নিয়তি-কণচুক স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে causality বা কারণ-ফল-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে—তাই মানুষ ভাবে, “এটা ঘটেছে, কারণ আমি করেছি”।
কালা-কণচুক অসীম শক্তিকে সীমিত ক্রিয়াশক্তিতে সংকুচিত করে—ফলে জন্ম নেয় অক্ষমতার অনুভব, “আমি সব করতে পারি না”।
এই পাঁচ কণচুকের আবরণে চেতনা নিজের অসীম সত্তাকে ভুলে যায় এবং সীমাবদ্ধ ব্যক্তিস্বরূপে জগতে প্রবাহিত হয়। তখন চেতনা নাম, রূপ ও কর্ম—এই তিনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। “নাম” হলো ধারণা ও পরিচয়, যার দ্বারা চেতনা নিজেকে ও জগৎকে ভাষায় সংজ্ঞায়িত করে। “রূপ” হলো সেই চেতনার আকার ধারণ করা—নিরাকার সত্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আর “কর্ম” হলো এই রূপগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক—চেতনার গতিশীল প্রকাশ।
অপরা স্তরে চেতনা আর নিস্তরঙ্গ আলো নয়; সে হয়ে ওঠে ক্রিয়াশীল শক্তি। কালী এখানে শ্মশানকালী, ঘোরকালী বা চামুণ্ডারূপে অনুভূত হন—যিনি মৃত্যুর, সংঘর্ষের ও পরিবর্তনের মধ্যেই চেতনার দীপ্তি প্রকাশ করেন। তাঁর ভয়ংকরতা আসলে অন্তরের মায়ার জাল ছিঁড়ে দেওয়ার প্রতীক—যেন চেতনা নিজেই নিজের সীমা ভেঙে নতুন রূপে জন্ম নিচ্ছে।
এই স্তরে কালী ধ্বংসকারিণী নন, বরং রূপদাত্রী। তিনি চেতনার অবতরণ ঘটান—অসীম সত্যকে সীমিত অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত হতে দেন, যাতে জীব জগৎকে ত্যাগ না করে বরং জগতের মধ্যেই নিজের পরম সত্তাকে চিনে নিতে পারে। তাই অপরা স্তরে কালী সময়, স্থান ও কর্মের মধ্য দিয়ে চেতনার অন্তর্লীন জ্যোতি জ্বালিয়ে দেন এবং শেখান—“এই জগৎই শিব, এই ক্রিয়াই মুক্তি, এই লীলাই পরম সত্য।”
এখানেই কালী ভয়ংকরী চামুণ্ডা, রক্তকালী বা ঘোরকালীর রূপে অন্তর্লোকে আলো আনেন: তিনি অবচেতনের জমাট অন্ধকারে প্রবেশ করেন, আসক্তি-সংস্কার-ভীতির গিঁট খুলে দেন, এবং কর্মের প্রবাহে নৈতিক-আধ্যাত্মিক দায়িত্ব জাগিয়ে তোলেন। অপরায় কালী ধ্বংস মানে নৈরাশ্য নয়; বরং যা অনাবশ্যক, যা সৃজনকে স্তব্ধ করে, যা সত্যের আচ্ছাদনে পরিণত হয়েছে—সেইসব খোলস ঝরিয়ে দেওয়া। ফলে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়—এই ত্রিবিধ ক্রিয়া আমাদের দেহ-মন-সমাজের নিরবচ্ছিন্ন শৃঙ্খলায় রূপ নেয়: জ্ঞান জন্মায়, চরিত্র গঠিত হয়, অনর্থ ক্ষয় হয়, আর প্রতিক্ষণে নতুন ন্যায়-রীতি স্থাপিত হয়। এখানেই শ্মশানকালীর উপদেশ—মৃত্যুই শেষ নয়; প্রতিটি ক্ষয়ে আদি-প্রভা আবার দীপ্যমান।
