমি” ও “জগৎ”, “জ্ঞানী” ও “জ্ঞেয়” আলাদা করে দেখি, তা আসলে চেতনার নিজের খেলা।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে ক্ষেমরাজ বলেছেন (স্পন্দনির্ণয়, ১.৩)—“স্পন্দত্তে নিত্যং চিদ্রূপাত্‌, অস্মিন বিভেদো ন তত্ত্বতঃ”—চেতনা সর্বদা স্পন্দিত হয়, কিন্তু সেই স্পন্দনে কোনো প্রকৃত ভেদ নেই। অর্থাৎ, চেতনা নিজের মধ্যেই চলমান, প্রাণময়; তবু সেই চলন চেতনার একত্বকে ভাঙে না। যেমন ঢেউ উঠলেও সমুদ্র আলাদা হয় না, তেমনি চেতনা নিজের প্রকাশে বিভক্ত হয় না।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৬২)-এ বলেন—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌”—অদ্বৈত চেতনা নিজেই নিজের খেলায় দ্বৈততার আভাস ধারণ করে। অর্থাৎ, “আমি” ও “তুমি”, “ভিতর” ও “বাইরে”—এই পার্থক্য আসলে এক চেতনারই রসনুভূতি, যেন চেতনা নিজেকে দেখতে আয়নায় নিজেরই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে।

এই ‘দ্বৈতাভাস’ বা আপাত দ্বৈততার মূল কারণ হল চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti)—যা তাকে নিজের মধ্যে ভিন্নতার অনুভূতি করতে দেয়। এই শক্তিই “বিমর্শ (vimarśa)”—যা চেতনার নিজের প্রতি সচেতনতা। যেমন, কেউ নিজের মুখ দেখতে চায় বলে আয়না ব্যবহার করে—চেতনা তেমনি নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিফলনে “আমি” ও “এটা” সৃষ্টি করে।

কিন্তু যখন চেতনা উপলব্ধি করে যে এই “অন্য” বা “বাইরের” জগৎ আসলে নিজেরই প্রতিফলন—তখন ঘটে প্রত্যভিজ্ঞা (pratyabhijñā), অর্থাৎ, নিজের মধ্যেই নিজেকে চিনে ফেলা। এটাই মুক্তি। তখন subject (জ্ঞাতা) ও object (জ্ঞেয়)-এর বিভাজন মুছে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে একমাত্র চেতনা—যা জানে, যা দেখা যায়, এবং যা জানার প্রক্রিয়া—সব একসঙ্গে।

অর্থাৎ, আমাদের অভিজ্ঞতার জগতে যে “আমি” ও “বিশ্ব” আলাদা মনে হয়, তা আসলে এক চেতনারই দুই দিক—যেমন একই সূর্য আকাশে আলো ছড়ায় আর প্রতিফলিত হয় জলে। প্রতিফলনের ঢেউ আলাদা মনে হলেও সূর্য তো একটাই।

এভাবেই, কাশ্মীর শৈব দর্শন বলে—দ্বৈততা অভিজ্ঞতার স্তরে সত্য, কিন্তু তত্ত্বত এক অদ্বৈত চেতনারই লীলা। চেতনা নিজের স্বাধীনতায় (svātantrya) জগৎ সৃষ্টি করে, আবার নিজের সচেতনতায় (vimarśa) সেই জগতকে নিজের মধ্যেই ফিরিয়ে নেয়। এই উন্মোচন ও প্রত্যাহারের ধারাবাহিক প্রবাহই শিবচেতনার “স্পন্দন”—যেখানে সৃষ্টি ও লয়, আমি ও তুমি, ভেতর ও বাহির সব মিলেমিশে একাকার।

পশ্চিমে দেকার্ত “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” বলে চিন্তাশীল সত্তা (res cogitans) ও বস্তুজগত (res extensa)-এর মধ্যে কঠোর বিভাজন তৈরি করেছিলেন। কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শন সেই বিভাজন মেনে নেয় না। এখানে বলা হয়—চেতনা একটাই, তার মধ্যেই চিন্তা ও বস্তু, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়, কর্তা ও কর্ম—সব ঘটছে, যেন একই নাট্যমঞ্চে এক অভিনেতা নানা চরিত্রে অভিনয় করছে।

এই দর্শনের মূল কথা হলো—চেতনা কখনও বিভক্ত হয় না; আমরা যেভাবে দ্বৈততা দেখি, তা কেবল চেতনার নিজের খেলা, নিজের রূপভোগ। মুক্তির মানে হলো এই খেলার মধ্যেই চিনে ফেলা—সব চরিত্র, সব অভিজ্ঞতা, সব রূপ আসলে আমিই। এই উপলব্ধিতেই শেষ হয় ভেদ, আর প্রকাশিত হয় সেই এক, চিরন্তন, স্বাতন্ত্র্যময় চেতনা—পরম শিব।