“ক্রম” (Krama) শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ধারাবাহিকতা, প্রবাহ, বা পরম্পরা—এবং কাশ্মীর শৈব দর্শনে এটি এমন এক গভীর তত্ত্ব, যা চেতনার নিত্য গতি, বিকাশ ও প্রত্যাহারের ছন্দকে প্রকাশ করে। চেতনা কখনও স্থির নয়; সে একসঙ্গে উন্মেষ (expansion), ক্রিয়া (activity) ও নিমেষ (withdrawal)—এই তিন প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত নিজেকে প্রকাশ করে ও গোপন করে।
এই উন্মেষ হলো শিবচেতনার প্রথম স্পন্দন—অদ্বিতীয় সত্য নিজের মধ্যে আনন্দস্ফূর্তি পায় এবং নিজের দীপ্তি থেকে জগৎকে উদ্ভাসিত করে। এটিই সৃষ্টির আদি মুহূর্ত। কালী-তত্ত্বে এটি মহাকালীর উন্মেষ—সময়েরও পূর্ববর্তী চেতনার জাগরণ। এরপর আসে ক্রিয়া, যেখানে সেই চেতনা অসংখ্য রূপে, তত্ত্বে ও ভাবনায় বহির্মুখ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে কালী দক্ষিণা বা শ্যামা—যিনি করুণা ও লীলার রূপে সর্বত্র কার্য করছেন। আর নিমেষ হলো প্রত্যাহার—যেখানে সব কার্য ও রূপ পুনরায় নিজের উৎসে লীন হয়ে যায়; এখানেই কালী শ্মশানবাসিনী, যিনি মৃত্যুর নীরবতায় সব কিছু আত্মস্থ করেন।
এই তিন প্রক্রিয়া একত্রে “সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়”—তিন কৃত্য বা তিন দেহমান নৃত্য। কিন্তু কাশ্মীর শৈব মতে, চেতনার কার্য এখানেই থামে না; এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও দুই স্তর—তিরোভাব ও অনুগ্রহ। তিরোভাব মানে আচ্ছাদন—চেতনা নিজের দীপ্তিকে ঢেকে ফেলে, যাতে লীলা আরও গভীর হয়; জীব মনে করে সে পৃথক, ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই আচ্ছাদনই লীলার আস্বাদ এনে দেয়, কারণ অন্ধকার ছাড়া আলোর আনন্দ টের পাওয়া যায় না। অনুগ্রহ হলো সেই পুনর্জাগরণ, যখন কৃপাশক্তি বা কালী নিজে ভেদ ভেঙে স্বরূপস্মৃতি ফিরিয়ে দেন। তাই বলা হয়—কালী ধ্বংস করেন না, তিনি আসলে স্মৃতি জাগান; তিনি ভেতরের অমর চেতনার কথা মনে করিয়ে দেন।
এইভাবে ক্রমতত্ত্বে চেতনার প্রতিটি স্তরই এক অপরটির পরিণতি, বিচ্ছিন্ন নয় বরং পরস্পর নির্ভর। মুক্তি তাই এক লাফে ঘটে না; এটি এক পরম্পরাগত জাগরণ, যেখানে সাধক ধীরে ধীরে কালীশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যে পৌঁছে যায়। এই সামঞ্জস্য অর্জনের উপায় তিন প্রকার—আণবোপায়, শাক্তোপায়, এবং শম্ভোপায়।
আণবোপায়ে (Āṇavopāya) সাধনা শুরু হয় বহিরাঙ্গ আচরণ ও নিয়ম দিয়ে—যেমন ব্রত, ধ্যান, শ্বাসনিয়ন্ত্রণ, মন্ত্রপাঠ। এখানে সাধক নিজের দেহ ও কর্মকে পরিশুদ্ধ করে, যাতে চেতনার সূক্ষ্ম অনুভূতির জন্য উপযুক্ত হয়।