অভিনবগুপ্ত বলেন, মৃত্যু কেবল শরীরের বিলয়, কিন্তু মুক্তি হলো অজ্ঞতার বিলয়। যে-ব্যক্তি জানে, “আমি শিব,” তার জন্য মৃত্যু নেই, কারণ তিনি ইতিমধ্যেই অমর চেতনা হিসেবে নিজেকে চিনেছেন। এই উপলব্ধিতে জীবনই হয়ে ওঠে মুক্তির রূপ। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি কোনো বিরাগ বা ত্যাগে নয়, বরং পূর্ণ অংশগ্রহণে বাস করেন। তিনি জানেন, জগৎও চেতনারই প্রকাশ, তাই কোনো কিছুকে প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজন নেই। তাঁর কাছে প্রতিটি মুহূর্তই শিবের স্পন্দন—চেতনার নৃত্য।

জীবন্মুক্ত অবস্থায় মানুষ সর্বদা চতুর্থ স্তরে—তুরীয় বা তুরীয়াতীত চেতনা স্তরে—স্থিত থাকে। এখানে জাগরণ, স্বপ্ন ও নিদ্রা—এই তিন অবস্থার পার্থক্য লুপ্ত হয়ে যায়। জাগ্রত অবস্থায়ও তিনি অন্তর্নিহিত শান্তিতে নিবিষ্ট, নিদ্রায়ও তিনি জাগ্রত চেতনার দীপ্তিতে ভাসমান। তাঁর চেতনা সর্বদা এক অদ্বৈত সজাগতা, যেখানে কিছুই তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারে না।

এভাবে কাশ্মীর শৈব জীবন্মুক্তি হলো জীবনের মধ্যেই ঈশ্বরত্বের উপলব্ধি—এক এমন অভিজ্ঞতা, যেখানে চেতনা ও জীবন, শিব ও জগৎ, প্রকাশ ও লয়—সব এক অখণ্ড ছন্দে মিলিত। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি সেই জন, যিনি জীবনের প্রতিটি ধ্বনিতে শুনতে পান পরম স্পন্দন, প্রতিটি নিঃশ্বাসে অনুভব করেন শিবের উপস্থিতি। তাঁর কাছে অস্তিত্ব মানে চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত দীপ্তি; তাঁর জীবন হয়ে ওঠে মুক্তিরই আরেক নাম।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের এক অনন্য গ্রন্থ স্পন্দসিদ্ধি-তে চেতনার তিনটি স্তরকে খুব সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—স্থিতি (sthiti), উদয় (udaya), এবং প্রতিসংহৃতি (prati-saṁhṛti)। এই তিনটি শব্দের অর্থ যদি সহজভাবে বলা যায়, তবে—স্থিতি মানে চেতনার স্থির, গভীর ও শান্ত অবস্থা; উদয় মানে চেতনার প্রকাশ, নিজের থেকে নিজেরই অভিব্যক্তি; আর প্রতিসংহৃতি মানে নিজের মধ্যে ফিরে আসা, সেই উৎসস্থলে বিশ্রাম নেওয়া, যেখান থেকে সমস্ত প্রকাশ শুরু হয়।

এই তিনটি ধাপ কোনো “আগে-পরে” বা সময়ের ধারাবাহিক পর্যায় নয়। এগুলো চেতনার এক চিরন্তন ছন্দ, যা প্রতিটি মুহূর্তে একসঙ্গে ঘটছে। যেমন নিঃশ্বাস নিতে ও ছাড়তে আমরা একসঙ্গে জীবনের গতি ও বিশ্রাম অনুভব করি, তেমনি চেতনা তার মধ্যে একসঙ্গে স্থিরও থাকে, আবার প্রকাশও পায়, আবার নিজের ভেতরে ফিরে যায়।

ভট্ট কল্লট এই প্রসঙ্গে বলেন—চেতনা স্থির হলেও কখনোই নিষ্ক্রিয় নয়। তাঁর মতে, “যথা সমুদ্রস্তরঙ্গৈঃ প্রাবল্যাহীনৈঃ সুষুপ্তিভূতৈঃ চ স্পন্দিতঃ, তথৈব চিদপ্যপিকল্পিতা স্পন্দনা।” অর্থাৎ, যেমন সমুদ্র শান্ত থাকলেও তার গভীরে অদৃশ্য ঢেউ রয়েছে, তেমনি চেতনা বাহিরে স্থির মনে হলেও তার অন্তরে নিত্য এক আত্ম-স্পন্দন চলমান। এই স্পন্দনই শিবের প্রাণ, তাঁর নীরব নৃত্য।

অভিনবগুপ্ত স্পন্দসিদ্ধি ও তন্ত্রালোক-এর ভাষ্যগুলিতে এই তত্ত্বকে আরও গভীরভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন—“ন হি শিবো নাভভেত্‌ স্পন্দাত্মা”—শিব কখনও স্পন্দনহীন নন, স্পন্দই তাঁর আত্মা। অর্থাৎ, শিব নিস্তব্ধ হলেও তাঁর ভেতরে চলমান সেই অন্তর নাড়ন, সেই চেতনার আত্মকম্পনই বিশ্বসৃষ্টি, যা কখনো সৃষ্টিরূপে, কখনও স্থিতিরূপে, কখনও লয়েরূপে প্রকাশিত হয়।