শাক্তোপায়ে (Śāktopāya) মন ও ভাবের স্তরে কাজ হয়—চিন্তা, দর্শন, ভাবনা ও রসাস্বাদে চেতনা সূক্ষ্ম হয়। সাধক শেখে কীভাবে প্রতিটি ভাব, শব্দ বা প্রতীকের মধ্যে চেতনার অনুরণন আছে—এটাই কালীশক্তির সক্রিয় উপলব্ধি।
শম্ভোপায়ে (Śāmbhavopāya) সব প্রচেষ্টা মিশে যায় নিঃশব্দ চৈতন্যে; এখানে কোনো কৌশল নেই, কেবল প্রত্যক্ষ স্থিতি। এটি পরা-দৃষ্টির স্তর—যেখানে কালী আর “অন্য” নন, তিনি নিজ চেতনার পরিপূর্ণতা।
এছাড়াও আছে এক চতুর্থ উপায়—অণুপায় (Anupāya)—যা কোনো পদ্ধতি নয়, বরং আকস্মিক কৃপা। কখনো কখনো কালী নিজেই সাধকের মধ্যে চেতনার ঝলকানি আনেন, যেন বজ্রপাতের মতো—কোনো কারণ ছাড়াই, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই, কেবল অনুগ্রহে। এই কৃপাজাগরণই সর্বোচ্চ মুক্তি, যেখানে জ্ঞান ও জাগরণ এক মুহূর্তে মিলেমিশে যায়।
ক্রমতত্ত্ব কেবল দার্শনিক ধারণা নয়; এটি এক জীবন্ত নৃত্য, যেখানে চেতনা উন্মেষে প্রসারিত হয়, ক্রিয়ায় নিজেকে প্রকাশ করে, নিমেষে আবার নিজেরই অন্তরে ফিরে যায়—তিরোভাব দ্বারা নিজেকে গোপন করে, আর অনুগ্রহ দ্বারা পুনরায় উদ্ভাসিত হয়। এই ছন্দই কালী-তত্ত্বের হৃদয়—সৃষ্টি থেকে লয় পর্যন্ত প্রতিটি গতি তাঁরই স্পন্দন, প্রতিটি উত্থান ও বিলয় তাঁরই চিরন্তন মহাকালীয় নৃত্য।
তাই “কালী কেবল ধ্বংস”—এই জনপ্রিয় সংকোচন ত্রিকের পূর্ণ প্রেক্ষিতে অচল। পরায় তিনি অবিভক্ত স্বরূপ; পরাপরায় তিনি করুণাময় সৃষ্টি-সংহার-সাম্য; অপরায় তিনি কর্মক্ষেত্রে নৈতিক-আধ্যাত্মিক শুদ্ধির আগুন। একই শক্তি তিন স্তরে তিনভাবে ক্রিয়াশীল, অথচ অন্তরে এক ও অভিন্ন। কাশ্মীর শৈববাদের মূল কথাই এই—জগৎ মায়ার ছায়া বলে উড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং জগৎকে শিবরূপে চিনে নেওয়া; কালী-শক্তি সেই স্বীকৃতিরই সহচরী। তিনি ভেদের আড়াল সরিয়ে দেখান—যা-কিছু জন্মায় তা লয়ে ফিরে যায়—যে-লয়ও আবার নতুন জন্মের সম্ভাবনা। এই এঁকেবেঁকে চলা, তবু চক্রাকারে স্বরূপে প্রত্যাবর্তন—এই নৃত্যেই কালী সব সময়, সব স্তরে একটানা উপস্থিত: কোথাও নিস্তরঙ্গ চেতনা, কোথাও করুণার গতিময়তা, কোথাও বা শুদ্ধির দহন; কিন্তু সর্বত্রই এক অপরিমেয়, অনাবৃত, অদ্বৈত আলো।
ক্রম দর্শন (Krama) দেখায়, কালী-রূপ চেতনার ধারাবাহিক বিকাশ—যেখানে দিব্য স্বাধীনতা (Svatantrya) প্রকাশ পায়, কার্য করে, এবং শেষে নিজের মধ্যেই লয় পায়। কাশ্মীর শৈব মতে, মুক্তি মানে জগৎ থেকে পালানো নয়, বরং জগৎকেই শিবরূপে চিনে তার সঙ্গে এক হওয়া। কালী তাই জগৎ ও চেতনার ঐক্যের প্রতীক—তিনি সেই শক্তি, যিনি অজ্ঞান দূর করে জীবকে নিজের সত্য স্বরূপে জাগিয়ে তোলেন।
অদ্বৈত বেদান্তের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বেদান্ত যেখানে জগৎকে মায়া বলে অনিত্য মনে করে, সেখানে কাশ্মীর শৈববাদ জগৎকেই চেতনার বাস্তব প্রকাশ বলে মানে। কালী তাই এখানে বিনাশের নয়, স্বীকৃতির শক্তি—যিনি সমস্ত সময়, সৃষ্টি ও লয়কে এক পরম চেতনার নৃত্যরূপে প্রকাশ করেন।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, পরম বাস্তবতা হলো নির্গুণ ব্রহ্ম—যিনি রূপহীন, নিরাকার, চিরনিষ্ক্রিয় ও অপরিবর্তনীয় চেতনা। জগৎ বা দৃশ্যমান বিশ্ব কোনো চূড়ান্ত সত্য নয়; এটি মায়া বা মিথ্যা (mithyā)—অর্থাৎ আপাতভাবে বাস্তব, কিন্তু আসলে ব্রহ্মের উপর প্রক্ষেপিত বিভ্রম।
এই প্রেক্ষিতে কালী হলেন সেই ব্রহ্মেরই দ্বিমাত্রিক প্রকাশ। তিনি মূলত নির্গুণ পরব্রহ্ম—অচঞ্চল চেতনা, কিন্তু যখন তিনি নিজেকে গতিশীলভাবে প্রকাশ করেন, তখনই তিনি মহামায়া—যিনি বিভ্রম বা প্রকৃতির খেলা রচনা করেন। তাঁর নৃত্য তাই ব্রহ্মের স্থিরতার উপর মায়ার গতির প্রতীক—চলমান হলেও আসলে অপরিবর্তনীয় সত্তারই প্রকাশ।
অদ্বৈতের মতে, মুক্তি আসে সত্যজ্ঞান বা বিবেক দ্বারা—যখন মায়ার পর্দা সরে যায় এবং চেতনা বুঝতে পারে “আমি ব্রহ্ম” (অহং ব্রহ্মাস্মি)। কালীর ভয়ংকর রূপ সেই জ্ঞানেরই প্রতীক—যিনি অজ্ঞান বা অবিদ্যা-র গিঁট কেটে দেন, অহংকার (অহংকারা) দগ্ধ করেন, আর ব্যক্তিকে তার স্বরূপে জাগিয়ে তোলেন।
যেখানে কাশ্মীর শৈববাদ জগতকে চেতনারই লীলা বলে গ্রহণ করে, সেখানে অদ্বৈত বেদান্ত জগৎকে মায়ার বিভ্রম বলে নিরপেক্ষ করে। তবুও দুই ক্ষেত্রেই কালী চেতনারই প্রতীক—একজনের কাছে তিনি প্রকাশমান শক্তি, আর অন্যজনের কাছে অচল সত্যের জাগ্রত স্মৃতি।
কাশ্মীর শৈববাদের মতে, পরম সত্য স্থির নয়—তিনি সক্রিয়, সজীব ও স্বতঃপ্রকাশমান। এই পরম নীতি হলেন পরমশিব, যাঁর স্বভাব হলো স্বাতন্ত্র্য (Svatantrya)—নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সম্পাদনের স্বাধীন ক্ষমতা। এই স্বাতন্ত্র্যের প্রকাশই হল শক্তি, যিনি চেতনার বাস্তব রূপ; তাই জগৎ কোনো বিভ্রম নয়, বরং শিবচেতনারই বাস্তব বিকাশ।
এই দৃষ্টিতে, কালী হচ্ছেন শিবের সেই কার্যক্ষম শক্তি—স্পন্দ (Spanda) বা চেতনার স্পন্দনরূপ গতি। তিনি কেবল ধ্বংস করেন না; বরং সৃষ্টির চক্রে সংহার, নবজন্ম ও পরিবর্তনের মাধ্যমে চেতনার লীলাকে সম্পূর্ণ করেন। তাঁর ক্রিয়া হলো দিব্য শক্তির অবিচ্ছেদ্য প্রকাশ, যেখানে প্রতিটি বিনাশই এক নতুন সৃষ্টির প্রস্তুতি। মুক্তি তাই এখানে জগৎ থেকে দূরে নয়, বরং প্রত্যভিজ্ঞান (Pratyabhijñā)—এই উপলব্ধি যে, সমগ্র মহাবিশ্বই নিজের অন্তর্গত চেতনার খেলা।
এই দর্শনে শিব–শক্তি বা প্রকাশ–বিমর্শ (Prakāśa–Vimarśa) এক অবিচ্ছেদ্য দ্বিত্ব। শিব হলেন নিস্তরঙ্গ আলো—অস্তিত্বের ভিত্তি; কালী সেই আলোয় প্রতিফলিত সচেতনতা—যিনি তাকে জীবন্ত করে তোলেন। তাই কালীর শিবের ওপর অবস্থান কোনো বিভ্রম নয়, বরং সত্যের প্রতীক: চেতনা (শিব) ও তার আত্মবিমর্শন (কালী) অবিচ্ছেদ্য। ভক্ত এখানে কালীর নৃত্য থামাতে চান না, বরং চিনে নিতে চান যে, এই ধ্বংস, মৃত্যু ও রূপান্তরের লীলা আসলে তাঁর নিজের চেতনারই আনন্দময় প্রকাশ।
সহজভাবে বলতে গেলে, কাশ্মীর শৈববাদ ও অদ্বৈত বেদান্ত—দুই ব্যবস্থাই চেতনার অদ্বৈত সত্যে একমত হলেও, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মুক্তির ব্যাখ্যা একেবারে ভিন্ন।
কাশ্মীর শৈববাদে, পরম সত্য বা পরমশিব সক্রিয়, সজীব ও সৃষ্টিশীল। তাঁর স্বভাবই স্বাতন্ত্র্য (Svatantrya)—নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ঘটানো। জগৎ কোনো বিভ্রম নয়; এটি শক্তির (Śakti) বাস্তব প্রকাশ, চেতনারই দৃশ্যমান রূপ। তাই ব্যক্তি আত্মাও এখানে গতিশীল—সে স্পন্দ (Spanda) বা চেতনার কম্পমান শক্তি। মুক্তি মানে জগৎ থেকে পালানো নয়; বরং এই জগৎকেই নিজের চেতনার প্রকাশ হিসেবে চিনে নেওয়া—এই প্রত্যভিজ্ঞান (Pratyabhijñā) বা “নিজেকে শিব হিসেবে স্বীকৃতি”-ই আসল মুক্তি।
অন্যদিকে, অদ্বৈত বেদান্তে, পরম সত্য ব্রহ্ম—নিষ্ক্রিয়, অপরিবর্তনীয় ও নিস্তরঙ্গ। জগৎ হলো মায়া বা বিভ্রম—দেখায় বাস্তব, কিন্তু আসলে অস্থায়ী ও আপাত। আত্মা এখানে কেবল সাক্ষী (Sākṣī)—সে দেখে, কিন্তু কোনো ক্রিয়া করে না। মুক্তি মানে হলো কৈবল্য (Kaivalya)—সমস্ত ভেদবুদ্ধি, কর্ম ও মায়ার পর্দা সরে যাওয়া, যাতে ব্যক্তি বুঝতে পারে “আমি ব্রহ্ম”—অর্থাৎ চেতনা ছাড়া আর কিছুই সত্য নয়।
সংক্ষেপে, কাশ্মীর শৈববাদ: চেতনা সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল; জগৎ বাস্তব; মুক্তি মানে ঐক্যে অংশগ্রহণ। অদ্বৈত বেদান্ত: চেতনা নিস্তরঙ্গ ও নিষ্ক্রিয়; জগৎ মায়াময়; মুক্তি মানে জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রহ্ম-স্বরূপে স্থিতি। দুটির লক্ষ্য এক—অদ্বৈত উপলব্ধি, কিন্তু পথ ও অভিজ্ঞতার রূপ একেবারে আলাদা।